ষষ্ঠী থেকে দশমী : দুর্গা পূজার পাঁচদিনের অনুষ্ঠান

মহালয়ার মাধ্যমে পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে শুরু হয় দেবীপক্ষের। এই দেবীপক্ষেই ষষ্ঠী তিথিতে থেকে শুরু হয় দেবী দুর্গার পুজো। পুজোর এই কয়েক দিন, মানুষ তার জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে নিজেকে দেবীর সেবায় নিমজ্জিত করে রাখেন। বছরের বাকি দিনগুলো সুখে-শান্তিতে কাটানোর জন্য দেবীর আশীর্বাদ পেতে নিষ্ঠাভরে পূজার্চনা করেন সকলে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সামিল হয় এই আনন্দ উৎসবে। এইসময় দেবী তাঁর সন্তানদের সকল মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন।

ষষ্ঠী থেকে দশমী, দুর্গাপুজোর এই পাঁচ দিনে একাধিক নিয়ম-নীতি পালনের মাধ্যমে দুর্গার আরাধনায় মেতে ওঠেন সকলে। আসুন জেনে নেওয়া যাক, দুর্গা পুজোর মুখ্য কয়েকটি রীতি সম্পর্কে।

মহাষষ্ঠীতে দেবীর বোধন : ষষ্ঠীর দিন বোধনের মাধ্যমেই শুরু হয় দুর্গা পুজো। দেবীপক্ষের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে হয় দেবী দুর্গার বোধন। দুর্গা পুজোর এই রীতির সঙ্গে জড়িত আছে পৌরাণিক কাহিনী। বোধন কথার অর্থ হল জাগ্রত করা। মনে করা হয়, শরৎকালে দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। লঙ্কার রাজা রাবণকে পরাজিত করার জন্য দেবীর আশীর্বাদের কামনায় তিনিই এই সময় দুর্গা পুজো করেন। বোধনের মাধ্যমেই দুর্গাকে আবাহন করা হয়। আর তাতে রামচন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা।

২) মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা বা কলা বউ স্নান : সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নানের রীতি আছে। নবপত্রিকার অর্থ বোঝায় নয়টি পাতা, কিন্তু এখানে নয়টি উদ্ভিদ দিয়ে নবপত্রিকা গঠন করা হয়। এই নয়টি উদ্ভিদ মা দুর্গার নয়টি শক্তির প্রতীক। উদ্ভিদগুলি হল – কলাগাছ, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধান। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকাকে স্নানের জন্য নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর লাল পাড় সাদা শাড়িতে মুড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর আকারে সেটিকে গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়। অনেকে একে কলা বউ স্নানও বলেন। গবেষকদের মতে, নবপত্রিকার পূজা প্রকৃতপক্ষে শস্যদেবীর পূজা।

৩) মহাষ্টমীর অঞ্জলি : দুর্গা পুজোর অষ্টমী মানেই সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে মন্ডপে গিয়ে অঞ্জলি দেওয়া। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিনদিনই পুষ্পাঞ্জলি হয়, তবে অষ্টমীর অঞ্জলিকে একটু বেশিই গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। দু’হাত ভোরে ফুল নিয়ে পুরোহিতের বলা মন্ত্র উচ্চারণের পর, হাতে ধরে থাকা ফুল-পাতা দেবীর চরণে অর্পণ করার রীতি আছে। অঞ্জলি দেওয়ার মাধ্যমে মায়ের প্রতি নিজেদের বিশ্বাস, শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন ভক্তরা এবং তাঁর আশীর্বাদ চান।

৪) কুমারী পুজো : অষ্টমী বা নবমী তিথিতে বহু জায়গায় সাড়ম্বরে কুমারী পুজো হয়ে থাকে। শাস্ত্রমতে, এক থেকে ষোল বছর বয়স পর্যন্ত ঋতুমতী না হওয়া বালিকাদের কুমারী রূপে পূজা করা হয়।

৫) সন্ধি পুজো : অষ্টমীর সমাপ্তি ও নবমীর সূচনার সন্ধিক্ষণে করা হয় সন্ধিপুজো। মনে করা হয়, অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবী চামুণ্ডা চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই অসুরকে নিধন করেছিলেন। তাই এই সময় দেবীকে চামুণ্ডা রূপে পুজো করা হয়। সন্ধিপুজোর সমস্ত মন্ত্রই চামুণ্ডা দেবীর মন্ত্র। সন্ধিপুজোয় দেবীকে ১০৮ পদ্ম এবং ১০৮ দীপ দান করার রীতি রয়েছে।

৬) ধুনুচি নাচ : দুর্গা পুজোয় ধুনুচি নাচের রীতি বহু পুরানো। দুর্গা পূজা চলাকালীন ঢাকের তালে তাল মিলিয়ে ধুনুচি নাচে মেতে ওঠেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে। হাতে ধরে, অনেকে মাথায় রেখে বা দাঁত দিয়ে চেপেও ধুনুচি নাচের আসর জমান। অনেক পূজা সংগঠন সেরা ধুনুচি নাচের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।

৭) বিজয়া দশমীতে সিঁদূর খেলা : দুর্গাপূজার অন্ত চিহ্নিত হয় ‘বিজয়া দশমী’-র মাধ্যমে। বিজয়ার দিনে সিঁদুর খেলা দুর্গাপুজোর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে বাপের বাড়ি ছেড়ে মা দূর্গা পাড়ি দেন স্বামীগৃহ কৈলাসে। পতিগৃহে রওনা দেওয়ার আগে উমাকে বরণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। তাই, দশমীর দিন ঘরের মেয়েকে সিঁদূরে রাঙিয়ে, মিষ্টি মুখ করিয়ে, পান, ধান, দূর্বা দিয়ে বরণ করা হয়। দেবীর বরণের পরই সধবা মহিলারা মেতে ওঠেন সিঁদূর খেলায়।

৮) দেবীর বিসর্জন : প্রতিমা পূজার সর্বশেষ ধাপ হল বিসর্জন। জলেই মাটির প্রতিমা পুনরায় প্রকৃতিতে মিশে যায়। বনেদি পরিবারের দুর্গার মূর্তি কাঁধে করে নিয়ে যাওয়ার চল ছিল এক কালে, তবে এখনও অনেক বনেদি পরিবারে এই নিয়ম মানা হয়। এখন সর্বজনীন পুজো বা বাড়ির পুজোর প্রতিমাও ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় বিসর্জনের জন্য। নৌকায় করে মাঝ নদীতে নিয়ে গিয়ে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন করা হয়।

সূত্র : Bengali Bold Sky