একটি সুইসাইড নোট/নাসির আহমেদ কাবুল

শেষ পর্ব ।।

প্রিয় পার্থ, তোমার কাছে এটাই আমার শেষ চিঠি। আর কোনোদিন তোমাকে কিছু বলার সময় বা সুযোগ হবে না আমার। একদিন যে পৃথিবীতে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতাম, মাত্র চব্বিশ বছরে সেই স্বপ্ন ধূলিস্যাত হয়ে গেছে আমার। জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি আমি। আমার মনে হচ্ছে, পার্থিব এই জীবনের দুঃখ-কষ্ট-জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। এখন আর এই পৃথিবীর দূষিত আলো-বাতাসে বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। তুমি ছাড়া আর কাউকেই ছেড়ে যাওয়ার কোনো কষ্ট নেই আমার। আমার জন্য কষ্ট পেয়ো না। আমার জন্য আশীর্বাদ করো, যেন ওপাড়ে ভালো থাকি আমি। তুমি যদি মৌরিকে বিয়ে করে সুখি হতে পারো, তাহলে আমি ওপাড়ে ভালো থাকব। তোমরা যদি অসুখি হও, তাহলে আমার কষ্টের সীমা থাকবে না। প্রিয়জনের সুখী দেখার মতো আর কোনো সুখ আছে বলে আমার এই মুহূর্তে মনে হয় না। আমার চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ না হলেও একটি কারণ হলো যে, আমি বেঁচে থাকলে তুমি মৌরিকে নিয়ে সুখি হতে পারতে না। আমি তো পারতামই না। হয়তো কোথাও না কোথাও বিয়ে হতো আমারও। স্বামী-সন্তানের সেই সংসারে আমি একজন পাকা গৃহিণী না হলেও পাকা অভিনেত্রী হয়ে সবার কাছে সুখী দম্পত্তির সুনাম কুড়াতাম। কিন্তু ভিতরে আমার দগদগে ঘা নিয়ে সুখি হতে পারতাম না; তুষের আগুনের মতো জ্বলতাম আমি। দৈবাৎ আমাদের দুজনের দেখা হলে তুমিও যে দগ্ধ হতে, আমার চেয়ে তা আর কে বেশি জানবে বলো!
পার্থ, তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাওনি; আদর করতে চেয়েছ। যেদিন ছাদের ওপর তোমার বাসার ড্রইং রুমে আমার বাঁধানো ছবিটা লাগালাম, তারপর গোপনে তোমাকে লক্ষ্য করেছি, বহুবার দেখেছি তুমি একা একা আমার ছবিটার সাথে কথা বলছো, হাত দিয়ে আমার ঠোঁট, গাল, চিবুকে আদর করছ! সেই থেকে আমার সবকিছু তোমাতে সমর্পণ করেছি পার্থ। আমার এই শরীর কীভাবে অন্য একটা পুরুষকে স্পর্শ করার অধিকার দেই তুমিই বলো। তার চেয়ে কি আমার চলে যাওয়াই যুক্তিসঙ্গত নয়?
অনেকগুলো ঘুমের বড়ি ও ইনেকজশন সংগ্রহ করেছি আমি। যন্ত্রণার জগত থেকে ঘুমের দেশে চলে যাওয়ার পাথেয় হিসেবে এর মতো মোক্ষম আর কিছু নেই। পার্থ তোমাকে ভাবতে-ভাবতে আমার ঘুমের দেশে যাবো, তারপর অনাদিকাল স্বপ্নের মধ্যে তোমাকে পাবো, কেউ তখন আমাদের বাধা দিতে আসবে না। কেউ চোখ রাঙাতে পারবে না।
তোমাকে আমি মৌরির হাতে সঁপে দিয়েও কিছুটা দিন বাঁচতে চেয়েছিলাম। কাছে না গেলেও তোমাদের দুজনকে সুখী দেখতে ইচ্ছে ছিল খুব। কিন্তু কিছুদিন ধরে কী হয়েছে তুমি জানলে আমার এই এই চলে যাওয়াকে দোষ দিতে পারবে না। প্রায় পনের দিন আগে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে যায় সেই ছেলেটির সাথে; যাকে তুমি দেখেছিলে বার্থডের অনুষ্ঠানে। বিয়ের তারিখ তখনও ঠিক হয়নি। কিন্তু ছেলেটিকে গত সপ্তাহে আমাদের বাসায় থাকার সম্মতি দিয়েছে আমার মা। এই সাতদিনে একটি দিনও আমি তার সাথে কথা বলিনি। গতকাল রাতে হঠাৎ সে আমার ঘরে এসে স্ত্রীর মতো ভোগ করতে চেয়েছিল আমাকে। আমি তাকে ফুলের টপ দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করেছি। এরপর মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আমাকে কোমড়ের বেল্ট দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে। আমার মা পাশের ঘরে থেকে সবকিছু জেনেও কিছু বলেনি। বরং আমার কাছে লোকটির ওসব নোংড়ামির কথা শুনে তার পক্ষ নিয়ে আমাকে বলেছে, বিয়ে না হলেও তো বিয়ে ঠিক। তার সাথে ওসব করলে নাকি আমার কোনো অপরাধ ছিল না! এমন মাকে আমি মা বলে মানি না পার্থ।
আমার মা এমন আচরণ করবে না তো কে করবে? আজ একটা সত্যি কথা তোমাকে বলি পার্থ, যা কোনোদিন তোমাকে বলিনি বা বলব বলেও ভাবিনি। কোন সন্তানই মায়ের অন্যায়কে প্রকাশ করে না, করতে চায়ও না। কিন্তু যে মা নিজের মেয়েকে অপবিত্র করার জন্য অন্যকে ইন্ধন যোগায়, উৎসাহ দেয়, কোনো অপরাধ নেই বলে ফতোয়া দেয়, সে আমার মা হতে পারে না! তার অতীত অপরাধের কথা আমি অকপটে অন্তত তোমাকে বল যেতে চাই।
তোমার মনে আছে কিনা জানি না। তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছিলে যখন তোমার দেড় বছর বয়স। আর আমার এক বছর। বাবা মারা গেলেন, যখন আমার বয়স সাড়ে তিন আর তোমার চার বছর। তুমি জানো বাবা ঘুমের ঘোরে মারা গেছেন। শুধু তুমি নও পার্থ, এটা সবাই জানে আর বিশ্বাসও করে। কিন্তু বাবা কীভাবে মারা গেলেন, আমি ছাড়া আর কোনো সাক্ষী নেই এ পৃথিবীতে। পার্থ, আমার বাবাকে আমার মা হত্যা করেছে! অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। আমি তার মৃত্যুযন্ত্রণা দেখেছি। এতোটা বছর সেই কষ্ট বুকের মধ্যে লালন করেছি। আজ তোমাকে বলে আমি কিছুটা হালকা হতে চাই পার্থ। আমার মৃত্যুর পর আমার বাবাকে হত্যাকারীকে ঘৃণা করার আর কেউ থাকবে না। আমি চাই তুমি আমার বাবার হত্যাকারী আমার মাকে যতদিন বাঁচবে ততদিন ঘৃণা করবে, আমি যেমন করতাম।
যে রাতে বাবাকে মেরে ফেলা হলো, সে রাত ছিল ঝড়ের তাÐবের রাত। বাবার পাশে ঘুমিয়েছিলাম আমি। হঠাৎ ধ্বস্তাধস্তি ও বাবার গোঙানিতে ঘুম ভেঙে যায় আমার। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি মা বাবার উপর বসে বালিশ দিয়ে বাবার মুখ চেপে ধরেছে আর একটি লোক বাবার পা দুটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। বাবা ছটফট করছে। এভাবে দু-এক মিনিট পর বাবা আস্তে-আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেলেন। আমি তাকিয়ে-তাকিয়ে সবকিছু দেখছি, মা হয়তো বুঝতে পারেনি, পারলে হয়ত ওই রাতে আমাকেও মেরে ফেলত।
লোকটি কে জানো তুমি? আজ তার নাম প্রকাশ না করে পারছি না। যাকে তুমি আমার ফ্যামিলির সবচেয়ে ‘ওয়েল উইসার’ হিসেবে চিনতে সেই আমির সাহেব, বাবার বন্ধু ব্যবসায়িক পার্টনার! আমির সাহেবের সাথে মায়ের পরকীয়ার সম্পর্কের জন্য বাবাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আর সেই আমির সাহেবের শেষ পরিণতিও তুমি জানো না। তুমি বা সবাই যা জানে সেটা ভুল। আমির সাহেবকে মা খুন করেছে। মদের বোতলে বিষ মিশিয়ে আমির সাহেবকে খুন করেছে মা। আমি তার জ্বলন্ত সাক্ষী। তবে এই খুনের কথাটা আমি জানতাম, মা সেটা জানত বলে আমাকে অনেক সময় ভয় পেতো। আমি এই হত্যাকান্ডের বিষয়টি ফাঁস করে দেবো বলে-বলে আমার বিয়েটা এতদিন আটকে রেখেছিলাম। কিন্তু মা অন্য পথ ধরল; ছেলেটিকে দিয়ে আমাকে নোংরা বানিয়ে বিয়ে দিতে চাইল। সে হয়ত ভেবেছিল যে, ছেলেটির সাথে শারীরিক সম্পর্কে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না; কারণ সে মনে করেছিলেন তার মেয়ে তো তার মতোই হবে। আমি তা হতে পারিনি পার্থ। মা ভেবেছিল, ছেলেটির সাথে শারীরিক সম্পর্কের ফলে আমি গর্ভবতী হলে সেটাকে সে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আমার বিয়ে দেবে। কিন্তু আমি তা হতে দিতে পারি না। হতে দেইনি।
রাত পোহালেই আমার বিয়ে ওই অসভ্য জানোয়ার ছেলেটার সঙ্গে। আর তাই আজ রাতটাই শুধু আমার হাতে আছে। আমার জীবনের শেষ রাত আজ। একটু পরেই আমি ইনজেকশন পুশ করব আমার শরীরে। যতক্ষণ চেতনা আছে, ততক্ষণ তোমাকে আমার জীবনের কিছু অজানা কথা বলে শেষবারের মতো তোমার ইমেইলে লেখাটা পাঠিয়ে দিয়ে চিরদিনের জন্য চোখ বুজব।
আমির সাহেবের কথা বলছিলাম, যার জন্য বাবা প্রাণ দিয়েছিলেন। যাকে মা খুন করেছিল। মা আমির সাহেবের সাথে নষ্টামি করার জন্য তোমাকে আমাকে আলাদা করে দিলেন। বাবার মৃত্যু দৃশ্যটা দেখার পর আমি খুব ভয় পেতাম। ঘুমের ঘোরে বাবার গোঙানির শব্দ কানে আসত। আমি ঘুমাতে পারতাম না। তখন থেকে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবার চেষ্টা করতাম। ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠলে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে সাহস দিতে, ভরসা দিতে। আমি তোমার সাহস পেয়ে-পেয়ে কল্পনায় কখন যেন তোমাকেই আমার সারা জীবনের অভিভাবক ভেবে নিয়েছিলাম। ভাবতাম বড় হলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু তখন তো জানতাম না যে, বোন বলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে না। অথচ আমরা আপন ভাইবোন ছিলাম না, বিয়ে হতে সামাজিক কোনো বাধা না থাকলেও তুমি রাজি হওনি। আমি তোমার ইচ্ছেকেই দাম দিয়েছি।
তোমার মনে আছে পার্থ, মাঝে মধ্যে দুজনই রাতের অন্ধকারে ভয় পেতাম বলে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে না ঘুমিয়ে সারাটা রাত কাটিয়ে দিতাম। এভাবে না ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, সে কথা তোমার মনে নেই পার্থ?
আমাকে অসুস্থ রেখে মা বাইরে চলে গেলে তুমি আমাকে সেবা করতে। মাথায় পানি দিতে জ্বর এলে, শরীর মুছিয়ে দিয়ে বলতে, ‘ভয় পাস নিন্দিতা, আমি তো আছি!’ সারা জীবন তুমি আমাকে নিন্দিতা বলে ডেকেছ, আমি রাগ করেছি কেন জানো? আমি জানতাম তুমি আমাকে আদর করে নিন্দিতা বলে ডাকছ। নামের অর্থের জন্য রাগ করতাম না, রাগ করতাম এ জন্য যে, যখনই আমাকে নিন্দিতা বলতে তখন অতীত আমার সামনে এসে পড়ত। তুমি কেনো জানো না যে, মেয়েরা অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে চায় না।
ছেলেবেলা থেকে আমি তোমাকে ভরসা করতে শিখেছিলাম, তোমার উপর বিশ্বাস রাখতে শিখেছিলাম। সেই থেকে তুমি একান্তই আমার ভাবতে শিখেছিলাম। কিন্তু সেই আমার তোমাকে নিজের হাতে যখন মৌরির হাতে তুলে দিলাম, তখন আমার ভিতরের জ্বালা তুমি জানতে না পার্থ, আমি তখন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম, আগ্নেয়গিরির আগুনে জ্বলছিলাম আমি। যখন তোমাদের দুজনকে এক করে দিয়ে হেঁটে-হেঁটে বাসার পথ ধরছিলাম তখন বার-বার পিছন ফিরে দেখছিলাম তোমাদের। আমার তখন ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরি সেই ছেলেবেলার মতো, যখন ভয় পেতাম, কষ্ট পেতাম আর তোমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¦না পেতাম, সে রকম করে।
পার্থ এই আমি শুধু তোমার। এই হাত, এই ঠোঁট, চিবুক একান্ত তোমার বলে জেনে এসেছি আমি। এতে আমি যে আর কারও অধিকার বা স্পর্শ মেনে নিতে পারব না। তাই এনগেজমেন্ট হওয়ার পর ঠিক করেছিলাম, তোমাদের বিয়েতে এটেন্ড করে দুজনকে আশীর্বাদ করে চিরদিনের জন্য তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবো আমি। এর জন্য বার-বার বিয়ের দিনক্ষণ পাল্টাচ্ছিলাম আমি। মা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন। না হলে মেয়েকে অবৈধ ভোগ করার অধিকার দেয় কাউকে? আমি অপবিত্র হয়ে বেঁচে থেকে বা অন্য কারও বউ হয়ে এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে ঘেন্না করি। আমি আমার ভালোবাসাকে জয়ী করতে চেয়েছি পার্থ, তোমার জায়গায় আমি কাউক বসাতে চাইনি বলে আজ নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দিয়ে যাচ্ছি।

তুমি খুব কফি পছন্দ করতে। আমাকেও কফিতে আসক্ত করেছিলে তুমি। তুমি বলতে কফিতে ক্লান্তি দূর হয়। এই মুহূর্তে আমি খুব ক্লান্ত পার্থ। তোমাকে আমার শেষ কথাগুলো লিখে যাওয়ার ক্ষমতাও হারিয়েছি। এখন তাই নিজের হাতে কফি বানিয়ে তোমার দেয়া কফির মগে কফি খাবো। ক্লান্তি আমার হয়তো দূর হবে না, যার চিরযাত্রা নিরুদ্দেশের পথে তার আবার ক্লান্তি কি? আমি কফি খাওয়ার আগে ঘুমের ওষুধ খাবো অনেকগুলো। যতক্ষণ চেতনা থাকবে, ততক্ষণ আমি তোমাকে লিখে যাবো।
আজ চলে যাওয়ার সময় কত কথা মনে পড়ছে আমার। সেসব আজ এলোমেলোÑবিপর্যস্ত। কোনটা রেখে কোনটা বলি তোমাকে ভেবে পাই না। সময় খুব কম হাতে অথচ হাজার কথার পাহাড় জমা হয়ে আছে বুকে। কী করে বলবো তোমাকে, না বলতে পারলেও যে আমার ওপাড়ে শান্তি হবে না।
এই মাত্রা কফি খেয়েছি। অনেকগুলো সিডেটিভ খাওয়ার পর মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বুকের মধ্য থেকে উছলে উঠছে হাজার কথার ঢেউ। পার্থ এই মুহূর্তে যদি তোমার বুকে একবার মাথা রাখতে পারতাম, একবার যদি তোমার হাত দুটি ধরতে পারতাম, তুমি যদি একটিবার আমার হাত দুখানি তোমার হাতের মধ্যে আঁকড়ে ধরতে, যদি একবার আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে তুমি, তাহলে আমি মনে হয় স্বর্গসুখ অনুভব করতে-করতে মরতে পারতাম; সে উপায় নেই আমার। আমি হতভাগ্য, আমার তোমাকে অন্যের হাতে দিয়ে নিঃস্ব আমি দূর অজানার পথে পাড়ি দিলাম।
তুমি প্রায় প্রতিটি বার্থডেতে আমাকে শাড়ি কিনে দিতে, আর আমি রাগ করতাম। একদিন রাতে, তখনও কৃষ্ণপক্ষের অর্ধেক ক্ষয়ে যাওয়া ম্লান-মূক চাঁদ উঠেনি আকাশ জুড়ে। তখনও বাতাস ফেলেনি নিঃশ্বাস। আকাশের অযুত তারার সে আধো আলো-আধো অন্ধকারে তুমি হঠাৎ গুন-গুন করছিলে অনূপ ঘোষালের গাওয়া একটি গান। তুমি ঠিক কী গাইছিলে বুঝতে পারছিলাম না আমি। আমি তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম গানটি স্পষ্ট করে গাওয়ার জন্য। হঠাৎ তুমি কেনো যেন লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়েছিলে। বললে, থাক না। এ গান তোর শুনে লাভ নেই। সেদিন তোমাকে জোর করায় গানটি গেয়েছিলে তুমিÑ

এখনই উঠিবে চাঁদ আধো আলো আধো ছায়াতে
কাছে এসে প্রিয় হাতখানি রাখো হাতে ।।

এখনই জাগিবে ভীরু চামেলী
জোছনায় নয়ন মেলি
ফিরিবে কপোত নীরে
প্রিয় পাশে তরু শাখাতে ।।

হের গোধূলি আকাশে জ্বলে দুটি তারা
পথহারা
গত জনমের মোরা যেন ছিনু মোরা
দুটি তারা।

এ মায়া গোধুলী তীরে প্রিয়
চিরদিন মনে রাখিও
যত কথা যত গান
ডুবে যাক ভালোবাসাতে ।।

পার্থ, আজ এই গানটি আমাকে নতুন করে কাঁদালো। আমার জীবনের ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে সত্যিই আমি যখন একান্ত মনে প্রত্যাশা করছিলাম, তুমি এসোÑএসো তুমি, তখন কোথায় যেন বিরহের বাঁশি বেজে উঠেছে পঞ্চমী সুরে। আর আমার বুকটা ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে।
আমার হাত কেমন নিস্তেত হয়ে আসছে পার্থ। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। অথচ এখনও কত কথা বলা বাকি!
মৌরিকে নিয়ে কত হিংসা করেছি আমি। বলেছি ওকে আমি সহ্য করতে পারতাম না। কেনো তুমি কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করোনি। আর তোমার এই জিজ্ঞেস না করায় আমি খুব অপমান বোধ করতাম। মনে হতো তুমি সবকিছু জেনেও না জানার ভাণ করে আমাকে হারিয়ে দিতে চাইছ। অথচ আমি কোনোদিনই তোমার কাছে হারতে চাইতাম না। কিন্তু যেদিন থেকে বুঝলাম যে, তোমাকে কোনোদিনই পাবো না আমি, কোনোদিনই তুমি আমার হবে না, সেদিন আর জেতার মানসিকতা ছিল না আমার। কারণ আমি তো নিজের কাছে নিজেই হেরে গিয়েছিলাম। সেই হারের পূর্ণতা পেলে তোমাকে মৌরির হাতে সঁপে দিয়ে। আর এই হারটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জিত। যখন কেউ হেরে মনে করে সে জিতেছে, সত্যিকার অর্থেই সেটা সেরা জেতা মনে হয় আমার। পার্থ, জীবন আমাকে হারিয়ে দিয়েছে সত্যি, কিন্তু আমার মন বলছে আমি হারিনি। তুমি জিতে গেলে আমিও জিতি, কথাটা একদিন তোমাকে বলেছিলাম আমি।
আজ আরও একবার মনে হয়েছিল আর কটা দিন বাঁচতে। ঘুমের ওষুধগুলো হাতে নিয়েও খাবো কি খাবো না, ভাবছিলাম অনেকক্ষণ। কিন্তু যখন মনে পড়ল একা একা বেঁচে কী লাভ? কাকে নিয়ে বাঁচব আমি। জানো পার্থ, বাবাকে যেদিন হারালাম সেদিন আমি তিনজন থেকে দুজন হয়ে গিয়েছিলাম। বাবার মৃত্যুদৃশ্য দেখার পর মায়ের কোনো অস্থিত্ব ছিল না আমার কাছে। তুমি যেটা দেখেছ সেটা লোক দেখানো। ওটা মেকি। জানো তো, মেয়েরা খুব নিখুঁত অভিনয় করতে পারে। আমি সারাটা জীবন মায়ের সাথে অভিনয় করে গেছি। তাকে হত্যাকারী জেনেও কিছুই না জানার ভাণ করে তার বশ্যতা স্বীকার করে একান্ত বাধ্যগত মেয়ে হয়েছিলাম আমি। কিন্তু যেদিন বার্থডে পার্টিতে তোমাকে অবজ্ঞা করে কথা বলল, যখন আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল এবং যেদিন রাতে ছাদের ওপর বসে তুমি বললে যে, মা তোমাকে আমার সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে, আর এ বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছে, সেদিন আমি মাকে প্রচÐ ঘৃণা করা শুরু করলাম। তুমিও যখন বললে, বোন বলে আমাকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না, সেদিন সত্যিকার অর্থে আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন মনে হয়েছিল, আমার আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তোমাকে আমি মৌরির হাতে তুলে দেবো। আমি তা করতে পেরেছি পার্থ। এখানটায় আমি তোমাকে হারিয়ে দিয়ে গেলাম।

আজ বিদায়ের ক্ষণে কত কথা মনে পড়ছে আমার। মনে পড়ে একবার তুমি আমাকে নিয়ে মেলায় গিয়েছিলে। সেই মেলার ভিড়ে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমি কাঁদতে-কাঁদতে কতশতজনকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি। কীভাবে জিজ্ঞেস করেছি সে তোমাকে কখনও বলিনি, আজ বলছি শোনো। আমি লোকজনকে জিজ্ঞেস করেছিÑআমার পার্থকে তোমরা দেখেছ কেউ। আমার দুঃখের মধ্যে আমার কথা শুনে কেউ-কেউ হেসেছে। আমি তো সত্যিই বলেছিলাম, তুমি তো আমারই পার্থ। সারা জীবন তো তোমাকেই আমার জেনে এসেছি। মা যেদিন তোমাকে অস্বীকার করল, তুমিও যেদিন আমাকে বিয়ে না করার কথা বললে, সেদিনও কিন্তু তোমাকে আমি অন্য কারও ভাবতে পারিনি। আর শেষটায় তোমাকে যখন মৌরির হাতে সঁপে দিয়েছিলাম, সেদিনও আমি তোমাকে আমারই ভেবেছে। তুমি আমার এই এক জনমের নও পার্থ, হাজার জনমেও তুমি আমারই থাকবে। মনের ওপর তো কারো রাজত্ব চলে না। আমি তোমাকে মনসিংহাসনে বসালাম, সেখানে তুমি রাজা আর আমি রানী।

আমি আর পারছি না পার্থ। আমার জগত অন্ধকার হয়ে আসছে। একটু পরেই হয়তো থেমে যাবে আমার সবকিছু। তার আগে অন্তত চেষ্টা করব আমার এ লেখাগুলো তোমাকে মেইল করে যেতে।
আজ আমি কোন সাজে সেজেছি তোমাকে আগেই বলেছি আমি। যদি জানতে আমি মনে মনে তোমাকে কোন আসনে বসিয়েছি, যার জন্য আজ বিদায়ের মুহূর্তে আমার এই সাজ, তাহলে বোন বলে বিয়ে না করার কথা বলতে পারতে না তুমি। না, তোমার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, কোনো অনুযোগ নেই। তোমার দেয়া সবগুলো শাড়ি থেকে বাছাই করে আজ আমি লাল শাড়িটা পড়েছি। যে শাড়িটা তুমি কিনে আনার পর মা বলেছিলÑকিরে পার্থ, অনিন্দিতাকে বউ সাজিয়ে এখনই পরের ঘরের পাঠাতে চাস নাকি? এ কথায় আমার লজ্জা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লজ্জা না পেয়ে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম এই জন্য যে, বউ সেজে তো আমি অন্যের ঘরে যেতে চাইছি না, আমি যে তোমারই থাকতে চেয়েছিলাম!
একদিন সন্ধ্যায় তুমি নজরুল গীতি ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী’ গানটি যখন গাইছিলে তখন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার বউকে কীভাবে সাজাবে তুমি? তুমি বলেছিলে, পরনে থাকবে লাল শাড়ি। কপালে টিকলি। খোঁপায় বেলি ফুলের মালা। পায়ে আলতা আর ঠোঁটে কৃষ্ণাচূড়া রঙ লিপিস্টিক। আমি আজ তোমার প্রিয় সেই সাজেই সেজেছি পার্থ, শুধু তোমার জন্য। আমি মনে মনে তোমাকে বিয়ে করে তোমার স্ত্রী হয়েই এই পৃথিবীকে থেকে বিদায় নিচ্ছি পার্থ। গত বার্থডেতে তুমি আমাকে যে শাওমি নোট ৯ ফোনটি দিয়েছিলে সেটা দিয়ে ছবি তুলে রেখেছি। চিরকুটে লিখে দিয়ে গেলাম ফোনটা যেন তোমাকে দেয়। আমি জানি আমার শেষ অনুরোধ রাখবে মা, তোমাকে ফোনটা দেবে। ফোনের মধ্যে তুমি আমার এখনকার বউ সাজের ছবিগুলো দেখতে পাবে পার্থ। তাছাড়া তোমার ইমেইলে কয়েকটি ছবি পাঠিয়ে দিয়ে গেলাম। তুমি যতœ করে রেখো। আমি ওপার বসে দেখব তুমি কতটা যতœ করতে পারো আমাকে। কতটা ভালোবাসো তুমি।
তুমিও যদি আমাকে বউ বলে স্বীকার করো, তাতে তোমার তো ক্ষতি বলে কিছু নেই। তোমার মনের তালা খুলে আর কেউ না জানলেই হলো। তুমি যদি আমার স্ত্রী বলে মনে-মনে স্বীকৃতি দাও, তাহলে হয়তো আমি মরে গেলেও কিছুটা শান্তি পাবো। এই অনুরোধটুকু রেখো প্লিজ।
আমার এই সুইসাইড নোট কোনোদিন প্রকাশ হলে তোমাকে কোনরকম ঝামেলায় পড়তে না হয়, সে জন্য আমি লিখে গেলাম আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
আমার মৃত্যুর জন্য পার্থ তোমাকে সামান্যতম দায়ী করছি না, বরং তুমিই ছিলে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর মায়ের ¯েœহ পেলেও আমি মনেপ্রাণে মাকে গ্রহণ করতে না পারায় তার ¯েœহকে অকৃত্রিম মনে হয়নি কখনও। তবুও আমার মৃত্যুর জন্য মাকে দায়ী করব না। মৌরি, যাকে আমি প্রচÐ বিদ্বেষ করতাম, সেও দায়ী নয়। কারণ আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়জন, সবচেয়ে ভালোবাসার জন্য আজ মৌরির কাছে। মৌরিকে আমার পার্থর রক্ষাকবচ করেছি, সুতরাং তাকে দায়ী করার তো প্রশ্নই আসে না। আমি আমার আত্মহত্যার জন্য আমার ভাগ্যকে দায়ী করলাম; ভাগ্যবিড়ম্বিতা আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তাই নিজের ইচ্ছায় আমি আমাকে হত্যা করলাম।
পার্থ আমি আর পারছি না। আমার দুই চোখ বুজে আসছে। জিহŸা আড়ষ্ট হয়ে আসছে। হাতের আঙ্গুলগুলো আর নাড়াতে পারছি না, কম্পিউটার কীবোর্ডে আমার আঙ্গুল বসছে না। এবার তোমার ইমেইলে এই লেখা কয়েকটি ছবি পাঠাতে পারলেই আমার কর্তব্যটুকু শেষ হবে। যাবার আগে একটি কথা বলার চেষ্টা করছি আমি। গত জন্মদিনে তোমার দেয়া লাল শাড়িটা আমার শরীর জড়িয়ে আছে, আমার মনে হচ্ছে তুমিই আমাকে জড়িয়ে ধরেছ। আমি তোমার কোলেই চোখ বুজছি। ভালো থেকো পার্থ, আমি ওপাড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। বিদায়, বি দা য়— চি র ত রে।

শেষ