একটি সুইসাইড নোট/নাসির আহমেদ কাবুল

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পর্ব- দশ

মৌরি পরের দিন আসবে বললেও গত সাতদিনে আসেনি একবারও। গত দুবছরে মৌরি গানের ক্লাস কখনও মিস করেনি। হঠাৎ কী হলো মৌরির ভাবতে-ভাবতে দিশেহারা হয় পার্থ। ভাবে কাল একবার যাবে মৌরিদের বাসায়। কখনও যায়নি সে। হঠাৎ যাওয়াটা কি ঠিক হবে, নাকি আরো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করবেÑসিদ্ধান্ত নিতে পারে না পার্থ।
শ্রাবণের পড়ন্ত বিকেলে ছাদের এক কোণে রেলিংয়ে হেলাল দিয়ে দাঁড়িয়েছিল পার্থ। মন খারাপ হলে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সে আকাশ দেখে। আজও সে আকাশ দেখতে-দেখতে হারিয়ে গিয়েছিল দূরে কোথাও। হঠাৎ পিছন দিক থেকে অনিন্দিতা এসে পাশে দাঁড়ায়।
পার্থ অনিন্দিতাকে দেখে চমকে উঠে বলে, ‘তুই কেন এলি? আমার কাছে আসতে ফুপু তো তোকে নিষেধ করেছে।
: কে বলেছে তোমাকে?
: ফুপু এসে আমাকেও বলে গেছে।
: ওহ! তাহলে সে কাজটিও করেছে মা! কী বলেছে তোমাকে?
পার্থ অনিন্দিতার হাত ধরে বলে, থাক না ওসব। তুই শুধু চলে যা। ফুপু দেখলে আবার রাগ করবেন।
: যাবো না। কিছুতেই যাবো না। আগে বলো কী বলেছে মা তোমাকে।
: আচ্ছা বলছি। তবে ফুপুকে বলিস না যেন। তাহলে আবার আমার ওপর রাগ করবেন।
: আগে বলো, কী বলেছে মা।
: বলেছে তোর সাথে যেন আর না মিশি, যেন কথা না বলি। আর…
: আর কী?
: আগামী মাসে অন্য কোথাও চলে যাই।
: কী! মা তোমাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে?
হঠাৎ মিসেস রহমান ছাদে উঠে অনিন্দিতা ও পার্থকে দেখতে পেয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, ‘অনিন্দিতা, তোমাকে না বলেছি পার্থর সঙ্গে মিশবে না তুমি। আর পার্থ তোমার এতো সাহস হয় কী করে যে, তুমি আমার কথার অবাধ্য হও।
অনিন্দিতা বলে, মা তুমি পার্থকে এ বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছ?
: হ্যাঁ বলেছি।
: কেন বলেছ?
: সে কৈফিয়ত আমি তোমাকে দেব না অনিন্দিতা।
: দিতে হবে মা। তুমি মনে করেছ আমি কিছু জানি না। এ বাড়ির মালিক তুমি নও। এ বাড়ির মালিক পার্থ। যখন বাবা মারা গেলেন, ঋণের দায়ে নিলামে উঠেছিল এই বাড়ি। পার্থর বাবা তখন নিলাম থেকে কিনে এ বাড়ি তোমার নামে এনে দিয়েছিলেন। আর আজ তুমি তার ছেলেকে তারই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছ? তুমি কী মা! তোমাকে মা বলে পরিচয় দিতেও আমার ঘেন্না হয়।
: অনিন্দিতা!
: কাকে চোখ রাঙাচ্ছ তুমি? আমি এখন বড় হয়েছি। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারি। সেটাই আইনসিদ্ধ। আজ আমি যদি পার্থকে বিয়ে করি, তুমি ঠেকাতে পারবে না। আজ পার্থ চাইলে তোমাকে ও আমাকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারেন। আমি দেখেছি মামার দলিল। পার্থ আঠারো বছর বয়স হলে তাকে এ বাড়ি ফিরিয়ে দেয়ার কথা আছে দলিলে। অথচ তুমি বেইমানী করেছ পার্থর সঙ্গে।
পার্থ মাথা নিচু করে বলে, ফুপু তুমি ওর কথায় কিছু মনে করো না। এসব কিছুই জানি না আমি। জানতেও চাই না। জন্মের সময় মাকে হারানোর পর তোমাকেই মা বলে জেনেছি। তুমি আমাকে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছ, আমি আজই চলে যাচ্ছি। আর কোনদিন তোমার সামনে এসে দাঁড়াব না, কথা দিলাম।
: শোনো মা, আমি পার্থকে বিয়ে করে এ বাড়িতেই থাকতে পারি, তুমি কিছুই করতে পারবে না। তবে আমি তা করব না। পাড়া-প্রতিবেশীরা এতোদিন আমাদের ভাইবোন জেনে এসেছে, আজ তারা অন্য কিছু জানুক, এটা পার্থও চায় না, আমিও চাই না। তাই তোমার প্রতিশোধটা নিতে পারলাম না। একটা কথা মনে রেখো মা, পার্থ যেদিন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, সেদিনই হবে আমার এ বাড়িতে শেষ দিন। তুমি তখন এ বাড়িতে একাই থাকবে।
: কোথায় যাবি তুই, আমিও দেখে নেবো।
: হাসালে মা। তোমার দেখে নেয়ার কোনো ক্ষমতার মধ্যে আমি থাকব না। চিরতরেই হারাবে তুমি আমাকে।

সেদিন অনিন্দিতা পার্থকে সাথে নিয়ে মৌরিদের বাড়ি যায়। মৌরির মায়ের সাথে দেখা করে পার্থ ও মৌরির সম্পর্কের সব কথা খুলে বলে। অনিন্দিতা পার্থকে মনে মনে ভালোবাসতো সে কথাও জানিয়ে মৌরিকে বলে, তোমাকে এতোদিন মনে মনে খুব হিংসে করতাম আমি। তোমাকে নিয়ে হাজারবার খোটা দিয়েছি পার্থকে। আজ তুমি আমার ছোট বোনের জায়গাটা দখল করে নিলে। আমি আমার পার্থকে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। তোমাকে একটা অনুরোধ করব, ওকে কোনদিন এতটুকু কষ্ট দিও না।
অনিন্দিতা আর সেখানে দাঁড়ায়নি। দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। রাত তখন এগারোটা।
তার পরের দিন সকালে পার্থর সবকিছুÑ হারমোনিয়াম, তানপুর, বইপত্র, কাপড়চোপড় মৌরির বাসা অবধি পৌঁছে দিয়ে অনিন্দিতা বলেছিল, ‘আর কোনোদিন তুমি মায়ের সামনে যাবে না।’
তারপর আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিল, এটাই যদি আমাদের শেষ দেখা হয়, তাহলে ক্ষমা করে দিয়ো তুমি। তারপর আর দাঁড়ায়নি অনিন্দিতা; যাওয়ার সময় চোখ মুছতে-মুছতে দু-তিনবার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল। তারপর প্রায় তিন মাস কেটে গেছে, অনিন্দিতা আর কখনও পার্থর কাছে আসেনি। পার্থর ফোনও রিসিভ করেনি। একবার শুধু মৌরিকে ফোন করে বলেছিল, যেদিন তোমাদের বিয়ে হবে, সেদিন আমাকে একবার ফোন করো।
মৌরি বলেছিল, পার্থ ও আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার বিয়ের আগে আমরা কখনও বিয়ে করতে পারবো না। অনিন্দিতা সে কথা শোনার পর ফোন কেটে দিয়ে সেট সাইলেন্ট করে রেখেছিল।