আমার মেজো বোন দোদুল হঠাৎ করে চলে গেল! কিছুই না বলে মহাপ্রস্থান হলো ওর! একটু-একটু জ্বর ছিল তিনদিন ধরে। একটুও গুরুত্ব দিইনি আমরা, একটুও না!বয়সের খুব পার্থক্য না থাকায় ওকে নাম ধরে ডাকতাম, তুই করে বলতাম। আমার ছোট চার ভাইবোন আমাকে মেজদা বলে ডাকলেও তুই বলেই সম্বোধন করে। তবে বড়ো বোনকে বুজি ও বড়ো ভাইকে ভাইয়া বলে ডাকি এবং আমরা বাকি ভাইবোন খুব সমীহ করে চলি তাদেরকে।মাত্র ১৫ বছর বয়স, ক্লাস নাইনে পড়ত দোদুল। আমি ক্লাস এইটে। ১৯৭২ সালের ৫ আগস্ট বিকাল তিনটায় রেডিওতে ‘নবীন কণ্ঠ’ শুনছিলাম আমি। রান্নাঘর থেকে ওর জন্য চা নিয়ে এসে মা বললেন, ‘খাবি একটুখানি?’ দোদুল চা পছন্দ করত। মায়ের হাতে চা মুখে দিলেও খাওয়া হলো না ওর। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘মা খুব ক্লান্তি লাগছে আমার।’ দোদুলকে চোখ বুজে বিশ্রাম নিতে বলে বাবাকে অফিস থেকে ডেকে আনতে বললেন মা। গুরুত্ব দিইনি আমি। বাবার অফিস বাসা থকে পাঁচ মিনিটের পথ। আমি না গেলেও ছোট দুই বোন বাবাকে ডেকে আনল। বাবার সঙ্গে তার এক ডাক্তার বন্ধু সংবাদ পেয়েই ছুটে এলেন। ডাক্তার চাচা এসে নাড়ী ধরে বললেন, ‘সব শেষ হয়ে গেছে!’আমার মা আর বড়ো বোন আর্তনাদ করে কাঁদছিল। আমার আরও ছোট দুই ভাই ও দুই বোন অবুঝ খুব; বুঝতে পারেনি আমাদের কতটুকু ক্ষতি হয়ে গেল। সবার কান্না দেখে দেখে মনে হচ্ছিল আবার বোধ হয় চোখ মেলে তাকাবে দোদুল! আবার হয়তো খুব আনাড়ী হাতে ওর গানের সঙ্গে তবলা বাজাব আমি। রবীন্দ্রনাথের ‘খোলো খোলো দ্বার/রাখিও না আর/বাহিরে আমায় দাঁড়িয়ে’ গানটি দোদুল গাইত। বিধাতা ওর দ্বার খুলে দিলেন এত অল্প সময়েই! ৫ই আগস্টের শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বাদল ধারার মধ্যে বিকাল চারটার দিকে কিছু না বলে চলে গেল দোদুল। শনিবারের বিষণ্ন সেই দিনে বাসার সামনে ওর হাতে লাগানো দোলনচাঁপা ও সাদা গোলাপের পাপড়ি বেয়ে টপ টপ করে চোখের জলই যেন গড়িয়ে পড়ছিল। আমি কাঁদছিলাম না। একটুও চোখের জল পড়েনি আমার! পাথর হয়ে গেলাম আমি। তারপর একবারমাত্র ওর কবরের কাছে গিয়ে কাঁদতে চেয়েছিলাম, পারিনি। ও আমাকে স্তব্ধ করে দিয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত খুনসুঁটি, রাগ, মান-অভিমান চুরি করে নিয়ে চলে গেল ও!তবলা আর হারমোনিয়াম দেখলেই ওর কথা খুব মনে পড়ে আমার। মনে পড়ে ওর প্রিয় কয়েকটা গান : ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে/শারদপ্রাতের বুকে ওই’; ‘কী নামে ডেকে/বলব তোমাকে/মন্দ করেছ আমাকে/ওই দুটি চোখে।’ এ গানগুলো খুব প্রিয় ছিল ওর।ছেলেবেলায় থেকেই নজরুল গীতি খুব পছন্দ আমার। সে সময় রবীন্দ্র সঙ্গীতও শুনতাম, তবে অর্থ বুঝতাম না। যতটুকু বুঝতাম আজ সেটুকুও বুঝি মনে হয় না! রবীন্দ্র সঙ্গীতের কথা ও সুর শ্রোতাকে এক অপার্থিব জগতে নিয়ে যায়। তাই সে কারণে বিশেষ করে কম বয়সের কারো পক্ষে সেটা রপ্ত করা সম্ভব হয় না। আমি আজও পারিনি তেমনটা, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। তবে নজরুলের গানগুলো বুঝতে পারতাম সহজেই। ছেলেবেলায় যখন থেকে গান শেখা শুরু আমার, তখন থেকে নজরুল গীতি আমার প্রিয়। কথা ও সুর মুখস্ত হয়ে যেত সহজেই। ছেলেবেলায় পল্লী গীতি বিশেষ করে আব্দুল আলীম ও নীনা হামিদের গাওয়া গানগুলো আমি পছন্দ করতাম। আব্দুল আলীমের ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী/তোর কাছে শুধাই’ এবং নীনা হামিদের ‘আমার সোনার ময়না পাখি’ আজও আমার খুব পছন্দের। দোদুলের মৃত্যুর পর নজরুল গীতি ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয়’ গানটি গাইতাম খুব মন খারাপ করে। কেন ওই গানটা এতটা দরদ দিয়ে গাইতাম কেউ জানত না সে খবর।আমার চেয়ে দুবছরের বড়ো দোদুল ও আমি আমাদের সঙ্গীত গুরু বাশীরাম শীলের কাছে গান শিখতাম। বাশীরাম শীলের চুল কাটার দোকান ছিল মঠবাড়িয়ায়। বাশী দা আমার বাবার খুব পরিচিত ছিলেন। যে বছর গান শিখতে শুরু করলাম ১৯৭০ সালে সে বছর দোদুল ক্লাস সেভেনে পড়ত হাতেম আলী গার্লস স্কুলে, আমি কে এম লতিফে ক্লাস সিক্সে। পিঠাপিঠি হওয়ায় শুধু পড়ার সময়টায় হেরিকেনের আলো নিয়ে খুনসুঁটি হতো আমাদের। দোদুল এলাকায় শিল্প-সংস্কৃতির সম্ভাবনাময়ী তারকা ছিল। মঠবাড়িয়া আন্তঃস্কুল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনটি বিষয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সে। পরবর্তীকালে মঠবাড়িয়ার একমাত্র সঙ্গীত গুরু বাসুদেব মিত্র প্রভাবশালী কারো কারো চাপে দোদুল বা আমাকে গান শেখাতে পারেননি। কারো কাছে না শিখিয়েই বাসুদেব মিত্রের ছাত্র-ছাত্রীদের গোহারা হারিয়ে দিয়েছিল দোদুল। ও তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে আমাদের গ্রামের তেঁতুলতলা প্রাইমারি স্কুলে। এই অপরাধেই বাসুদা আমাদেরকে আর গান শেখাতে পারলেন না মনে হয়। আমাদের গান শিখিয়েছিলেন বাশীরাম শীল। সঙ্গে থাকতেন আজীবন অকৃতদার ধলু মজুমদার-ধলু দা। বাশীরাম শীল স্বাধীনতার পর ভারতে চলে গেলে একপর্যায়ে অন্ধ হয়ে যান তিনি। ধলু দাও বেঁচে নেই আজ; যিনি আমার ত্রিতালে গাওয়া গানগুলো বাজাতে পছন্দ করতেন। ঘরোয়া পরিবেশে গানের অনুষ্ঠান হলে ধলুদা বলতেন, ‘ওই গানডা গাও দেহি, ওই ত্রিতালডা–আজও মধুর বাশরী বাজে!’শংকর দার প্রচেষ্ঠায় মঠবাড়িয়ায় উদীচীর শাখা গঠিত হয়। তখন উদীচীর মূল শিল্পী ছিলেন শংকর সাওজাল, ডা: মতিয়ার রহমান চাচার বড় মেয়ে রওশন আপা, তার ছোট ভাই জাকির হোসেন মন্টু, রোজি আক্তার দোদুল, জব্বার চাচার ছেলে সফিকুর রহমান তকদির, মিজানুর রহমান তসলিম ও মন্মথ চৌধুরী। বাসুদেব মিত্র ছিলেন উদীচীর সাধারণ সম্পাদক, জব্বার চাচা ছিলেন সভাপতি। একপর্যায়ে অজানা কোনো কারণে জব্বার চাচা ও তার দুই ছেলে উদীচীতে না থাকলে বাসুদা, বাশী দা, শংকর দা, রওশন আপা, দোদুল ও মন্টুকে অনুষ্ঠানে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হতো। দোদুলের মৃত্যুর পর উদীচী তাকে মনে রাখেনি। মনে রাখেনি দোদুলের হারমোনিয়াম, তবলা না হলে অনুষ্ঠান হতো না, মনে রাখেনি আজীবন অকৃতদার ধলু তাকে। তখন তিনিই ছিলেন উদীচীর একমাত্র তবলাবাদক!চলবে