‘এই করেছ ভালো নিঠুর হে…’/নাসির আহমেদ কাবুল

‘এই করেছ ভালো নিঠুর হে/এই করেছ ভালো/এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটিতে ঈশ্বরের প্রতি নিজেকে নিবেদন করার একটি গান। বার-বার শোনা এই গানটি প্রথম কবে শুনেছিলাম, কে গেয়েছিলেন গানটি, সেটি নিয়েই আজ আমার স্মৃতিচারণ। আমি স্মরণ করছি বুলু দি-কে। যার কণ্ঠে প্রথম গানটি শুনেছিলাম আমি। বুলু দি তুমি বেঁচে থাকলে আমার শতকোটি প্রণাম তোমার চরণ তলে।
আমার জন্ম ১৯৬০ সালে, ৬ জানুয়ারি। জন্মস্থান বর্তমান পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার ব্যাংকপাড়ায়। আমরা আট ভাইবোনের (চার ভাই, চার বোন) মধ্যে শুধু আমিই মঠবাড়িয়ায় জন্ম নিয়েছিলাম। বাকি ভাইবোনরা গ্রামে দাদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করে। আমার বাবা একটি ব্যাংকে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে ব্যাংকপাড়ায় একটি বাসা পেয়েছিলেন টিনের চালার। আমি সেখানেই জন্মগ্রহণ করি। বাসাটি খুব ভয়ঙ্কর ছিল। প্রচুর সাপ ছিল বাসাটিতে। মায়ের মুখে শুনেছি এত সাপ ছিল যে, মাঝে-মধ্যে রাতে মশারির বাইরে সাপে ফনা তুলে খেলত! মশারি টানাতে গিয়ে দেখা যেত মশারির সাথে সাপ পেঁচিয়ে আছে। অনেক সময় বন্দুক দিয়ে গুলি করে মারতে হয়েছে সাপ। আমার মা খুব সাহসী বলে তিনি আমাদের নিয়ে ওই বাসাটিতে থাকতে পেরেছিলেন। দিনে-দিনে ওখানেই বড় হয়ে উঠেছিলাম আমরা। তারপর এক সময় বাবা ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে গেলেন। একেবারেই গ্রাম। সেখানে আমার শৈশব কেটেছে। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত লেখাপড়া শিখেছি একজন গৃহশিক্ষকের কাছে। স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ক্লাস পাল্টাতে হয়Ñএ নিয়মটি আমার জানা ছিল না। আমি মনে করতাম বই পড়া শেষ হলেই ক্লাস পাল্টানো যায়। নতুন বই পেয়ে আমি তাই ক্লাস পাল্টানোর জন্য বইগুলো মোটামুটি মুখস্ত করে নতুন বইয়ের বায়না ধরতাম। বাবা বায়না পূরণ করতেন আমার শিক্ষকের সাথে পরামর্শ করে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ক্লাস ফোর থেকে। ১৯৬৯ সালে আমি ক্লাস ফোরে মাসখানেক চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েছি। স্কুলটির নাম তেঁতুলতলা সরকারি প্রাইমারি স্কুল। আমাদের গ্রামের নাম ঘোষের টিকিকাটা। এই স্কুলটিই ছিল আমাদের বাড়ি থেকে খুব কাছে। স্কুল জীবনে আমি নগেন স্যারকে পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন গণপতি হালদারের পিতা। গণপতি হালদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। ১৯৭১ সালে রাজাকারা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারের নির্দেশে তাকে গুলি করে হত্যা করে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী ছিল। ভারতে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
১৯৬৯ সালের সম্ভবত মার্চ-এপ্রিলে একদিন মঠবাড়িয়া থেকে ফিরে এসে বাবা জানালেন, তিনি আবারও ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেবেন। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমাদের আট ভাইবোনকে নিয়ে আবার সেই ব্যাংকপাড়ার বাসায় চলে যাবেন। এতে আমাদের লেখাপড়ার সুবিধা হবে।
ওই দিন রাতে সবাই পিছনের বারান্দায় খেতে বসেছে। আমি আগেই খেয়ে এসে পাশের রুমে শুয়ে আছি। আর মন শিহরিত হচ্ছে নতুন জায়গায় যাওয়ার আনন্দে। হঠাৎ আমি আমার অজান্তেই গাইতে শুরু করলাম, ‘আমার সোনার ময়না পাখি/কোন দেশেতে গেলা উড়াইরা রে/দিয়া আমায় ফাঁকি/ আমার সোনার ময়না পাখি।’ পাশের বারান্দা থেকে কথার গুঞ্জন শুনতে পেলাম। হাসির শব্দও পাচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য আমি। শুধু বাবার একটি কথা আমার কানে বাজলো খুব। তিনি বলেছিলেন, ‘ওতো ভালোই গায়। একটা হার্মোনিয়াম কিনে দিলে কেমন হয়?’
১৯৬৯ সালে এপ্রিল মাসের দিকে আমরা সবাই মঠবাড়িয়া চলে গেলে আমি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। আমার সহপাঠি হিসেবে যাকে প্রথম পেয়েছি সে আমার চাচাতো ভাই। তার নাম মিজানুর রহমান তসলিম। ব্যাংকপাড়ায় তসলিম ও আমাদের বাসা ছিল পাশাপাশি। ওর বাবা ছিলেন ব্যাংকের ম্যানেজার আব্দুল জব্বার। তিনি একজন সঙ্গীত শিল্পী ও নাট্যশিল্পী ছিলেন। জব্বার চাচার মেজো ছেলে তসলিম একজন সংগীত শিল্পী। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে সে তালিকাভুক্ত শিল্পী। স্কুলে যাওয়া-আসা ওর সাথেই করতাম। সব দুষ্টুমিও আমরা দুজনের করতাম। ও ক্লাসে প্রথম হতো, আমি টেনেটুনে পাস করতাম। তসলিমের কথা বার বার আসবে এই লেখায়। তবে সেটা আরও পরে। তবে বড় হয়ে এই বন্ধুটির সঙ্গে আমার টকমিষ্টির সম্পর্ক তৈরি হয়। বর্তমানে একেবারেই ওর সাথে আমার সম্পর্ক নেই আমার!
বুলু দি ছিলেন আমাদের ব্যাংকপাড়া বাসার পাশের বাসার পিসিমার মেয়ে। পিসি মা ছিলেন থানার মিডওইফ। আমার মায়ের সাথে তার প্রচুর সখ্যতা ছিল। সে সূত্রে তাকে মাসীমা ডাকা উচিত ছিল। কিন্তু কেন যে পিসিমা ডাকা হলো সে কথা জানি না আমি।
বুলু দি বিবাহিতা ছিলেন। সবে বিয়ে হয়েছে। মাঝে মধ্যে শ্বশুর বাড়ি থেকে তিনি মায়ের বাসায় বেড়াতে আসতেন। তিনি বয়সে বড় ছিলেন। আমাকে ‘তুই তুই’ করে সম্বোধন করতেন। একদিন সন্ধ্যায় বুলু দি ও পিসিমা এলেন আমাদের বাসায়। এসে আমাকে বললেন, ‘কাবুল তোর হার্মোনিময়ামটা দিবি একটু?’ কেউ কিছু চাইলে কেন দেবো না! দিতেই যেন আমার আনন্দ সেই কৈশোরকাল থেকে।
আমি হার্মোনিয়ামটা বয়ে নিয়ে বুলু দির বাসায় রেখে এলাম। বুলু দি খুব খুশি হলেন। বাসায় ফিরে তিনি প্রথম নামকীর্তন গাইলেনÑ‘হরে রাম-হরে কৃষ্ণ/কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।’ আমি একদিন পিসিমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘পিসিমা, হরে রাম কি?’ পিসিমা কৌতুল করে কী যেন বলেছিলেন, তবে ব্যাখ্যাটা সঠিক ছিল না, বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম।
নাম কীর্তন শেষে বুলু দি গান ধরলেন, ‘এই করেছ ভালো নিঠুর হে…/এই করেছ ভালো।’ তার গান ভেসে আসতো আমার জানালার ফাঁক গলিয়ে। আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম গানটি। বড় হয়ে জানতে পেরেছিলাম এটি রবীন্দ্র সঙ্গীত। তখন আমি রবীন্দ্র সংগীতের ভক্ত হইনি; এই করেছ ভালো গানটির ভক্ত হয়েছি। রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত হওয়ার গল্প আছে। সেটা নাট্যব্যক্তিত্ব শংকর সাওজালকে নিয়ে। সে অধ্যায়টি আমি পরে লিখব আশা করছি।
তারপর কতবার যে বুলু দিকে অনুরোধ করে গানটি শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। আজও বুলু দির কণ্ঠ শুনতে পাই আমি-‘এই করেছ ভালো নিঠুর হে/এই করেছ ভালো/এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো।’

চলবে

মন্তব্য করুন