জীবন যেখানে যেমন।। শাহনাজ পারভীন

মনিকা লিউনিস্কী যখন নিউইয়র্কে ক্লিনটনের সময় ঝড় তুলেছিল, তখন মনিকা জেসিকা কাজের স্বার্থে তার নিক নেম জেসিকাকে ফিরিয়ে আনে। ও এখনও আঁচ করে মনিকার মতোই জেসিকা নামটাও তাকে আপাদমস্তক সন্দিহান সমীক্ষায় নিয়ে আসে। একই প্রশ্ন তাকে রিপিট করা হয়-হটস ইওর নেম?
-জেসি।
-কাম ফ্রম?
-বাংলাদেশ।
-ইউ বাংলাদেশী?
ইয়েস!
-বাট!
ও বুঝতো না। কেনো ওকে ডানকিনেও একই প্রশ্ন করা হয়েছিল দ্বিতীয়বার। পিজাসপে তৃতীয়বার। অবশ্য সে একটা বিষয় খেয়াল করেছে যে, সে যেখানেই যাক না কেন, যে রেস্টুরেন্ট বা মার্কেটিং কোম্পানিতে যাক চাকরি তার প্রথম চান্সেই হয়ে যায় । দ্বিতীয় ইন্টারভিউ লাগে না। মনিকা (জেসিকা) এসেছে উনিশশো আটানব্বইয়ে । স্বামী মো. মনজুরুল ইসলামের সিটিজেনশিপ ভিসায়। সেই থেকে সে আছে এদেশে । কিন্তু এর আগে তাকে কাজ করতে হয়নি। পায়ের ওপর পা দিয়ে আয়েশ করে খেয়েছে।

সে এমনিতেই একটু নিরিবিলি । আরাম পিয়াসী। একটু অন্তর্মুখী । কাউকে ঘাটায় না, ঘাটতেও চায় না। দুটো সাদাভাত, কাঁচা ঝাল, পিঁয়াজ, খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে যে কোন ভর্তা আর ছোট মাছ চচ্চড়ি হলেই সে খুশি । তার কোনো পিৎজা-স্যান্ডউইচে মন নেই। তবে যে কোন জুস এর ব্যাপারে তার সব সময় একটু বাড়তি আকর্ষণ এবং কখনোই খানদানি বোরহানীতে না নেই।
তাকে সুন্দরী বলা যায় । বরং নিঃসেন্দহে । সুন্দরীদের যে কয়টি প্রচলিত শর্ত আছে সবগুলিতেই তার প্লাস মার্ক। শুধুমাত্র উচ্চতায় টেনেটুনে পাশ। তা না হলে তার গোল্ডেন প্লাস কেউ ঠেকাতে পারত না। তবে এসব নিয়ে তার আফসোস নেই। নেই কোনো খারাপ লাগা কিংবা মন খারাপের সাতকাহন। কারণ জেসিকা মিয়া বাড়ির মো. বজলুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্রবধু। প্রথম পুত্রবধু শিরিনা আক্তার পলির থেকেও সে একটু মাথাতোলা। তাই আর শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ, দেবরদের এই বিষয়টা নতুন করে মাথায় ঢোকেনি। তাই সারাজীবনের এই আক্ষেপ মুহূর্তেই মিলিয়েছে শতভাগ।

তার খাড়া নাক, পটল চেরা ভাসা-ভাসা দুটি গভীর চোখ, চিলের ডানার মতো উড়ন্ত ভুরু, উত্থিত চিবুকসহ তার টনটনে ব্যক্তিত্ব সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য যথেষ্ট । তাছাড়া তার রয়েছে দুধে আলতার মতো ধবধবে ফর্সা রং। এতকিছু সত্বেও পিতবর্ণের ঘোলাটে চোখের মনি তাকে সন্দেহের মধ্যে আনে সহজেই । সে কি খাঁটি বাঙালি? নাকি টোটেম, ট্যাবু, দ্রাবিড়, না মোঙ্গলীয় কোন উপজাতি থেকে তার জিন এসেছে? সে যাই হোক! সব মিলিয়ে সে হ্যাপি।

তার বাবা ছিলেন থানা ইঞ্জিনিয়র । সেই সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় থানায় তার বসবাস । ছোটবেলা থেকেই সে সকলের কাছে বাড়তি মনোযোগ পেতে অভ্যস্ত । বাংলাদেশের অসংখ্য থানায় থানায় মনোযোগ পেতে-পেতে আজ নিউইয়র্কের ব্রুকলিনেও সে সমান্তরাল ভাবে আকর্ষিত।

দীর্ঘদিন সে আমেরিকার স্থায়ী নাগরিক হলেও বাইরে সে খুব একটা কাজে যায়নি। তবে এবার কাজ করতে হবে। মেয়েটা এবার ভার্সিটিতে যাবে। ও পড়তো স্টাইফেসেন্ট হাইস্কুলে। ওখানকার এ প্লাস গ্রেডের ছাত্রী। এবার যাচ্ছে স্টোনিব্রোক ইউনিভার্সিটি । ছেলেটি ব্রোন্সসায়েন্স হাইস্কুলের ছাত্র ছিল। ও পড়ছে স্টোনিব্রোক-এ। নিউইয়র্কের কেন্দ্র লং আইল্যান্ড এর এক নিরিবিলি পরিবেশে গড়ে উঠেছে শহরের দ্বিতীয় শ্রেণীর এই ভার্সিটি । অবশ্য হাভার্ট ভার্সিটি, কলম্বিয়া ভার্সিটিতে চান্স হয়নি বলে জেসিকার মোটেও মন খারাপ হয়নি। ব্রুকলিন থেকে টানা দু’ঘণ্টার ড্রাইভ শেষে উইকেন্ডে যখন ছেলেটি বাসায় আসে তখন সে অন্য গর্বে হেসে ওঠে। ছেলে জাকির ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও মেয়েটির ইচ্ছা মেডিক্যাল স্টাটাস । তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর ডলার । এখানে উচ্চ শিক্ষা বাংলাদেশের মতো সকলের নাগালের মধ্যে থাকে না। এখন তো বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ কিংবা মফস্বলের কলেজগুলিতে অনার্স পড়ার সুযোগ আছে । কিন্তু এদেশে তা নয়। এখানে উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রচুর খরচ লাগে। যেটি মধ্যবিত্ত সমাজে একজনের আয়ে সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই জেসিকা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, টাকা থাকলেই ওর বাবা মেয়ের পেছনে খরচ করতে চাইতো না। মেয়ে বড় হয়েছে। তাকে হোস্টেলে পাঠানো যাবে না। এটাই তার একান্ত ইচ্ছে। মেয়েদের নিয়ে তার অযাচিত সন্দেহের বাতিক রয়েছে। এতদিন সে সন্দেহের মধ্যে রাখতো জেসিকাকে। এখন তার সাথে যোগ হয়েছে মেয়ে তাহান। হাত খরচ চাইলেই উল্টাপাল্টা কথা–‘বয়ফ্রেন্ড নিয়ে লাঞ্চ করেছো! এত টাকা লাগে কেন! তুমি জানো আমি ডায়াবেটিকস। বাট এভরিডে আমি কিভাবে ব্রেকফাস্ট করি? অনলি ওয়ান ডলারের একটি ক্রোসেন ব্রেড এবং এক ডলারের একটি কফি। দুপুর না খেয়েই কেটে যায় আমার। রাতে জাস্ট একটা জাইরো। আমার মেয়ে হয়ে তোমার এত ফুটানি কোথা থেকে আসে?’
মেয়ে একদম চুপ।
মুহূর্তকাল অপেক্ষা করেই ফেটে পড়ে।
‘আর ইউ নো হট আর ইউ সেয়িং? হাউ ননসেন্স?
ভাইয়াকে তুমি প্রতিদিন আমার ডাবল ডলার দাও। তখন? তখন তো…নট এনি কোশ্চেন? হোয়াট হ্যাপেন্ড?
তোমার একটি ডলারও আমি নিতে চাই না। আমি লোন নিব। সরকার বসে আছে ডলার নিয়ে। আমি আর্ন করে পেমেন্ট করব। ব্যস, ইটস মাই লাস্ট ডিসিশন।’

এই সব ঘটনার পর থেকেই জেসিকা তার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। কাজ শুরু করেছে। পাপাইয়াচে কাজ করতে যেয়ে সে প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে। নিজের চুল নিজে ছিড়ছে। কেন সে পড়াশোনাটা শেষ করে নাই? ওর বান্ধবী শিউলি। যাকে সে কোনোদিন গোনার মধ্যে রাখে নাই! অথচ সেই কিনা এখন এ গ্রেড টিচার । ছোটবেলায় জিয়ল মাছের মতো প্যাতপেতে ছিল! হাবলু! অথচ পড়াশোনার জোরে আজ সে হাইহিলে ঝড় তুলে স্কুল কাঁপিয়ে বেড়ায় । স্টুডেন্টস তার ভয়ে যখন তখন ড্রেস নষ্ট করে ফেলে। সেই জিয়লের প্যাতপেতে শিউলি আজ পার্লারের কল্যাণে ঐশ্বরিয়ার গ্লোর কাছে কম্পিটিশনে নাম লেখাতে পারে? কেনো? শুধু ঐ পড়াশোনার জোরেই তো? নাকি তার কল্যাণেই তো আজ পোষ্ট পেয়েছে। আর পোষ্টটির কারণেই তো হাই সোসাইটিতে বর্তমান তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে। আর সবকিছু মিলে পেয়েছে গ্লোরিয়াস মুভমেন্ট।

আর লায়লা। তারও একই অবস্থা । কালো ছিল বলে সময়মত বিয়ে হলো না। ঠিকই পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস করলো প্রশাসনে। বিয়ে করেছে কলিগকে। ব্যস…! অথচ ও বলতো শুধু নাকের জায়গায় নাক আর চোখের কাছে চোখ থাকলেই হলো। তারপর ঘসে মেজে সুন্দরী হওয়া তো চোখের পলকের ব্যাপার। সত্যি তাই। লায়লা যেনো বসরার ফুটন্ত গোলাপ। এই সাত সমুদ্র তের নদী দূরে থেকেও জেসিকা ফেসবুকের কল্যাণে প্রতিদিন তার ফুটন্ত গোলাপীয় ছবি আর স্ট্যাটাস দেখতে দেখতে অস্থির । আর আমেরিকা বসে এই শুন্য দশকে ডিজিটাল সময়ে তার মেধাবী মেয়েকে টাকার অভাবে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করাবে এমন গাধা সে কোনোকালে ছিল না। বিশেষ করে যেখানে শ্রম দিলেই ঘন্টা মেপে আয় করা সম্ভব । তাহলে আর ঘরে বসে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থেকে ফেসবুক ঘেটে ঘেটে সময় নষ্ট কেন?

জেসিকা এই বয়সে এসে বিষয়টি বুঝতে পারে। এতো আর বাংলাদেশ নয় যে ইচ্ছে থাকা সত্বেও যে কোনও বয়সে, যে কোনও শিক্ষায় ঘন্টা মেপে কাজ পাওয়া যায়? এর নাম আমেরিকা । সারা বিশ্বকে যারা শাসন করে ইচ্ছেমতো । সে আরো বুঝতে পারে যেসব মেয়েরা সুন্দরী তাদের অল্প বয়সে বিয়ে হয় মাঝারি স্ট্যাটাসের ছেলেদের সাথে । আর যেসব মেয়েরা সুন্দরী না হওয়ার কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারে পরবর্তীতে তাদেরই ভাল বিয়ে হয় চোখ বন্ধ করে । না হলে
নিতান্তই নিজের কলিগ তো থাকেই! আর জেসিকা! পড়াশোনাটা শেষ করতে পারেনি বলেই আজ এতো বিড়ম্বনার শিকার। পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি তার এই অতি মাত্রায় সুন্দরের কারণে। সেই ছোট বেলা থেকেই সবাই ওর মাথা চিবিয়েছে। আর একটু বড় হতেই শুরু হলো বিয়ের প্রস্তাব । যাকে মানায় সেও পাঠায় আবার যাকে মোটেও মানায় না সেও আসে!
এভাবেই এসএসসি দেবার পর পরই তার বিয়ে হয়ে যায় একই এলাকার মনজুরুল এর সাথে। মনজুরুলের তখন দেবার মতো আলাদা কি পরিচয় ছিল? পরিচয় ছিল তার ভাইয়ের, তার বাবার। ও ছিল ঐ ফ্যামিলির
ফ্যাশন সচেতন স্মার্ট যুবক সর্বস্ব । দেখতে তেমন সুদর্শন বলা যাবে না। তবে সায়ন্তনী জুতা ছাড়া তার চলতো না। ওয়ান ম্যান সো পারফিউম তাকে জানান দিতো সব সময়ে সে আছে। আর ছিল এক দঙ্গল বন্ধু সমাজ। ব্যস, বড় আপা পটে গেল! এখনও সময় অসময় বলে জেসিকা- কী চাইছিলে তোমরা? সত্যিকারের বলো তো? আসলে তোমরা চাইছিলে সারাজীবন আমি তোমাদের হাতে পায়ের নিচে থাকি? সুন্দরী ছিলাম বলে সারাজীবন সমাজ তোমাদের চেয়ে আমাকে বেশি মনোযোগ দিয়েছিল তার প্রতিদান এইভাবে নিতে চাইছিলে?

আবার নিজেই নিজের সাথে হাহা করে, হাহাকার করে। কি পাগল আমি? এই কি সম্ভব? কখনও সম্ভব? কোনোদিনও সম্ভব? নিজের মায়ের পেটের বোন। হাতে করে মানুষ করেছে। তাই কি সম্ভব? বলার জন্য বলা! মন যে কী বলে? সে বোঝে না কিছুই। আসলে ঐ সময়টা মনজুরুলের ফ্যামিলি ছিল কামারখালীতে সবদিক থেকে এগিয়ে। প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক, কনস্ট্রাকশন ফার্ম ক’জনের ছিল! ও রকম একটা ভরা ফ্যামিলি রেখেই ওরা চলে এলো স্বপ্নের আমেরিকায়। কিন্তু এখানে ইচ্ছে করলেও পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে খাওয়া যায় না। বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে আর্দালি, চাপরাশি সাথে নিয়ে বাজারের সবচেয়ে বড় আইড় মাছটা কেনা যায় না। এখানে ঘন্টা হিসাবে কাজ করতে হয় । ইচ্ছে করলেই কাজে যেয়ে আয়েশ করে বসে থাকা যায় না। এই হচ্ছে এদেশ আর ওদেশের পার্থক্য।

কিন্তু জেসিকা অনেকটাই এদেশের মতো। খাওয়া দাওয়া । চলা ফেরা। পোশাক পরিচ্ছেদে । লাইফ স্টাইলে এদেশীয়। চেহারার মধ্যে মঙ্গোলীয় একটা স্লাইড আগে থেকেই আছে ।
সব মিলিয়ে ও যেখানেই কাজে যায় ওকে নিয়ে একটা গসিপ চলে । ও কি সত্যিকারের বাঙালি নাকি ফেক বাঙালি!
ও সময় অসময়ে এসব ভাবতে বসে। পেছন থেকে তাড়া লাগায় মালিক কাম ম্যানেজার।
এতো কি ভাবো? গার্বেজ করো। হাত লাগাও।
জেসিকা নড়েচড়ে বসে। হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
ঘড়িতে তখন অনেকটা অকারণ সময় পেরিয়েছে।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়

মন্তব্য করুন