কিশোর উপন্যাস : ঝিল, জঙ্গল ও লোকালয়ের কথা ll তাপসকিরণ রায়

প্রথম পর্ব

পাঁচমারি মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত। এটা হোশঙ্গাবাদ জেলায় মধ্যে পড়ে। মধ্যপ্রদেশের একমাত্র পাহাড়ি স্টেশন পাঁচমারি। এ জাগা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার সাতষট্টি মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এখানকার সাতপুরা অঞ্চল সবচে সুন্দর জাগা। পাঁচমারিকে এই সাতপুরার রাণীও বলা হয়। এ জাগা বলতে গেলে ঘন বনে ঢাকা। তারই মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র পাহাড়-পর্বত মালা। আর আছে ঢালান জলপ্রপাত, ঝর্না, ঝিল এবং বড় বড় জলাশয়। সাতপুরা ন্যাশনাল পার্কের অংশ হিসাবে, এখানে খুব ঘন বন আছে। বনের মধ্যে সিংহ, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, সাম্বর, হরিণ এবং অন্যান্য অনেক রকম বন্য জন্তু-জানোয়ার  এখানে বাস করে।

এই পাঁচমারিতেই লাল বাবু থাকে। পাঁচমারিকে মধ্যপ্রদেশের গ্রীষ্ম নিবাসও বলা হয়। গরমের দিনে লাল বাবুর পূর্বপুরুষ সপরিবারে এখানে ঘুরতে এসেছিল। তারপর এ জাগার মোহ ছাড়তে না পেরে এখানেই বসবাস করতে শুরু করেছিল। বাংলাদেশে থাকার মত তাদের তেমন জাগা-জমিন ছিল না।  তাই এখানে কিছু কাজকর্ম করতে করতে লাল বাবুর ঠাকুর দা এক ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে নিয়েছিল। লাল বাবুর বাবাও বেশ করিতকর্মা ছিল। কয়েকটা বছর যেতে না যেতেই সে পাকা দুই ঘরের দালান তৈরি করল। আর বর্তমানের লাল বাবু সেই দুই ঘরকে চার ঘর বানিয়ে দিব্যি বসবাস করছে। বাংলার বাইরে থেকে থেকে সে বাঙালিত্ব বজায় রাখতে পারছিল না। কথা-বার্তা, চাল-চলন সবই প্রায় এখানকার মতো হয়ে গেছে। এখানে বেশির ভাগ হিন্দি কথা বলতে হয়। তবু বাংলার ভাঙচুর কথার চল এখনও লাল বাবুর ঘরে রয়ে গেছে। তার ছেলে-মেয়েরা বাংলা বলে বটে, কিন্তু লেখার বেলায় একেবারে লবডঙ্কা।

লাল বাবুর ব্যবসা সামান্য। কিছু কাঁচা টাকা তার আছে। সে টাকার আবার বেশির ভাগটাই তাকে রাখতে হয় ঘরে। সে জন্য সে ভেবে-চিন্তে দুটো কুকুর পুষেছে। তার মতে বিদেশি কুকুর রাখার কোনও প্রয়োজনই নেই। জাগা পরিবেশ সব মিলিয়ে চলতে হবে তো ? তাই সে হৃষ্টপুষ্ট দুটো দেশী কুকুরের বাচ্চা ঘরে নিয়ে এসেছে। সে বাচ্চা দুটো আজ বড় হয়েছে। সে গুলো খাওয়া-দাওয়া যা পায় তাতেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে। লাল বাবু নিজে তাদের নাম দিয়েছে, লালু, ভুলু। তার স্ত্রী এ নিয়ে সে সময় একটু আপত্তি জানিয়ে ছিল, ‘এ কি রকম নাম গো ? এ তো তোমার নাম মিলিয়ে নাম রাখা !’

লাল বাবু হেসেছিল, বলেছিল, ‘জানো গো গিন্নি, ছোটবেলা আমি একটা মাত্র সিনেমা দেখেছিলাম। তার নাম ছিল, লালু-ভুলু। কাহিনী বড় ভালো ছিল। দুই বন্ধুর মধ্যে খুব মিল ছিল, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। ওই লালু-ভুলু নামের মধ্যেই কেমন একটা মিল দেখছো না ?’

সেই লালু, ভুলু তখন ছোট ছিল। লাল বাবুর তখন ছেলে-মেয়েরাও ছোট ছিল।  ওদের পছন্দ-অপছন্দ ধরার মত ছিল না। সেই কুকুর দুটোর মধ্যে ছিল ভীষণ মিল। খাবার দিলে কেউ আগেভাগে বেশি খেয়ে নেবে না। কিছুটা খেয়ে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তার মানে বলতে চায় যে, না, এটুকু তুই খেয়ে নে !

লালু মুখ খোলে, মাথা নেড়ে ওঠে, তার মানে হল, না, আমি খাব না, তুই খেয়ে নে ! পাহারাদার হিসেবে লালু-ভুলুর জুড়ি নেই। দিনভর প্রায় ঘুমিয়ে কাটায় ওরা।  আর রাত হলে ওদের চোখে আর ঘুম নেই। লাল বাবুর ঘরে দিনের বেলায় কেউ আসলো তো ওরা দুজনে তাকে শুঁকে শুঁকে চিনে নেয়। ওরা কি বোঝে কে জানে ! কারও ওপর আবার ওরা, ‘ঘেউ ঘেউ’, করে ওঠে। লালু বাবু সঙ্গে থাকলে সেই লোকটার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। না, লোকটার চেহারা ছবি তো খারাপ নয় ! তবে হবে লালু-ভুলু তার ঘ্রাণ শক্তিতে সবকিছু বুঝে নেয়। বুঝে নেয় যে  কে সৎ, আর কে অসৎ। এ সব কুকুররা বুঝে নিতে পারে। লাল বাবুর ভালো লাগে। সে  লালু, ভুলুর পিঠ চাপড়ে আদর করে দেয়, বলে, ‘সাবাস, এই না হলে আমার কুকুর !’

লালু, ভুলুর জন্য পাড়ার লোকেরা ভীষণ টাইট। বিশেষ করে রাত হলে তো কথাই নেই। ইঁদুর হোক, বাঁদর হোক, তাকে এমন তাড়া করবে যে সে ঘরের ত্রিসীমানায় আসতে ভয় পাবে। এই তো সে দিনের কথা, দুই ধেড়ে ইঁদুর সুড়সুড় করে ঢুকে যাচ্ছিল লাল বাবুর বাড়ির ভেতর। লালু দেখে ফেলল ওদের। প্রথমেই সে ওদের সামনে গিয়ে এক ধমক দিলো। দুই ধেড়ে ইঁদুর আচমকা শব্দে ভয় পেয়ে একেবারে চিৎ হয়ে  পড়ল। ততক্ষণে ভুলু এসে গেছে। ইঁদুরের চিৎপাত অবস্থা দেখে ওরা যেন হেসে উঠলো, ‘খেঁক খেঁক খেঁক।’ তারপর বলল, ‘এই যা যা, এই ঘর মুখো আর যেন তোদের কোন দিন না দেখতে পাই। পশুপাখি নিজেদের কথা, হাবভাব, ডাক বুঝতে পারে। আওয়াজ ধারণা করে নিতেই পারে। কুকুরগুলি চুপ করে গেছে। তা দেখেই ধেড়ে ইঁদুর দুটো উঠে দাঁড়িয়ে দে ছুট। ওরা একেবারে লাল বাবুর বাড়ি থেকে এক শ হাত দূরে গিয়ে তবে থামে। তারপর বলে, ‘আর কোনদিন ও বাড়িমুখো হবো না।’

এ রকম আশপাশের বিড়ালদের অবস্থাও তাই। ওরা শুরু-শুরুতে লাল বাবুর বাড়ি গিয়ে চুরি করে খাওয়া দাওয়া করেছে। কিন্তু এখন পারে না, কারণ ওই লালু-ভুলু। তবুও মেনি বিড়াল নিজেকে চালাক ভেবেছিল। বলেছিল, ‘তোরা পারলি না তো ? দেখ আমি লালু-ভুলুকে ফাঁকি দিয়ে ওদের ঘরে কি ভাবে যাই ! ওর ঘর থেকে আমি মাছ-দুধ খেয়ে তবে আসবো।’

–‘চ্যালেঞ্জ রাখো তা হলে ?’ ভীতু বিড়ালরা লেজ উঠিয়ে বলেছিল।

মেনি সে দিন হাত বাড়িয়ে সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল। তারপরের ঘটনা ছিল এই রকম–

মেনি বিড়াল সন্ধ্যের পর আড়ি পেতে থাকলো। লালু-ভুলু তখন বাড়ির পেছনের দিকে ছিল। এ সময় মেনি বিড়াল পা টিপে টিপে এগোল।  তখন ও লাল বাবুর ঘর ছুঁইছুঁই করছিল। ঠিক এমনি সময় বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে লালু-ভুলু এসে হাজির। মেনী বেড়াল ভয় পেয়ে গেলো, মনে মনে বলল, বাপ রে  লালু-ভুলু  কেমন কুকুর রে বাবা ! কি ভাবে টের পেয়ে গেলো ? আমাদের বিড়াল থেকেও দেখছি ওদের ঘ্রাণশক্তি অনেক বেশি !

–‘এই এই এই, কোথায় যাচ্ছিস তুই ?’ ভুলু বলে ওঠে।

লালু বলল, ‘চোর কাঁহিকা !’

মেনি জানে কুকুর একটা হলে চলত। কিছু সে করতে পারতো কিন্তু ওই দুই দুইটা আহাম্মককে সামলানো বড় মুশকিল ! মেনি তবুও ওদের সামনে দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করল, বলল, ‘এই দেখ ভাই, তোদের একটা কথা জানাতে এসেছিলাম। আসলে তোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে চেয়েছিলাম।’

–‘কোনও কথা না, যা ভাগ, বাতালা ছাড়তে হবে না, চুরি ছাড়া তো আর কিছুই জানিস না তোরা !’ লালু এ কথা বলেছিল।

মেনী বলল, ‘তোদের আমার ভালো লাগে তাই–’

ভুলু বলেছিল, ‘কি ভালো লাগে, বল ?’

মেনী বেড়াল বলেছিল, ‘তোদের প্রভুভক্তি, কাজের ওপর নিষ্ঠা, এসব দেখে আশ্চর্য হই ! তাই এসেছিলাম তোদের সঙ্গে চুপিচুপি মিলতে।

ভুলু বলল, ‘চুপিচুপি কেন ?’

–‘আরে আমাদের হুলো, মিনি ওরা সবাই বড় চোর, আমি আসবো জানলে সবকটা আমার পেছন নিতো। তারপর চুরি করে আমার বদনাম দিত।’

ভুলু একটু নরম হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, কি চাস বল ?’

লালুর পছন্দ হচ্ছিল না, বলল, ‘মেনীর কথা সব মেকি, না, না, কোনও কথা আমরা শুনব না। আগে এখান থেকে তুই বেরো !’

অবস্থা খারাপ বুঝে মেনীকে ফিরে আসতে হল। ওর চ্যালেঞ্জ বিফল হয়েছিল।  সে জন্য তাকে মিনি, হুলোদের একটা একটা করে চুরি করা মাছের টুকরো দিতে হয়েছিল। মেনীর মনের দুঃখ মনেই রয়ে গিয়েছিল। মেনীর মনে হয়েছিল, ওই লালু কুত্তাটা মোটেও ভালো না। ভুলুটা তবু নরম হয়ে এসেছিল। আসলে দুনিয়ায় যে যার মতলব নিয়ে থাকে দেখছি !

 

দ্বিতীয় পর্ব : ঝিল ও পিপুল জঙ্গল

লাল বাবুর বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে আছে এক মন্দির। তার নাম মহাদেব মন্দির। এখানে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা আসে। মন্দির ও তার আশপাশটা দিনভর জমজমাট থাকে। তারপর সামান্য রাত হলেই সব শুনশান হয়ে পড়ে।  চারদিক জনশূন্য হয়ে যায়। পূজারীরা সন্ধ্যের সময় পূজা-আচ্চা সেরে ঘরের দিকে চলে যায়। আর রাতে পাহারার জন্য থাকে দু’চারজন পাহারাদার। এই মন্দিরের  সামনেই বড় রাস্তা। তারপর একটু এগোলে জঙ্গলের সীমানা শুরু হয়। আর সে জঙ্গল ধরে ক’পা এগোলেই পড়ে বেশ বড় একটা ঝিল। এই ঝিলে আছে বড় বড় মাছ, জলসাপ, কাঁকড়া আর কচ্ছপের দল। কচ্ছপের দল এখানে দলে ভারি। ঝিলে ওদের দৌরাত্ম্য কম নয়। ঝিলের  চার পার ঘিরে আছে হালকা জঙ্গল। জঙ্গলে ঝোপঝাড় আর তার মাঝে মাঝে বড় বড় দু’একটা গাছ। এ বনে আছে শেয়াল, সাপ, বন বিড়াল, সজারু, এ ছাড়া আছে কাঠবিড়ালি ও নানা পাখির দল। বাঘ, ভাল্লুক সাধারণত এ জঙ্গলে আসে না। ঝিলের এক কোনায় বাঁধা থাকে একটা নৌকো। সরকারী ঝিল বলে মিউনিসিপাল অফিস তার তদারকি করে। মাস-দু’মাস অন্তর অন্তর জেলেরা এতে মাছ ধরে। আর কখনও সখনও নৌকা বিহারে এসে পড়ে লোক। এ জন্যে নগরনিগমের অনুমতি নিতে হয়। আর বাকী সময় সে নৌকা জলের ওপর ভাসতেই থাকে।

এখানে দুই কচ্ছপের বেশ দাদাগিরি চলে। ওরা ছোকরা বয়সের। ওদের এক জন হল নট, আর একজন ঘট। এমনি নামগুলি বেশ প্রচলিত ওদের মুখে। এ সব শব্দগুলি চট করে ওদের  মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। নট-ঘট ভীষণ দুষ্টু প্রকৃতির। কারও কথা ওরা মানতে চায় না।

ঝিলের বড় মাছ হল গজাল মাছ।  ও ঝিলের সবচেয়ে বড় মাতব্বর। সবাই গজালকে খুব ভয় করে চলে। ওর কথা ঝিলের সবাই খুব মান্য করে চলে।  তবে নট-ঘট অনেক সময় মাতব্বরের কথাও মানে না। গজাল সে জন্যে ওদের শাস্তি দিতে পারে না। ওরা ছুটে ছুটে পালিয়ে যায়। এই তো সে দিনের কথা, নট-ঘটকে গজাল বলেছিল, ‘এই তোরা আমার জাতের কাউকে বিরক্ত করতে আসবি না যেন !’ কিন্তু কে, কার কথা শোনে ? নট-ঘট সে দিন গজালের নাতিকে এসে পেছন থেকে থাপা মেরে দিয়ে চলে গেল। নাতি বলে কথা, একে তো ছোট, সত্যি তার পিঠ ছড়ে গিয়েছিল। গজাল দাদুকে শেষে নাতি গিয়ে নালিশ করল। গজাল তখনই ডাকাল নট-ঘটকে কিন্তু কোথায় নট-ঘট ? ওরা তো কোথাও নেই ! নেই, নেই, নেই, তিন দিন তাদের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। তিন দিন পরে ওরা যখন গজালের কাছে এলো। নট-ঘট উল্টে বলল, ‘তোমার নাতি আমাদের দেখলেই মুখ ভেংচায়। আমাদের দেখলেই ও চোখ ঘুরাতে থাকে !’

গজাল বলল, ‘তাই বলে আমার নাতির সঙ্গে এমনটা–’

নট বলল ‘বিচারের সময় আমার নাতি, তোমার নাতি কি আলাদা নাকি গো ? তুমি মাতব্বর বলে বিচার তো আলাদা হতে পারে না ! বিচার তো সবার জন্য সমান হবে।’

গজাল তখন ওদের ওপর ধমক দিয়ে উঠেছিল। নট-ঘট আর কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘এই যে আমরা কান ধরলাম, উঠ বস করলাম। আর কোন দিন এমন হবে না।’

ওরা দু’তিনবার কান ধরে উঠ বস করেই ছুটে পালিয়ে গেল। ‘ব্যাটার ছেলেরা এ রকমই’, গজাল তা জানে। ওদের শাস্তি দেবার সুযোগই পাওয়া যায় না।

নট ও ঘট মাঝে মাঝে অন্যের উপকারেও আসে। এই তো সে দিন রুই মাছ অসুস্থ হয়ে পড়ল। মনে হয় ওর হার্টের বিমারী। ব্যাস জ্ঞান হারিয়ে ও একেবারে চিৎপাত ! বুড়ো কচ্ছপ কবিরাজ এলো। ওষুধ-পত্র দেয়া হল কিন্তু তাতে কিছু কাজই হল না। কবিরাজ কচ্ছপ শেষে বলল, ‘শাল ফলের রস চাই, তবে এ রোগের নিবারণ সম্ভব।’

শাল ফল ? সে আবার কোথায় পাওয়া যাবে ? ধারে-কাছে কোথাও নেই। ওই পিপুল জঙ্গলে নাকি দু’তিনটে শাল গাছ আছে। তবে এ সময় ফল পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। শাল ফল এনে দেবে কে ? ভেবে ভেবে অসুস্থ রুইয়ের দাদার মনে হল এ কাজ একমাত্র নট-ঘটরাই করতে পারে। নট-ঘটদের ডাকা হল। ওরা এসে দেখল অনেক জনের জটলা সেখানে। গজালও এসেছে রুইকে দেখতে। গজাল বলল, ‘এই নট-ঘট, তোরাই পারবি, দেখ শাল ফল কোথাও থেকে জোগাড় করে নিয়ে আয় !’ গজালের কথায় আদেশের সুর।

নট-ঘটের গজালের এমনি মাতব্বরি ভাল লাগলো না। নট কিছু না জেনেই বলে উঠল, ‘এখন শাল ফুলের সময় না।’

–‘এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না’, বলে গজাল মুখ ফেরাল।

এবার রুইয়ের বড় দাদা নট-ঘটের কাছে এসে ওদের পিঠে হাত রেখে স্নেহের সুরে বলে উঠলো, ‘বাবারা, দেখ না বাবারা, চেষ্টা করে–’

আর কিছু না বলে নট-ঘট রাজী হয়ে গেল। ওরা ঠিক করল সালের ফল ওরাই নিয়ে আসতে যাবে। তবে একটা দিন পরে যাবে।

পিপুল জঙ্গল অনেক দূরে। বন, লোকালয় পার করে যেতে হয়। সেখানে যেতে মাঝে লোকালয় পড়ে।  সে বন পাঁচমারি শহরের এক প্রান্তে। সেখানে যেতে হবে গভীর রাত হলে। নট-ঘট তা জানে। দিনের বেলা কিছুতেই সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। আর ওদের সবচেয়ে বড় শত্রু হবে গিয়ে মানুষ। এ ছাড়া আছে বনের শিয়াল আর লোকালয়ের কুকুর। কুকুররাও ওদের বড় শত্রু। নট ও ঘট আরও একবার গিয়েছিল পিপুল জঙ্গলে। ঝিলে তখন বড় এক শোল মাছের মরো মরো অবস্থা ছিল। ওরা তখন গিয়েছিল ওষুধ আনতে।  তখন ছিল শিমুলের ছাল নিয়ে আসার কথা। সেই পিপুল বনে যেতে বিশেষ বাধা তাদের পেতে হয়নি। কেবল ওই শহরের পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা বাড়ি থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছিল দুটো কুকুর। কুকুর দুটো কম বয়সের হবে। সব কিছু তখনও তারা বুঝে উঠতে পারে না। ওরা তো নট-ঘটদের অদ্ভুত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কুকুররা ওদের পাথরের টুকরো ভেবেছিল হবে। ‘কাউ কাউ’ শব্দ করে ওরা দূর থেকে লেজ নাড়িয়ে যাচ্ছিল। কুকুর দুটো ভয়ে ভয়ে ওদের দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল। প্রথমে তো খুব ঘেউ ঘেউ করে জোরে তেড়ে এসেছিল। মাঝে মাঝে ‘ঘর ঘর’ আওয়াজ করছিল। মুখ ঘুরিয়ে অদ্ভুত ভাবে নট, ঘটের দিকে তাকিয়ে দেখছিল।

এবার কি করবে ? নাট-ঘট ভাবছিল, দৌড়াবে নাকি ! না কি খোলের মধ্যে  ঢুকবে ? নট বলেছিল, ‘আরে দাঁড়া, ছুটিস না, ছুটলে না কি কুকুররা আরও তেড়ে আসে।‘

ঘট বলে উঠেছিল, ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা !’ বলে সে দৌড়ানো শুরু করেছিল। অগত্যা নটও বাধ্য হয়ে দৌড়াচ্ছিল। আর তাতেই ঘটে গিয়ে ছিল বিভ্রাট।  কুকুরগুলি ওদের পেছনে দৌড়ে এলো। মুখ দিয়ে ঘটকে প্রায় ধরে ফেলেছিল আর কি ! ঠিক এমনি সময় নট চীৎকার দিয়ে বলেছিল, ‘তাড়াতাড়ি খোলের মধ্যে ঢুকে চুপচাপ বসে থাক !’ তখন নট-ঘট দুজনেই চুপচাপ খোলের মধ্যে ঢুকে বসে ছিল।  কুকুরা দেখল, এটা আবার কি ?  একেবারে নড়ন-চড়ন নেই ! ঠিক যেন দু খণ্ড পাথর পড়ে আছে। একটা কুকুর সাহস করে একটা পাথর উল্টে দিয়ে দেখল, না, সে দিকটাও পাথর খণ্ড বলেই মনে হচ্ছে ! তবে এ দিকটা বেশী চকচকে বলে মনে হচ্ছে। অনেক ক্ষণ বসে ছিল কুকুরগুলো। শেষে ধৈর্য চ্যুত হয়েই বোধহয় ওরা ধীরে ধীরে ঘরের দিকে চলে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য নট-ঘটকে দু-একবার চিৎ করে, উপুড় করে, দেখে নিয়েছিল।

ব্যাস, ওই বাঁধা ছিল সে দিনের বাধা। তারপর ওরা শিমুল জঙ্গলে গিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে শিমুল ছাল তুলে নিলো। তার দুই চার টুকরো মুখে গুঁজে নিয়ে ওরা এক সাথে ফিরে এসেছিল। ফেরার সময় নট-ঘটদের ভীষণ ভয় ভয় করছিল। যদি ওই কুকুর দুটো আবার এসে হাজির হয় ? না, শেষ পর্যন্ত ওদের কবলে আর পড়তে হয়নি। তবে হ্যাঁ কুকুর দুটোর নাম ওদের জানা হয়ে গিয়েছিল। ওরা তখন শিমুল ছাল নিয়ে ফিরছিল। সেই লোকালয়ের পাশ দিয়ে চলছিল। শেষ রাতেই ওর মালিক হবে বাইরে বেরিয়ে ছিল। বেরিয়ে এসে কুকুরদের ডাক দিয়ে উঠেছিল, ‘এই লালু, এই ভুলু তোরা কোথায় গেলি রে ?’

 

দ্বিতীয় পর্ব :  ঈশান কোণের লাল মেঘ, গেঁড়ি-গুগলির খোঁজে 

এদিকে বর্ষাকাল এসে গেল। কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে গেছে।  বিকেল হতে না হতেই ঝড় শুরু হয়ে যায়।  আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে চারদিক। ক’দিন যাবত এমনি যাচ্ছে। দুপুরের পর থেকে শুরু হয়ে যায় ঝড়-জল। শোঁ শা শব্দে বাতাসের দাপট চলতে থাকে। পাতা ঝড়ে, গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে। এমন কি কখনও কখনও বড় বড় গাছ ভেঙে পড়ে। অনেক সময় সে সব গাছ চাপা পড়ে অনেক জীবজন্তুদের মৃত্যু ঘটে। এই তো গত বছরের ঘটনা। নট-ঘট কোন কাজে বেরিয়েছিল। কি কাজে যেন ? হ্যাঁ মনে পড়েছে। কিছু দিন যাবত ওদের ইচ্ছে হচ্ছিল গেঁড়ি-গুগলি খাবার। ঝিলের পাড়ে এক সময় গেঁড়ি-গুগলি ছড়াছড়ি ছিল। পাখিরা, কচ্ছপরা, এমনকি বিড়াল, ইঁদুর, শেয়ালেরা খেত। অনেক সময় মরা গুগলি জলে ভেসে থাকলে বড় মাছরাও তা ভেঙে ভেঙে খেয়ে নিত। এখন গেঁড়ি-গুগলির বড় অভাব। ঐ গেঁড়ি-গুগলি কাছের বনে অনেক খুঁজে পেতে কখনও কখনও তা পাওয়া যায়।  সে দিন নট-ঘট বেরিয়ে ছিল গেঁড়ি-গুগলি খেতে। ওদের অনেক দিন থেকেই খুব ইচ্ছে হচ্ছিল খাওয়ার। সে দিন তখনও ঝড় জল শুরু হয়নি। ওরা দুপুরে বেরিয়ে পড়েছিল বনের ঘন ঝোপঝাড়ের নিচে। যেখানে ভেজা ভেজা ভাব থাকে।          শ্যাঁদলা পড়ে যায়। সে সব জায়গাতেই থাকে গেঁড়ি-গুগলি দল। বড় সাবধান হয়ে থাকে ওরা। গাছপালার নড়াচড়া শুনতে পেলে তৎক্ষণাৎ নিজেদের ওরা গুটিয়ে নেয়। নিজেদের খোলার ভেতরে, না হলে মাটির গর্তে গিয়ে জাগা নেয়। বনে ঘুরতে ঘুরতে নট-ঘটদের বেশ সময় কেটে গেল। ওদিকে ঝড় বড় আকার ধারণ করেছে। বড় একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ওরা ভাবছিল, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু ঝড় যে আরও বেড়ে যাচ্ছে !

ঝড়ের দাপটে হঠাৎ ঘটে গেল একটা ঘটনা। হুড়মুড় শব্দ করে ওদের সামনেই ভেঙে পড়ল বিশাল এক বৃক্ষ। সে কি ভয়ংকর আওয়াজ তার ! নট-ঘট ভীষণ ভাবে চমকে উঠল। কানফাটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে ওরা নিজেদের দেহ ঢুকিয়ে নিলো নিজেদের খোলের ভেতর। মিনিট খানেক কেটে গেল। এভাবেই বাইরের শব্দগুলো ওদের কনে আর পৌঁছালো না। ওরা এবার ধীরে ধীরে নিজের খোল থেকে মুখ বের করল। আর সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল চারদিকের চীৎকার-চেঁচামেচি। কিছু পাখির কিচিরমিচির, কিছু শেয়ালদের হৈহল্লা হচ্ছিল। কি ব্যাপার ? বড় একটা গাছ ভেঙে পড়েছে। কিন্তু এত চেঁচামেচি শোরগোল কেন ? শেয়ালে হুক্কাহুয়া ডাকে কিন্তু ‘খ্যাঁক, খ্যাঁক, খ্যাঁক’ ডাকার মানে বুঝতে পারল না ওরা। কোন দুর্ঘটনা হবে।

নট-ঘট এবার ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল। ওরে বাবা–সেই বিরাট গাছটা চার দিকে ছড়িয়ে অনেকটা জায়গা নিয়ে পড়ে আছে ! ওর তলে চাপা পড়ে অনেক ছোট গাছ ঝোপঝাড় মাটিতে লুটিয়ে আছে। তখনও অনেকগুলি পাখি ‘খ্যাঁচ খ্যাঁচ’, করে যাচ্ছে। ওরা দেখল চারপাশে অনেক পাখি মরে পড়ে আছে।  চারদিক রক্তাক্ত হয়ে আছে। পাখির কিছু বাচ্চাও ডাল চাপা পড়ে মরেছে। আর আরেক দিকে শেয়ালদের জটলা চলছে। ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে  গেল নট-ঘট। ওরে বাবা, ওরা দেখল, দুটো শিয়াল ওদের থেকে সামান্য দূরে মরে পড়ে আছে। একটার মাথা ফেটে আছে, আর একটা শেয়ালের পেটের উপর গাছের মোটা ডাল চাপা পড়ে আছে। দুটো শেয়ালই একেবারে মরে গেছে ! নিশ্চয় শিয়াল দলের তখন মহা শোক চলছে। তাই বুঝি ওরা হুক্কাহুয়ার বদলে ‘খ্যাঁক খ্যাঁক’, শব্দ করে দুঃখ প্রকাশ করছিল। হয়ত এ ভাবেই ওরা দুঃখ বা কান্না প্রকাশ করে।

নট-ঘটের আর গেঁড়ি-গুগলি খাওয়া হল না। ওদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এতগুলো প্রাণ চলে গেল !  কে জানে ঝড়ে আবার যদি ওদের উপর কোন গাছ ভেঙে      পড়ে ! সে দিন নট-ঘট তাড়াতাড়ি জঙ্গল থেকে ফিরে এসে ছিল। ওদের মনটা খুব খারাপ ছিল। ওদের মাতব্বর কচ্ছপ মাথা দুলিয়ে বলেছিল, ‘কি ব্যাপার বাবারা, তোমরা চুপচাপ কেন ? হৈহল্লা নেই, মারপিট নেই, জাগাটা বড় শান্ত শান্ত লাগছে যে !’  মাতব্বর কচ্ছপের অনেক বয়স হয়েছে। প্রায় দেড় শ বছর তার বয়স হবে। ও দেখেছে অনেক কিছু তার সামনে দিয়ে হয়ে যেতে। কত বাচ্চারা বড় হল, কত জাঁদরেল মাছ, কচ্ছপ মারা গেল। কত বাচ্চা-বুড়োদের মরে ভুত হয়ে যেতে সে দেখেছে। কচ্ছপরা পাঁচ শ, ছ’শ বছর বাঁচে। সাগরে যে সব কচ্ছপ থাকে ওরা নাকি হাজার বছরও বাঁচে। ওদের দেখতে অনেকটা বড় পাথর খণ্ডের মত।

নট মাতব্বরের কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, ‘তাই না কি ? তুমি তা হলে নাচো না, নাচো, গান গাও, গলা পাঠাও !’

মাতব্বর কচ্ছপ, হেসে বলল, ‘ওরে বাবা, বাবা তুমি দেখছি রেগে গেছ ?’

ঘট বলল, ‘রাগবে না কেন ? একে তো এতগুলো প্রাণ অকালে মারা পড়লো, আমাদের মন খুব খারাপ।’

এবার মাতব্বর কচ্ছপ ওদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে উঠল, ‘কি হয়েছে বাবা ?’ নট এবার  গলা ঝেড়ে নিয়ে কচ্ছপ দাদুকে জঙ্গলের গল্প বলে গেল। মাতব্বর কচ্ছপ বলল, ‘ও তো হয়      বাবারা ! এর জন্য এত মন খারাপের কি আছে ? ওই শেয়ালরা তো বলতে গেলে আমাদের শত্রু। ওদের কি হল আর কি গেল তাতে আমাদের কি ?’

ঘট বলল, ‘তুমি কি বুঝবে ? শেয়ালগুলো যে ভাবে কাঁদছিল, আমরা তা দেখেছি। ওদের দলের কয়েকটা শেয়াল গাছ চাপা পড়ে মরেছে। সে রক্ত মাংস মিলিয়ে কি ভয়ংকর সব দৃশ্য।’

নট বলল, ‘আর কতগুলি পাখিও মরেছে, ওদের কান্নার আওয়াজ বুকে বড় লাগছিল !’

–‘এই সব কিছু দেখে-শুনে আমরা বড় হয়েছি। ওসব আমাদের প্রাণে লাগে না  রে–তোরা বরং মন খারাপ ছেড়ে আনন্দ কর, হৈহল্লা কর।’

এ তো গেল গেঁড়ি-গুগলি খাওয়ার গল্প।

 

তৃতীয় পর্ব : পিপুল বনের অভিযান

রুই মাছের অবস্থা ভালো না। সে একেবারে চুপ মেরে গেছে। তার নাড়াচাড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এবার বুঝি তার চিৎ হবার পালা। আর, একবার চিৎ হয়ে গেলে নাকি মাছরা আর বাঁচে না। নট-ঘটদের তখনই বের হবার কথা। সেই পিপুল বনে। নট-ঘটদের এখনই পিপুল জঙ্গলের দিকে বের হতে হবে। সেখান থেকেই ওদের আনতে হবে শাল ফল। বড় ডানপিটে এই নট আর ঘট। যাকে বলে বড় নটখট, চূড়ান্ত দুষ্টু। কিন্তু ঐ খারাপ সময় ওরাই কাজে আসে। অসাধ্য কাজগুলি ওরাই স্বেচ্ছায় করে। জীবনের ভয় খুব একটা ওদের নেই। রুই দাদুকে বাঁচাতে হবে। বয়সে বেশি বড় বুড়ো হলেই ওরা তাদের দাদু বলে ডাকে। ঝিলের প্রতিবেশীরা যেমন একে অন্যের শত্রু তেমনি অসময় এলে ওরা একে অন্যের মিত্রও বটে। এই যে ঝিলের গজাল মাছ, খিদে পেলে ও গবগব করে মাছের পোনা গিলে খায়। ব্যাং, কচ্ছপের ডিম এসব খায়। তাই সবাই ওকে ভয় ও সমীহ করে চলে। ওর কথা বাধ্য হয়ে সবাই শোনে। নট-ঘট মাঝে মধ্যে তার প্রতি একটু তাচ্ছিল্যের ভাব দেখায়। সেটা ইচ্ছে করেই করে, ওদের স্বভাবের দোষই হবে এটা।

যাই হোক এবার নট-ঘটের যাত্রা শুরু হবে। পিপুল বনে ওরা সালের ফল আনতে যাবে। মাঝরাতে তাদের রওনা দিতে হবে। মাঝ রাত হলে ওরা নিরাপদে মনুষ্য লোকালয় পার করে যেতে পারবে। ওরা দেখেছে মানুষ ওদের কম বড় শত্রু নয়। ওরা অনেকেই কচ্ছপের মাংস খায়। ওদের বাজারে নিয়মিত কচ্ছপ বিক্রি হয়।

ঝিলের জঙ্গল পার করতে ওদের বেশি বেগ পেতে হল না। এখানের খেঁক শিয়ালগুলি বড় নাছোড়বান্দা। ওরা তাকে তাকে থাকে,  মাথা বের করা কচ্ছপকে কখন ধরতে পারবে বলে। মাথা বের করা থাকলে তবেই ওরা কচ্ছপকে মেরে খেতে পারে। তা না হলে কচ্ছপ খোলে ঢুকে থাকলে শেয়াল কিছুই করতে পারে না।

পথে একটা ঘটনা ঘটে গেল। নট-ঘট ওরা জানে, এই ঝিল জঙ্গলের দশ হাত অজগরের কথা। ও বুড়ো হয়ে গেছে। এখন গাছে থেকেই নাকি শ্বাস টেনে ছোট ছোট শিকার ধরে খায়। অজগরের চলতে ফিরতে বেশ কষ্ট হয়। নট বলল, ‘এই পাশেই তো দশ হাত অজগর থাকে–ওকে একবার দেখতে যাবি নাকি ?’

ঘট বলল, ‘চল একবার দেখতেই যাই–’

সামান্য পথ গেলেই সে বড় বট ঝাড়। অনেক জটাজুট ছড়িয়ে ঝাঁপরা  অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারই এক পাশের আড়ালে মোটা এক ডাল  জড়িয়ে পড়ে থাকে অজগর।

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল নট-ঘট। ওই বট গাছ দেখা যাচ্ছে। বাইরের চাঁদের আলো বট গাছের ডালপালা গলিয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। চারপাশে জটা ছড়িয়ে মূল গাছটা একেবারে ঘিরে ফেলেছে। মনে হয় একটা গোল ঘরের সৃষ্টি করেছে। নট-ঘটের সত্যিই ভয় ভয় হচ্ছিল। ওদের মনে হল যদি অজগর গাছের গোড়ায় নেমে বসে থাকে তবে তো ওদের ধরে গিলে খেয়ে নিতে পারে। ওরা শুনেছে একবার ও না কি এক শিয়ালের বাচ্চা গিলে ফেলে ছিল। শেয়ালরা নাকি তা জানতেও পারেনি।

‘ঘস ঘস, সাঁ শাঁস, এমনি শব্দ হচ্ছিল। নট বলে উঠলো, ‘এই ঘট সাবধান ! অজগর আশপাশে কোথাও আছে।’

অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছিল না। চাঁদের আলো এ জায়গা ও জাগায় সামান্য ছিটেফোঁটা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে বটে ! হঠাৎ ঘটের নজরে এলো, সে চিৎকার করে উঠলো, ‘ওই যে নট তোর মাথার কাছে অজগর !’

নট ঝটপট করে লাফ দিয়ে সরে দাঁড়ালো। ঘট বলল, ‘আজ তোকে ধরে ফেলত, নেহাত ওর মুখে কিছু একটা ছিল হবে। তাই ঘস ঘস শব্দ হচ্ছিল। আমি বুঝতে পেরে গেলাম।’

নট খুব বাঁচা বেঁচে গেল। দূর থেকে ওরা অজগরকে দেখছিল। আধ অন্ধকারেও ওদের মনে হল অজগর অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। ওর মোটা চেহারা অনেক সরু হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই ও তেমন খাওয়া-দাওয়া পায় না। নট বলল, ‘আর বেশিদিন বাঁচবে না রে ও।’

ঘট বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়।’

ঠিক এমনি সময়ে ধপাস করে একটা শব্দ হল। নট-ঘট চমকে উঠলো, কি হল ? কি হল ? ওরা দেখল অজগর গাছের নিচে পড়ে গেছে। কেমন যেন ফাঁস ফাঁস শব্দ হচ্ছিল। অজগর শরীর খুব ঝাঁকাচ্ছিল।

নট বলল-‘চল ঘট, আমরা পালিই। ওই দেখ না আমাদের ধরবে বলে ও কেমন নড়েচড়ে উঠছে !’

ঘটের মনে হল এমন তো নয়, গাছ থেকে ও পড়ে গেছে। অন্যদিকে অজগর ভীষণ ছটফট করতে করতে একেবারে চুপ মেরে গেল। নিশ্চল হয়ে গেল সে। ঘট বলল, ‘এই নট, এই, অজগর মরে গেল না তো ? একেবারে চুপ হয়ে গেছে, ব্যাপার কি ? চলতো একটু ধারে গিয়ে দেখি।’

নট বলল–‘না রে–ও ভান করে পড়ে নেই তো ? আবার আমরা কাছে গেলাম শেষে গপ করে ধরে আমাদের গিলে খাবে না তো ?’

না, বেশ সময় ধরে অজগর আর নড়াচড়া করছে  না। নট, ঘট এবার ধীরে ধীরে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল অজগরের কাছে। ওর দেহ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কেমন বিকৃত হয়ে আছে। দেখলেই মনে হচ্ছে, অজগর মরে পড়ে আছে !

–‘চল, চল, আর এখানে থাকতে আমার ভয় করছে’, ঘট বলল।

ওরা আবার রওনা দিল পিপুল জঙ্গলের দিকে। এত সময় ওরা ভুলেই ছিল যে ওদের পিপুল জঙ্গলে যেতে হবে।  নট-ঘট ছুটে চলেছে। প্রায় ঘন্টাখানেক লাগবে পিপুল জঙ্গলে পৌছাতে। রাত কত বাকি আছে কে জানে ! আর কোথাও অপেক্ষা করা চলবে না। ওই যে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ওখানে রাস্তার ধারের খাম্বায় খাম্বায় বাতি জ্বলছে। চারদিক নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে। কেউ যেন এখানে বেঁচে নেই, এ যেন কোন এক মৃত নগরী ! ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল। ওদের একপাশে বড় রাস্তা।তারপর লোকালয় শুরু হয়েছে। লোকালয়ের ভিতর দিয়ে গেলে পিপুল জঙ্গলে সহজে পৌঁছানো যায়। কিন্তু ওখানে বড় বাধা, ওই দুই কুকুর, লালু-ভুলু  ওখানে বাস করে। ওরা ওদের দেখতে পেলে আর ছাড়বে না। ওই দিন তো কোন মতো ওদের কাছ থেকে ওরা পালিয়ে বেঁচেছিল।

–‘কোন ঘরটা যেন ওই লালু-ভুলুর ?’ ঘট প্রশ্ন করল।

‘রাস্তার পাশেই হবে রে’. বলল নট।

বনের অন্ধকার এখন আর নেই। লোকালয়ের পথের রাস্তায় আলো জ্বলছে। যদিও জোরালো আলো না। তবে নিঝুম নিঝুম চারদিক। দ্রুত হেঁটে চলেছে নট-ঘট। আর বেশি পথ নেই। মিনিট পনেরো আরও লাগবে। দূরে একটা কুকুর ডেকে উঠল। ওরা ভয় পেল, আরও জোরে জোরে ছুটতে লাগলো। ওদের লোকালয় তাড়াতাড়ি পার হয়ে যেতে হবে। ঘট বলল, ‘এ ডাক মনে হচ্ছে লালু-ভুলুদের হবে–আমাদের দিকে তাকিয়ে হয়ত ডেকে উঠেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘট প্রশ্ন করল, ‘রাত কত বাকি আছে রে ?’

নট তাকাল আকাশের দিকে। চাঁদ ছিল প্রায় আকাশের শেষ সীমানায়। চাঁদ অনেকটা ঢলে পড়েছে। তার মানে খুব বেশি রাত বাকি নেই। মোরগ ডাকার সময় অবশ্য এখনো হয়নি। এবার লোকালয় পার করে ওরা পিপুল জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছালো। আরও বেশ খানিক জায়গা পার করে শাল গাছ পাওয়া যাবে। কয়েকটা শাল গাছ প্রায় পাশাপাশি বলা যায়। এ জঙ্গলে সাপের উপদ্রব বেশি। ঘটের মনে পড়ে গেল. অজগরের কথা। ওটা আজ মরে গেল।

এক পাল শেয়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। ওরা আবার পা টিপে টিপেই এগুলো। শেয়াল চট করে ওদের কিছু করতে পারে না। তবে বেকায়দা হলে অবশ্য ওরা মুখ কামড়ে ধরতে পারলে সবই করতে পারে। নট-ঘট জানে ওদের থেকে বাঁচার উপায়। সময় হয়েছে শেয়ালগুলির, হঠাৎ ওপরের দিকে মুখ করল ওরা, আর ডাক দিয়ে উঠল।  হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া, শেয়ালগুলি একের পর এক ডেকে উঠল। ওরা কিছু সময় ডাকল। এটা শেয়ালের শেষ প্রহরের ডাক হবে।

নট-ঘট দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ওদের ডাক থামলে তারপর ওরা আবার চলতে লাগলো। বেশি দূরে নয়, মনে হল সামান্য দূরেই দাঁড়িয়ে আছে দু একটা শাল গাছ। শাল গাছ এসেই গেল। এবার দেখতে হবে ফল, ফল কি এ সময় হয় ? কবিরাজ দাদু বলেছে, ‘হয়, এটা হল ফল ধরার সময়, ফুল সব ঝরে গেছে, ফলের  গুটি ধরেছে।’

ওরা এসে গেলো শাল গাছের তলায়। এ সময় গাছের দিকে তাকিয়ে কিছুই ঠাওর করা যাবে না। না ফল, না পাতা, কালো জট পাকানো অন্ধকারই দেখা যাচ্ছে। নট-ঘট নিচে মাটিতে দেখল, শুকনো ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে আছে। ওগুলি শুকিয়ে শুকনো পাতার মত হয়ে আছে।

–‘কিন্তু ফল পাব কি করে ?’ ঘট বলে উঠল।

নট খুঁজতে খুঁজতে বলে উঠল, ‘পেয়েছি, পেয়েছি কিন্তু তা যে একেবারে শুকিয়ে আছে। একেবারে হরিতকীর মত !’

ঘট আবার বলে উঠল, ‘একটা দুটো নিয়ে চল আমাদের ফিরতে হবে !’

বেশি সময় লাগল না। ওরা কয়েকটা ফল মুখে কামড়ে ধরে নিলো। এবার ফেরার পালা। ভোরের আলো ফোটার আগে ওদের লোকালয় পার করে জংগলে ঢুকতে হবে। না হলে মানুষগুলি উঠে যাবে আর ওদের একবার দেখে নিলে আর উপায় নেই। ধরে নেবে, ধরে নেবে খাওয়ার জন্য। আর ওই লালু-ভুলু তো আছেই। ওদের নামগুলি যত ভালো আসলে ওরা ততটাই কঠোর। ওরা ঘেউ ঘেউ এত জোরে করে যে নট-ঘটের খোলার ভেতরে পর্যন্ত গুমড়ে ওঠে ! অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল নট-ঘট। লোকালয় শেষ হতে চলেছে। লালু-ভুলু উপদ্রব থেকে বেঁচে গেল বুঝি ওরা। আর ঠিক এমনি সময় কিছুটা দূরেই হবে দুটো কুকুর ডেকে উঠল। আর কুকুরগুলি দৌড়ে এসে গেলো ওদের দিকে। নট-ঘট একেবারেই বুঝতে পারলো না। এতদূর থেকে কুকুরগুলি ওদের কি করে টের পেয়ে !

লালু-ভুলু ওদের বেশ কাছে এসে দাঁড়ালো। একটু মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওদের দেখল। আর এ কি ! ঘটের একেবারে সামনে এসে তার মুখ কামড়ে ধরতে চাইল।  কিন্তু ঘট মুহূর্তে তাঁর মুখ খোলায় ঢুকিয়ে নিলো। নট, ঘট থেকে একটু এগিয়ে ছিল। সে তাড়াতাড়ি নিজেকে একটা গাছের আড়াল করে নিয়েছে। লালু-ভুলু এবার ‘ঘেউ ঘেউ’ করতে করতে চারদিক শুঁকতে লাগল। মনে হয় ওরা অন্য কচ্ছপ নটকে খুঁজছিল। নট অনেক বড় গাছের শিকড়ের নিচে ঢুকে গেছে। কুকুর দুটো অদ্ভুত, নটকে না পেয়ে ওরা এবার ঘটের কাছে এসে তার চারদিকে ঘুরতে লাগলো। আর ‘ঘেউ ঘেউ’ করতে লাগলো। ঘট নিজের খোলার মধ্যে চুপ করে বসে থাকল। কিন্তু চকিতে ঘটনাটা ঘটে গেল। কুকুর লালু আচমকা ঘটকে কামড়ে ধরে নিয়ে এলোপাথাড়ি ছুটতে লাগলো। কি হচ্ছে ব্যাপারটা ? এমন একটা ভাব, মনে হচ্ছিল যেন ঘটকে নিয়ে লালু-ভুলু ওরা  খেলে বেড়াচ্ছে। কি হচ্ছে ঘট তার খোলের ভেতর থেকে কিছুই বুঝতে পারছিল না। কুকুর খেলছে ওদের খেলা আর অন্যদিকে ঘটের প্রাণ যায় আর কি ! কি যে হবে ? তবে এটুকু ঘট বুঝতে পারলো ওর খোলে সুরক্ষা থেকে বেরোলেই ওর মহা বিপদ। লালুর পেছনে ছুটছে ভুলু।

এবার লালু একছুটে পৌঁছে গেল ঘরে। লাল বাবু সকালে নিম দাঁতন করছিল। এমনি সময় লালু-ভুলু দৌড়ে উঠে এলো ঘরের বারান্দায়। লাল বাবু কুকুরদের দেখে, বলে উঠল, ‘সকাল বেলা তোদের এত মস্তি কেন ?’ বলেই এবার তার চোখে পড়ল, লালুর মুখে একটা কচ্ছপ না? হ্যাঁ, তাই তো।

লাল বাবু ডাক দিল, ‘এই লালু ?’

লালু মুখের কচ্ছপ নিয়ে এক পাক খেয়ে মালিকের কাছে হাজির হল। সে মালিককে দেখিয়ে ‘ঘেউ ঘেউ’ করে কিছু যেন বলতে চাইল। কুকুররা বেশ উত্তেজিত।

লাল বাবু অনেকটা আদেশের সুরে ডাক দিল, ‘এই. এটা রাখ নিচে !’

লালু তাও একটা চক্কর খেয়ে নিলো। তারপর কচ্ছপটা লাল বাবুর সামনে এনে রাখল। সকাল বেলায় চেঁচামেচি শুনে লাল বাবুর স্ত্রী বারান্দায় বেরিয়ে এলো।  কিছু আন্দাজ করতে না পেরে বলল, ‘কি হল গো–সাত সকালে কুকুর নিয়ে পড়েছ কেন ?’

লাল বাবু মুখে হাসি নিয়ে বলল, ‘ওই দেখো, লালু কি ধরে নিয়ে এসেছে ?’

–‘কি ?’ বলেই লাল বাবুর স্ত্রী কচ্ছপকে দেখে ভয়ে  দু’পা সরে গিয়ে বলল, ‘ওরে বাবা কচ্ছপ !’

–‘ওটাকে কোথাও  রাখতে হবে’, লাল বাবু বলল।

–‘কি হবে ওটা দিয়ে ?’ লাল বাবুর স্ত্রী বলে উঠলো।

–‘খাবো–বহুদিন কচ্ছপ খাই না গো !’ লাল বাবু বলে উঠলো।

–‘আমি ওসব খাই না, তুমি রান্না করে খাবে, ’ লাল বাবুর গিন্নি বলে উঠল।

লাল বাবু বলল, ‘তাই হবে, একদিন না হয় কচ্ছপ রান্না করে বাপ-বেটা মিলে খাব।’

বেটার কথা বলতেই বেটা হাজির হল। ও শুরুতে ঘট, কচ্ছপকে দেখতে পায়নি। ও একেবারে পায়ের কাছে কচ্ছপ পড়ে থাকতে দেখে যেন আঁতকে উঠলো, বলল, ‘ওরে বাবা কচ্ছপ !’

লাল বাবু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ কচ্ছপ রান্না করে তুই আর আমি খাব।’

–‘না না আমি খাব না’, বেটা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল। লাল বাবুর মনে পড়ল, বহুদিন আগে দেশের বাড়ির পাশে ছিল ডোবা। সেটা  থেকে তার বন্ধু ধরে এনেছিল এক কচ্ছপ। তার ঘরে কেউ রান্না করবে না বলে সে নিয়ে এসেছিল লাল বাবুর ঘরে। সে দিন কচ্ছপ কাটতে গিয়ে কচ্ছপ বন্ধুকে কামড়ে ধরে ছিল। সে কচ্ছপের সে কি কামড়। ওর আঙুল থেকে দরদর করে রক্ত পড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুর সে কি চিৎকার ! ব্যথায় চিৎকার করছিল বন্ধু। লাল বাবু কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তার শুধু মনে হচ্ছিল যে মেঘ ডেকে উঠলে তবেই নাকি কচ্ছপ তার কামড় ছাড়ে। শেষে চিৎকার-চেঁচামেচিতে লাল বাবুর মাথা খেললো, সে তার সামনে রাখা কচ্ছপ কাটার ছুরি হাতে তুলে নিলো। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে কচ্ছপের গলা পুঁছিয়ে কেটে দিল। বন্ধুর আঙুল থেকে রক্ত ঝরছিল। ওষুধ ব্যান্ডেজ করে সে দিন কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল লাল বাবু, বলেছিল, ‘এ কচ্ছপের কি হবে ?’

কাটা আঙুল নিয়ে বন্ধু রেগে চোখ লাল করে বলেছিল, ‘এ কচ্ছপকে খেতেই হবে।’

মনে আছে সেদিন লাল বাবুর কচ্ছপের মাংস ভালো লেগেছিল। বন্ধু তার রাগে কচ্ছপের ছোট ছোট হাড্ডিগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে গুঁড়ো করেছিল।

লাল বাবু ঘটকে ধরে এক খালি বালতিতে রাখল। বালটির ওপর চাপিয়ে দিল কাঠের ওজনদার  পিঁড়ি। মনে মনে ভেবে নিলো, কাল বাদে পরশু এটাকে খাব।  দরকারে কোন বন্ধুকে ডেকে নিয়ে আসব। একটা জিনিস একেবারে একা খেতে যে ভালো লাগে না!

 

চতুর্থ পর্ব : ঘটের কি মৃত্যু হল ?

এদিকে নট একা। সে শুরুতে কিছুই বুঝতে পারছিল না। কি ব্যাপার ঘটে গেল বলে। ঘট কোথায় গেল ? অনেক ডাকাডাকি করল সে। এদিক-ওদিক খুঁজে ওকে পেল না। এবার, এবার কি হবে ? ঘটকে নিশ্চয়ই ঐ কুকুরগুলি ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঘট মুখ খুললে ওরা ওকে ধরে খেয়ে নেবে। না খেলেও মেরে ফেলবে।  ভোর হতে চলেছে, জঙ্গলের বাইরে নিরাপদ নয়। তবে সে যাবে না, এ জায়গা ছেড়ে সে এক পা’ও নড়বে না। ঘটকে না নিয়ে সে ফিরে যাবে না–কিছুতেই যাবে না। নটের নিজেকে খুব দুর্বল বলে মনে হল। ওর বুকের ভেতর থেকে কান্না ঠেলে আসতে লাগল। সে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেল।  বাইরে থাকা মোটেও নিরাপদ নয় কিন্তু ও ঠিক করেছে ঘটতে না নিয়ে ও আর ফিরবে না।

ঘটের একটা ভয়ঙ্কর রাত পার হল। এদিকে আর এক দিন পরেই ঘটের মৃত্যু হবে। লাল বাবু তাকে কেটে খাবে। সে একাই নাকি খাবে। সম্ভব হলে কোন বন্ধুকে ডেকে নেবে বলেছে। ঘটের ডানপিটে ভাব কোথায় গেল এখন ? সে চুপ মেরে গেছে। একমাত্র নিজের মৃত্যুর কথা ছাড়া আর কোন ভাবনাই তার নেই। সে বড় বালটিতে মোটা কাঠের পিঁড়িতে ঢাকা পড়ে আছে। শুরুতে সে কাঠের পিঁড়িতে অনেকবার ধাক্কা দিল। না কোন ভাবে পিঁড়ি নাড়ানো গেল না।  ঘট না পেরে শেষে ক্লান্ত হয়ে চুপ হয়ে গেল।  ওকে লালু-ভুলু বাইরে থেকে এসে দেখে গেল। বালটির পাশে এসে দু-একবার ‘ঘেউ ঘেউ’ শব্দ করে চুপ করে গেল। কুকুরের শব্দ শুনে ঘট বালতির মধ্যে চুপচাপ পড়ে রইল।

মাঝে নটের কথা তার মনে এলো। ঘট আপন মনে বলে উঠল, ‘নট, বন্ধু আমার, বাঁচা বুঝি আমার আর হল না !’ ঘট কেঁদে উঠলো। তারপর আবার পিঁড়ি ঠেলে বের হবার চেষ্টা চালাল সে। পিঁড়ির শব্দে লাল বাবুর ছেলে বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, ‘মা, বাবা যে কেন এটাকে এখানে রেখেছে ! বারবার কি বিচ্ছিরি আওয়াজ হচ্ছে দেখো?’

–‘কি জানি বাবা, তোর বাবার কথা বুঝি না কিছু !’ মা বলে উঠল।

ছেলে এবার বলল, ‘এটাকে ছাদে রেখে দিয়ে আসছি।’

–‘কচ্ছপ পালিয়ে গেলে আমায় আবার কথা শুনতে হবে, বালটির ওপর পিঁড়ি ভাল করে চাপা দিয়ে রাখিস’, মা বলল।

ছেলে তারপর বালটি পিঁড়ি ঢাকা দিয়েই ছাদে নিয়ে রেখে এলো। বালটির নাড়াচাড়া দেখে ঘটের মনে হল যে এই বুঝি তার জীবন শেষ হবে ! তারপর আবার স্থির হল সে। ঘট বুঝলো, তাকে অন্য জায়গায় এনে রাখা হয়েছে। কিন্তু কোথায় তা জানার কোন উপায় নেই। আর জেনেই বা কি হবে ? এ বাধা সে অতিক্রম করতে পারবে না।

সন্ধ্যে নেমে এলো। ঘট কিছুই বুঝতে পারছে না। মাঝেমধ্যে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পারছে সে। কুকুরদের ছাদে অগাধ গতি। ওরা যে মাঝে মাঝে ওর বালটির পাশে এসে নিরীক্ষণ করছে তা সে বুঝতে পারছিল। ঘট বেরোবার প্রচেষ্টায় লেগে ছিল। ওর বালটিতে সমানে  শব্দ হয়ে যাচ্ছিল।

রাত নেমেছে, ঘট তা বুঝতে পারল। বোঝা গেল লালু-ভুলুর দৌরাত্ম শুরু হয়ে গেছে।  নিচে ঘরের আশপাশে, এমনকি ছাদে এসে ঘুরতে লাগলো ওরা।  অচেনা লোক দেখলে ওরা ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে হল্লা করতে থাকে। রাতে হঠাৎ ঘটের মনে একটা বুদ্ধি এলো। ও বহু সময় চুপ থেকে মাঝরাতের দিকে বালতিতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো আর বারবার পিঁড়িতে ঠেলা দিতে লাগল। তাতে বারবার শব্দ হতে লাগল। ও ইচ্ছে করে মুখ দিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলতে লাগল। সাঁ সাঁ মত শব্দ করতে লাগল। এতে কাজ হল। শব্দ শুনে লালু-ভুলু উঠে এলো ছাদে। ওরা বালটিতে নানা রকম শব্দ হতে দেখে ‘ঘেউ ঘেউ, কুঁই কুঁই আওয়াজ  করতে লাগলো। তারপর একটা কুকুর তার সামনের পা তুলে পিঁড়ি নাড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করল। বারবার পিঁড়িতে থাপা মারার সময় ধপ করে পিঁড়ি গেল পড়ে। এবার ঘট চুপ মেরে মরার মত খোলের ভেতর পড়ে রইল। কুকুর বালটি, পিঁড়ি তুলতে পারবে না, ঘট তা জানে। তাই হল, কুকুররা কুঁই কুঁই করে কিছু সময় বালটির কাছে বসে থাকল।  দেখল ঘট শক্ত হয়ে বসে আছে। তাই দেখে ওরা যেন নিশ্চিন্ত হয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেলো। ঘট সবকিছু বুঝতে পারছিল। এবার, এবার তাকে পালতে হবে।  সে জন্য অনেক লাফালাফি ঝাঁপাঝাপি করতে হবে। তাই করলো কচ্ছপ ঘট। ও লাফ-ঝাঁপ দিতে লাগলো। বালটি উল্টে পড়ল না। ঘট ভাবল, না, গায়ের জোর দিয়ে লাফাতে হবে। তার যে আজ জীবন-মরণ সমস্যা। ঘট বুঝল আর গায়ে সমস্ত জোরে নিয়ে বালটির ওপর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যস, এতেই কাজ হল। বালটি ছাদে কাত হয়ে পড়ল। ঝনঝনাৎ শব্দ হল। তখন গভীর রাত। কারও জাগার কথা নয়। তবে লালু-ভুলু তো টের পাবেই। ওরা ‘ঘেউ ঘেউ’, করে উঠে আসছে এদিকে। ঘট  নিজেকে বাঁচাতে দৌড়চ্ছে। আপাতত সে গিয়ে ঢুকল জলের ট্যাঙ্ক আর ছাদের আলসের মাঝখানটাতে। সেখানে কুকুরের মুখ পৌঁছাবে না। লালু-ভুলু ছুটে ছাদে এলো। ওরা বুঝতে পেরেছিল যে বালটি পড়ে গেছে। আর সেই কচ্ছপ নিশ্চয়ই পালিয়ে যাবে। ওরা ছাদে উঠে দেখল বালটি পড়ে আছে। তার মধ্যে মাথা নিচু করে দেখল, না কছুয়া তার মধ্যে নেই। পালিয়ে গেছে। লালু, ভুলু আবার ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠলো। তারপর শুঁকে শুঁকে ওরা পৌঁছল ঘটের কাছে। কিন্তু তাকে ধরবে কি করে ? ছাদের কার্নিশ ও জলের ট্যাংকের মাঝে সরু জায়গায় ওটা চুপচাপ বসে আছে। শেষে কুকুরগুলো বেশ কয়েক বার নানা রকম চিৎকার-চেঁচামেচি করে অনেক সময় সেখানে ঠায় বসে থাকলো। তারপর শেষ রাতের দিকে ধৈর্য হারিয়ে ওরা ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল।  আর তা বুঝতে পেরে বাইরে বেরিয়ে এলো ঘট। ওর চারদিকে চুপিচুপি ঘুরে বুঝে নিলো, সিঁড়ি দিয়ে নামা যাবে না। ধীরে ধীরে সে ছাদের আলসেতে চড়ে দেখল জলের ট্যাংকের সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় দুটো পাইপ ছাদ থেকে নিচে নেমে গেছে বাইরের রাস্তায়। ওর চোখে মুখে বাঁচার আশা ফুটে উঠল। ও সন্তর্পণে দুই পাইপের তলা দিয়ে চার পা টিপে টিপে নামতে লাগলো। ওদিকে কুকুরের ঘন ঘন ডাক শুনে টর্চ হাতে উঠে এলো লাল বাবু। ছাদে উঠেই দেখল কচ্ছপের বালটি উল্টে পড়ে আছে।  সে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আরে কচ্ছপ, কচ্ছপ পালিয়েছে।’

লাল বাবু কুকুরের আওয়াজে উঠে এসেছে। কুকুর দুটো তখন চিৎকার করে চলেছে। এবার এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে লাল বাবু চেঁচাতে লাগলো। কুকুরদের কানে একটা আওয়াজ ধরা পড়ল। ওরা ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে মুখ বাড়িয়ে আবিষ্কার করল কচ্ছপকে। আর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠলো। কচ্ছপ তখন রাস্তা থেকে দু-তিন হাত ওপরে, দেওয়াল ও পাইপ ধরে নামছে। লাল বাবু হাতের টর্চ জ্বলে দেখতে পেল কচ্ছপকে। কুকুরগুলো এদিকে ঘেউ ঘেউ করতে করতে নিচে রাস্তায় নেমে এলো। আর এক দৌড়ে ওরা ছাদের পাইপের কাছে হাজির হল। কচ্ছপ রাস্তা থেকে তখন মাত্র হাত খানেক ওপরে ছিল। আর এক হাত নামলেই রাস্তার পাশের নর্দমা। বেশ বড় নর্দমা। সেখানে পচা গন্ধ জল জমে আছে। লাল বাবুও কুকুরগুলির পেছনে পেছনে টর্চ হাতে নেমে এলো। ছাদের জল-ট্যাঙ্কের নিচে পাইপ, তার নিচেই মনে হল কচ্ছপ নিচের দিকে হেঁটে আসছে। কুকুর ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে তার মাঝে লাল বাবু চিৎকার করে উঠল, ‘এই ধর ধর ধর–’

আর ওদিকে ধপ করে ঘট গিয়ে পড়ল নর্দমায়। ভীষণ দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। নোংরা কাদায় ডুবে গেছে ঘট। ওর মনে হল, এ পাক-কাদা যে অসহ্য দুর্গন্ধময় ! তবু বাঁচতে হবে তাকে। সে ডুবে ডুবে হেঁটে চলল। লাল বাবু হতাশ হয়ে বলে উঠলো, ‘যা শালা, কচ্ছপ খাওয়া আর হল না–এই পচা নর্দমা থেকে ওটাকে ধরতে যাবে কে ?’

পঞ্চম পর্ব : নট-ঘট ঝিলে ফিরে এলো

ঘট নর্দমার জলে ডুবে ডুবে এগিয়ে গেল। অনেকটা জাগা নিয়ে এই লোকালয়।  এটা পার হতে না পারলে তার জীবনের সংশয় যাবে না। নর্দমা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ও চিনতে পারবে তো ? লোকালয় পার করতে হবে। কুকুরগুলির ঘর জঙ্গলের পাশের বড় রাস্তার ধারে।  নট বোধহয় একাই পৌঁছে গেছে ঝিলে।  কিংবা এমন তো নয় যে সে এখনও তার জন্য অপেক্ষা করছে।  লালের ঘর থেকে বেশ কিছুটা নর্দমা পার করল ঘট। এরপর নিজেকে তার কিছুটা নিরাপদ মনে হল।  চারদিকে কারও সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তবু ঘটের ভয় হচ্ছে। কুকুরগুলির আচরণ অদ্ভুত। ওরা খেতে না পারুক ওকে নিয়ে এলো ওদের মনিবের বাড়ি।  আর যদি আবার টের পায় ওর কথা, তবে কে জানে আবার এসে তাকে মুখে কামড়ে নিজের মনিবের বাড়ি হয়ত নিয়ে যাবে !

ঘট নর্মদা থেকে উঠে আসলো। সে এবার ছুটছে ছুটছে একটা বাড়ি বাঁদিকে পার করে এলো। ওই যে সামনে বড় রাস্তা। আর কিছুটা এগোলেই কালকের সেই জায়গা যেখান থেকে তাকে কুকুর মুখে করে তুলে নিয়ে এসেছিল।  ঘট এক বার চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর ও চাপা স্বরে, ‘নট, নট’, বলে ডাকতে লাগল। ওর গলার আওয়াজ বড় ধীর।

নট জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে নিরাপদ মত একটা জাগায় ঝিমাচ্ছিল। ও রাতে লোকালয়ের আশপাশের বেশ কিছু জাগা সাহস করে ঘুরে এসেছে। কিন্তু বুঝতে পারেনি যে কোথায় ঘট থাকতে পারে।  কে বলতে পারে কুকুরের পাল্লায় পড়লে আর উপায় থাকবে না ! বাঁচার কথা আর ভাবা যাবে না। সব ভাগ্য, ভাগ্য হলে মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসতে পারে। নট তখন কেঁদে উঠেছিল, ‘বন্ধু, আমার বন্ধু ! তুই কোথায় চলে গেলি রে ?’ জন্মের পর থেকেই বলতে গেলে ওদের বন্ধুত্ব। সুখে দুখে সব সময় প্রায় ওরা একসাথেই থেকেছে। এক সঙ্গে খেলেছে, এক সঙ্গে দুষ্টামি করেছে, এক সঙ্গে কাজে নেমেছে। সেই একাত্ম বন্ধু ছেড়ে সে থাকবে কি করে  ? এই মুহূর্তে তার খুব খালি খালি লাগছিল। বুক ফেটে তার কান্না বেরিয়ে আসছিল। মুখ চেপে সে কান্না থামিয়ে নিলো। আর ঠিক  সেই মুহূর্তে চমকে উঠলো। কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকল না ? ঠিক যেন ঘটের গলার মত গলা ! পরক্ষণেই মনে হল, না, তার মনের ভুল হবে। কিন্তু না, এবার নট স্পষ্ট শুনতে পেলো তাকেই ডাকছে, ‘নট তুই কোথায় ?’

নট চঞ্চল হয়ে বলে উঠলো, ‘এই যে আমি বন্ধু !’ ঘট দেখতে পেলো নটকে। ও দৌড়ে এলো নটের কাছে। উভয়ে উভয়ের গায়ে হাত রাখল। জড়িয়ে ধরল। চুপচাপ কিছু সময় থেকে যেন  দুঃখ-বেদনা ভুলতে চাইল !

এদিকে ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে করছে। দূরে জঙ্গল থেকে বন মোরগ ডেকে উঠল। সে সঙ্গে লোকালয় থেকে মোরগ ডাক দিল।

–‘আর দেরি না, চল ঘরে, তুই চলতে পারবি তো ?’ নট বলে উঠলো।

ঘট বলল, ‘হ্যাঁ পারবো, তবে আজ আমি নতুন জন্ম পেলাম রে !’

–‘চলতে চলতে তোর সব কথা শুনবো রে !’ নট বলল।

পথ চলতে লাগলো নট-ঘট। এবার নিজেদের ঝিলের দিকে হাঁটতে লাগল।  পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা হল, রোদের ঝিলিক এসে লাগছিল ওদের গায়ে। বনের ডালপালার ফাঁক গলিয়ে ঝিকির মিকির রোদ উঠেছে। মুক্তি, মুক্তির আনন্দ অনুভব করতে পারছিল ঘট। দুই বন্ধু মিলে এবার ঝিলে ঝাঁপ দিল। নট তার মুখের মধ্যে ধরে রেখেছিল দুটো সাল ফল। গজাল মাছ ওদের দেখতে পেয়ে অমনি ধমক দিয়ে উঠল, ‘তোরা ওষুধ আনতে গিয়েছিলি–না ঘুরতে গেছিলি রে ? ওদিকে রুই মাছ তো অক্কা পেয়েছে !’

ঘট বলল, ‘এ্যঁ !’ ও খুব দুঃখ পেল।

গজাল বলল, ‘এ্যঁ না, হ্যাঁ, কাল রাতেই ও মরে গেছে। এবার তোরা যা–ঘরে গিয়ে নাচ গিয়ে !’

–‘কি করবো আমাদের যে মহাবিপদ ছিল।’

গজাল বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি, বাতালা অনেক শুনেছি। মিথ্যা কথা আমায় আর বলতে হবে না, যা যা নিজের জাত-পাতদের গিয়ে সোনা ওসব কথা।’

একটু এগিয়ে গিয়ে মাছের জটলা চোখে পড়লো নট-ঘটদের। ওরা সবাই তাকিয়ে ছিল জলের উপরে। সেখানে ভাসছিল মৃত রুই। ব্যাস, সব প্রায় শেষ হতে চলেছে। মরা রুইয়ের গা থেকে পচা গন্ধ বের হওয়া শুরু হয়েছে। কিছু শোল মাছ তার আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের উদ্দেশ্য ভালো নয়। আর কিছু সময় পরেই ওরা তার দেহ খুটে খুটে খাওয়া শুরু করবে। এমনি হয়। মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ জাতিতে নিজেদের মরদেহ নিজেদেরই খেতে হয়। এতে পেট ভরে। বদ গন্ধ দূর হয়। আর শুধু জলচরদের নয়, বন্যপ্রাণীদেরও এমনি ব্যবস্থা। ওরা নিজেদের দেহ নিজেরা খেয়ে নেয়।

না, মন খারাপ হয়ে গেল। ঘট কেমন বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে যে তার জীবনও হারিয়ে ফেলছিল। রুই মাছ মরে গেল।  ওরা পারল না সময় করে ওষুধ নিয়ে আসতে। কিন্তু ওদের তো কিছু করার ছিল না। পথের এমনি বিপদের ঘটনার কথা তারা তো আগে থেকে জানতো না।  আর বিপদ কখনও বলে কয়ে আসে না। ওরা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো।  অন্যদিকে দেহ টেনে ছিঁড়ে খাওয়া শুরু হয়েছে। শোল মাছের দল এখন শোক ভুলে উদরপূর্তির আনন্দে মেতে উঠেছে। এমনিই বুঝি হয়–কারও পৌষ মাস, আর কারও সর্বনাশ !

ষষ্ঠ পর্ব : ঝিলের কুমির ও অতল সুরঙ্গ

ঝিলে একটা নৌকা বাঁধা থাকে। ওটা মাঝে মধ্যে চলে। ওটা মাছ ধরার কাজে লাগে। আবার কখনও সখনও নৌকা বিহারও চলে। মাছ ধরার দিনগুলিতে ঝিল বাসিন্দাদের খারাপ সময় চলে। কে কোথায় লুকাবে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।  মাছ, কাছিম, কাঁকড়া ওরাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কচ্ছপ, কাঁকড়ারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। মাছরাও জানে ঝিলে জাল পড়লে ওপরে ভেসে থাকা নিরাপদের না। তবু অনেক মাছ ধরা পড়ে। যদভবিষ্যরা জালে ধরা পড়ে। ভবিষ্যতের কথা যারা চিন্তা না করে চলে তাদের বলাহয় যদভবিষ্য । সংস্কৃতে একটা কথা আছে, যদভবিষ্য বিনস্যতি। মানে ভবিষ্যতের কথা যারা না ভেবে চলে তারা মরে।

সে দিন সকাল থেকে জাল ফেলা চলছিল। ছোট-বড় অনেক মাছ ধরা পড়েছিল। নট-ঘটের চেনা জানা একটা কাঁকড়া ধরা পড়েছে। কিছুই করার নেই ওদের। ঐ কাঁকড়ার নাম ছিল, কেরু। কাঁকড়াটা কথা শুনত না কারও। ও নিজেই যেন সবজান্তা ছিল।  অবুঝ এসব জল প্রাণীরাই জালে বেশি ধরা  পড়ে। মিউনিসিপাল অফিস থেকে  ঠিক করা জেলেরা এসে জাল ফেলল। চেনাজানা অনেক মাছ কাঁকড়া সে দিন ধরা পড়ে গেল। নট সাবধান করেছিল, ‘কেরু কোথায় যাচ্ছিস ? আজ জলে জাল পড়ছে জানিস তো ?’

–‘আজ পর্যন্ত আমায় কেউ ধরতে পেরেছে ?’ গর্ব করে কেরু কাঁকড়া বলে উঠেছিল।

ওর নাকি খুব সর্দি হয়েছে, তাই সে  ডাঙ্গাতে রোদ পোহাতে যাবেই।  আর একটু সময় পরেই ঝুপ করে জলে জাল পড়ল। সে জাল গিয়ে পড়লো একেবারে কেরুর ওপর। পালাবার পথ নেই, ও যে তোর যম আছে পিছে ! কেরু  সে দিন ধরা পরল। জেলেরা তাকে দেখে আনন্দিত হল, এক জেলে বলল, ‘এই ও কিন্তু কামড়ে ধরবে তার আগে ওটার কাঁটা কাঁটা দাঁড়া দুটো ভেঙে দে–’

যেই বলা সেই কাজ। জেলে কেরু কাঁড়াকে চেপে ধরে তার দু’দিকের দাঁড়া খট করে ভেঙে দিল। ব্যথায় কেঁদে উঠল কেরু কাঁকড়া। কিছু করার নেই, দুঃখের মাঝে একবার তার নটের কথা মনে পড়েছিল। কেরু এখন বন্দি। ওর মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না।

এই ঝিল আয়তনে বেশ বড়। নট-ঘট সাঁতরে মিনিট তিরিশ লেগে যায় পারাপার করতে। ঝিলের একটা জাগা আছে সেখানে বেশ জল। কোথাও তো আছে অথৈ গভীরতা। নট-ঘট ওরা ভয়ে সে দিকে যায় না। ছোট থাকতেই ওরা শুনেছে ঝিলের পূবের দিকে নাকি অথৈ জলের সুরঙ্গ আছে। তার ধারে কাছে কেউ যেতে সাহস পায় না। এখানকার ভয়ংকর ভয়ংকর সব গল্প নট-ঘট শুনেছে।  এখান থেকে সদাসর্বদা ভেসে ওঠে বড় বড় বুদবুদ। অনেকে বলে এখানে নাকি সুরঙ্গ আছে। ওর কাছে গেলে নাকি জলের তোড় সবকিছু টেনে নিয়ে যায়। যাকে টেনে নিয়ে যায় সে আর কোনদিন ফিরে আসে না।

বহুদিন আগে এ ঝিলে নাকি একটা দুষ্ট কুমির থাকত। সে কুমির রাতদিন মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়া খেয়ে বেড়াতো। তার পেট ভরা থাকলেও সে চুপ করে বসে থাকত না। গপাগপ শুধু খেয়েই যেত। তারপর এক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ, সব জলজ প্রাণীদের মিটিং হল। ওরা পরামর্শ করে বের করলো যে ওই কুমিরকে যেভাবেই হোক ওই সুড়ঙ্গের কাছে নিয়ে ফেলতে হবে। বড় বড় মাছ, কচ্ছপ, কাঁকড়ারা মিলে কতবার কুমিরকে আপ্যায়ন করল। কুমির বলল, ‘তোদের তো সাহস কম নয়–আমায় ডাকার সাহস করিস তোরা ?’

একদিন মাছ, কচ্ছপ, ক্যাঁকরা ওরা সবাই এসে হাত জোড় করে বলল, ‘হুজুর একটা কথা ছিল ?’

–‘কি কথা, কি কথা ? বল শুনি’, কুমির গম্ভীর হয়ে বলল।

‘তুমি তো জানো ওই সুরঙ্গ পথে আমরা যেতে ভয় পাই’, বোয়াল বলল।

কুমির বলল, ‘ও তোরা ভয় পাস আমি তা জানি।’

–‘কিন্তু হুজুর আমরা একথা কেউ বিশ্বাস করতে পারছি না যে আপনিও ওই সুড়ঙ্গের ধারে যেতে ভয় পান !’

কুমির কথার মাঝখানে গর্বভরে বলে উঠলো, ‘চোপ ! আমি কুমির, একথা তোরা মনে রাখবি।’

এক মহা শোল সাহস করে বলে উঠলো, ‘তবে হুজুর সবাই যে বলছে তোমারও সেখানে যাওয়ার সাহস নেই ?’

–‘কি বলছিস ? আমার সাহস নেই ? এই দেখ, আমি এখনই যাচ্ছি।’ কুমির আর কথা না বলে শা শা করে ছুটে চলল সুরঙ্গর দিকে। তা দেখে অভিজ্ঞ-বিজ্ঞ বোয়াল, শোল, মহাশোল ওরাও তার পেছনে পেছনে চলল। সবাই কুমিরের থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে চলতে লাগলো। কুমির এসে পরল পাতাল সুড়ঙ্গের ধারে। তারপর  সবার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘এই দেখ এই খানে পাতাল সুরঙ্গ। তোরা দেখতে থাক। আমি এক ডুব দিয়ে ফিরে আসছি।’

তারপর সে কুমির এক ডুবে পাতাল সুড়ঙ্গের কাছে এসে গেল। মাছ, কাছিম, কাঁকড়া ওরা সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখছে। সুড়ঙ্গের কাছে গিয়ে কুমির আবার ডুব দিল। ব্যাস, তারপর আর সুড়ঙ্গ মুখ থেকে সে কোন দিন ফিরে আসেনি। সে দিন মাছ কাঁকড়া কাছিম ওরা বহু সময় ধরে দাঁড়িয়ে থেকে শেষে ফিরে এলো। সেই থেকে এই ঝিল কুমির মুক্ত হল।

 

 শেষ পর্ব : ব্যথার কথা

নৌকা অনেক দিন বাঁধা পড়ে ছিল ঝিলের ঘাটে। এখানে নিয়মিত নৌকা বিহার চলে না। নট-ঘট সে দিন ডাঙ্গায় উঠে রোদ পোহাচ্ছিল। বেলা তখন কত হবে ? এই দশটা বা এগারটা। হঠাৎ ওরা দেখল এক নতুন বিয়ে করা বর-বউ এসেছে। ওরা নিশ্চয় সামনের মন্দিরে হয়েই এসেছে। ওরা মিউনিসিপাল্টির লোকদের আত্মীয় স্বজন কেউ হবে। ওরা মাঝিকে সঙ্গে করে এনেছে। বউ বরের বেশ নিয়েই ওরা নৌকায় চড়ে বসলো।  বর-বৌ ছেলে-মেয়ে দুটো খুব হাসছিল। বউ মেয়েটা বলল, ‘ওরে বাবা কত বড় ঝিল না ?’

এবার বর, ছেলেটা ঝিলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, হ্যাঁ, খুব বড় তো !’

–‘আজ আমরা সারাদিন নৌকা বিহার করব’, মেয়েটা আনন্দে হাত মুখ নাড়িয়ে বলে উঠলো।

–‘খাওয়া-দাওয়া করতে হবে না ?’ বর ছেলেটা বলল।

–‘এক দিন না খেলে কি হবে ?’ বউ মেয়েটা বলল। সে হেসে কুটিপাটি হচ্ছিল।

ছেলেটা বলল, ‘তোমার জন্য আমি সব করতে পারি।’

–‘সত্যিই ?’ খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটা। তত সময় মাঝি নৌকা ছেড়ে মাঝ ঝিলে এসে গেছে। নট-ঘট পারে শুয়ে ছিল। গাছের ছায়া-রোদ দুটোই ছিল।  পারে রোদ পোহাতে থাকলে ওদের আর জলে নামতে ইচ্ছে করে না। ওরা নৌকোটা দেখছিল–নৌকায় চড়া ছেলে-মেয়েটাকে ভাল করে দেখছিল। ওদের খুব ভালো লাগছিল। কণে মেয়েটা কত সুন্দর আর ছেলেটাও দেখতে অদ্ভুত সুন্দর।  মেয়েটা নানা অঙ্গভঙ্গি কর ছিল। ও হাত-পা ছুঁড়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলছে হবে।  ছেলেটা হাসছে, মাঝে মাঝে মেয়েটার দিকে কেমন যেন তাকিয়ে থাকছে ! ওদের হাব-ভাব খুব ভালো লাগছে। নট-ঘট তাই ইচ্ছে করে পারে দাঁড়িয়ে এ সব দেখছিল। ঘট বলল, ‘ওরা যদি আমাদের দেখে ফেলে কি হবে ?’

নট বলল, ‘ওরা তো আর আমাদের ধরতে আসেনি–তবে আর ভয় কিসের ?’

নৌকাটা ওদের দিকে এগিয়ে আসছিল। ছেলে-মেয়েরা ওদের দেখতে পাইনি।  এক সময় নৌকাটা ওদের পারের কাছে এগিয়ে আসছিল। আর হঠাৎই মেয়েটা  ওদের দেখে নিলো। ও চিৎকার করে বলে উঠল. ‘ওই ওই, ওই দেখো দুটো কচ্ছপ, বাবা ওদের দেখে আমার ভয় করছে।’

–‘আরে কচ্ছপ দুটো তো অনেক দূরে–এত ভয় পাবার কি আছে ?’ ছেলেটা বলল।

মেয়েটা ভয় পেয়ে বলে উঠলো, ‘ওরে বাবা, ওরাও তো আমাদের দিকে মুখ করে আছে–এ দিকেই তাকিয়ে আছে !’

নট-ঘট তবু দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের ভয় অবশ্য কিছুটা করছিল বটে। তবু ভালো লাগছিল। ওরা জানে যে এই নতুন বর-বউ ওদের কোন অনিষ্ট করতে আসেনি।  শুধু ওই মাঝি যদি থাকত তবে অবশ্য ভয়ের কারণ ছিল।

এবার নৌকো ওদের ছেড়ে অনেক দূর চলে গেল। মাঝি বলল, ‘নৌকায় ছেদ আছে গো, ওর জল ফেলতে হবে।’

বড়-কণের কোন উত্তর নেই, ওরা চারদিকে তাকিয়ে আনন্দে মত্ত হয়ে আছে। ওরা মাঝে মাঝে নিজেদের দিকে তাকাচ্ছিল আর কি যেন বলাবলি করছিল।  মেয়েটা মাঝে মাঝে নেচে উঠছে। ওদের নট-ঘটরা দূর থেকে দেখে যাচ্ছে। ঘট বলল, ‘মানুষরা আমাদের শত্রু না।’

নট বলল, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক কিন্তু সব মানুষ তো আর সমান হয় না ! ওই ছেলে-মেয়েটাকে দেখলে তুই বুঝতে পারবি যে ওরা ভালো।’

নৌকোটা ঝিলের পূব দিকে চলে গেছে। হঠাৎ দুলে উঠল নৌকা।

– -‘ওদের নৌকা কেন এত দুলছে রে ?’ ঘট প্রশ্ন করল।

–‘সত্যি তো !’ হঠাৎ নট চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে ওখানটাতেই  তো সুরঙ্গ তল রে !’

–‘আরে হ্যাঁ তাই তো !’ ঘট ভীত গলায় বলে উঠল, ‘চল চল আমরা এগিয়ে যাই–’

নৌকা দুলছিল। মাঝি বারবার সাবধান করে যাচ্ছিল। নৌকার বর-কণের কানে তা পৌঁছাল না। শেষপর্যন্ত নৌকা গিয়ে হাজির হল সুরঙ্গ পথের কাছে। মাঝি হয়ত ভেবেছিল সে  নৌকা সামলে দেবে। মাঝি সুরঙ্গর কাছে গিয়ে বুঝতে পারল সেখানে জলের তলে ঘূর্ণি আছে। উপর থেকে তা বোঝা যায় না। মাঝি ভয় পেয়ে চীৎকার করে ছেলে-মেয়েদের বলল, ‘এই এখানে চুপ করে আপনারা বসুন, না হলে নৌকা ডুবে যাবে। এখানে সুরঙ্গ তল আছে।’

বড়-কণে এবার ভয় পেলো। নৌকা দুলতে লাগলো। নৌকা ডুবে যেতে পারে, এ কথা বলাই বুঝি কাল হল। মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। ও নৌকার তালে তালে এপাশ-ওপাশ অস্থির হয়ে ছুটতে লাগলো। আর তার পরিণাম হল ভয়ংকর। হঠাৎ নৌকা গেল উল্টে। এ জায়গায় অথৈ জল। মাঝি জানে, সে  ‘বাঁচাও, বাঁচাও,’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। দুর্ভাগ্য ছেলে-মেয়ের কেউ বুঝি সাঁতার জানে না।

–‘ওই যে ওরা হাবুডুবু খাচ্ছে, মেয়েটা, মেয়েটা কোথায় ?’ আতঙ্কিত হয়ে নট বলে উঠলো।

ঘর বলল, ‘’চল চল আমরা এগিয়ে যাই–গিয়ে দেখি–মানুষকে আমরা তুলতে পারব তো না–তবু চল–’ বলে নট আর ঘট ছুটতে লাগলো। ওরা পার  ধরে সুরঙ্গ তলের ধারে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। খুব অস্থির লাগছে ওদের। খারাপ লাগছিল খুব। মাঝি সাঁতার জানে। ও চেষ্টা করল ছেলে-মেয়েকে বাঁচাতে। কিন্তু ও মেয়েটাকে সামনে না পেয়ে ছেলেটাকে ধরে পারের দিকে আসছিল। ওদিকে মন্দির থেকে কিছু লোক ছুটে এসেছে। ওরা মাঝির ডাক সুনতে পেয়েছে। ওরা পারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে। কেউ ঝিলে নামতে সাহস পাচ্ছে না। সবাই ‘বাঁচাও বাঁচাও’, বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটাকে পারে টেনে তুলেছে মাঝি। ছেলেটা বিশেষ কাবু হয়নি। ও উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল, বলছিল, ‘দীপা, দীপা, দীপাকে বাঁচাও তোমরা ! ও জলে ডুবে গেছে। আমার স্ত্রী, দীপা জলে ডুবে গেছে।’ ছেলেটা কেঁদে উঠলো, উন্মত্ত হয়ে ও বলে উঠলো, প্লিজ তোমরা আমার স্ত্রীকে বাঁচাও !’

দুজন ও মন্দিরের এক পাণ্ডা ঝাঁপ দিল জলে। ওরা জানে ওখানে জল খুব গভীর, নিচে ঘূর্ণি স্রোত আছে। ওরা ভয়ে ভয়ে এগোচ্ছিল। বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারছিল না। সুড়ঙ্গর ঘূর্ণির আশপাশে ডুব দিয়ে যাচ্ছিল। অনেকটা সময় হয়ে গেল মেয়েটাকে পাওয়া গেল না। ছেলেটা উন্মাদের মতো স্ত্রীর নাম ধরে চিৎকার করে উঠছে। পারের এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। হতাশ হয়ে পারের  লোকরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

প্রায় ঘন্টাখানেক বয়ে গেল। এবার মিউনিসিপালটি থেকে লোক এলো। সঙ্গে দুটো পুলিশ এলো। স্থানীয় ডুবুরি ও কিছু জাল এলো। সুরঙ্গ তলে অনেক লোক নেমে পড়ল। ওরা জলে জাল ফেলতে লাগলো। বারবার ডুব দিচ্ছে ডুবুরি। ডুব দিয়ে দেখে যাচ্ছে আর খালি হাতে উঠে আসছে। নট-ঘট অনেকটা আড়ালে দাঁড়িয়ে গাছের আড়াল থেকে দেখছে সব কিছু। ওরা সব কিছুই বুঝতে পারছিল।  বুঝতে পারছিল যে ওই সুন্দর মেয়েটা আর বেঁচে নেই। নির্ঘাত ওর মৃত্যু হয়েছে।  আরও প্রায় ঘণ্টা দুই পর ডুবুরির পায়ে মেয়েটার শরীর ঠেকল। ঘূর্ণিজল থেকে তার দেহ তুলে আনতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। সে তিন-চারবার ডুব দিয়ে তারপর মেয়েটাকে টেনে তুলল জলের উপর। সেখান থেকে সাঁতরে নিয়ে এলো তাকে ডাঙায়। ভীষণ ভিড় ঘিরে আছে মেয়েটাকে। বর ছেলেটার কান্না ও চীৎকার কানে আসছে। নট-ঘটের ইচ্ছে হচ্ছিল একবার গিয়ে দেখে আসতে। আহা কি সুন্দর মেয়েটা ! ওদের চোখের পর্দায় এখনও  যেন লেগে আছে। ওর আনন্দ-উৎসব হাবভাব ওদের যে খুব ভালো লাগছিল।

–‘মরে গেছে, মরে গেছে,’ সবার মুখে একই কথা চলছিল।

নট-ঘট শুনতে পাচ্ছিল সব কিছু। ওদের খুব, খুব দুঃখ লাগছিল। ঘট মাথা নিচু করে আছে। তা দেখে নট বলল, ‘কিরে, চুপ করে আছিস কেন ?’

ঘট হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠল। নট ঘটের পিঠে হাত রাখল। ও কি বলে সান্ত্বনা দেবে ঘটকে ? ওর চোখ-মুখও যে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে।  কান্না তার বুকেও যে থেমে আছে। অথচ মানুষ ওদের শত্রু ! তবে, তবে এত দুঃখ ওদের বুকে ঢুকে আছে কেন ? কেন ??

মেয়েটাকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠছে, ‘দীপা, দীপা’, বলে। এখন সবাই চলে যাচ্ছে। পৃথিবী থেকে একটা সুন্দর মেয়ে বিদায় নিয়েছে।

নট-ঘট চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক সময় হয়ে গেল। পেছন থেকে হঠাৎ ওদের কেউ ডাক দিয়ে উঠলো, ‘এই নট-ঘট, তোরা এখানে ?’

নট-ঘট তাকিয়ে দেখল, কবিরাজ কচ্ছপ দাদু ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কবিরাজ দাদু সব জানে। সে বলল, ‘নট-ঘট চল এবার–জীবনে এমনি দুর্ঘটনা কত হয় রে ! দেখিস না আমাদের জীবন। আমরা তো আরও অনিশ্চিত !’

–‘একটা সুন্দর মানুষ মরে গেল’, ঘট ধরা গলায় বলে উঠলো।

আসলে কবিরাজ দাদু জানে যে এই নট-ঘটের মতো সৎ ও সরল এই ঝিলে আর কেউ নেই। পরের উপকারে একমাত্র ওরাই যখন তখন ছুটে আসে।

কবিরাজ দাদু বলল, ‘এবার চল, চল দাদুরা আমরা যাই। আমাদের যে অনেক কাজ পড়ে আছে দাদারা !’

ওরা ঝিলের ধারে গেল। তারপর  ঝাঁপ দিল ঝিলের জলে।

জীবন জীবনের মত ছুটে চলছে। তার মাঝে ঘটনা-দুর্ঘটনা তো থাকবেই। চারদিক দেখে শুনে জীবন পথে এগিয়ে চলতে হবে।  তারপর আছেন ভগবান। তিনি সর্বশক্তিমান। সমস্ত পৃথিবীর তিনিই তো নিয়ন্তা।

শেষ

 

লেখক পরিচিতি

নাম : তাপসকিরণ রায়। পিতার নাম : স্বর্গীয় শৈলেশ চন্দ্র রায়।  মাতাঃ শ্রীমতী বেলা রায়। জন্মস্থান : ঢাকা, বাংলা দেশ। জন্ম তারিখ : ১৫ই এপ্রিল, ১৯৫০

একটা সময় লেখকের সঙ্গে নিয়মিত পত্রালাপ ছিল শ্রদ্ধেয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিমল মিত্রের সঙ্গে। বিমল মিত্রের পত্রিকা কালী ও কলমে লেখকের একাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছিল।

স্বর্গীয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রকাশনায় কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে লেখকের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :  চৈত্রের খরায় নগ্ন বাঁশির আলাপ। উদার আকাশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত লেখকের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থঃ তবু বগলে তোমার বুনো ঘ্রাণ। শিশু বিতান প্রকাশনী থেকে দুটি শিশু-কিশোর বই প্রকাশিত হয়েছে–১) গোপাল ও অন্য গোপালেরা ২) রাতের ভূত ও ভূতুড়ে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। নান্দনিক থেকে প্রকাশিত লেখকের গল্প সঙ্কলন, গুলাবী তার নাম।

এ ছাড়া প্রসাদ, সারাক্ষণ, পত্রিকা, পথের আলাপ, লং জার্নি, দৌড়, কালি কলম ও ইজেল, রেওয়া, কর্কট ক্রান্তি, দিগন্ত, নিরুক্ত, কবিতার সাত কাহন, অঙ্কুর, আত্মদ্রোহ, বেদুইন ইত্যাদি বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় লেখকের গল্প, কবিতা ছাপা হয়েছে। লেখকের সঙ্কলন গ্রন্থ পত্রভারতী প্রকাশনীর অণুগল্প সঙ্কলন, গ্লপেন্দু, কবিতা পাড়ার ছলাৎছল, গল্পায়ন, নবারুষ কাব্যগ্রন্থ-এক ও নবারুষ-দুই।

এ ছাড়া ঐহিক, কলামটি, কৌরব, আদরের নৌকা, সৃষ্টি, পরবাস ইত্যাদি আরও কিছু  অনলাইন পত্রিকাতে তিনি লেখেন। শিশু-কিশোরদের পথের সুজন, কিচির মিচির, জয়ঢাক, ম্যাজিক ল্যাম্প, মানভূম সংবাদ, ইচ্ছামতি, কচিকাঁচা ইত্যাদি পত্রিকায় লেখকের অনলাইন ও ছাপান উপন্যাস, গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকা সংগঠন থেকে লেখক পুরস্কৃতও  হয়েছেন।

Address:
Tapaskiran Ray
C/o Sri Indrajit Das.
Street 31, Plot 4, Pragati nagar,
Rishali, Bhilai, Durg, Chattisghar 490001
Mobile no. ০9424306671

মন্তব্য করুন