অভিশপ্ত বাড়ি

এ ই ডি স্মিথ ।।

আমি বেশ ভালো করেই জানি, অফিসের লোকেরা আমাকে এক অদ্ভুত জীব মনে করে। যদিও একজন লোক যে অধ্যয়নশীল স্বভাববিশিষ্ট, যে গোলমাল পছন্দ করে না এবং যে নির্বোধের সঙ্গই বেছে নেয়, আরও বিশেষ করে দৃষ্টির অভাবহেতু যে মোটা কাঁচের চশমা পরে, তাকে ভুল বুঝে থাকবে সব সময় নীচমনা লোকজন। সাধারণভাবে আমার বন্ধুদের মতামতের জন্য যে অবজ্ঞা পাওয়া উচিত তাই দিয়ে থাকে। কিন্তু আমি ভাবতে শুরু করেছি যে, তাদের অভিমতের পেছনে হয়ত কিছু থাকতে পারে এই বিশেষ মুহূর্তে। তবে নিঃসহে আমি একটা প্রথম শ্রেণীর বোকা লোক। তা না হলে আমি ছুটিটা উপভোগ করতে পারতাম দিব্যি আরামে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে। ভাঁড়ের গান শুনে অথবা সমুদ্রের ধারে বিশ্রাম নিয়ে দিন কাটাতাম। তার পরিবর্তে ফ্রান্সের এক নাম না-জানা জায়গায় বোকার মতো সাইকেলে ঘুরে বেড়াবার মতলব করছি! বৃষ্টিতে পুরাদস্তুর ভিজে, ক্ষুধার্ত ও দিশেহারা হয়ে, মাল বোঝাই সাইকেল ঠেলতে-ঠেলতে ঘুরে বেড়াছি এক অচেনা দেশে অপরিচিতের মতো!
অনেক মাইল দূরে সরে গেছি ঝড়ের বেগে। আমি নির্দিষ্ট পথ থেকে ভোজসেজের এক জনশূন্য রাস্তা দিয়ে প্রায় দু’ঘন্টা ধরে প্রবল বৃষ্টি মাথায় করে অনেক কষ্টে চলেছি, কোথাও চোখে পড়েনি জীবন্ত মানুষ অথবা মানুষের বাসস্থান।
অবশেষে অনেকক্ষণ পর একটা মোড় ঘুরতেই সামনে একটা বাড়ির ছাদের অংশ এবং চিমনি চোখে পড়ল। বাড়িটার অবস্থান রাস্তা ছেড়ে একটু ভেতরে একটা গাছের আড়ালে নির্জন জনশূন্য পরিবেশে। এমন কি সেখানে আকর্ষণ করার মতো কিছু নেই। তবু ওই বন্য পরিবেশের মধ্যেও বাড়িটা স্বাগতম জানবার পক্ষে যথেষ্ট।
সাময়িক আশ্রয় পাবার আশায় এবং কিছু খাবারের প্রয়োজনে আমি সেদিকে চলতে লাগলাম। এক শোচনীয় হতাশার সম্মুখিন হলাম দুশ’ গজ যাবার পর। ছাদহীন দারোয়ানের ঘর, পুরোনো ক্ষয়প্রাপ্ত লোহার গেট দুটো কব্জার ওপর ভর করে ঝুলছে। সামনের পায়ে চলার পথটা ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি। এখানে কেউ থাকে না, এ সবকিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মন থেকে সব ভাবনা-চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মনকে চাঙ্গা করে তুলতে লাগলাম যে, এমন দুর্যোগময় অবস্থার মধ্যে এই পরিত্যক্ত বাড়িটা অবজ্ঞা করা ঠিক নয়। আমার ভিজে পোশাক নিংড়াতে পারবো আর ভাঙা সাইকেলটাও মেরামত করে নিতে পারবো কোন এক আস্তানায় দাঁড়াতে পারলে। তাই আর সময় নষ্ট না করে সাইকেল নিয়ে বারান্দার নিচে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেটা মনে হলো একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি। লতাগুল্ম বাড়িটার দেয়াল ঢেকে ফেলেছে। দরজার পাশে দু-ধারের খোদাই করা পাথরে বংশমর্যদার নিদর্শন। বোঝা যাচ্ছে উঁচুদরের লোক বাস করত এখানে কোন এক সময়ে। ঝুলে ভর্তি জানালাগুলো প্রায় বন্ধ, বোধ হচ্ছে বহুদিন কেউ বাস করেনি এখানে।
চেষ্টা করলাম দরজাটা খোলার। কী আশ্চর্য, দরজা খোলা পাল্লাটা ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দে ফাঁক হয়ে গেলো একটু ধাক্কা লাগতেই! সামনে বড় হলঘর, অস্পষ্ট আলোর ভেতর ঢুকলাম। একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এলো। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে চোখ বুলালাম। একটা পুরোনো খালি বাড়িতে ঢুকলে যেমন গা ছম-ছম করে, আমারও তেমনি একটু ভয়-ভয় করছিল। আমার সামনে একটা চওড়া সিঁড়ি, তার ঠিক উপরে লম্বা মতো জানালা—কাঁচগুলো মাকড়সার জালে আর ময়লায় ভর্তি, একটুও আলো দেখা যাচ্ছে না। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনেই যে ঘরটা দেখা গেলো তার দরজাটা ঠেলে খুলে ফেললাম। সাজানো-গোছানো ঘরটা বেশ বড়। এটাই প্রধান ঘর বলে মনে হলো, যদিও বহুদিন অযতœ ও অব্যবহারে শোচনীয় অবস্থা।
কারুকার্য করা কার্নিশ ভেঙে গেছে, ঘরের ছাদের এক কোণের চুনবালি একেবারে খসে পড়েছে। আঠারো শতাব্দীর আসবাবপত্রগুলো রঙচটা হয়ে পড়েছে। ছেড়া পর্দা ও কার্পেট ধূলায় ঢেকে আছে।
আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো ফায়ারপ্লেসটা দেখে। জ্বালানি কিছু পেলে আগুন জ্বালিয়ে গরম চা করতে পারি, আর ভিজে পোশাক শুকিয়ে নিতে পারি।
শুকনো ডালপালা পাওয়া গেল বাইরে একটু খুঁজতেই। কিছু ডালপালা নিয়ে এসে আবার বাড়িতে ঢুকে চটপট সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। কিন্তু কেন জানি না, হঠাৎ থমকে গেলাম ঘরটার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। পা দুটো যেন আমাকে আর টেনে নিয়ে যেতে চাইল না। কিছু যেন আমাকে ঘরের বাইরে যাবার জন্যে প্ররোচিত করছে। ডালপালা আবার পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে কিছুটা অনিশ্চিতভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই পরিবেশের মধ্যে আমি অজানা বিপদের গন্ধ উপলব্ধি করতে লাগলাম। এ জায়গা ছেড়ে যাবার সময় সব যেমন ছিল তেমননিই আছে, তবু আমার মনে হচ্ছে আমার স্বল্পকালীন অনুপস্থিতিতে অশুভ কিছু এই ঘরে ঢুকেছিল, আবার বেরিয়ে গেছে।
আমি ভীতু অথবা কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক নই। কিছুক্ষণ পরে আমি ডালপালা তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে ফিরে গেলাম। আসলে আমি এ কাজ করিনি কোনো ভয় পেয়ে। আমি চিন্তা করলাম সদর দরজার কাছাকাছি থাকলে এবং নিচে কোন ঘরে আগুন জ্বালালে হয়ত আমি বেশি স্বস্তি পাবো।
সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে পা দিয়ে যেই খোলা সদর দরজার আলোর দিকে তাকিয়েছি হঠাৎ একটা জিনিস নজরে পড়তেই চমকে উঠলাম। মনে হলো কেউ যেনো এইমাত্র ধূলোর ওপর দিয়ে থলে কিংবা ওই ধরনের কিছু সিঁড়ির মাঝখান দিয়ে উপরে টেনে তুলেছে।
সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে লক্ষ্য করলাম, সেই ঘঁষা দাগটা হলঘর পেরিয়ে উল্টোদিকে দেয়ালের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেখান দেয়ালে আটকানো আলনায় একটা পুরোনো, পোকায় কাটা কোর্ট ঝুলছে। দেখলাম অনেকগুলো দাগ ঘরের বিভিন্ন দিকে গেছে, কোনোটা দুদিকে দরজার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে, কোনোটা সিঁড়ির পাশ দিয়ে বাড়ির পেছন দিকে গেছে, কিন্তু সবগুলো একটা জায়গা থেকেই উদ্ভুত, কোর্ট ঝোলানো আলনা থেকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, আর কোন পায়ের চিহ্ন নেই আমার পায়ের দাগ ছাড়া।
আবার আমায় ঘিরে ধরল অস্থিরতা। মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ বাস করে না, অথচ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কেউ বা কিছু সম্প্রতি এখানে ছিল।
পুরোনো কোটটার কাছে গিয়ে দেখলাম সেটা পুরোনো ধাঁচের মিলিটারি ওভারকোট। তখনও দু-একটা ময়লাধরা রুপোর বোতাম লাগানো রয়েছে। স্বাক্ষর বহন করছে বহুদিন ব্যবহারের। যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে আস্তে-আস্তে আলনাটাকে ঘোরালাম। দেখলাম বাঁ-কাঁধের ঠিক নিচে পনীর মতো গোলাকার একটা গর্ত, তার চারধারের কাপড় পোড়া ও বিবর্ণ, মনে হয় যেনো খুব কাছে থেকে পিস্তলের গুলি লেগে এমন হয়েছে। যদি এই গর্ত হয় পিস্তলের গুলিতে নিশ্চয়ই এই কোটটা কোনো মৃত মানুষের।
মনটা ভরে উঠল একটা বিরক্তিতে, কিন্তু স্থান দিলাম না বেশিক্ষণ।
এটা একটা কল্পনাও হতে পারে না। তবে মনে হচ্ছে বিশ্রী কাপড়ের গন্ধ ছাড়াও যেন একটা পচা মাংস ও হাড়ের গন্ধ বেরোচ্ছে…।
কোনো জন্তুর পচা গন্ধÑমৃদু অথচ সন্দেহাতীত বাতাসে তো আমি ঘ্রাণ নিতে পারছি। সেই সঙ্গে কিছু অবর্ণনীয় কিন্তু সত্য, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভূত অতীতের কোন কলঙ্কিত ও লজ্জাজনক পাপকার্যে সমস্ত পরিবেশটা ঘিরে রয়েছে।
নিজেকে শক্ত করে তুললাম। কী এমন আছে, যা ভয় করতে হবে? কোনো মনুষ্য লুণ্ঠনকারীদের ভয় পাই না, কারণ সব সময় আমার কাছে পিস্তল থাকে। আর ভুত? যদি সত্যিই ভূতের অস্তিত্ব থাকে, তবে দিনের বেলায় তারা ঘুরে বেড়ায় না। গা-ছমছমে জায়গা এটা ঠিক, আমি তো আর এখানে রাত কাটাচ্ছি না। আমার অতি প্রয়োজনীয় গরম চা ও সাইকেল মেরামত না করে কোনো ভয়ে ভীত হয়ে বৃষ্টির তাÐবের মধ্যে বাইরে বেরুচ্ছি না।
সুতরাং, আমার কাছেই যে দরজাটা ছিল সেটা খুলে একটা ছোটো ঘরে ঢুকলাম। এক সময় এটা পড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো বলে মনে হল। দরজার উল্টোদিকে ফায়ারপ্লেস, তখনও ঝাঁঝরিতে শেষ কাঠের ছাই পড়ে আছে। কিন্তু কাঠগুলো এমন স্যাঁতসেতে ছিল যে, আমার অর্ধেক দেয়াশলাই শেষ হয়ে গেল, তবু আগুন ধরল না, শুধু ধোঁয়া বেরুতে লাগল। ঘরের মধ্যে ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গেল চিমনি দিয়ে এক দমকা বাতাস এসে। মেঝেয় হাঁটু ও হাত রেখে কাঠগুলোর কাছে মুখ নিয়ে মরিয়াহয়ে ফুঁ দিয়ে আগুন ধরাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। এই বিরক্তিকর কাজের মধ্যে হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম, মনে হলো দপ করে কে যেন মেঝেয় জামা ফেললো।
পলকের মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করলাম কান খাড়া করে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। অটোমেটিক পিস্তলটা হাতে নিয়ে পা টিপে-টিপে দরজার দিকে এগুতে লাগলাম। হলঘরে কোথাও কিছু নেই, কিছু শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না, কেবল বাইরে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই পুরোনো কোটটার ঠিক নিচে মেঝেয় ধূলো উড়ছে।
দূর! একটা ইঁদুর! নিজের কাজে ফিরে গেলাম স্বগতোক্তি করে। পোড়া কাঠে আরও জোরে ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। এর মধ্যেও আবার সেই অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম খুব জোরে নয়, অথচ পরিষ্কার ও নির্ভুল।
আর একবার হলঘরে গেলাম। ঠিক একই জায়গায় একইভাবে ধূলো উড়তে দেখলাম। চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। কিন্তু সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত আরও বেশি করে অনুভূত হলো। এবার আমি বুঝতে পারলাম, এই পুরোনো খালি বাড়িতে আমি একা নই, কোনো অপবিত্র অদৃশ্য কিছু চলাফেরা করছে!
আমার আর দরকার নেই এসব চিন্তায়। যা ঘটে ঘটুক, আমার জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাই। এই বলে শক্ত করে তুললাম নিজেকে।
ঘরের মধ্যে ফিরে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে হ্যাভারস্যকের ভেতর জিনিসপত্র পুরতে পুরতে এক-একবার ভয়ে দরজার দিকে তাকাতে লাগলাম। থলির মুখ বন্ধ করে দড়ির শেষ পাক দিয়েছি, এমন সময় হলঘর থেকে খুব আস্তে চাপা হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। তারপরই মৃদু পায়ের শব্দ। ক্ষিপ্রগতিতে পিস্তলটা বার করে দরজার দিকে ফিরে ঘরের মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠাÐা হয়ে আসছে দেহের রক্ত। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম একটা ছায়ার মতো কী যেন চলে গেল। তারপরেই দরজায় একটু ক্যাঁচর-ক্যাঁচর শব্দ, আস্তে-আস্তে দরজাটা খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল সেই কোট!
সেটা সোজা হয়ে দাঁড়াল দরজার গোড়ায়। তারপর একটু এদিক-ওদিক দুলতে লাগল। অদৃশ্য লোক যেনো কলারটা তুলে রেখেছে। এই কোটটাই হলঘরে ঝুলতে দেখেছি আমি।
পাথরের মূর্তির মতো আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সমস্ত দেহ অবশ হয়ে গেল। পিস্তলটা মাটিতে পড়ে গেলো অসাড় আঙুল থেকে। তবু আমার মাথা ঠিক রইল। আমি জানতাম চরম অমঙ্গলের সান্নিধ্যে রয়েছি। দোরগোড়ায় নরকপ্রসূত বস্তুটির যে অলৌকিক আভা বিচ্ছুরিত তা সংক্রামক, এর সামান্য স্পর্শ শুধুমাত্র যে আমার দেহের ধ্বংস তা নয়, আমার আত্মার অনন্ত নরকভোগ।
এখন সেটা ঘরের মধ্যে ঢুকেছে। চলার গতি এক অবর্ণনীয়Ñঅদ্ভুতভাবে খালি হাত দুটো দুলছে। কোটের প্রান্ত মেঝেয় একবার করে পড়ছে আর ধূলো উড়ছে। ধীরে-ধীরে আমার দিকে এগোচ্ছে কোটটা! আমার বিস্ফোরিত চোখ দুটি বস্তুটার উপর স্থিরভাবে নিবন্ধ রেখে পায়ে-পায়ে পিছু হঁটতে লাগলাম। আড়ষ্ট, অচেতন যন্ত্রের মতো চলতে-চলতে একেবারে অগ্নিকুÐের দেয়ালে পিঠ স্পর্শ করলা। আমার পিছনে যাবার আর কোনো জায়গা নেই। তখনও সেটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। উপরে উঠে আমার গলা ছোঁবার চেষ্টা করছে শূন্য হাত দুটি কাঁপতে কাঁপতে। মনে হলো পর মুহূর্তে সেগুলো আমাকে ধরে ফেলল। ভীত ও আতঙ্কে বুঝতে পারলাম আমার সমস্ত বিচারবুদ্ধি লোপ পাবে। সেই মুহূর্তে একটা চিন্তা আমার মাথায় এলো, অনেকদিন আগে কোথায় যেনো পড়েছিলাম কী শুনেছিলাম, পবিত্র চিহ্নের ক্ষমতা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে খুব কার্যকর। প্রচÐ প্রয়াসে ইচ্ছেশক্তিকে জাগ্রত করে অসাড় আঙুল তুলে ক্রুস চিহ্ন তৈরি করলাম। সেই মুহূর্তে পেছনে আমার অন্য হাতটা কিছু পাবার জন্যে উত্তেজিত হয়ে হাতড়াচ্ছে। একটা ঠাÐা শক্ত, গোল কিছুর সংস্পর্শে পেলাম। সেটা পুরোনো ভারী উনুন খোঁচার হাতল।
সেই ঠাÐা লোহার স্পর্শ আমার বোধশক্তিকে জাগিয়ে দিলো। বিদ্যুতের গতিতে সেই ভারী খোঁচানিটা তুলে নিয়ে আমার সামনে আতঙ্কজনক বস্তুটিকে আঘাত করলাম। মুহূর্তে বস্তুটি পড়ে গেলো। সেটা কোর্ট ছাড়া আর কিছু নয়। আমার পায়ের কাছে জড়ো হয়ে রয়েছে। আমি দিব্যি করে বলছি, এক লাফে সেটা পার হয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম। বস্তুটি আমার পিছনে হামাগুঁড়ি দিয়ে তাড়া করছে, আড়চোখে ফিরে দেখলাম।
সেই অভিশপ্ত বাড়ির বাইরে এসে যে দৌড় লাগালাম জীবনে সেরকম কখনও দৌড়াইনি। একটা সরাইখানার দরজার অর্ধচৈতন্যহীন অবস্থায় পড়ে যাবার আগে পর্যন্ত আমার আর কিছু মনে নেই।
অনেকগুলো মানুষ আমাকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে। আমার কাহিনী বলতে চেষ্টা করলাম ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ফরাসী ভাষায়। তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে বিহŸল দৃষ্টিতে। অবশেষে সহানুভূতির ভাব ফুটে উঠল সরাইখানার মালিকের মুখে।
আমি একটা গল্প শুনি সরাইখানার মালিকের কাছে। ওই পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকত নেপোলিয়নের সৈন্যদলের একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। আফ্রিকান বংশজ লোকটি আধা পাগল ছিল। গল্প শুনে মনে হয় লোকটি অতি বদ ছিল। নিশ্চয়ই মশাই খুব খারাপ লোকÑঐ লোকটি। সে তার স্ত্রীকে মেরে ফেলে। খুব বদনাম আছে পুরানো জমিদার বাড়িটার। এ দেশের কোন লোকই ঐ বাড়িটার কাছে যাবে না, যদি কাউকে এক মিলিয়ন ফ্রাঁও দেন।
গোড়ার যা বলেছি, আমি জানি অফিসের লোকেরা আমায় একটা বোকা মানুষ মনে করে। তাই তাদের কাছে আমি এ গল্প করিনি। তবু এটা ডাহা সত্যি। আমার নতুন সাইকেল ও জিনিসপত্র হয়ত এখনও পড়ে আছে ঐ ভূত-প্রেত অধ্যুষিত জমিদার বাড়ির হলঘরে।