একটি সুইসাইড নোট। নাসির আহমেদ কাবুল

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পর্ব -আট ।।
গাড়িতে বসে মৌরির আর যেন তর সইছিল না। বার-বার সে পার্থকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল আর কতটা দূর পার্থ দা?
পার্থ এই তো এসে গেছি বলে সান্তনা দিচ্ছিল। দেখতে দেখতে এক সময় ওরা দুজন চলে এলো ‘ছিন্নমুকুল এতিম নিবাসে’। বিশাল এলাকা উচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটে কয়েকজন আনসার সদস্য। পার্থকে দেখে ওরা বলল, ‘স্যার আপনার কথা বলে রেখেছেন। ভিতরে যেতে পারেন আপনারা। ড্রইং রুমে অপেক্ষা করতে বলেছেন। স্যার এখন বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসবেন।’
গেট থেকে ঢুকতেই বিশাল একটি ফুলের বাগান। বাগানের মধ্যে কয়েকটি স্ট্যাচু। প্রতিটি স্ট্যাচু মা ও সন্তানকে নিয়ে গড়া। কোনটাতে মা তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন। কোনোটিতে আবার সন্তান মাকে ধরে চুমু খাচ্ছে। বাগানের পাশেই একটি দীঘি। পদ্মদীঘি বলা যায়। দীঘির একটা অংশে প্রচুর পদ্ম ফুটে আছে। যেন মৌমাছি আর প্রজাপতিদের হাট বসেছে সেখানে। কয়েকটি ভোমরা গুন-গুন করছে ফুলের চারপাশে। মৌরি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
সান বাঁধানো ঘাটের স্বচ্ছ জলে নেমে দুই হাত দিয়ে পানির স্পর্শ নিতে-নিতে মৌরি বলে, ‘পার্থদা আমি এখানেই থাকব।’
পার্থ হা-হা করে হাসতে-হাসতে বলে, সত্যি থাকবে? স্যারকে বলবো?
মৌরি বলে, তোমাকে বলতে হবে না।
: তাহলে?
: কেন বাবাকে আমিই বলব।
: তোমাকে যদি চিনতে না পারেন স্যার।
: বললেই হলো? চিনতে পারবে না মানে? দেখে নিয়ো তুমি কী করি আমি বাবার।
আরিফ হাসানের থাকার জায়গা ছোট্ট একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। লাল সিরামিক ইটের। নিচ তলায় বিশাল ড্রইং রুম। ড্রইং রুমের দেয়াল আরিফ হাসানের আঁকা চিত্রকর্ম দিয়ে সাজানো। মৌরি ঘুরে-ঘুরে দেখতে থাকে বিচিত্র রঙের আর্ট। হঠাৎ একটি পেইন্টিংয়ের সামনে গিয়ে থমকে যায় মৌরি। অ্যাক্রিলিকে আঁকা নুশরাত নাহিদের কম বয়সের একটি চিত্র। শাড়ি পরা। হাতে একটি লাল গোলাপ।
পার্থ কতদিন এসেছে এখানে, অথচ এই ছবিটির দিকে কখনও খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে হয়ত বুঝতে পারত যে ছবিটি মৌরির মায়ের। পার্থ সোফায় বসা ছিল। মৌরি তাকে অস্থির হয়ে ডেকে বলে, ‘এই দেখে যাও পার্থ দা, মায়ের ছবি!’
পার্থ সোফা ছেড়ে মৌরির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আরিফ হাসান রুমে ঢুকে দুজনকে দেখে বলে, ‘তোমরা এসে গেছ? পার্থ, কই দেখি তোমার বন্ধু। তুমি তো এতদিন বলোনি তোমার বন্ধু আছে!
আরিফ হাসানকে দেখে মৌরির চোখ ফেরে না কিছুতে। কি সুন্দর সৌম্য মূর্তি তার বাবার! কিছু বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে মৌরি। কত কথা মনে-মনে ঠিক করে রেখেছিল বাবার সাথে দেখা হলে বলবে। অথচ এই মুহূর্তে সেসব কথা একেবারেই মন থেকে হারিয়ে গেছে।
আরিফ হাসান মৌরির দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে বলেন, কেমন আছ মা তুমি? কী নাম তোমার?
মৌরি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে, ‘তুমি আমার মায়ের ছবি এঁকেছ কেন?’
আরিফ হাসান বলেন, ‘এটা তোমার মায়ের মতো দেখতে বুঝি?’
: দেখতে হবে কেন? এটা তো আমার মা-ই।
: বোকা মেয়ে! মানুষ দেখতে মানুষের মতো হয়। তুমি কি জানো পৃথিবীতে একই রকম দুজন মানুষ আছে। আমাদের সৃষ্টিকর্তা জোড়ায়-জোড়ায় যে সৃষ্টির কথা বলেছেন, বিজ্ঞানও সেই একই কথা বলে।
: সে জানি। কিন্তু এটা আমার মা। তুমি মাকে এঁকেছ। তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?
: না তো!
: আচ্ছা দাঁড়াও। আমি মাকে ফোন করছি। মা-ই বলবে এ ছবি কার।
আরিফ হাসান মিট-মিট করে হাসছেন। তিনি মনে করেছেন হয়ত এ ছবিটির সাথে ওর মায়ের কোনো মিল আছে। পার্থ নীরব দাঁড়িয়ে আছে। কোনো পক্ষে কোনো কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকটা নিথর হয়ে গেছে সে।
মৌরি ওর মাকে ফোন করে। ওপাশ থেকে ফোন ধরলে মৌরি ঝর-ঝর করে কাঁদকে-কাঁদতে বলে, ‘মা, বাবা আমাকে চিনতে পারছেন না! কিছুতেই না। অথচ সে তোমার স্কেচ এঁকে রেখেছেন। এই নাও তুমি বাবার সাথে কথা বলো।’
মৌরি ফোন সেট আরিফ হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। আরিফ হাসান কী করবেন বুঝে উঠতে না পেরে পার্থর দিকে তাকায়। পার্থ বলে, ‘স্যার মৌরি মিথ্যা কিছু বলছে না। আপনি ওর মায়ের সাথে কথা বলুন প্লিজ।’
মৌরি কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘কেনো বিশ্বাস করতে পারছ না তুমি আমার বাবা আর আমি তোমার মেয়ে। মাকে জিজ্ঞেস করো, আমি তোমার মেয়ে কি না।’
আরিফ হাসান মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফোন সেট কানের কাছে রেখে হ্যালো বলতেই থর থর-করে কাঁপতে থাকেন তিনি। ফোন রেখে মৌরিকে জড়িয়ে ধরে বলেন, হ্যাঁ মা, চিনতে পারছি তোকে।’
মেয়ে ও বাবার এ মিলন দৃশ্য দেখে পার্থর দুই চোখে আর্দ্র হয়ে ওঠে। সারাদিন এখানে-ওখানে ঘোরাফিরা করে সন্ধ্যায় ফিরে যাবার সময় মৌরি বলে, ‘কালই কিন্তু মাকে নিয়ে আসছি তোমার কাছে।’
আরিফ হাসান বলেন, ‘আসবি? সত্যি তোর মাকে নিয়ে আসতে পারবি তো মা?’
: পারব না মানে? মা আমার কোনো কথা ফেলেন না।
: আমিও তোর কোনো কথা ফেলব না। সব কথা শুনব তোর।
: কথা দিলে কিন্তু।
: হ্যাঁ মা, কথা দিলাম।
আরিফ হাসান নিজের গাড়ি দিলেন ওদেরকে পৌঁছে দেয়ার জন্য। যতক্ষণ গাড়ি দৃষ্টির আড়ালে চলে না যায় ততক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি। আরিফ হাসানের দুই চোখ ভিজে গেলো, কষ্টে না আনন্দে, সে খবর আরিফ হাসান নিজেও জানেন না।

চলবে