চিমনির ধোঁয়া।।সুপ্রিয়া বিশ্বাস

বেশ কয়েকদিন আগে শাট ডাউনের মধ্যে অফিসিয়াল কাজে বাইরে বের হয়েছিলাম। আগেই ডিপিও স্যার ফোন করেছিলেন একটি কাজে জেলা অফিসে যেতে হবে। কাজটা ছিল উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসাবে যিনি দায়িত্বে ছিলেন তাঁর। কিন্তু তিনি করোনা পজিটিভ হওয়ায় আমাকেই যেতে বলেছেন। বাড়ি থেকে জেলার দুরত্ব প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার। আরো একটা স্কুলে ক্ষুদ্র মেরামতের কাজ দেখতে যেতে হবে। কীভাবে যাই এই শাট ডাউনে?
কর্তাবাবু শুনে বললেন, ‘আমি নিয়ে যাবো মোটর সাইকেলে।’ দশটার মধ্যে পৌঁছাতে বলেছেন। তথ্য স্বাক্ষর হওয়ার পর অধিদপ্তরে পাঠাতে হবে। তাই জরুরী যেতে বলেছেন। আমরা দু’জন যথাসময়ে বাড়ি থেকে বের হলাম।
মোটর সাইকেলে যাচ্ছি দুজন। পিছনে বসে আমি আকাশ দেখছি আর গুনগুনিয়ে গান করছি।
‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো?’
ওপাশ থেকে কোন সারা শব্দ নেই। সে আর উত্তম কুমারের মতো বলছে না, ‘তুমিই বলো। লা লা লা।’

আমি এবার রাস্তার দিকে মনোযোগী হলাম। দেখলাম, এসময় এপাশ ওপাশ দিয়ে আরো কিছু মোটর সাইকেল চলে গেল। মাঝে মাঝেই ভ্যান, অটো, ট্রাক ও অনান্য যানবাহন চলাচল করছে। একটি মোটর সাইকেলে দেখলাম একজন মহিলা পিছনে বাচ্চা কোলে বসে আছেন।বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি
বাচ্চাটাকে এক হাতে কোন রকমে ধরে আছেন। অন্য হাতে কেরিয়ার ধরে আছেন। হঠাৎ ব্রেক করলে বাচ্চাটার অবস্হা কি হবে? ভাবতেও ভয় লাগে। এভাবে রাস্তাঘাটে অনেককেই শিশুকে বহন করা দেখি । এভাবে জার্নি করা মনে হয় উচিত নয়।

যাইহোক, ভাবলাম আগের গান বুঝি পছন্দ হয়নি। তাই গান পরিবর্তন করে গুনগুনিয়ে আরেকটা গান গাইতে লাগলাম, ‘খোলা আকাশ কি এত ভালো লাগতো? যদি কিছু কিছু মেঘ নাহি থাকতো।’

না! সাড়াশব্দ নেই! একমনে মোটর সাইকেল চালাচ্ছে।
আমার ভাবনা অন্যদিকে মোড় নিলো।

চুপচাপ পিছনে বসে ভাবছি আমার (বাবা এবং শ্বশুর মশাই) বাবার কাছে শোনা দার্জিলিং এর কথা। বাবা গল্প বলতেন, ছোটকালে নাকি একবার দার্জিলিং এ গিয়েছিলেন বেড়াতে । আমার শ্বশুরের বাবা অর্থাৎ শেখরের ঠাকুরদাদু ওরফে আমার দাদুশ্বশুর উনি বৃটিশ আমলেই রেলের স্টেশন মাস্টার ছিলেন। সরকারী চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় বদলী হয়েছেন। তারই একটি সময় দার্জিলিং এ ছিলেন। সময়টা ১৯৪৬-৪৭ হবে। যেহেতু পাশাপাশি বাড়ি। আমার বাবাও বেড়াতে গিয়েছিলেন পিসির বাড়িতে।
যাইহোক গল্প শুনেছি দার্জিলিংয়ের উঁচু পাহাড়ের টিলার উপর দিয়ে নাকি বাড়িগুলো । ওখানে কখন যে বৃষ্টি ঝুপঝুপ করে চলে আসে তা বোঝা মুশকিল। মেঘেরা নাকি পাহাড়ের খুব কাছ দিয়ে উড়ে উড়ে যায়। তারা নাকি জানালা দরজা খোলা রাখলে মাঝে মাঝে ঘরের মধ্য দিয়েও সব ভিজিয়ে উড়ে চলে যায়। আমরা উৎসুক হয়ে এই গল্প শুনতাম। আর বলতাম, ‘আচ্ছা বাবা, মেঘ কি মুঠো ভরে ধরা যেতো?’
বাবা বলতেন, ‘ছোটকালের কথা মনে নেই। তবে ভিজিয়ে দিয়ে যেতো এটা মনে আছে।’
কি মজা!
মেঘেরা গা ঘেঁষে চলে যায়? ছোটবেলায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছিল আমাদের জানার। বাবা বলতেন, হুম। বাইরে দাঁড়ালে ভিজিয়ে দেওয়া মানেই তো গায়ের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া। আর আমার কল্পনায় মেঘেরা খেলা করতো। মনে হতো মেঘেরাও বুঝি পাল্লাপাল্লি খেলা করতো। আর কার আগে কে যাবে টিলার উপর ঘরগুলোকে ভিজিয়ে দিতে সেই পাল্লায় কোন মেঘ জিতে যেতো কেউবা হেরে যেতো। কেউ বা এককোণে সুযোগ না পেয়ে থমকে দাঁড়াতো। তখন থেকেই কেমন মজা মজা লাগতো। মনে হতো বড় হয়ে দার্জিলিং বেড়াতে যাবো। হয়নি যাওয়া।
যাইহোক, মোটর সাইকেলে বসে আকাশ ভরা মেঘ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। আকাশ আমায় সব সময় টানে। আমি ভালোবাসি আকাশ দেখতে। দেখছি বিভিন্ন স্তরে স্তরে মেঘেরা ভেসে ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম, বিদ্যুতের খাম্বার ঠিক উপর দিয়ে কুন্ডলী পাকানো কালো কালো মেঘেরা উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আমার মনে হলো কি অপরূপ!! দার্জিলিং এর মেঘ বুঝি এখানেও উড়ে উড়ে চলে এসেছে।কি মজা!! কি মজা ! একটা মই বা গাছের ডগায় উঠলেই মেঘ ছোঁয়া যাবে বুঝি!
আপাতত ছুঁতে না পারলেও অপরূপ সে মেঘ দেখতে ভারি সুন্দর লাগছিলো!!!
আমি একা দেখে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই বাইক চালককে হাল্কা পিঠে ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘দেখো, দেখো! কত নিচ দিয়ে কী থোকাথোকা মেঘেরা ভেসে যাচ্ছে। আমার কাছে মেঘেদের হুরপরি মনে হচ্ছে।’
যদিও এটা আমার নির্বুদ্ধিতা। কোন চালককে এভাবে বিরক্ত করা অনুচিত। আমি ঠিক করিনি।
সে মোটরসাইকেলের গতি কিছুটা কমিয়ে আমার দেখানো মেঘের দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্ত হয়ে বললো, ‘এটা মেঘ নয়। চিমনির ধোঁয়া।’ ওমা! তাকিয়ে দেখি সত্যিই তাই। রাস্তার দক্ষিণ পাশ থেকে চিমনীর ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উড়ে উড়ে উত্তর পাশে যাচ্ছে।আমি কিছুক্ষণের জন্য থ’ মেরে রইলাম!

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়

মন্তব্য করুন