টুকরো স্মৃতির গল্প

পর্ব – ৬ ।।

মেজবোন দোদুল মারা যাওয়ার পর মিনতি দিদির মধ্যে আমি দোলুলকে খুঁজে পেতাম। মিনতি দি ছিলেন দোদুলের ক্লসমেট। থাকতেন আমাদের ব্যাংকপাড়া বাসার সাম‌নে পুকু‌রের ঠিক ওপাড়ে। বাসাটি ছিল হাজী ইসাহাক আলী সাহেবের। হাজী ইসাহাক সাহেব দীর্ঘদিন মঠবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার  এক ছেলে দেলোয়ার আমার শ্রেণিবন্ধু ছিল। ছোট ছেলে মহসিন ডা. জাকির হোসেন মন্টুর ক্লাসমেট ছিল।  বড় ছেলে ডা: আনোয়ার হোসেন পরবর্তীতে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিয়ে করেছিলেন রওশন আপাকে। আগেই বলেছি রওশন আপা ছিলেন ডাক্তার মতিয়ার রহমান সাহেবের বড় মেয়ে। অসাধারণ কণ্ঠের অধিকারী তিনি। একাত্তর সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলন। রওশন আপা তখন হাতেম আলী গার্লস হাইস্কুলের দশম  শ্রেণির ছাত্রী। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। দোদুল সে বছর ক্লাস এইটের ছাত্রী। এ জন্য দোদুলকে বার বার রাজাকারদের জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল।

আমাদের ব্যাংকপাড়ার বাসার পাশের বাসায় থাকতেন হোমিও ডাক্তার আনিসুর রহমান সাহেব। তিনি আমার বন্ধু কিবরিয়া ও দোদুলের ক্লাসমেট জাহেদা আপার বান্ধবী ছিলেন। আনিসুর রহমান সাহেবের মেয়েদের মধ্যে খালেদা ছিল অসাধারণ সুন্দরী। কিবরিয়া খুব কম বয়সে মারা যায়। খালেদার বিয়ের পর মঠবাড়িয়া উদীচীর কার্যালয়ের (ফিরোজ ভাইয়ের বাড়ি) পাশে বাসা ছিল তার। এই পরিবারটির   ছেলে বা মেয়ে সবার কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা ছিল।

আনিসুর রহমান সাহেব স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিরোধিতা করলেও খুব সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। একবার আমার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ উদ্দিন বাবুল অসুস্থ হলে ডা. আনিসুর রহমান সাহেবের চিকিৎসাধীন ছিলেন। হোমিওপ্যাথি ওষুধ, ঘড়ির কাঁটায় ওষুধু খেতে হবে। আমাদের বাসায় তখন বাবার একটি টিসর্ট ঘড়ি ছাড়া আর কোনো ঘড়ি ছিল না। তিনি অফিসে চলে গেলে ভাইয়ার ওষুধ খেতে যাতে অসুবিধা না হয, সে জন্য ডা. আনিসুর রহমান সাহেব নিজের হাতের ঘড়ি খুলে আমাদের বাসায় রেখে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতা ‍যুদ্ধের সময় ভাইয়া রাজাকারের হাতে ধরা পড়লে আনিসুর রহমান সাহেব তাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যাপারে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। শুধু তিনি নন, আলী মেম্বার সাহেব তিনিও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে থাকলেও ভাইয়া ও বড় ভগ্নিপতি এম এ মালেক দুলাভাইকে ছাড়িয়ে  আনতে আমার বাবাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। দুলাভাইকে পিরোজপুরের চালান করা হলে তখন পিরোজপুরের এসডিও সাহেবের স্ত্রী ও আলী মেম্বার সাহেব যথেষ্ট সাহায্য করেছেন।

রওশন আপারাসহ কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে গেলে বেশ কয়েকবার দোদুলকে আনিসুর রহমান সাহেবের বাসায় নিয়ে জেরা করা হয়েছিল। যে বাসায় ডাক্তার আনিসুর রহমান থাকতেন   সে বাসাটি ছিল কে এম লতিফের  এক সময়ের জাদরেল হেড মাস্টার এমাদুল হক  স্যারের। শুনেছি তার সময় কোনো পুলিশও স্কুল গেট থেকে পূর্বানুমতি না নিয়ে স্কুল কমাউন্ডে ঢুকতে পারতেন না। তার এক ছেলে এক সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে খবর পড়তেন। নামটা ভুলে গেছি।

 কেএম লতিফ ইন্সস্টিটিউশনের ইংরেজির শিক্ষক মনীন্দ্র স্যারের (মনীন্দ্রনাথ মিত্র) বড় মেয়ে মিনতি দি। স্যারের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। সন্তানদের মধ্যে মিনতি দি সবার বড়। তারপর আরতি এবং সবার ছোটটির নাম সুনীতি। ওদের বাসায় গেলে সুনীতি  আমাকে সই বলে ডাকত। সুনীতির বয়স তখন ৩/৪ বছর।  মঠবাড়িয়া উদীচীর সদস্য বীরেন দা আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। তিনি আমাকে ইয়ার্কি করে ‘সই’ বলে ডাকতেন। তাকে অনুসরণ করে  সুনীতি আমাকে সই বলে ডাকত।

মনীন্দ্র স্যারের বসায় থাকতেন কে এম লতিফের বিজ্ঞান শিক্ষক সুধীর স্যার। তিনি চমৎকার রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে/ জানিনে জানিনে কিছুতেই কেন যে মন লাগে না’ গানটি আমি পুকুরের এপাড়ে বাসায় বসে শুনতে পেতাম। এই গানটি এক সময় আমিও গাইতাম। গানটি গাওয়ার সময় সুধীর স্যারের চেহারা ভেসে উঠত মনের পর্দায়। তিনি সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন না, আমি মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিলাম বলে।  স্যার কখনো কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতেন না। মনীন্দ্র স্যার ছিলেন সুধীর স্যারের দূরসম্পর্কে শ্বশুর।  একাত্তর সালে রাজাকাররা সুধীর স্যার ও মনীন্দ্র স্যারকে ধরে  নিয়ে যায়। মনীন্দ্র স্যার টাকা-পয়সার ফয়সালা করে নিজে ছাড়া পেলেও বাঁচাতে পারেননি সুধীর স্যারকে। কারণ রাজাকারদের দেওয়ার মতো অর্থ তার ছিল না। তবে তিনি বার বার অনুরোধ করেছিলেন সুধীর স্যারকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।

সুধীর স্যারকে যখন গুলি করা হয়, তখন সুধীর স্যার  ‘ফ’ আদ্যাক্ষরের এক রাজাকারকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, তোরা আমাকে মারবিই যখন তখন তুই আমার ছাত্র, তুই-ই আমাকে গুলি কর। এসবের সরাসরি সাক্ষী আমি নই, বিশ্বস্ত কয়েকিট সূত্র থেকে জানতে পারি আমি।

বীরেন দা ছিলেন সহজ-সরল একজন মানুষ। উদীচী করতেন।  থানা থেকে কিছুটা দূরে তাদের বাড়ি। আমি বেশ কয়েকবার তাদের বাড়িতে গিয়েছি। একবার তার মায়ের হাতে রান্নাও খেয়েছি। বীরেন দার পরিবারে পিঁয়াজ খাওয়ার প্রচলন ছিল না। তবুও মাসীমা  আমার জন্য পিঁয়াজ দিয়ে রান্না করে খাইয়েছেন। আমি মুসলমান হলেও হিন্দু পরিবারগুলো আমাকে এতটা ভালোবাসত ভাবলে অবাক হতে হয়। আমিও হিন্দু-মুসলমান ভেদ না রেখে সবার সঙ্গে সমান তালে চলতে পছন্দ করতাম। আমার বন্ধু দ্বিজেন গোলদার। সাবরেজিস্টি অফিসের দলিল লেখকের কাজ করত (হয়তো এখনো করে), ওর বাবার শ্রাদ্ধে আমাকে নিমন্ত্রণ করলে বললাম, ‘তোমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আমি মুসলমান আমাকে নিবি কেন?। দ্বিজু উত্তরে বলল,  তোকে ব্রাহ্মণের সাড়িতে বসে খেতে হবে।  আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ওর চোখ তখন ছল ছল করছিল। বলল, তুই জানিস না তোাকে কতটা ভালোবাসি।  আমার কাছে তুই মানুষ। মানুষ হিসেবেই তুই আমার বন্ধু। মুসলমান বা হিন্দু পরিচয় তো অনেক পরের কথা। আমি গিয়েছিলাম ওর বাবার শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে। ব্রাহ্মণের সাড়িতে সবার ডানদিকে বসেছিলাম আমি। হিন্দুরা কীভাবে খাওয়া-দাওয়া করে সেটা রপ্তা ছিল বলে কোনো সমস্যা হয়নি। ওরা আমাকে উচ্চজাতের হিন্দু বলে ধরে নিয়েছিল।

চল