চিঠি/অলিয়ার রহমান

চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে আজ চাঁদের হাট বসেছে। তার মেয়ে মেহজাবিন সকালের ফ্লাইটে চিটাগং থেকে ঢাকা এসেছে – সাথে দুই ছেলে রাতুল আর রাকিব। ছেলে দুটো দেখতে হয়েছে যেমন রাজপুত্রের মত – তেমনি ভালো লেখাপড়ায়। ওদের বাবা ইফতেখার চিটাগং ওয়াসার সিনিয়র প্রকৌশলী। অফিস খোলা থাকায় আজ ওদের সাথে আসতে পারেনি। তবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার ফ্লাইটে ঢাকায় এসে যাবে ইনশাআল্লাহ।

মেহজাবিন নিজেও চিটাগং মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তার নিজেরও অনেক ব্যস্ততা। কিন্তু না এসে উপায় ছিল না তার। তার ছোট দুই ভাই মোরশেদ আর মুনতাসির প্রায় দেড় বছর পর আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছে আগামী কাল দুপুরে। ভাই দু’টো বোন বলতে পাগল। এমন বোন পাগল ভাই পৃথিবীতে আর আছে কিনা – তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে মেহজাবিনের।

সন্ধ্যার পরপরই মেহজাবিন তার মা’য়ের সাথে কিচেনে ঢুকে পড়লো । কতদিন পর ভাই দুটো দেশে ফিরছে! ওদের প্রিয় ডিশগুলো সব রান্না করা দরকার। চৌধুরী সাহেব তার দুই নাতি রাতুল ও রাকিব নিয়ে ছাদে চলে গেলেন। আকাশে এত্তো বড় একটা চাঁদ। পুরো ছাদে জুড়ে সুন্দর করে টাইলস্ লাগানো। তারপরও চৌধুরী

সাহেবের জন্য কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ছাদে, সাথে কয়েকটা পিলো। তিনি ছাদের লাইট বন্ধ করে দিয়ে দুই নাতিকে নিয়ে আরাম করে বসে পড়লেন কার্পেটের উপর। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে ছাদটা। পাশেই একটা এ্যারোমেটিক জুঁই গাছে ফুটে আছে শত শত ফুল – তারই সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে ছাদজুড়ে।

রাতুল আর রাকিব ওদের নানু ভাইয়ের ভীষণ ভক্ত। নানু ভাই এতো সুন্দর করে গল্প বলতে পারেন! মনে হয় – সবকিছু ফেলে সারাদিন শুধু নানু ভাইয়ের গল্প শুনি। আর তাই অনেকদিন পর নানু ভাইকে কাছে পেয়ে দুই ভাই আবদার করে বসলো গল্প শোনার জন্য। চৌধুরী সাহেব ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন – ” তোমাদের আমি আজকে একটা সত্যি গল্প শোনাতে চাই – তোমরা কি শুনতে চাও সেই গল্পটা ?” দুই ভাই একসাথে বলে উঠলো – ” অবশ্যই শুনবো নানু ভাই।”

” আচ্ছা শোন তাহলে। আমি তখন বিদেশ থেকে লেখাপড়া শেষ করে সবে দেশে ফিরেছি। বাবা আমাকে বারবার অফিসে বসার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। আমি বললাম – আমাকে একমাস সময় দাও বাবা। অনেকদিন লেখাপড়ার মাঝে ডুবে থেকে মাথায় জট বেঁধে গেছে। কিছুদিন একটু ঘুরাঘুরি করে জটটা খুলে নিই – তারপর ঠান্ডা মাথায় অফিসে বসবো ইনশাআল্লাহ। বাবা রাজি

হলেন। আমি ড্রাইভারকে নিয়ে সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে তোমাদের আপুমনি থাকেন আমার সাথে। তোমাদের আপুমনির সাথে তখন আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। তিনমাস পরে বড় অনুষ্ঠান করে বিয়ে হবে আমাদের। ঠিক এমনি এক সময় একদিন আমরা বিকাল চারটার দিকে রমনা পার্কে ঘুরতে গেছি। পার্কে কিছুক্ষণ হাঁটার পর অবাক হয়ে দেখলাম – একটা বেঞ্চের উপর ৫-৬ বছরের একটা মেয়ে একা একা বসে আছে – মেয়েটার চোখে জল । মেয়েটা দেখতে অবিকল পরীর মত, অথচ গায়ের পোশাক মলিন – মুখটা শুকনো। আমি মেয়েটার কাছে গিয়ে বললাম – ” তুমি এখানে একা একা বসে আছো কেন মামনি? “
” আম্মু বসতে বলছে “
” তোমার আম্মু কোথায়?”
” আমি জানি না।”
” কখন এসেছো এখানে?”
” অনেকক্ষণ।”
” কি নাম তোমার?”
” মৌটুসী।”
” তোমাদের বাসা কোথায়?”
মেয়েটা আঙুল দিয়ে রাস্তার দিকে দেখালো। বুঝলাম, সে বাসার ঠিকানা বলতে পারবে না। তাকে জিজ্ঞেস করলাম – ” আজই প্রথম, নাকি আগেও এসেছো এখানে? “
” আগেও এসেছি।”

” তোমার আম্মু কখন আসবে – তুমি জানো?”
” একটু পরেই চলে আসে, কিন্তু আজ আসছে না।”- বলেই মেয়েটা কান্না শুরু করে দিল। আমি মেয়েটার পাশে বসলাম। ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা মা তার বাচ্চাকে বাসায় না রেখে পার্কে এনে বসিয়ে রাখছে কেন? বাচ্চা তো হারিয়ে যেতে পারে, আবার দুষ্টু লোকেরা ধরে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিতে পারে। একজন মা জেনে বুঝে এমন ঝুঁকি কেন নেবে? আমি মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম – “দুপুরে কিছু খেয়েছো মামনি?” মেয়েটি ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালো। আমি ড্রাইভারকে ফোন করে হাফ প্লেট বিরিয়ানি, একটা পেপসি আর এক বোতল পানি আনতে বললাম। মেয়েটা অনেক তৃপ্তি নিয়ে খেলো খাবারটা। তারপর আরও অনেকক্ষণ কেটে গেল – কিন্তু মেয়েটার মা এলো না ওর কাছে । হঠাৎ আকাশে মেঘ জমতে শুরু করলো। আমি তোমার আপু মনিকে বললাম ড্রাইভারের সাথে বাসায় চলে যেতে। তোমার আপু মনি বললেন -” চলো, মেয়েটিকে আমরা থানায় দিয়ে যাই – পুলিশ ওর মাকে খুঁজে বের করে ফেলবে।” আমি বললাম – ” আমি সেটা করতে চাই না। আমি ওর মা’র সাথে কথা বলতে চাই। আমি বুঝতে চাই – কেন ওর মা মেয়েটাকে বাসায় না রেখে এই পার্কে রেখে দুরে চলে যায়।” তোমাদের আপু মনি আমাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। আমি ড্রাইভারকে বললাম

গাড়ি থেকে ছাতা বের করে আমাকে দিয়ে তারপর তোমাদের আপু মনিকে বাসায় রেখে আসতে। তোমাদের আপুমনি বাসায় চলে গেলেন। এর একটু পরেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। ছাতায় বৃষ্টি মানলো না। আমরা দু’জনেই ভিজে একাকার হয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটা কাঁপতে শুরু করলো। সন্ধ্যার সাথে সাথে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল পুরো রমনা পার্ক। মেয়েটা আমার হাত শক্ত করে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি মেয়েটিকে বললাম – ” এক কাজ করি মামনি। এখন তো রাত হয়ে গেছে। অন্ধকারে তোমার আম্মু তোমাকে খুঁজে পাবে না। চলো এখন আমরা আমাদের বাসায় চলে যাই। কাল সকালে আমরা আবার এখানে এসে বসবো। তারপর তোমার আম্মু এলে তোমাকে আম্মুর কাছে দিয়ে আমি চলে যাবো বাসায়।” মেয়েটি কোন কথা বললো না। আমি মেয়েটিকে কোলে তুলে গাড়িতে উঠে বসলাম এবং বাসায় যাবার আগে মেয়েটার জন্য কিছু ড্রেস কিনে নিলাম নিউ মার্কেট থেকে। মেয়েটিকে বাসায় নিয়ে এলাম, কিন্তু ওর কান্না থামছে না কিছুতেই। আমার মা মেয়েটিকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে নতুন জামাকাপড় পরালেন। রাতে যত্ন করে মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন। তবুও মন ভরছে না মেয়েটার। সে বারবার চোখ মুছে বলছে ” আমি আম্মুর কাছে যাব।” আমি মেয়েটিকে বেডে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম – “কাল তোমাকে তোমার আম্মুর

কাছে নিয়ে যাবো, তুমি এখন ঘুমাও মামনি।” মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

“তারপর – তারপর কি হলো নানুভাই?” রাতুল আর রাকিব একসাথে বলে উঠলো।
“তারপর আর কি – পরদিন সকালে নাস্তা করে মেয়েটিকে নিয়ে হাজির হলাম রমনা পার্কে। তারপর আগের দিনের সেই বেঞ্চিতে বসে মেয়েটির মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। দুপুর বেলায় মেয়েটিকে বিরিয়ানি কিনে খাওয়ালাম। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হয়ে গেল , মেয়েটিও কান্না শুরু করে দিলো – তবুও মেয়েটির মা এলো না ওকে নেবার জন্য। এভাবে তিনদিন কেটে গেল। আমি মেয়েটিকে নিয়ে পার্কে যাই – আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসি। চতুর্থ দিন দুপুরে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো।”
” কি ঘটলো নানু ভাই?”
চৌধুরী সাহেব ঘটনা বলতে যাবেন – এমন সময় ছাদে লাইট জ্বলে উঠলো। মেহজাবিন এসে লাইট জ্বালিয়ে বললো- ” এই — তোমাদের আপুমনি তোমাদের জন্য পিঠা বানিয়েছেন। যাও খেয়ে আসো।”
” আমরা নানু ভাইয়ের কাছে গল্প শুনছি মামনি। পিঠা পরে খাবো।”
” না, এখনি যাও । পিঠা ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না আর।”
রাতুল আর রাকিব উঠে নীচে চলে গেল। মেহজাবিন

বাবার কাছে এসে বসলো – তার চোখ ভেজা।
” তুমি এই গল্পটা ওদের কেন বলতে গেলে বাবা?”
” একটা বিশেষ কারণে বলেছি মামনি। আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না আজকাল। নানা রকম দুশ্চিন্তা এসে মাথায় ভর করে সারাদিন। তোমাদের না বলে আমি একটা কাজ করে ফেলেছি গত সপ্তাহে। আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি তিন সন্তান আর তোমাদের মায়ের নামে সমান উইল করে দিয়েছি। কেন জানি মনে হচ্ছে – আমি আর বেশিদিন বাঁচবোনা মামনি। এজন্যই এতো তাড়াহুড়ো করছি আমি।”
” আমার কোন সম্পত্তির দরকার নেই বাবা।”
” তোমার দরকার না থাকলেও আমার আছে। তোমাকে আমি আমার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চাই না মামনি। তোমার দুটো ছেলে আছে – ভবিষ্যতে ওদের জন্যও তোমার অর্থের প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া তুমি মোরশেদ আর মুনতাসিরের বড় বোন। আমরা চিরদিন বেঁচে থাকবো না এই পৃথিবীতে। আমাদের মৃত্যুর পর ওরা যদি কোন বিপদে পড়ে কোনদিন – তখন তোমাকেই ওদের পাশে দাঁড়াতে হবে মামনি । কি জানি – সেদিনও হয়তো তোমার টাকা পয়সার প্রয়োজন হতে পারে।”

” তুমি রাতুল রাকিবকে বলছিলে চতুর্থ দিন দুপুরে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন তো কোন ঘটনা ঘটেনি বাবা – তাহলে ওদের মিথ্যে বলছিলে কেন?”

” ঘটনা একটা ঘটেছিল মামনি। তোমাকে সে কথা বলা হয়নি কোনদিন । সেদিন দুপুর বেলায় আমাদের ড্রাইভার আমাকে একটা চিঠি এনে দিয়েছিল – তোমার মায়ের লেখা চিঠি। চিঠিটা তোমাকে বহুবার দেবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই জীবনে । কিন্তু পুরাতন স্মৃতি তোমাকে কষ্ট দিতে পারে – এই চিন্তা করে দিতে পারিনি। তাছাড়া মোরশেদ আর মুনতাসির তোমাকে আপন বোন হিসেবে জানে। আমি চাই না এটা নিয়ে তোমাদের মাঝে কোন জটিলতা সৃষ্টি হোক।”
” তাহলে আজ হঠাৎ সেই চিঠির প্রসঙ্গ আসছে কেন বাবা?”
” আসছে তার কারণ আছে মামনি। আমার মনে হয় চিঠিটা তোমার পড়া দরকার।”
” আমার আম্মু কি তাহলে এখনো বেঁচে আছেন বাবা? “
” না না, এই চিঠি দেবার চারদিন পরেই উনি মারা যান।”
” কি হয়েছিল ওনার?”
” চিঠিটা পড়লেই তোমার কাছে সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে মামনি। সারাজীবন মায়ের উপর তোমার যে অভিমান – এই চিঠি পড়লে সেটা আর থাকবেনা আশাকরি। এই নাও চিঠি – পড়া শেষ হলে আমার চিঠি আমাকে ফেরত দিয়ে দিও।”
মেহজাবিন জল ভরা চোখে চিঠিটা নিলো তার বাবার কাছ থেকে। খুব সাধারণ কাগজে ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখা একটা চিঠি, তবে হাতের লেখাটা চমৎকার – গোটা

গোটা অক্ষর। মেহজাবিন পড়া শুরু করলো –

ভাইজান,
আসসালামু আলাইকুম। আমি মৌটুসীর আম্মু। একটা বিশেষ কারণে এই চিঠি আপনাকে লিখতে বসেছি আমি – যদিও এই মূহুর্তে চিঠি লেখার মত শারিরীক ও মানসিক সক্ষমতা আমার নেই । তবুও চেষ্টা করছি – জানি না এই চিঠি লিখে শেষ পর্যন্ত আপনার কাছে পৌঁছাতে পারবো কিনা। তবে আমার বিশ্বাস – আল্লাহ পাক এই টুকু সুযোগ অবশ্যই আমাকে দেবেন।

আমার নাম রোকেয়া। জন্মের পর আমি আমার বাব-মা – এমনকি কোন আত্মীয় স্বজনকে চোখে দেখিনি কোনদিন। আমি বড় হয়েছি গাজীপুরের একটা এতিম খানায়। সেখানে থেকেই আমি এস এস সি পাশ করি। এর কিছুদিন পর ঐ এতিম খানার একটা সিনিয়র ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায় আমার। ছেলেটার নাম ছিল রাতুল – অসম্ভব ভালো একটা ছেলে। রাতুল একটা বুক সপে চাকরি করতো। আমরা ছোট্ট একটা বাসা নিয়ে থাকতাম পল্লবীতে। মনে হতো – এই পৃথিবীতে আমরাই সবচেয়ে সুখী মানুষ। বিয়ের দুই বছর পরে মৌটুসী আমার গর্ভে আসে। ওর বয়স যখন মাত্র এক মাস – সেই সময় রোড এক্সিডেন্টে রাতুল মারা যায়। আমি শোকে পাথর হয়ে গেলাম। আমার পৃথিবী ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেল। মনে

হলো – কি লাভ এই পৃথিবীতে বেঁচে থেকে? তবুও একসময় মেনে নিলাম সবকিছু।
মৌটুসীর জন্য আমি নতুন করে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়লাম। বাসা ছেড়ে বস্তিতে একটা ঘর নিলাম। ওকে কোলে নিয়ে বিভিন্ন বাসায় কাজ করতে শুরু করলাম । এভাবেই কেটে যাচ্ছিল সময়। মাস খানিক আগে আমি হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। মেয়েকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হলাম। তিনদিন পর জানলাম – আমি আর মাত্র একমাস বেঁচে থাকবো এই পৃথিবীতে। আল্লাহর উপর ভীষণ অভিমান হলো আমার। আমি মেয়েকে নিয়ে চলে এলাম বাসায়। একটুও কাঁদলাম না আমি – যদিও বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল আমার। বাসায় ফিরে মৌটুসীকে ঘুম পাড়িয়ে আমি সিজদায় পড়ে আল্লাহর কাছে ভীষণ কান্না শুরু করে দিলাম এবং কাঁদতে কাঁদতে একসময় জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঠিক সেই সময় একটা মধুর স্বপ্ন দেখলাম আমি। দেখলাম – আপনি পার্কের বেঞ্চিতে বসে আমার মেয়েটিকে কোলের উপর বসিয়ে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। বেঞ্চের ঠিক পিছনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছে লাল টকটকে ফুল ফুটে আছে। খাওয়া শেষ করে আপনারা দুইজন অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলেন পার্কে বসে। তারপর একসময় মেয়েটিকে কোলে নিয়ে একটা সাদা গাড়িতে করে বাসায় ফিরে গেলেন আপনারা। পরপর তিনদিন আমি একই স্বপ্ন দেখলাম এবং শেষের দিন রমনা পার্কের সাইন

বোর্ডটিও চোখে পড়লো আমার। বুঝতে পারলাম – আমাকে কোন একটা ইঙ্গিত করা হচ্ছে। আমি আপনার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।

প্রথমে রমনা পার্কে ঢুকে কৃষ্ণচূড়া গাছটা খুঁজে বের করলাম। তারপর গাছের সামনে ঐ বেঞ্চটিতে মেয়েকে বসিয়ে একটু দুরে ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসে থাকতাম আমি। আমি তখন মৃত্যু পথযাত্রি। প্রতিটা মূহুর্ত মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে কাটতো আমার।
প্রথম দুইদিন আপনার দেখা পেলাম না আমি। তবে তৃতীয় দিনেই পেয়ে গেলাম আপনাকে। একবার দেখেই আপনাকে চিনতে পারি আমি, কারণ স্বপ্নে আমি আপনাকেই দেখেছি বারবার। কি যে খুশি হলাম আমি! আমার সমগ্র জীবনে এতোটা খুশি আমি হইনি কোনদিন। আপনাদের দুই জনের সময় কাটানো আমি দুর থেকে দেখলাম। সেদিন বৃষ্টির সময় আমিও বসেছিলাম ঝোপের আড়ালে। তারপর আপনারা চলে গেলে আমিও ফিরে গেলাম বাসায়।
সেদিন রাতে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি। গায়ে আকাশ পাতাল জ্বর। সেই রাতেও একটা স্বপ্ন দেখলাম আমি । দেখলাম – রাজপ্রাসাদের মত বিশাল বড় একটা বাড়ি। সেই বাড়ির একটা ঘরে আপনি মৌটুসীকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। ঘুমের মধ্যে আমার মেয়েটাকে দেখতে অবিকল রাজকন্যার মত লাগছে। কি যে আনন্দ কি যে আনন্দ!!

অসুস্থ শরীর নিয়ে পরদিন আবার পার্কে আসি আমি। কারণ আমি জানতাম আপনারা আমাকে খুঁজতে আসবেন আবার। আর আমি এটাও জানতাম – আপনি কোনদিনই মৌটুসীকে ছেড়ে চলে যাবেন না এই জীবনে। কিন্তু তবুও আমার মন মানতো না। তাছাড়া মেয়েটিকে এক নজর দেখার লোভ আমার মৃত্যু যন্ত্রণাকেও হার মানিয়ে দিতো বারবার। এভাবেই গত তিনদিন কেটে গেছে আমার।
আমি বুঝতে পারছি আমার অন্তিম সময় চলে এসেছে। আমি ওকে গর্ভে ধরেছি বটে – তবে আল্লাহ পাক আপনার জন্যই ওকে পাঠিয়েছে এই পৃথিবীতে। মৌটুসী আজ থেকে আপনার।
চিঠিতে আমার বাসার ঠিকানাটা লিখে দিলাম ভাইজান। দয়া করে মৌটুসীকে আমার কাছে আর আনবেন না কোনদিন । সেটা আমাদের দুজনের জন্যই ভয়াবহ কষ্টের কারণ হবে। তবে আপনার প্রতি আমার একটা দাবি আছে। আপনি আমার বড় ভাই। আমার মৃত্যুর পর আপনি নিজ হাতে আমাকে কবরে নামাবেন। আমার মৃত্যুর সংবাদ আপাতত মৌটুসীকে জানাবার প্রয়োজন নেই। আমার মেয়েটা যখন সব দুঃখ ভুলে যাবে – তখন একদিন ওকে আমার কবরটা দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।
এই জীবনে প্রচুর কষ্ট করেছি আমি। সজ্ঞানে কোনদিন

কোন অন্যায় করিনি। সর্বশেষ মৃত্যু হচ্ছে এক কঠিন অসুখে। আমি জানি না – পৃথিবীতে সারাজীবন এতোটা অসহনীয় কষ্টের পর আল্লাহ পাক পরকালে আমাকে জান্নাতবাসী করবেন কিনা। তবে সত্যিই যদি আমার জন্য জান্নাতের ফয়সালা হয় – আমি ওয়াদা করলাম ভাইজান , আমি আপনাকে ছাড়া ওই সুখের জান্নাতে প্রবেশ করবো না কোনদিন।
আমি জানি – আমার মেয়েটাকে আপনি যত্নে রাখবেন। তবুও মেয়েটা যেন আপনার ভালবাসার শীতল ছায়ায় সারাজীবন বেঁচে থাকতে পারে – মা হিসেবে এই দাবি টুকু আমি রেখে গেলাম আপনার কাছে।
সারাজীবন ভালো থাকবেন ভাইজান। আল্লাহ হাফেজ।

                                                    রোকেয়া
                                                    ১৭/৫/১৯৯০

মেহজাবিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে – একটু পরপর পুরো শরীর কেঁপে উঠছে ওর। চৌধুরী সাহেব মেয়ের মাথায় একটা হাত রেখে বললেন – ” এভাবে কেঁদোনা মামনি। তোমার গর্ভধারিণী হয়তো তোমার কাছে নেই – কিন্তু আমরা তো আছি তোমার মাথার উপর সারাজীবন।”
” আমি জানি বাবা। তোমাদের ছাড়া আমার পৃথিবীটা আমি কল্পনাও করতে পারি না। একটা অদ্ভুত কথা কি জানো বাবা? আম্মুর মত আমিও আল্লাহ পাককে

সবসময় বলি – ” আমি আমার বাবাকে ছাড়া কোনদিনই বেহেশতে যেতে চাই না। বেহেশত বলে যদি কিছু থাকে – তাহলে সেখানেও আমি তোমার হাত ধরে বেঁচে থাকতে চাই অনন্তকাল।”
চৌধুরী সাহেবের চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। এতোটা ভালবাসা সত্যিই কি তার প্রাপ্য ছিল? কতটুকুই বা তিনি করতে পেরেছেন এই পৃথিবীর জন্য?

চৌধুরী সাহেব মেহজাবিনের কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে ওর পিঠে একটা হাত রেখে বললেন – ” তোমাকে একটা কথা বলতে চাই মামনি। আসলে গত দুইদিন ধরে তোমার আম্মুকে স্বপ্নে দেখছি আমি। স্বপ্নে সে বলছে – ” আমার মেয়েটা কোনদিন আমার কবরটা দেখতে এলো না ভাইজান! ওর ছেলে দুটোও তো এলো না কোনদিন ! আমি ওদের কি কেউ না? তবে ভাইজান – আপনি যে মৌটুসীর বড় ছেলের নাম রাতুল রেখেছেন – আমি খুবই খুশি হয়েছি। আপনি একজন অসাধারণ মানুষ ভাইজান। মৌটুসীর জন্মদাতাকে আপনি আবার প্রতিষ্ঠিত করলেন পৃথিবীতে।”
“আর একটা কথা মামনি – তোমাদের বিয়ের আগে আমি
ইফতেখারকে তোমার গল্পটা বলেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম – তোমার সবটুকুই জেনেই যেন তোমাকে সে ভালবাসে। তবে সাথে এটাও বলেছিলাম – মোরশেদ আর মুনতাসির যেন কোনদিন বিষয়টা জানতে না পারে। “

” আমি সেটা জানি বাবা – ইফতেখার আমাকে বলেছে সবটা। “
” আমি অসুস্থ হবার আগেই তোমার আম্মুর কবরটা তোমাকে দেখাতে চাই মামনি। তুমি দিন তারিখ ঠিক করে আমাকে জানাবে । তোমাকে বলা হয়নি – তোমার আম্মুকে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল। কারণ মৃত্যুর আগে সে আমাকে তার বড় ভাইয়ের স্থানে বসিয়েছিল।”

আকাশের চাঁদটা আস্তে আস্তে মলিন হতে শুরু করেছে। এক টুকরো মেঘ এসে অন্তরায় হয়ে গেল জোছনার। মেহজাবিন জলভরা চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মনে মনে বললো – “বাঁধভাঙা এই সুখের মাঝেও পৃথিবীতে এতো অসহনীয় কষ্ট কেন – কেন এই কষ্টগুলোকে আমরা সোনার খাঁচায় বন্দী করতে পারলাম না কোনদিন?