একটি সুইসাইট নোট/নাসির আহমেদ কাবুল

চার
মৌরির বয়স ১৮। উচ্ছ্বল তরুণী। ওর ঘন কালো চুল ঘাড় অবধি নেমে গেছে। ভরাট বুক। সুউচ্চ নিতম্ব। চলনে ওর ঝরনার চঞ্চলতা। পার্থর চোখ আটকে যায় মৌরির দিকে। মৌরি পার্থর কাছে গান শেখে দুবছর হতে চলল। প্রথম যখন মৌরি গান শিখতে আসে, তখন অতটা চোখে পড়ার কিছু ছিল না মৌরির মধ্যে। মৌরির প্রতি পার্থর এই আকর্ষণটা যতটা শারীরিক, ততটা ঠিক মনের দিক থেকে নয়। এটা জানে পার্থ। কারণ পার্থর মন আটকে আছে অন্য জায়গায়, অন্য কোনোখানে। যদিও সে স্থান নিষিদ্ধ তার কাছে, পার্থ অন্তত সেটাই মনে করে। কোনোদিনই অতিক্রম করা যাবে না সে নিষেধের বেড়াজাল। বিষয়টি তাই অপ্রকাশিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্থ। মৌরির রূপ-যৌবন পার্থকে টানে, একজন পুরুষ হিসেবে, অন্য কোনো কারণে নয়।
পার্থর ড্রইং রুমে কোনো সোফা বা চেয়ার নেই। কার্পেটের ওপর হারমোনিয়াম, তবলা আর তানপুরা ছাড়াও ওয়ালের পাশে গান শোনার একটি ডেকসেট আছে। ছোট্ট একটি বুকসেলফ আছে। নিজের কিছু পছন্দের বই আছে সেলফটিতে। সেলফের উপর পার্থর একটি সাদাকালো ছবি আছে। ওয়ালে কয়েকটি পেন্টিং আর জলরঙে আঁকা একটি মেয়ের ছবি আছে। ছবিটি অনিন্দিতার। ঘর সাজাবার সময় অনিন্দিতা নিজে লাগিয়ে দিয়েছে ছবিটি।
প্রথম-প্রথম মায়ের সঙ্গে গান শিখতে আসত মৌরি। তারপর একা-একা আসা শুরু করে। ড্রাইভার ওকে পৌঁছে দিয়ে নিচে অপেক্ষা করে। গান শেখা হলে আবার ওকে বাসায় পৌঁছে দেয় ড্রাইভার। একদিন বিকেলে হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল চালাতে-চালাতে মৌরি বলেÑপার্থ দা, একটা কথা বলি?
: তুমি তো কত কথাই বলো। আজ অনুমতি চাইলে যে!
: আজ একটা বিশেষ প্রশ্ন করব।
: করো।
: মাঝে মধ্যে আপনাকে নার্ভাস মনে হয় কেন?
মৌরির কথায় নড়েচড়ে বসে পার্থ। বলে, ‘না তো! নার্ভাস হবো কেন?’
: তাহলে সহজভাবে তাকাতে পারছেন না যে?
: কোথায়?
: আমার দিকে।
: কখন?
: এই তো একটু আগে, যখন দরজা খুলে দিলেন। আপনি আমার দিকে তাকালেন। চোখে চোখ পড়তেই কেমন কুণ্ঠিত হলেন, ফিরিয়ে নিলেন চোখ!
পার্থ হাসতে-হাসতে বলেÑ‘না, তেমন কিছু না।’
হাসে মৌরি। বলে মায়ের সঙ্গে যখন আসি, আপনি খুব সহজে আমার দিকে তাকাতে পারেন। একা এলে পারেন না। তাহলে কাল থেকে না হয় মাকেই সঙ্গে নিয়ে আসব।
পার্থ কিছুই বলছে না দেখে মৌরী নিজে কাছে হার মেনে বলে, ‘ঠিক আছে, একাই আসব!’

পরের দিন আরও বদলে যায় মৌরি। পার্থর সঙ্গে সম্পর্কটা আপনি থেকে হঠাৎ তুমিতে নামিয়ে এনে বলে, ‘তুমি আমাকে সবার ডাকা নামে ডেকো না তো পার্থ দা!’ পার্থর অস্বস্তি হয়। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে না।
পার্থ অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘কী?’
মৌরি বলে, ‘বুঝতে পারলে না তো?’
: না, ঠিক বুঝতে পারিনি। তোমার নাম তো মৌরি। সবাই তোমাকে এই নামেই ডাকে, তাই না? তো আমিও তোমাকে মৌরি বলে ডাকছি।
: না, তুমি আমাকে সবার ডাকা নামে ডাকবে না।
: তাহলে কী নামে ডাকব?
: মা বলে আমি নাকি খুব দুষ্টু, খালামণিও বলে। তবে কেউ কিন্তু দুষ্টু বলে ডাকে না। তুমি আমাকে কখনও দুষ্টু ভাবোনি। তবে দুষ্টু নামে ডাকবে।
: ভালো লাগবে তোমার?
মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় মৌরি।
পার্থ ভাবে, আজকাল মেয়েরা এমনই হয় বুঝি! সহজ-সরল, যা মুখে আসে তাই বলে! হঠাৎ পার্থ বোকার মতো প্রশ্ন করে মৌরিকে, ‘তোমার বয়স কত দুষ্টু?’
মৌরি পার্থর দিকে তীর্যকভাবে তাকায়। তারপর বলে, ‘কেন পার্থ দা? তুমি জানো না মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই?’
: সরি। ভুল হয়েছে।
: সরি কেন? আচ্ছা তুমি গেজ করো তো, কত হতে পারে আমার বয়স?
পার্থ আপদমস্তক তাকায় মৌরির দিকে। গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়ে পার্থর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়।
: কী দেখছ অমন করে? বলো না আমার বয়স কত হতে পারে।
ঘোর কেটে গেলে লজ্জিত পার্থ বলে, ঠিক বুঝতে পারছি না!
: আচ্ছা বলতে হবে না। একটি কথা জিজ্ঞেস করব?
: কী?
: তুমি ফুল ভালোবাসো তো?
: খুউব।
: আমি বলব তুমি কোন ফুল বেশি ভালোবাসো?
: বলতে পারবে?
: চেষ্টা করি? বলতে পারলে কী দেবে?
: কী চাও?
: যা চাই, তাই দেবে তো?
: হুঁ।
: কথা দিলে কিন্তু!
: কথা দিলাম।
মৌরি হঠাৎ পার্থর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘এই আমাকে ছুঁয়ে বলো, যা চাই তাই দেবে তুমি?’
কুণ্ঠিত পার্থ মৌরির দিকে তাকায়। ওর দৃষ্টির সামনে স্থির থাকতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে, ‘কীসব পাগলামি করছ দুষ্টু? রেওয়াজে মন দাও। এখন পূরবীর সময়। এসো শিখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।’
: ওঃ তাহলে দিতে চাও না তুমি?
: বললাম তো দেবো।
: তাহলে আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও। না হলে এক্ষুণি চলে যাবো আমি। আর কোনদিন তোমার কাছে আসব না।
পার্থ ভাবে, এই পাগলীটাকে থামানো দরকার। আস্তে করে মৌরির হাতের ওপর হাত রেখে বলে, ‘কথা দিলাম, হলো তো?’
: তাহলে এবার বলি? মিলে গেলে সত্যি বলবে কিন্তু।
: আচ্ছা বলো।
মৌরি একটু ভেবে বলে, বেলি তোমার খুব প্রিয় ফুল।
পার্থ অবাক হয়। মৌরি ফিক করে হেসে বলে, কী ঠিক হয়েছে তো?
: হুঁ হয়েছে। কী করে বললে?
: খুব সহজ।
: যেমন?
: তোমার জানালার পর্দা সাদা রঙের, বিছানার চাদর তাও। তোমার প্রায় সবগুলো পোশাকই সাদা রঙ। আর তুমি ঘরে যে এয়ারফ্রেশনার ব্যবহার করো, সেটা তো বেলি ফুলের গন্ধ, তাই না?
: তুমি এগুলো দেখে বললে?
: শুধু এগুলো নয়। আরও কিছু বিষয় আছে।
: কী?
: সেসব আজ আর বলব না। আরেকদিন। আচ্ছা বলো তো, আমি কী ফুল পছন্দ করি?
: বলতে পারব না।
: কেন পারবে না?
: তাও জানি না।
: তুমি সত্যিই বোকা! কেন তুমি এত বোকা, কিছু বোঝো না কেন?
: দুষ্টু, পাগলামি করো না তো! একটু রেয়াজ করো। আজ তো সারাক্ষণ কথাই বললে!
কথা বলতে ইচ্ছে করলে কি থামিয়ে রাখা যায়? তুমি পারো?
: না পারি না।
: শোনো, প্রায় সব মেয়েই গোলাপ পছন্দ করে। বলতে পারো শতকরা নিরানব্বই জন। আমিও।
: আচ্ছা এখন বলো তুমি কী চাও। আমি তোমাকে দিতে পারব। কথা দিয়েছি তোমাকে।
: পারবে না পার্থ দা। আমি বলছি তুমি দিতে পারবে না।
: পারব তো! তুমি বলো।
: তাহলে আজ নয়। এখনও চাওয়ার সময় হয়নি। হলে তোমাকে জানাব আমি। তখন কিন্তু না করতে পারবে না।
: আচ্ছা।
: আচ্ছা পার্থ দা। তুমি কি তোমার পছন্দের ফুলের সঙ্গে কথা বলেছ কখনও?
: হয়ত বলেছি।
: ফুলের কাছে জানতে চেয়েছ বয়স কত?
হঠাৎ পার্থ হো-হো করে হেসে উঠে বলে, ফুলের আবার বয়স! কী যে বলো তুমি!
: কেন ফুলের বয়স হবে না? কলি থেকে ফুল হয়ে ফোটা পর্যন্ত প্রতিটি ফুলেরই তো আলাদা-আলাদা সময় থাকে। মেয়েদের যেমন কৈশোর থেকে যৌবন। ফুটন্ত ফুলের সঙ্গে তরুণীদের তুলনা করা যায় না? তাহলে তুমি তোমার প্রিয় বেলির এই দিকটা জানতে চাইলে না কেন? আচ্ছা, তোমার দৃষ্টিতে শুধু বেলিই সুন্দর। আমি সুন্দর নই?
লজ্জিত হয় পার্থ। ভাবে কীসব বলছে মেয়েটি! কেন এসব বলছে, মেলাতে পারে না কিছুতে।
: কী বলছ না কেন? আমি সুন্দর না?
: তুমি? খুউব সুন্দর।
: ফুলের মতো?
: হুঁ। ফুলের মতো।
: ফুল সুন্দর। তুমি ওর রূপ দেখে মুগ্ধ। তুমি তো ওকে বয়স জিজ্ঞেস করছ না। তুমি তো আমাকে দেখে মুগ্ধ নও, তাহলে আমার বয়স জিজ্ঞেস করছ কেন? কী দরকার আমার বয়স জেনে?
: সরি।
: ছিঃ পার্থ দা। তুমি সরি বলবে না আমাকে, কোনদিনই না! তোমার কোনো সরি আমি গ্রহণ করব না। তুমি সরি বলার মতো কোন কাজ করতেই পারো না।
: আচ্ছা বলব না।
আমার বয়স সতের বছর তিনশ’ চৌষট্টি দিন। কাল আমি আঠারোতে পরব।
: হেপি বার্থডে টু ইউ…।
: মৌরি হাসতে-হাসতে বলে, আজই জানালে?
পার্থ বলে, ‘কাল তো তোমার আসার কথা নয়। কাল রোববার। কোনো রোববারই তুমি আসো না।’
: কাল আসব পার্থ দা। গান শিখতে নয়, তোমার মুখ থেকে বার্থডে উইশ শোনার জন্য।
পার্থ কিছু বলতে পারে না। মৌরির ঠোঁটের দিকে তাকায়। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে দেয়ালে অনিন্দিতার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে পার্থ।
মৌরিও ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আজ একটা কথা জিজ্ঞেস করব? অনেক দিন করব-করব ভেবেও করা হয়নি। যদি কিছু মনে করো, তাই।’
: কী কথা?
: ওয়ালে ওই মেয়েটি কে?
: তুমি চেনো না ওকে?
: না।
: ও অনিন্দিতা। আমার মামাতো বোন।
: তুমি কিন্তু ঘন-ঘন তাকাও ছবিটির দিকে।
: তুমি লক্ষ্য করেছ?
হ্যাঁ করেছি তো। আচ্ছা তোমার পরিচিত কারও সাথে মিল খুঁজে পাও বুঝি?
পার্থ কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। তারপর ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘না, কারো সাথে ওর কোনও মিল খুঁজে পাই না আমি। ও সবার থেকে আলাদা।’
: তাই বুঝি?
: পার্থ মাথা নাড়ায়।
: এখন তাহলে যাই।
: গান শিখবে না আজ?
: না।
: কেন?
: আজ আমার মন ভালো নেই।
মৌরি আর দাঁড়ায় না, দরজা খুলে বের হয়ে যেতে যেতে বলে, কাল সকাল সকাল আসব কিন্তু…

কবি আঞ্জুমান আরা খান

সকল পোস্ট : আঞ্জুমান আরা খান