অসহায়ত্ব না মায়া? সুপ্রিয়া বিশ্বাস

পাবলিক বাসে বসে বন্যা একাকী ফেসবুকে আঙুল দিয়ে উল্টাছিল। ফেসবুক দেখা অনেকটা নিশ্চুপ সময় কাটানো ছাড়া আর কিছুই না। কারো সাথে অহেতুক কথা বলতে ইচ্ছে না করলে চুপচাপ ফেসবুকে ডুবে থেকে সময় পার করা আর কি!এটা তার নিত্য দিনের জার্নির সঙ্গী।একটা সীট পেলেই হয়। নিশ্চুপ মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ রেখে বসে থাকে।অথবা মাঝে মাঝে জানালা পানে দুরে বাইরে তাকিয়ে থাকে।আজকাল কারো সাথে তেমন কথা বলতে ইচ্ছে করেনা বন্যার।চাকরী আর বাসায় ফিরে ছেলেকে সময় দেওয়া। এছাড়া আর কিছু তেমন ভালো লাগেনা।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিল দুরে শর্ষে ফুলের মাঝে দুইটি পাখির কাছাকাছি বসে রোদ পোহানোর দৃশ্য।অপরূপ! পৃথিবীর সব প্রানীই সঙ্গী চাই। মানুষ হয়তো আরো একটু বেশিই সঙ্গী চাই। কিন্তু এই চাওয়া সব সময় সব মানুষের জীবনে পূরণ হয়না। সারাজীবন সব মানুষের মনের সঙ্গী বা হাত ধরে রাস্তা পার করার সঙ্গী সবার থাকেনা। তবুও জীবন জীবনের মতো পার হয়ে যায়। হঠাৎ বাসটি একটি বাসস্টান্ডে থামলে বেশ কয়েকজন যাত্রী উঠে এলো। পাশের সীটে একজন ভদ্রলোক বসে পড়লো।স্বভাবসুলভ ভাবেই খেয়াল করেনি বন্যা। তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে দুর দিগন্তে যতদুর চোখ যায়।

হঠাৎ পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে অনিন্দ্য বসে আছে পাশের সীটে।বন্যার সারা শরীরে ভূমিকম্প হয়ে গেল।হয়তো বোঝেনি অনিন্দ্যও।প্রচন্ড শীত পরেছে।তারপর করোনার সময়।শীতের পোশাক আর মাস্ক পড়া অবস্থায় অনেক সময় পরিচিত মানুষকেও চিনে উঠা যায়না। বন্যা বুঝতে পারছে ওর সারা শরীর কাঁপছে।ইচ্ছা অনিচ্ছার দোলায় ও দুলছে। যে মানুষটি ছিল অতি আপনজন সে আজ বহুদুরের। আইনত এখনো আপনজন। তবুও কেউ কারো নয়। বন্যা দ্রুত চাদরের আড়ালে মুখ ঢেকে বাইরের জানালায় মুখ ঘুরিয়ে নিল।

এক বছর আগে হঠাৎ বন্যা এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়। বন্যার আবিষ্কার করে অনিন্দ্য মিতু নামের একটি বিবাহিত মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।বন্যার সাথে এই নিয়ে ক্রমাগত দুরত্ব বাড়তে থাকে অনিন্দ্যের। অনিন্দ্য এতটাই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে একমাত্র সন্তানের পড়ালেখার দিকেও নজর দেয়না সে। বরং এ নিয়ে কথা বললে, উল্টো বন্যাকেই নানা মিথ্যা অপবাদে কটু বাক্য বলতে থাকে। মানুষ যখন নষ্ট হয়ে যায় তখন তার বিবেকও নষ্ট হয়ে যায়। বন্যা বুঝতে পারে অনিন্দ্যের মধ্যের ভালোত্ব নষ্ট হয়ে গেছে।

বন্যা আর অনিন্দ্যের একমাত্র সন্তান নিশান । সে খুব মেধাবী ছিল। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে ও মা বাবার এই টানাপোড়নে লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ে। একদিকে অনিন্দ্যের প্রতিনিয়ত অবহেলা আর অন্যদিকে ছেলের লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগীতা বন্যাকে আরো অসহায় করে তোলে।অনিন্দ্যের মতো বন্যা পারেনি সন্তানের লেখাপড়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে।

তাদের অশান্তি এমন পর্যায়ে যায় যে, অনিন্দ্য কোন কিছুই তোয়াক্কা করেনা। নির্লজ্জের মতো মিতুর সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যায়।

মিতু সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার রুচি হয়নি বন্যার।যে মহিলা নিজের স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে দিনরাত অন্য পুরুষের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত থাকে এমন রুচিহীন মহিলার সাথে নিজেকে পাল্লায় তুলতে ঘৃনা হয় বন্যার। আজকাল পরকীয়ার ব্যাপারে শুধু ছেলেদের দোষ নয়, কিছু নির্লজ্জ মেয়েরাও এর জন্য দায়ী।

একদিন একটি পার্কে ঐ মহিলাকে নিয়ে ঘুরতে যায় অনিন্দ্য।বন্যাকে পরিচিত একজন ফোন করে জানিয়ে দেয়।বন্যা শুধু নিজ চোখে দেখার জন্য সেখানে যায়।সেখানে গিয়ে বন্যা দেখে ঐ মহিলাকে সঙ্গ দিচ্ছে অনিন্দ্য।বন্যাকে দেখেও বন্যার সাথে কথা বলেনা।ওকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে অনিন্দ্য।তখনও একই ছাদের নীচে ওদের বসবাস ছিল। সেদিনই মন ভেঙ্গে যায় ওর।

তাদের অশান্তি এমন পর্যায়ে যায় যে, অনিন্দ্য কোন কিছুই তোয়াক্কা করেনা।বন্যাকে কারণে অকারণে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।বন্যার এতদিনের ত্যাগ তিতিক্ষা ভালোবাসা সবকিছুই মূল্যহীন অনিন্দ্যের কাছে। নির্লজ্জের মতো মিতুর সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যায়।

এই নিয়ে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে বন্যা একদিন মিতু সম্পর্কে বলে যে, ‘ভাগাড়ের মেয়ে।’ অনিন্দ্য পাল্টা উত্তর দেয়, ‘ভাগাড়ই আমার কাছে যোগ্য মেয়ে।’ সাথে আরো কিছু অশালীন উক্তি।বন্যার মন ভেঙ্গে যায়।সে বুঝতে পারে এই ঝগড়া যত হবে বন্যা ততই আঘাত পাবে। অনিন্দ্যর প্রতিও ওর ঘৃনা হয়। কিন্তু আপনজন কে সবাই ভালবাসতে চাই।

আপনজনকে ঘৃনা করা অত সহজ কাজ নয়।বন্যা নিজের মানসিক যন্ত্রনায় নিজেই ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে।সেদিনই এক কাপড়ে শুধু ছোট একটা চাকুরীকে সম্বল করে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সংসার ছেড়ে আলাদা বসবাস শুরু করে বন্যা।বন্যা বাপের বাড়িতে যায়নি।কারণ ও জানে বাবাহীন ভাইয়ের সংসারে ও আপদ ছাড়া আর কিছুই নয়।

যদিও সে চলে এসেছিল তবুও আশা ছিল হয়তো একদিন অনিন্দ্য ভুল বুঝবে। আবার স্বাভাবিক সংসারে ফিরে আসবে সে। আবার সুখী হবে তারা। কিন্তু শুনেছি নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের আকর্ষন বেশি থাকে ,অনিন্দ্য ও হয়তো এমনি নিষিদ্ধ সম্পর্কে আকর্ষিত হয়ে সব কিছু ভুলতে বসেছে।

বন্যার খুব ইচ্ছে করছিল অনিন্দ্যর হাতখানি নিজের হাতের আঙুলে নিতে। কিন্তু কিভাবে? অনিন্দ্য যে একেবারেই মোহাবিষ্ট হয়ে আছে।এক বছরে একবারও বন্যার খোঁজ নেয়নি।অভিমানী বন্যা নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ অনিন্দ্যের ফোনটা বেজে উঠলো। অনিন্দ্য রিসিভ করেই বললো, ‘সোনাপাখি বিশ মিনিটের মধ্যেই আসছি।’

বন্যার বুঝতে বাকি রইলো না, সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে। বন্যার হু হু করে কান্না এলো। ও জানালার বাইরে দূরের মেঘে নিজের চোখকে আটকে দিলো। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিলো। অনিন্দ্য বাস থামলে নেমে গেল । বন্যা যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ ওর হেঁটে যাওয়া শরীরটার দিকে পিপাসার্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো। ও জানে না এত আঘাতের পরও কেন অনিন্দ্যের জন্যই ওর এই অপেক্ষা? এটা কি নিজের কোন অসহায়ত্ব না মায়া?

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়