একজন তালিকা বহির্ভূত মুক্তিযোদ্ধা কথা/জাকিয়া শিমু



প্রায়  বছরসাতেক পর ডালাসের এক কফিশপে, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেনের সাথে আমার আবার দেখা হয়ে যায়। বহুদিন পরে সাক্ষাৎ। প্রথম ধাক্কায় ঠাহর করতে একটু সময় লাগলেও প্রথম পরিচয়ের চমকটা এখনো স্মৃতিতে শক্তপোক্তভাবে গেঁথে আছে। 
সবেমাত্র স্বদেশ ছেড়েছি, এদেশে পরিচিতজন খুবই কম, বলতে গেলে আঙুলে-গোনা। রুমমেট বাংলাদেশী। তার সাথে তার পরিচিত এক পরিবারের বিয়ে পরবর্তী পার্টিতে বিনা দাওয়াতে উপস্থিত হই। আমার উদ্দেশ্য অবশ্য দেশি আমেজে কিছুটা সময় কাটানো এবং দেশ্য- খানাপিনার লোভ। আমি এবং আমার রুমমেট দুজনের রান্নার দৌড়, রান্নাঘর পর্যন্ত। ডিমভাজি আর পাতলা-ডাল ছাড়া বাড়তি এখনো কিছুতে পোক্ত হতে পারিনি। এমন একটা সুযোগ আমি অন্তত হাতছাড়া করলাম না।

বিদেশে আয়োজন করা অনুষ্ঠানগুলোতে দেশীয় আমেজ শক্তপোক্তভাবে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। ইদানিং দেশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরার প্রয়াস খুব একটা চোখে পড়ে না। ভিনদেশের মাটিতে যতটা যত্নে লালন করা হয়। চোখ ধাঁধানো এলিডি লাইটের আলোকচ্ছটার প্রবেশপথে জলজ্যান্ত কলাগাছ পোঁতে গেইট করা হয়েছে। গেইটের মাঝ বরাবর কচি হাতের লেখা- “শুভ বিবাহ” এবং লেখাটির চারিধারে লাল-হলদে জরির প্রলেপ দিতেও কোনোরকম ত্রুটি করা হয়নি। কলাগাছের সাথে লম্বা পাটের দড়ি ভেতর পর্যন্ত টেনে নেওয়া হয়েছে। দড়িতে ঝুলছে নানান বর্ণের কাগজের সাজ-সজ্জা। মাটির কলস- হাঁড়ি- পাতিল, লোটা বদনা কোনোটার কমতি নেই।

দেশীয় গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলতে ছিটেফোঁটা ফাঁক- ফোকর রাখা হয়নি। এ যেন অজোপাড়া গাঁয়ের কোনো বিয়ে বাড়ি। আমি মুগ্ধ হয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখছি। এমন সময় মূল আয়োজনের ভেতর থেকে তুমুল হট্টগোলের আওয়াজ ভেসে আসে। বাঙালি বিয়ে বলে কথা। দশ জনের দশ মত এবং মতের মিল-অমিল, ঝগড়া ফ্যাসাদ তারপর বিয়ে। বিয়েবাড়িতে শুধু দেশি সাজসজ্জা হলে তো দেশি বিয়ে হবে না। ঝগড়াঝাঁটিটাও বাদ যাবে কীসে! ভেবেছিলাম নতুন চমক বোধহয়। ঝগড়ার অভিনয় করে ষোলআনা দেশি-বিয়ের ছাঁচে ফেলা। কিন্তু না চারদিকের লোকজন রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু করে তাদের চোখমুখে বিষাদের ছায়া। আমি আর আমার রুমমেট ভিড় কাটিয়ে তুমুল ঝগড়াস্থলে ঢুকে পড়ি।  
হট্টগোলের মূল হোতা আব্দুল বাতেন। ছোটোখাটো হালকা পাতলা গড়নের প্রায় ষাটোর্ধ বয়সের একজন মানুষ। দুহাত নেড়েচেড়ে বাংলা, ইংলিশ দু’ভাষায় অনবরত বলে যাচ্ছেন। ঘটনা বুঝার চেষ্টা করি। আব্দুল বাতেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলের বিয়ে। বন্ধুর প্রতি তীব্র ক্ষোভ ঝরে পড়ছে আব্দুল বাতেনের। বন্ধু মাথা নিচু করে বসে আছে। লজ্জা অপমানের ভারে চোখজোড়া ছলছল করছে। গ্রামাঞ্চলে একটা কথা আছে- মাজা ভেঙে যাওয়া। বন্ধুর হয়েছে সে দশা। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। কষ্টের জল হৃদয় নিংড়ে উপচে পড়ছে। জীবনের পথ বড়ো শক্ত বিষয়। সে পথ সবসময় নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, প্রকৃতি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও জীবনপথের আকাবাঁকা সে পথে নিজের অজান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনার ফল তাঁকেই ভোগ করতে হয়।

আব্দুল বাতেনের বন্ধুর বাপ- চাচারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। নিজের মধ্যে দেশপ্রেমের বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই। পারিবারিক আদর্শ আজীবন ধারণ করে চলেছেন। ছেলে মেয়েদের নিজ আদর্শে গড়তে একটুও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু ছেলে মেয়ে যখন বড় হয় তখন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বন্ধুর ছেলে পড়তে যায় ভিন্ন ষ্টেটে। পছন্দ করে বসে নিজ সহপাঠী পাকিস্তানি মেয়েবন্ধুকে। তিনি নিজেও এ বিয়েতে রাজী নন, কিন্তু পরিস্থিতি তাঁকে এ পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। 
মেয়ে পক্ষের মুরব্বীদের বেশিরভাগের পরনে জিন্নাহ টুপি এবং কাবুলি ধরনের আলখেল্লা। তারা উর্দু ভাষায় কথা বলছেন। অতি সাধারণ বিষয়। কিন্তু প্যাঁচ লাগে ভিন্নখানে। আব্দুল মতিন তার বন্ধুদের নিয়ে হলরুমের এক কিনারায় গোলটেবিলে বসে গল্প করছেন। গল্প বেশ জমে উঠেছে। এ বিষয়-ওবিষয় পেরিয়ে গল্প অবধারিতভাবে নোঙর ফেলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধদিনের গল্পে। আব্দুল বাতেন খুব গর্বের সাথে বিশেষ এক যুদ্ধগল্প, পাকসেনাদের লঞ্চ ডুবির ঘটনা রসকষ মিলিয়ে বলতে শুরু করেন। পাশের টেবিলে কয়েকজন পাকিস্তানি বয়স্কলোক ছিলেন। তারাও তাদের গল্পে মশগুল। আব্দুল বাতেন স্বাভাবিক কারণে পাকিস্তানিদের সবসময় এড়িয়ে চলেন। কিন্তু এ যাত্রায় রেহাই পাননি। আব্দুল বাতেনকে অনেকটা জোর করে তার বন্ধুরা ধরে নিয়ে আসে এ বিয়েতে। ছেলের বাবা তাঁর চেয়ে বয়সে ঢের ছোটো হলেও তাঁদের বন্ধুত্ব দীর্ঘ দিনের। তার মুক্তিযুদ্ধের গল্প যখন জমে উঠেছে, পাশের টেবিলের একজন সেটা কান বিছিয়ে শুনে। এবং বিষয়টা তাদের টেবিলে এ বিষয়ে মনোযোগে আনে। তারা আব্দুল বাতেনকে হেয় করতে একাত্তর নিয়ে হাসি তামাশা করে। বিষয়টা সহজেই আব্দুল বাতেনের কানে চলে আসে। আব্দুল বাতেন চটে যান। এবং ভয়ঙ্করভাবেই রেগেমেগে আগুন হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। অবশ্য আব্দুল বাতেনের এমন ভয়ঙ্কর রূপ দেখে প্রতিপক্ষ ভয়ে চুপ হয়ে যায়। ওদিকে দুপক্ষের লোকজন তাঁকে ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয় না। বন্ধুর উপর চরম রাগ করে এক পর্যায়ে আব্দুল বাতেন হন্তদন্ত হয়ে অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যান। 

গায়েগতরে ছোটোখটো হলেও চারিত্রিক বলয়ে সাহসী এবং দৃঢ়চেতা মানুষটাকে দেখে আমার, আমার বইয়ে পড়া বিপ্লবী কমরেড নলিনী দাসের কথা মনে পড়ে গেল। আব্দুল বাতেন, চলনে- বলনে-তেজোদীপ্তে তাঁর প্রতিচ্ছবি। আমি মুগ্ধ এবং কৌতুহলী হয়ে লোকটির খোঁজ করলাম। অনেকের কাছে তাঁর সম্বন্ধে জেনে আগ্রহের মাত্রা বেড়ে হলো কয়েকগুন। জানা গেল বেশ মেজাজি মানুষ- রগচটা। একদিন সাহস করে এবং অনেকটা হুট করে তাঁর বাসায় উপস্থিত হলাম। স্বভাবসুলভ রাগক্ষোভ দেখালেন বটে।
আমি সমস্তটা হাসিমুখে নিলাম। জানালাম আমার উদ্দেশ্য স্বচ্ছ। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে এসেছি এবং নতুনপ্রজন্ম হয়ে তাঁর গল্প শুনতে বিশেষ আগ্রহী। এরপর খুব অল্প সময়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন। প্রস্তাবে মনে হলো তিনি খুশিই হলেন।
 তাঁর সম্বন্ধে অনেককিছু জানলাম। একা থাকেন। মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেন। মানুষ নামক মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভণ্ডামি মেনে নিতে পারেন না। প্রকৃতির সাথে বেজায় বন্ধুত্ব, ঘুরে বেড়ান যখন যেখানে মন চায়। স্ত্রী- সন্তান দেশে থাকেন তাঁদের দেখভাল করতে যতটুকু প্রয়োজন কাজ করেন, বাকি সময় ঘুরে বেড়ান।ভারি ভারি কথা বলেন, সময় নিয়ে এবং থেমে থেমে। আমার কাছে কোনো গল্প বইয়ের বিপ্লবী এক চরিত্র মনে হয়। কিছু কথা বুঝি বাকিসব মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। কিন্তু মুগ্ধতা কাটে না। তাঁর পছন্দের আলাপের বিষয়-বিপ্লব। নিজে বিপ্লবী ছিলেন পরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং দেশ স্বাধীন করেছেন। দেশের প্রতি তীব্র ভালোবাসা। বয়স ষাট পেরিয়েছে বেশ আগে, এ বয়সেও দেশকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তাঁর। দেশটাকে বিপ্লব করে বদলে দিতে চেয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করলেন কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেল না। কথার সুরে আক্ষেপ ভেসে আসে। দেশটা অন্য দেশের সাহায্য নিয়ে হুটহাট স্বাধীন হলো ঠিকই কিন্তু দেশের মানুষগুলো স্বাধীন হতে আজও পারল না। স্বাধীনতার পর কোনো সরকার তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এ বিষয়ে সে হতাশ। শেখ সাহেবের ডাকে যুদ্ধে গিয়েছিল কিন্তু স্বাধীন দেশ গড়তে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি দূরে সরিয়ে দিলেন। বেশ অভিমান ফুটে ওঠে তার চোখেমুখে। আজও বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন। দেশ বদলে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রবাসে নিঃসঙ্গ দিন পার করছেন। আমাকে সেদিনের মতো বিদায় করে কাজে চলে যান। ছুটির দিনে আবার যাওয়ার নিমন্ত্রণ করেন।
এরপর ছুটিছাটায় আমরা প্রায়ই একসাথে হই। অজানা কারণে তিনি আমাকে পছন্দ করতে শুরু করলেন। শহরের বেশিরভাগ মানুষ তাঁর স্বভাবের কারণে তাঁকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু আমি তাঁর স্বপ্নের ডালে সহবদ্ধ হয়ে তাঁকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি শহরের পছন্দের জায়গাগুলোতে। আমরা তাঁর টয়োটা করোলা নিয়ে ছুটির দিনগুলোতে বহুদূরে চলে যাই। স্থানীয় বাঙালিদের সাথে তাঁর তেমন সখ্য নেই। প্রকৃতির কোলে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। আমি নিজেও। আমরা সারাদিন ঘুরি, গল্প করি, পেটের টানবোধ করলে পথের কফি দোকানের খাবারে পেট চালিয়ে নিই। খুব চমৎকার করে গল্প বলেন আব্দুল বাতেন। আমি হা হয়ে শুনি। গল্পের শুরুটা বলে খানিকক্ষণ চুপ থাকেন, এ সময়ের ফাঁকে শ্রোতা তাঁর গল্পে ঝুঁকে পড়ে। আগ্রহ নিয়ে তার পরের কথাগুলো শুনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। মানুষকে কাছে টানার এবং ভালোবাসার সুপ্ত এক প্রতিভা তাঁর রয়েছে। আমি ঠিকঠাক তা টের পাই।
শৈশব- কৈশোরে যখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস জানার কথা ছিলো, কোনো এক রহস্যজনক কারণে সে সুযোগ আমাদের হয়ে ওঠেনি। ভাসা ভাসা অস্পষ্ট কিছু অংশ বড়োদের কাছ থেকে গল্পের ছলে কিংবা পাঠ্য বইয়ে যৎকিঞ্চিৎ পড়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো এমন গভীর একটা বিষয়ে আমাদের আগ্রহী করে তুলতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেনের সাথে পরিচয়ের পর বিশেষ করে তাঁর বিসদৃশপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং গল্পের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ করে তুলবার অসম্ভব ক্ষমতার কারণে আমি তাঁর কাছ থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে সেসব দিনের বীরত্বগাঁথা হাজারো গল্প শুনি এবং মুগ্ধ হই।
তবে চণ্ডরোগ ছাড়াও আব্দুল বাতেনের মধ্যে আরও কিছু রহস্যজনক সমস্যা আছে। খোলাসা করে বলি। দেখা গেল, আমি ছুটির ফাঁকে তাঁর বাসায় উপস্থিত হলাম। তিনি ভণিতা না করে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সোজা কপাটের ওপাশ থেকে খট আওয়াজে কপাটে ছিটকিনি তুলে দিলেন। প্রথম দশায় তাঁর এই আচরণে আমি কিছুটা আহত হলেও পরক্ষণে তাঁর বিশিষ্ট স্বভাবচরিতের আকর্ষণে যেন আগ্রহী হয়ে উঠতাম। এবং নিজের চণ্ডাল ইচ্ছেটাকে পুষে না রেখে পরদিন আবার তাঁর দরজায় কড়া নাড়তাম। হয়তো আত্নবিস্মৃত কিংবা আগের আচরণ মানুষটার মনে থাকে না কিংবা সৌজন্যতার ধার ধারেন না। নিজে যা সহি মনে করেন তাই বলেন এবং করেন। কারো অনুগ্রহের তোয়াক্কা করেন না। সবার সাথে গল্প কিংবা মিলমিশ করেন না। বুক ফুলিয়ে বলেন,  ” বিশিষ্টতাহীন কিংবা সাধারণে আমার গল্প শুনার যোগ্যতা রাখে না”। আমার কাছে তাঁর এ কথায় যুক্তি আছে মনে হলেও তাঁর কাছের মানুষজনও অহংকারী এবং দাম্ভিক ভেবে তাঁর কাছে ঘেঁষেন না বললেই চলে। পড়ুয়া মানুষ, পড়ার বিষয় আশয়ও অত্যন্ত উঁচুমার্গের। এক কামরার এক ঘর নিয়ে অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবনযাপন করেন। ঘরজুড়ে ছড়ানো ছিটানো The Old Regime and Revolution, Darkness At Noon, The End of Socialism এর মতো বইপত্তরে। মানুষটার কাছে আমাদের মতো সাধারণের সঙ্গ, উপদ্রব মনে হওয়া স্বাভাবিক বটে। আমি তাঁর বয়ানে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সরাসরি জড়িয়ে পড়ার গল্প শুনি।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ। আব্দুল বাতেন সবেমাত্র ঢাকার এক নামকরা কলেজের বি এ ক্লাশের ছাত্র। অত্যন্ত সাহসী, মেধাবী এবং দৃঢ়চেতা ছেলেটি; অল্প সময়ে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ফুটবল খুব ভালো খেলেন। ঢাকায় এক ক্লাবের হয়ে খেলে ইতিমধ্যে দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। বাবা গত হয়েছেন বেশ ক’বছর হতে চলল। মায়ের সার্বক্ষণিক উৎকণ্ঠা- ডানপিটে ছন্নছড়া একমাত্র সন্তান, আব্দুল বাতেনকে ঘিরে। দেশে সাধারণের ভাষায়, গোলমাল কিংবা গণ্ডগোল চলছে, তা অবশ্য বেশ ক’বছর জুড়ে। ৭ই মার্চ ১৯৭১, রক্ত তেতিয়ে ওঠা শেখ মুজিবের ভাষণের আহ্বানে, আব্দুল বাতেন নিজগাঁয়ে ফিরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ছেলে গাঁয়ে ফিরলেও বাড়ি থাকে না। মাঝেমধ্যে হ্যালির ধুমকেতুর মতো শেষ প্রহরে এসে মাকে একনজর দেখে, মুহূর্তে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। দেশজুড়ে পাকবাহিনীর চরম দৌরাত্ন- হাজার হাজার নির্দোষ মানুষকে হত্যা, ধর্ষণের হোলি খেলায় মেতে আছে। সাথে যুক্ত হয় দেশীয় সুবিধাভোগী সারির দখল- লুটতরাজ। তাদের এলাকা ( দোহার- নবাবগঞ্জ- বিক্রমপুর ) হিন্দু আধিপত্যের কারণে অত্যাচারের মাত্রা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। বেঁচে থাকা মানুষ রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। আব্দুল বাতেনের মা, রাতের অন্ধকারে দলের সাথে যুক্ত হয়ে অজানা পথে হারিয়ে যান।
একটার পর একটা গুপ্ত অপারেশন চলছে নিজের এবং আশেপাশের এলাকায়। দিনে তাঁরা বনবাদাড়, ঝোপঝাড়ে লোকচক্ষুর অন্তররালে ট্রেনিং নেন, রাতের ঘনঘোর আঁধারে নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকসেনারদের আস্তানায়। আব্দুল বাতেনের এসময় প্রায়ই মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ে। মা কোথায় আছেন তাঁর জানা নেই। আপন বলতে একমাত্র মা ছিলেন এখন তিনি বেঁচে আছেন, না কি মারা গেছেন তাও জানার পথ নেই। এক মাকে অনিশ্চয়তা পথে রেখে দেশ-মাকে বাঁচাতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেন ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার কমান্ডার সুলতানসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্বাদের সাথে রওনা হলেন ইছামতি নদীর ধারে; গালিমপুর এবং ছাইতার মোহনায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁছে তাঁদের গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর আসে পাকবাহিনী এ পথে ঢাকা থেকে আসছে নবাবগঞ্জ থানায়। নবাবগঞ্জ থানা মিলিটারির দখলে কিন্তু এলাকা এখনো তাদের আয়ত্বে আনা যায় নাই। স্থানীয় বিচ্ছু বাহিনীর যন্ত্রনায় থানার ভেতরও তারা ভয়ে আতঙ্কে দিনরাত পার করে। অতিরিক্ত সেনাসদস্য এনে বিচ্ছুবাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করা তাদের উদ্দেশ্য।
আলোচিত মুন্নিলঞ্চ যোগে কয়েক বহর পাকসেনা আসছে এ এলাকা দখল নিতে। রাতে কমান্ডার সুলতান, গোপনে বিচ্ছুবাহিনীর সাথে বুদ্ধি আঁটে। ষ্টীল বডির মুন্নিলঞ্চকে কীভাবে ডুবিয়ে দেওয়া যায় তার বিভিন্ন কৌশল নিয়ে বৈঠক চলে শেষরাত ধরে। তাঁদের মুঠবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, বাড়তি সেনা এ এলাকায় কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া হবে না।

কিন্তু তাঁদের কাছে ভারি অস্ত্রপাতি বলতে গেলে কিছুই নেই। যদিও অদম্য সাহস এবং দুচোখ ভরতি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন সেসব অপর্যাপ্ততার দৈন্যতা সহজেই পাশ কাটিয়ে যায়।
বর্ষাকালের আকাশ কালো নেকাব পরে আছে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। দিনেদুপুরে হুট করে আকাশ আঁধার হয়ে পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে যায়। অথৈ ঘোলা-জল নদীরকূল উছলে পড়ছে। গতকদিনের আবহাওয়া এমনই চলছে। পাকসেনারা সাঁতার জানে না। এটা একটা মোক্ষম সুযোগ। বিচ্ছুর দল পরিকল্পনা মতো কয়েক দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। দেশীয় শাবল কাস্তে, সুরকি বল্লম এবং অল্পকিছু সামরিক সরঞ্জাম তাঁদের একমাত্র ভরসা। একদল নদীর মোহনায় দাঁড়ায়,আরেকদল নদীর মধ্যিখানে কচুরিপানার ভেতর মাথা লুকিয়ে কোনমতে নাক বের করে শ্বাসপ্রশ্বাস বাঁচিয়ে- অপেক্ষায়। কচুরিপানার ছোবায় হরিণা চিংড়ি ঘর বেঁধেছে। বিচ্ছুদের শরীরকে এরা বাসা ভেবে গায়ের সাথে লেপটে থাকে।। বিচ্ছুদল মরার মতো ঘোলাজলে দাঁড়িয়ে থাকে। বাকিরা যে যার দায়িত্ব বুঝে নিয়ে নদী এবং নদীরকূল ঘেঁষে বিশেষ অপারেশনে, নেকড়ে বাঘের মতো শিকারীর অপেক্ষায় প্রহর গুনে।

জীবন দিয়ে হলেও সেনাদের এ যাত্রা প্রতিহত করতেই হবে। অপেক্ষার পালা হয় দীর্ঘক্ষণ। দুপুর গড়িয়ে বৈকালি ছায়া নামে ইছামতীর পাড়ে কিন্তু মুন্নি লঞ্চের দেখা নেই। সহসা ইছামতীর বুক চিরে হাঁসের আদলে ভেসে আসে মস্ত বড়ো- মুন্নিলঞ্চ। পাকসেনায় ভর্তি লঞ্চ, বন্দুক তাক করে যুদ্ধের পজিশনে দূর থেকেই খাকীকাপড়ের সেনাদের দেখা মেলে। বিচ্ছু বাহিনী যে যার অবস্থানে চরম সতর্ক হয়ে একযোগে আক্রমণের অপেক্ষায়। সেনাদের মধ্যে অনেকে দূরবীনে সন্মূখশত্রু খোঁজাখুঁজি করছিল। লঞ্চ ধীর গতিতে এগিয়ে আসে। নদীভর্তি কচুরিপানা, এসব ছাড়িয়ে লঞ্চের গতি ক্রমশ কমে আসে। সেনাদের চোখ নদীর জলে ভেসে থাকা কচুরিফুলের সৌন্দর্যে তারা আপ্লূত হয়। নিজেদের দেশ- পশ্চিমে এমন জলেভাসা সৌন্দর্যের সাথে তাদের পরিচয় নেই। সহসা কচুরিপানা নড়েচড়ে ওঠে। কিছু একটা আঁচ করার আগেই বিচ্ছুর দল লঞ্চের তলা ফুটা করে ডুবসাঁতারে কূলে ফিরে আসে। অল্পসময়ে ইছামতীর তলায় তলিয়ে যায় ষ্টীলবডি খ্যাত মুন্নিলঞ্চ। বহু মিলিটারি অথৈ জলের গভীরে দাপাদাপি করেও বেঁচে উঠতে পারে না। জলের গভীরে তলিয়ে যায়। সেসময়ে যুদ্ধরত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিচ্ছু দলের বীরত্বের এ কাহিনি।

পাকসেনারা পানিপথে সবসময় পাশাপাশি দুটি জলযান ব্যবহার করত। একটার সমস্যা হলে যাতে অন্যটিতে এগিয়ে আসতে পারে। অন্য যানটি এগিয়ে এলো বটে কিন্তু তলিয়ে যাওয়া সেনাদের বাঁচানো গেল না। ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে গেল। চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের এমন করুণ মৃত্যু দেখে সেনারা প্রথমে ভেঙে পড়লেও পরমুহূর্তে ভয়ঙ্কর রূপে বেরিয়ে এলো লঞ্চ থেকে। এবং লঞ্চডুবির এলাকায় অর্থাৎ নবাবগঞ্জ এবং বিক্রমপুরের গ্রামগুলোতে চরম হত্যাযজ্ঞ শুরু করল। রেহাই পেল না দুধের শিশু থেকে হাড় জিরজিরে বৃদ্ধরা। যুবতী বউ-মেয়েদের ধরে ধরে লঞ্চে ভরা হলো এবং ক্যাম্পে নিয়ে দীর্ঘকাল অত্যাচার চলল, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত। অনেক মেয়ে অসহ্য এই নির্যাতন সইতে না পেরে আত্নহননের পথে যায়। ভয়ঙ্কর সে অত্যাচারের কথা মনে হলে আজও আব্দুল বাতেন আঁতকে ওঠেন। মায়ের কোল থেকে টেনেহিঁচড়ে শিশু বাচ্চাকে ছিনিয়ে নিয়ে আছড়ে মায়ের সামনে মেরে ফেলা হয়। ঘর থেকে অসহায় নির্দোষ মানুষ ধরে এনে লম্বা লাইনে দাঁড় করিয়ে জনসমক্ষে ব্রাশ ফায়ারে শত শত মানুষকে হত্যা যজ্ঞ চলে।
এমন পৈচাশিক অত্যাচারের নমুনা দেখিয়ে দেশের মানুষের মনে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এতকিছুর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দমানো যায় না। সাধারণ মানুষের মাঝেও তীব্র ঘৃণা বেরিয়ে আসে পাকসেনাদের প্রতি। এবং ঘটনা ঘটে তার উলটো রথে! এতদিন যারা ভয়ে ঘরে লুকিয়ে ছিল তারাও দলে দলে বেরিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। নবাবগঞ্জ এবং বিক্রমপুরের মুক্তিযোদ্ধারা আরও সুসংগঠিত এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে কোঁচড় বেঁধে নেমে পড়ে। সে এলাকায় তুমুল যুদ্ধ চলে গোপনে এবং সন্মুখে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত একাধারে।

দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বপ্ন এবং বাস্তবতার ফারাকে আব্দুল বাতেনের মন বিপর্যস্ত হয়। ন’মাস যাদের সাথে অভিন্ন স্বপ্ন বেঁধে দেশের জন্য জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে যুদ্ধ করেছেন,তারা অনেকে স্বাধীন দেশে হুট করে বদলে গেল। অন্যায়ভাবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধায় নিজেদের জড়িয়ে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে আদর্শহীন পথের যাত্রা শুরু করল। এমনকি দেশীয় আর্মির মতো যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করা দলটির অনেকেও এই একই পথ ধরল। ন’মাসের যুদ্ধে দেশের সকল অবকাঠামো ভেঙেচুরে তছনছ সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এত অল্প সময়ে মানুষের মানবিক ধসের নমুনা আব্দুল বাতেনের মতো দেশপ্রেমিক যুদ্ধাদের জন্যে মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর। তাঁরা প্রচণ্ডভাবে হতাশ হলেন। কোথাও কোনো স্বপ্ন নেই আশা-ভরসার চিহ্ন নেই। যার কিংবা যাদের ডাকে পুরোদেশ সুসংগঠিত হয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করল সেখানেও সেই একই সমস্যা। 
আব্দুল বাতেনদের মতো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাস হওয়ার কালের শুরু হলো। তাঁরা প্রচণ্ডভাবে হতাশ হলেন। হাতে কাজ নেই। পড়াশুনা যুদ্ধের কারণে শেষ করা যায়নি। চাকুরি হারিয়ে পথে বসে আছে অনেকে। আপনজনদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধে হারিয়েছেন। ঘর বাড়ি ফাঁকা। লুটতরাজে ঘরের খুঁটি আর উপরের ক/খানা ছাউনি ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নেই। চারদিকে অন্যায়ের পাহাড়, লুটতরাজ, হানাহানি, জোরদখল। পাকিস্তানিরা চলে গেছে। এখন নিজেরা নিজেদের আরও বেশি অন্যায়ভাবে শোষণ নিপীড়ন শুরু করেছে। আব্দুল বাতেন শূন্য ভিটায় ফিরলেন। মা নেই। মা রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন বাঁচবেন বলে। তাঁর বাঁচা হয়নি। এলাকার কুখ্যাত রাজাকার মাকে সেনাদের কাছে ধরিয়ে দেয়। বিচ্ছু আব্দুল বাতেনের প্রতিশোধ বৃদ্ধমায়ের ওপর চলে। বুটের আঘাতে মাকে পিষে মেরে ফেলে সেনারা মনের খায়েশ মিটিয়ে নেয়। বন্দি শিবির থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাঁর প্রতিবেশীর কাছে মায়ের শেষসময়ের বৃতান্ত শুনে আব্দুল বাতেনের মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়। দেশে অন্যায়ের হোলি খেলা চরমে ওঠে। আব্দুল বাতেন এ সময় সইতে না পেরে দেশ ছাড়েন। প্রথমে ইরাক এবং পরে সৌদি আরবে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এক সময়ে দেশে ফিরে আবার আমেরিকায় চলে আসেন। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে বিশেষ কোঠা এবং সন্মানীর রেওয়াজ করেছেন। আব্দুল বাতেন সে তালিকা থেকে তথৈবচ সূত্রে ছিটকে পড়েছেন। তার সহযোদ্ধারাও নামের তালিকায় তাঁকে যুক্ত করার কোনো চেষ্টা করেনি। পরবর্তীতে আব্দুল বাতেন নিজে বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা তদবির করেও নিজের নাম মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে তুলতে ব্যর্থ হন। আব্দুল বাতেন আজও রহস্যজনকভাবে অ- তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়ে গেছেন।

একটা সময় পর তাঁর এমন গল্পগুলো শোনার আমার আর সুযোগ হয় না। আমি চালডালের হিসাব সহজলভ্য করতে জায়গা বদল করি। কিছুদিন পর জানতে পারি, আব্দুল বাতেনও তাঁর ভবঘুরে স্বভাব মতো অন্য ষ্টেট-এ ঠিকানা নিয়েছেন।

তারও কয়েক বছর পরের ঘটনা। অফিসের কাজে টেক্সাসের ডালাসে আসি। কাজের ফাঁকে ঘুরতে আসি বিশেষ এক স্থানে। বসে আছি তার পাশের, এক কফি হাউজে। এ চমৎকার শহরটির কুখ্যাত একটা ইতিহাস আছে। এ শহরে বহুবছর আগে ১৯৬৩, ২২শে নভেম্বর এর মধ্য-দুপুরে আমেরিকার সুদর্শন এবং জনপ্রিয় ৩৫তম প্রেসিডেন্ট, জন এফ কেনেডি-কে হত্যা করা হয়। তারপর থেকে হাজার হাজার মানুষ কেনেডিকে ভালোবেসে এই শহরে ছুটে আসে। কিংবা আমার মতো শহরে কোনো কাজে আসলে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত জায়গাটি ঘুরে যায়। ঘটনার জায়গাটিকে মেমোরিয়াল মিয়জিয়াম করা হয়েছে। নীরবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চোখের পানি ফেলে তাঁর লক্ষ-কোটি অনুরাগী। ঘৃণায় স্মরণ করে ‘লি হ্যারভে ওসঅয়াল্ড-কে। 

আমিও কেনেডি-র একজন ভক্ত অনুরাগী। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে মিউজিয়ামের পাশে কফিশপে উত্তপ্ত কফি নিয়ে উদাস হয়ে বসে আছি। কফিমগের ধোঁয়ার মতো করে আমার মনে তাঁকে নিয়ে জানাশোনার ভাবনাগুলো উড়ে উড়ে ঘুরছে যেন চারপাশে। এসময়ে আব্দুল বাতেন, তাঁর সহজাত-ভঙ্গিতে কফিশপে ঢুকেন। তাঁর চলনবলন স্বতন্ত্র। সাধারণের নজর কাড়ে সহজে। অনেকেই দেখলাম খ্যাপাটে এই প্রৌঢ়ের দিকে ঘুরে তাকিয়ে দেখছে। আমি তাঁর সম্মুখভাগ না দেখেই তাঁকে ঠাহর করতে ভুল করলাম না।   
আমাকে অবাক করে দিয়ে আব্দুল বাতেন কফি হাতে আমার পাশের চেয়ারটাতে এসে বসে পড়লেন। কফিশপের বাইরে বিস্তর খোলা সবুজ মাঠ। আমরা বৃহৎ জানালাধারে বসে আছি। তাঁর উদাস করা দৃষ্টি জানালার ওপাশে, মাঠের পরে। আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে তাঁর দিকে চেয়ে থাকি। বেশ ক’বছর পর আমাদের দেখা। আমাকে তাঁর চিনবার কথা নয়। কিন্তু খুব পরিচিত ভঙ্গিতে আমার পাশে বসলেন, সরাসরি আমার দিকে না তাকিয়ে এবং আলাপের শুরুটা তিনি নিজেই করলেন। আমি হতচকিত হলাম এবং বরাবরের মতো মুগ্ধ। আব্দুল বাতেনরা আমাদের প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করেন তাঁদের কর্মে এবং চিত্ত দিয়ে।
বেশ ক’বছরের জমে থাকা গল্পগুলো দুপক্ষের মাঝে, আমরা বলতে মুখিয়ে আছি। অনেকটা সময় ধরে বসি কফিশপে। আমি তাঁর কথা শুনতে মনোযোগী হই। তাঁকে নিয়ে আমার আগ্রহ বাড়ে বৈ কমেনি। এ শহরে আস্তানা গেঁড়েছেন, তাও বছরখানেক হয়ে গেল। এর আগে কয়েক বছর নিউইয়র্ক ছিলেন। সেখানে তাঁর জীবনে জমা হয়েছে কিছু চরম অভিজ্ঞতা।

আব্দুল বাতেন দীর্ঘ চব্বিশ বছর এদেশে বাস করেও বৈধ কোনো কাগজপত্র যোগাতে পারেননি। অবশ্য সে চেষ্টায় তাঁর আন্তরিকতার বড়ো অভাব ছিল। কারণ স্বপ্ন ছিল দেশে ফিরে যাওয়ার, আজও আকাঙ্ক্ষাটা যে রয়েই গেছে! দেশ এবং দেশের মানুষ নিয়ে তাঁর চোখভরা স্বপ্ন। দেশ তাঁর স্বপ্নের সাথে একদিন মিলেমিশে একাকার হবে। সে তাঁর আপন দেশে ফিরবে। এমন দুস্তর স্বপ্ন- ভাবনা বুকপকেটে নিয়ে আজও দেশের দিকে চেয়ে আছেন আব্দুল বাতেন!
স্ত্রী-সন্তানকে দেশ থেকে নিজের কাছে এনেছিলেন। তাতে প্রচুর খরচা চলে যায়। এরপর সংসারের সাথে তাঁর বনিবনা হয়নি। আব্দুল বাতেনের জন্মসুত্রে চণ্ডরোগ আছে। বাবা ছিলেন চরম মাত্রার একগুঁয়ে লোক। বাবার জেদের বহুগল্প এখনও তাদের অঞ্চলে লোকমুখে শোনা যায়। সেসুত্রে এই দোষটা আব্দুল বাতেনের উপরও রয়ে গেছে। পারিবারিক গোলযোগের কারণও সেটাই ছিল। মোদ্দাকথা,এতবছর পর সংসারে আসলে নিজেকে মেলাতে পারছিলেন না। একবার সংসার ছাড়া হলে, পরবর্তীতে নিজেকে সংসারী করে তোলা আসলে কঠিন বিষয়। সংসারের হারানো আসনে আবার পোক্ত হতে গেলে যে সহ্যধৈর্য লাগে সেটা আব্দুল বাতেনের ছিল না। এক পর্যায়ে স্ত্রী এবং সন্তানদের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জেল জরিমানা হয়। এবং শেষমেশ কোর্ট তাঁকে মানসিক হসপিটালে পাঠিয়ে দেয়। অবশেষে সাইকো সোমাটিক ডিসঅর্ডার “ এর সার্টিফিকেট নিয়ে আব্দুল বাতেন এখন সংসার বিবাগী, ভবঘুরে। একা এক কামরার এক বাসায় বাস করছেন এ শহরে। আমি নিয়মিত তাঁর সাথে যোগাযোগের ইচ্ছা জানালাম। তাঁকে মোটেও আগ্রহী মনে হলো না। কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। মুখে বললেন সে কথা। কিন্তু তাঁর হৃদয় উপচে পড়ছে অভিমানে, চোখজোড়ার দিকে তাকালে স্পষ্ট টের পাওয়া যায়।  

একসময়ে হুট করেই উঠে দাঁড়ায় আব্দুল বাতেন। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মুখে কোনো কথা বলেন না কিন্তু চোখের মাঝে পৃথিবীর হাজার অনিয়মের প্রশ্ন ভেসে ওঠে। আমার সেসব উত্তর জানা নেই। ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি খেলে যায় তাঁর। শিরদাঁড়া সোজা করে ঝোলাকাঁধে বেরিয়ে পড়েন। আমি শূন্যদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকি তাঁর চলে যাওয়া পথের দিকে এবং ভাবনাগুলো শক্তপোক্ত করে কড়া নাড়ে আমার মনের গভীরে… 
আব্দুল বাতেনদের জন্ম আসলে স্বাভাবিক সমাজ ব্যবস্থায় কিংবা সময়ের ফ্রেমে বন্দি থাকতে নয়। এমন মহর্ষিরা মহাকাল ধরে আমাদের চিন্তাধারার অগোচরে সমাজ বদলে দিয়ে যান। আমরা নিজেদের দৈন্যতা ঢাকতে তাঁদের কৌশলে দূরে সরিয়ে রাখি। তথাকথিত গেজেট কিংবা আমাদের মনগড়া ইতিহাসে তাঁদের কোনো চিহ্ন রাখি না। তাঁদের অস্তিত্ব বয়ে বেড়ানোর যোগ্যতা আমাদের নেই। 
ঝোলাকাঁধে ছুটে চলা মানুষটা একসময় দূরে, বহুদূরে আমার দৃষ্টিদিগন্তের বাইরে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়!