ঈদে বাড়ি ফেরা।। সেলিনা আক্তার নূপুর

দিপা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের করিডোরে পায়চারি করছে। অপেক্ষার পালা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। তার যেন আর তর সইছে না। কখন বাবা আসবে আর সে দৌড়ে গিয়ে বাবা কে জড়িয়ে ধরবে। এসব ভাবছে আর বাবার আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। তার সাথে তার মা ও ছোট বোন দিশা ও আছে। তারা ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

দীপার বাবা হাফিজ সাহেব একজন প্রবাসী। তিনি প্রায় ৩০ বছর যাবৎ মালয়েশিয়ায় আছেন। ছুটি পেলেই দেশে পরিবারের কাছে ছুটে আসেন। যতটা আনন্দ নিয়ে দেশে আসেন ছুটি কাটানোর জন্য, ছুটি শেষে তিনি এক বুক কষ্ট নিয়ে আবার ফিরে যান। পরিবারকে ফেলে আবার বিদেশ ফিরে যেতে তার খুব কষ্ট হয় কিন্তু জীবিকার তাগিদে তাকে তো যেতেই হবে।

হাফিজ সাহেবের এবারের দেশে আসার আনন্দটা একটু অন্যরকম। তিনি এবার পরিবারের সাথে ঈদ করবেন বলে দেশে এসেছেন। সাধারণত তিনি ঈদের সময় খুব একটা ছুটি পান না তাই কখনো দেশে ঈদ করা হয়ে ওঠে না। এবার মেয়েরা জোর করাতে খুব কষ্ট করে তিনি ছুটি নিয়েছেন। মেয়েরা বাবার সাথে ঈদ করবে বলে বায়না ধরেছে। তিনি মেয়েদের আবদার ফেলতে পারেন না। তাইতো সুদূর মালয়েশিয়া থেকে ছুটে এসেছেন মেয়েদের সাথে ঈদ করবেন বলে।

সন্ধ্যা সাতটায় প্লেন বাংলাদেশে ল্যান্ড করার কথা। ঢাকা শহরের রাস্তায় যানজট অনেক বেশি হয় বলে ফাহিমা বেগম দুই মেয়েকে নিয়ে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে বিমানবন্দরে পৌঁছে গেছেন। রোজার দিন তাই তিনি দুই মেয়েকে নিয়ে বিমানবন্দরের করিডোরে বসেই ইফতার সেরে নিলেন। এবার শুধু অপেক্ষার পালা। অপেক্ষার পালা যেন শেষই হয় না। কোনো একটা বিশেষ কারণে প্লেন বাংলাদেশে ল্যান্ড করতে দেরি করলো। অবশেষে রাত ৯ টায় প্লেন বিমান বন্দরে ল্যান্ড করলো। বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে হাফিজ সাহেবের বের হতে রাত ১২টা বেজে গেল। মেয়েরা বাবাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বাবা ও মেয়েদের ধরে কাঁদছেন। এ কান্না কোনো বেদনার কান্না নয়, এ কান্না শুধুই আনন্দের। প্রিয়জনকে কাছে পাবার আনন্দ। ফাহিমা বেগমের চোখে ও পানি। তিনি কাছেই দাড়িয়ে বাবা – মেয়েদের অকৃত্রিম ভালোবাসা উপভোগ করছেন।

ঈদের আর ৭ দিন বাকী। মেয়েরা বাবাকে চোখের আড়াল করে না। সারাক্ষণ বাবার সাথে সাথে থাকে।বাবা আর মেয়েদের মধ্যে সম্পর্ক বন্ধুর মতো। দুই বোনের গল্প যেন আর ফুরায় না। হাফিজ সাহেব মেয়েদের গল্প শুনেন আর হাসেন। মেয়েরাও বাবার সাথে গল্প করতে করতে হেসে কুটি কুটি হয়। ফাহিমা বেগম বাবা মেয়েদের এসব কান্ড দেখেন আর মুচকি মুচকি হাসেন।

ঈদের আগের দিন মেয়েরা বাবার সাথে বসুন্ধরা সিটিতে কেনাকাটা করতে গেল। মেয়েরা বাবার কাছে এটা কিনে দাও, ওটা কিনে দাও, বলে বায়না করছে আর বাবাও সেটাই কিনে দিচ্ছে। মেয়েদের চোখে মুখে আনন্দ দেখে বাবা ও খুব আনন্দ পাচ্ছেন। সবশেষে মেহেদি কিনে দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরলেন।

রাতে দুই মেয়ে বাবার হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিবে বলে খুনসুটি শুরু করলো। হাফিজ সাহেব দুই মেয়ের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে মেহেদি দিয়ে দিতে বললেন। কারণ তিনি মেয়েদের মন খারাপ করতে চান না। মেয়েরাও খুশি মনে বাবার হাতে মেহেদি দিতে লাগলো।

ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দীপা ও দিশা দুই বোন বাবা মাকে সালাম করলো এরপর বাবার কাছ থেকে সালামি নিল। দুই মেয়ে ঈদের জামা পড়ে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাবে বলে রেডি হচ্ছে। হাফিজ সাহেব এসে দুই মেয়ের চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে দিলেন এবং মেয়েদের রেডি হতে সাহায্য করলেন। ফাহিমা বেগম রান্নাঘরে কাজ করতে করতে বললেন, আমি তো কেউ না, তোমাদের কাছে বাবাই সব। হাফিজ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তোমাকে তো ওরা সব সময়ই পায়, আমাকে তো পায় না। তাই এখন একটু বাবা মেয়েদের মধ্যে ভালোবাসা আদান-প্রদান হচ্ছে। এই আর কি। বাবার সাথে মেয়েরাও হেসে ফেললো।

মেয়েরা ঘোরাফেরা শেষ করে বিকেলে বাসায় ফিরলো ।ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে বাবার রুমে আসলো।বাবার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করল আর একসাথে চা খেতে বসলো। হাফিজ সাহেব চা খেতে খেতেই অসুস্থতা বোধ করলেন।
তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়লেন।শরীরে প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছে। তিনি কথা বলতে পারছেন না। কথা আটকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় মেয়েরা চিৎকার করতে করতে পাশের বাসার আঙ্কেলকে ডাক দিলো।তিনি এম্বুলেন্স কল করে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করলেন। ঈদের দিন বলে তেমন ভালো কোন ডাক্তার পাওয়া গেল না। শুধু ডিউটি ডাক্তার পাওয়া গেল।ডিউটি ডাক্তার হাফিজ সাহেব কে দেখে বললেন, উনার স্ট্রোক হয়েছে। অবস্থা ভালো না। তাই সাথে সাথে হসপিটালে ভর্তি করে নিলেন।

চিকিৎসা চলছে কিন্তু শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছে না। তাই তাকে আইসিউতে নেয়া হলো। না তবুও কোন উন্নতি হচ্ছে না। তারপর তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হলো তিন দিন। তিনদিন পর ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মেয়েরা বাবার লাশ সামনে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।আর ফাহিমা বেগম নিশ্চুপ নিস্তব্ধ। সে যেন কান্না করতে ভুলে গেছে। সে জানে না, কিভাবে এই শোক সামাল দিবে? আত্মীয়স্বজন সবাই অনেক বুঝাচ্ছে, সান্তনা দিচ্ছে। তিনি জানেন, এসব এর কোন সান্তনা হয়না।কিন্তু তবুও তাকে শক্ত হতে হবে তার মেয়েদের জন্য।উনি ভেঙ্গে পরলে মেয়েদের সামাল দেবে কে? এসব ভাবতে ভাবতেই তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

সময় কখনো থেমে থাকে না। এভাবেই মাস যায়, বছর কেটে যায়। আবার ঈদ আসে, ঈদ যায়। কিন্তু তাদের জীবনে আর ঈদ, আনন্দ বয়ে আনে না। তাদের কাছে ঈদ মানেই দুঃখের স্মৃতি।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়