একটি সুইসাইড নোট/ নাসির আহমেদ কাবুল

ধারাবাহিক উপন্যাস (দ্বিতীয় পর্ব)

অনিন্দিতাকে কেউ-কেউ বনলতা সেন বলে খেপায়। সত্যিই ওর চোখ দুটি বড় অদ্ভুত। যেন মেঘনায় জেগে ওঠা চর, যেন পাখির বাসা বা পদ্ম পাতায় একফোঁটা শিশির বিন্দু। অনিন্দিতার দুই ঠোঁটে সব সময় হাসি লেগে থাকলেও বয়সের তুলনায় খুব রাশভারী সে। একটুতেই রেগে যায়। আর একবার রেগে গেলে রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। খাবে না, কারও সাথে কথা বলবে না। তারপর আবার নিজে-নিজেই রাগ ভেঙে মাকে গিয়ে বলবেÑখাবার দাও, ক্ষিধে পেয়েছে খুব।
অনিন্দিতাকে অনেকেই অহংকারী ও জেদি বলে জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। কত আর বয়স হবে—বিশ চলছে। অনেক ছেলেরা অনিন্দিতার পিছনে ছোটে, কিন্তু কেউ ওর নাগাল পায় না। ক্যাম্পাসে ঢুকলে হাজারটা চোখ ওকে গিলে খায়। কোনো-কোনো ছেলে আবার শিষ দেয়। অনিন্দিতা সেদিকে একদম খেয়াল করে না। আপন মনে হেলেদুলে চলে যায় নিজের কাজে।

ফুপু চলে গেলে পার্থ অনিন্দিতায় রুমে যায়। পার্থকে দেখে মুখ আরও বেশি ভার করে বসে থাকে। পার্থ রুমে ঢুকেছে দেখেও না দেখার ভাণ করে সে।
পার্থ জিজ্ঞেস করে, ‘তুই আমার ওপর রেগে আছিস নিন্দিতা?’
পার্থর কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে অনিন্দিতা। বলে, ‘তোমাকে না হাজারবার বলেছি, ‘নিন্দিতা-নিন্দিতা করবে না আমাকে! তুমি জানো না নিন্দিতার অর্থ কী?’
পার্থ হাসতে-হাসতে বলে, ‘জানব না কেন? জেনেশুনেই তো তোকে খ্যাপাই।’

  • কেন, খ্যাপাবে কেন? কী সুখ পাও তুমি?
  • তুই রাগ করেছিস?
  • না করিনি। তুমি এখন যাও।
  • কোথায় যাবো?
  • তা আমি কী জানি? তোমার মৌরির কাছে যাও। ও তোমার ইয়ার্কি ভালো বুঝবে, আমি ওসব পছন্দ করি না।
    একটু থেমে অনিন্দিতা আবার বলে, কিছু বলবে?
    পার্থ কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে অনিন্দিতার দিকে। অনিন্দিতা আবার তাড়া দিয়ে বলে, কী ভাবছ? কিছু বলতে এসেছ?
    : না।
    : তাহলে?
    : ফুপু বাসায় নেই, কলাবাগান গেছে। জানো?
    : জানি। ছোট খালার বাসায়। খালু নাকি খুব অসুস্থ। অফিসে সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলেন।
    : তারপর?
    : তারপর আর কি! কলিগরা ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে এখন বাসায়।
    : কবে এমন হলো? আমি তো কিছুই জানি না।
    অনিন্দিতা বলে, আচ্ছা তুমি কি এসবের মধ্যে থাকো কখনও? কী করে জানবে?
    : ফুপু কি গাড়ি নিয়ে গেছেন? কখন আসবেন, জানিস কিছু?
    : হ্যাঁ, গাড়ি নিয়েই গেছেন। বলে গেলেন ফিরতে দেরি হবে।
    : কত দেরি?
    : তা আমি কী করে জানব! ফোন করে জেনে নাও।
    : দরকার নেই। আচ্ছা তুই পড়। আমি আসছি।
    পার্থ চলে যেতে চাইলে অনিন্দিতা বাধা দেয়। ‘তুমি কি কিছু বলতে এসেছ?’
    পার্থ পা বাড়াতে-বাড়াতে বলে, ‘না কিছু বলতে আসিনি।’
    : ওহ!
    : কী?
    : কী আর? আচ্ছা, কাউকে তোমার কিছু বলার থাকে না?
    : না।
    : আমাকেও না?
    পার্থ আবারও দরজায় দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে অনিন্দিতা বাধা দেয়। আমাকে বলার থাকবে কেন? সব বলা তো ওই…
    পার্থ চমকে যায়। তুই খেপে আছিস কেন? আমি কিছু বলতে আসিনি!
    : তুমি কি কিছুই বুঝতে চাও না?
    পার্থ কোনো উত্তর দেয় না অনিন্দিতার কথার। পকেট থেকে মানিব্যাগ হাতে নিতে-নিতে বলে, ব্যাগটা খালি হয়ে গেছে। ফুপু বাসায় থাকবে না বুঝতে পারিনি।
    : তোমার টাকার দরকার বুঝি?
    : হুঁ।
    : সিগারেট শেষ হয়ে গেছে?
    : কী করে বুঝলি?
    : না বোঝার কী আছে? আমি ছাড়া কে আর তোমাকে বুঝবে, মৌরি? বখাটে মেয়ে একটা! ও তোমাকে কোনোদিনই বুঝবে না।
    : তুই বুঝলেই চলবে। ওর বোঝার দরকার নেই।
    : সত্যি বলছ?
    : হুঁ।
    খুশি হয় অনিন্দিতা।
    : একটা কথা বলব?
    : বল।
    : আমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে? দূরে কোথাও?
    : না, তা হয় না!
    : কেন হয় না?
    : তুই আমার বোন।
    : অন্য কেউ হলে যেতে?
    : জানি না! তাছাড়া ফুপু কী ভাববে?
    : কিছু ভাববে না। আমি মাকে ম্যানেজ করব।
    : আচ্ছা সে পরে হবে। টাকা থাকলে দে তো? ফেরত দিয়ে দেবো।
    অনিন্দিতা হেসে বলেÑকী বললে, ফেরত দেবে?
    : হ্যাঁ, কেন দেবো না? ঋণী থাকব কেন?
    : তাহলে সব ঋণ শোধ করে দেবে তুমি?
    : হুঁ।
    : কত ঋণ শোধ করবে তুমি?
    : কী বললি?
    অনিন্দিতা পার্স থেকে হাজার টাকার একটা নোট বের করতে-করতে বলে, এই নাও টাকা। খবরদার ফেরত দিতে এসো না কখনও। তাহলে কিন্তু লঙ্কাকাÐ ঘটিয়ে ফেলব সেদিন।
    পার্থ কিছুই বুঝতে পারে না। টাকা নিয়ে মানিব্যাগে ভরতে-ভরতে বলে, আচ্ছা তুই যখন চাচ্ছিস না, ফেরত দেবো না।
    অনিন্দিতা বলে, সত্যি তুমি একটা স্টুপিড! হোপলেস!
    পার্থ ঘর থেকে বের হয়ে যায়, অনিন্দিতার কোনো কথা শুনতে পায় না সে। শুনলেও কথার গূঢ় কোনো রহস্য খুঁজতে চায় না সে। এটাই পার্থর স্বভাব।
    পার্থ দরজা খুলে বের হয়ে লিফটের কাছে যেতেই অনিন্দিতা পার্থর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ‘চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাই।’
    পার্থ অবাক হয় বলে—‘কোথায় যাবি তুই?’
    : তুমি যেখানে যাও, সেখানে।
    : আমি তো সিগারেট কিনতে টং-দোকানে যাবো—রাস্তার ওপারে।
    : আমিও যাবো তোমার সঙ্গে—চা খাবো; আর তুমি সিগারেট খাবে।
    পার্থ হাসতে-হাসতে বলে, ‘বাইরে গিয়ে চা খাবি তুই?’
    : হুঁ, খাবো।
    : ওখানে তো ভ্যাগাবন্ডরা খায়। রিকশাওয়ালারা খায়।
    : তুমি খাও না?
    : আমি তো ভ্যাগাবন্ডদের দলে।
    দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পার্থ।
    : কী!
    : সতিই তো বললাম। আমার কে আছে বল? জন্মের সময় মা মারা গেলেন। বাবা আরেকটা বিয়ে করলেন। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছি। গান গেয়ে, নাটক করে বেড়াই। আমি তো ভবঘুরেই। আর তুই হলি…
    : কী?
    : রাজদুলালী। মায়ের বিশাল ব্যবসা। চমৎকার এপার্টমেন্ট, গাড়িতে চড়িস।
    : তুমি কেন গাড়ি পছন্দ করো না? মা তো বার-বার বলছে গাড়ি কিনে দেয়ার কথা। তুমি কেন নিচ্ছ না?
    : ওসবে আমার মানায় না যে!
    : কেন?
    : আমার কী আছে বল? ওসব গাড়িতে কি আমাকে মানায়?
    : মাকে এ কথা বলব?
    : না, বলিস না।
    : কেন?
    : ফুপু কষ্ট পাবেন।
    : আমি বুঝি কষ্ট পাই না?
    পার্থ সে কথার উত্তর না দিয়ে লিফটের বোতাম টেপে। ঘড়িতে সময় দেখে।
    অনিন্দিতা ওড়না ঠিক করতে-করতে বলে, তুমি কিন্তু খুব সেকেলে।
    : সেকেলে?
    : হুঁ।
    : কেন?
    : কেন আবার! আজকাল কেউ ঘড়ি পরে? মোবাইলেই তো সময় দেখা যায়।
    : বোকা!
    : কে?
    : তুই?
    : আর মৌরি বুঝি খুব বুদ্ধিমতী!
    : ধ্যাত!
    লিফটে উঠতে-উঠতে অনিন্দিতা বলে, ‘এই, ধ্যাত মানে কী? ওই শব্দটা ডিকশনারিতে আছে নাকি? কী অর্থ শব্দটির? তোমার মুদ্রা দোষ এই ধ্যাত। আমার ভালো লাগে না। বার-বার বলবে না কিন্তু!
    পার্থ সুবোধ বালকের মতো সম্মতি জানিয়ে বলে ‘আচ্ছা।’ অনিন্দিতা হাসে। হাসতে-হাসতে বলে, ‘মনে থাকে যেন!’
    ছয়জনের ছোট লিফট। দুজন উঠলেই গায়ে-গায়ে লেগে যায়। পার্থ সংকুচিত হয়ে কিছুটা সরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুই বার-বার ওকে টেনে আনিস কেন?’
    : ও এসে দাঁড়ায় কেন?
    : মানে?
    : তোমার-আমার মধ্যে ওকে সহ্য হয় না আমার।
    : তুই একটা পাগলী!
    : কেন?
    : ও আমার ছাত্রী। আর…
    : আর কি?
    : তুই আমার বোন। তোর সাথে ওর তুলনা কেন হবে?
    : ওহঃ।

লিফট এসে নিচ তলায় থামলে দুজন হাঁটতে-হাঁটতে গেটের বাইরে বেরিয়ে আসে।
রাস্তার ওপারেই ছোট একটি চায়ের দোকান। দু-একটি ছেলে সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে দেখে পার্থ বলে, ‘তুই এখানে দাঁড়া, আমি চা ও সিগারেট নিয়ে আসছি।’
: তুমি আনবা মানে কি? আমি যাবো না?
: না।
: কেন?
: ওই দেখ, কয়েকটা ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
: সো হোয়াট?
: ওরা তোকে বিরক্ত করতে পারে।
: করুক না! নাও তো করতে পারে।
অনিন্দিতা পার্থর হাত ধরে টেনে রাস্তার ও-পারে চায়ের দোকানে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে দুটি ছেলে সিগারেট টানছিল। পার্থকে দেখে ছেলে দুটি সিগারেট লুকায়। দাঁড়িয়ে বলে, ‘আপনারা এখানে বসতে পারেন, আমরা না হয় চলে যাচ্ছি।’
পার্থ বাধা দিয়ে বলে, ‘না-না তোমরা যাবে কেন? বসো তোমরা। আমরা এখনই চলে যাচ্ছি।’
তারপরও ছেলেরা দোকানদারের পাওনা মিটিয়ে চলে গেলে অনিন্দিতা বলে, ‘তুমি তো ওদেরকে খারাপ ছেলেদের দলে ফেলে দিয়েছিলে। সবাই যে এক নয়, তুমি কিন্তু একদম বুঝতেই চাও না।’
রাস্তা পার হওয়ার সময় অনিন্দিতা পার্থর ডান হাত ধরে সাবধানের জেব্রা ক্রসিংয়ে পা রাখতে-রাখতে বলে, ‘তোমার সঙ্গে একদিন বেড়াতে যাবো। নিয়ে যাবে আমাকে?’
পার্থ বলে, হ্যাঁ। কিন্তু অনিন্দিতার কী কথায় ‘হ্যাঁ, বলেছে নিজেও হয়ত জানে না পার্থ। তবে অনিন্দিতা খুশি হয়ে বলে, ‘থ্যাংকু’।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়