টুকরো স্মৃতির গল্প [৭]

পূর্ব প্রকাশিতের পর ।।

অদ্ভুত এক পরিবেশে আমার জন্ম। যে বাসাটিতে জন্মগ্রহণ করি, সেটি ছিল বিষাক্ত কিছু সাপে পূর্ণ। ভাবতেও বিস্ময় লাগে, প্রতিদিন আমাদের বাসা থেকে দু-একটি সাপ মারা হতো। আমার বড় চাচা বন্দুক দিয়ে গুলি করেও সাপ মেরেছেন। সত্যিই রূপকথার মতো সেসব কথা মায়ের মুখ থেকে শুনেছি। আমার বাপ-চাচারা ছিলেন পাঁচ ভাই। আমার একজনই ফুপু। তিনি কে এম লতিফ ইন্সস্টিটিউশনের বিজ্ঞানের শিক্ষক সাঈদ মৃধার সহধর্মিনী ছিলেন। সাঈদ মৃধা স্যারকে (আমার ফুপা) ছাত্ররা এতটা ভয় পেতো যে, আমাদের পÐিত স্যারের ক্লাসে কেউ দুষ্টুমি করলে তিনি আমাদের ভয় দেখাতেন এই বলে যে, আমাদের দুষ্টুমির কথা তিনি সাঈদ মৃধা স্যারকে বলে দেবেন! ব্যাস, তার এই কথায় আমরা পিনড্রপ সাইলেন্ট হয়ে যেতাম।
পন্ডিত স্যারের নাম মনে নেই আমার। তার ক্লাসে ছাত্ররা একটু বেশিই দুষ্টুমি করত। কারণ তিনি শাসন করতে জানতেন না। ক্লাসে কিছু লিখতে দিলে একে অন্যের লেখা বা বই দেখে লিখে দিতো। কেউ যদি স্যারকে এ ব্যাপারে নালিশ করত, ‘স্যার বলতেন, তোর কি অ্যাঁ? লেখে লিখুক। তোমার নিজের লেখাটা শেষ করো।’ স্যারের এই আচরণে আমি কখনো তার অবাধ্য হতে পারতাম না। তবে একবার গোরুর রচনা লিখতে গিয়ে গোরুর রোগবালাই নিয়েও লিখে ফেলেছিলাম। গোরুর সর্দি হয়, নাক দিয়ে সর্দি পড়ে, দেখতে খুব খারাপ লাগে-এসব লিখলে স্যার হেসে বলেছিলেন, ‘এই পাগলা তুই কি গোরুর ডাক্তার হবি নাকি?’ স্কুল জীবন পার হলেও আমার বন্ধু আসাদ মাঝে মধ্যে গোরুর রচনার কথা বলত। প্রথম গোরুর রচনা লিখেছিলাম যখন ক্লাস ফোরে পড়ি। মাত্র ছয় মাস আমি ক্লাস ফোরে পড়েছি আমাদের তেঁতুলতলা প্রাইমারি স্কুলে। আমি গোরুর রচনা লিখতে গিয়ে সামনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম দূরে একটি গোরু। ওকে নিয়েই লিখে ফেলেছিলাম রচনাটি। রচনা লিখতে আমার বেশ ভালো লাগে। বিশেষ করে যদি হয় ‘একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা’, তাহলে তো কথাই নেই। সারাদিনও লিখতে পারি। এসএসসিতে আমি এমন একটি রচনাই লিখেছিলাম। আমার বিশ্বাস এক্সামিনার আমাকে প্রচুর মার্কস দিয়েছিলেন, না হলে বাংলায় ৬০ এর উপরে মার্কস পাই কী করে!
আমার বড়ো চাচা ছিলেন বন্দুকপ্রিয় মানুষ। জার্মানির তৈরি দোনলা একটি বন্দুক ছিল তার। সারাক্ষণ বন্দুক ও একজন বডিগার্ড নিয়ে চলাফেরা করতেন তিনি। বাবার মতো অতটা সাহসী ছিলেন না বলে সুন্দরবনে যাওয়া হয়নি তার কখনো। আমার বাবা সুন্দরবনে যেতেন হরিন শিকারে। ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন হওয়ার পর তিনি আর হরিণ শিকারে যাননি। বড়ো চাচার বন্দুকের নিশানা হতো ঘুঘু, ডাহুক এ জাতীয় পাখি। বন্দুক চালাতে হলে এক চোখ বুজে অন্য চোখ দিয়ে নিশানা ঠিক করতে হয়। তিনি এক চোখ বুঝতে পারতেন না। এ জন্য তিনি একজন লোক সব সময় সঙ্গে রাখতেন। লোকটির নাম ছিল রশিদ মিয়া, ‘লম্বা রশিদ’ বলতো লোকে। চাচা ঘর থেকে বের হলেই রশিদ মিয়া তার পিছন পিছন ছুটতো। শিকার করার সময় চাচা বলতেন, ‘রশিদ চোখটা টিপে ধর তো!’ রশিদ চোখ টিপে ধরলে তিনি গুলি করতেন। কিন্তু নিশানা ঠিক না থাকায় অহেতুক গুলিটাই খরচ হতো! একবার একটা তালগাছের ভাগাভাগি নিয়ে চাচার মামাতো ভাই মানিক জমাদ্দারের বুকে বন্দুক ঠেকিয়েছিলেন তিনি! আমার দাদী বন্দুকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বিষয়টি ফয়সালা করে দিয়েছিলেন, তালগাছটা মানিক চাচার ভাগেই দিয়েছিলেন। মানিক চাচা ছিলেন আমার দাদীর ভাইয়ের ছেলে। আমার দাদা ও দাদী চাচাতো ভাইবোন ছিলেন। মায়ের সিদ্ধান্তের উপর কোনো কথা বলেননি বড়ো চাচা। এই একটি স্মৃতি ছাড়াও বড়ো চাচার সঙ্গে আমার আরো একটি স্মৃতি আছে। বড়ো চাচা আমাকে ‘জ্যাঠা’ বলে ডাকতেন। তিনি মারা যাবার কয়েক দিন আগে আমাকে বললেন, ‘জ্যাঠা চলো নৌকা দেখে আসি।’ এরপর আমার হাত ধরে আমাদের ডিঙি নৌকা দেখাতে গিয়েছিলেন পুকুরের পাশে ডিঙি রাখার একটি নির্দিষ্ট জায়গায়। বড়ো চাচা সন্ধ্যার হলেই বন্দুক নিয়ে দোতলায় উঠে যেতেন।
১৯৬২ সালে বড়ো চাচা ঢাকায় মারা যান। তার কবর আজিমপুরে। আমি কখনো যাইনি সেখানে। তিনি যে বছর মারা গেলেন, সে বছর আমার বয়স আড়াই বা তিন। বড়ো চাচার সঙ্গে দুটি স্মৃতি ছাড়াও মামা বাড়ির কিছু স্মৃতি আমার মনে থাকায় মা অবাক হতেন অতোটা কম বয়সে পুরোনো কথা মনে রাখতে পারার জন্য।
চাচা ধোপদুরস্ত মানুষ ছিলেন। গ্রামে বাস করলেও বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে তিনি স্যুট-টাই পরতেন। সে সময় মুসলমানরাও ধূতি পরতো। মায়ের কাছে শুনেছি চাচা ও বাবার সব কাপড় কলকাতা থেকে ধোলাই করে নিয়ে আসা হতো। শুনেছি বাবার নাকি তিরিশিটির অধিক সার্ট ছিল। একটি সার্ট একদিনের বেশি পরতেন না।
আমার জন্মের সময় বাবা মঠবাড়িয়া কো-অপারেটিভ ব্যাংকে চাকরি করতেন। আমাদের চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে আমিই ব্যাংকপাড়ার বাসায় জন্মেছি। বাকিরা গ্রামের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করে। আমার জন্মের এক বছর পর বাবা ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আমরা গ্রামেই থাকতাম। ১৯৬৯ সালে বাবা আমাদের লেখাপাড়ার সুবিধার জন্য আবারও ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকলেন এবং আমি সে বছর মঠবাড়িয়া প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলাম। আমি ক্লাস ফোর ও ফাইভ এক বছরে পড়েছি।
ক্লাস ভাইভে টেনেটুনে পাস করলে আমার ভাইয়া আমাকে কে এম লতিফে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলেন। ভর্তি করানোর সময় আমার বয়স এগারো বছর। স্যার বললেন, বারো বছর হতে হবে। ভাইয়া প্রাইমারি থেকে নতুন করে আমার সার্টিফিকেট নিয়ে এসে ভর্তি করালেন এক বছর বয়স বাড়িয়ে। আমাদের ষষ্ঠশ্রেণির ক্লাস হতো কে এম লতিফের নিচ তলায় স্যারদের সিঁড়ির পাশের রুমে। প্রথম দিন আমার ক্লাসে যেতে দেরি হয়েছে। গিয়ে দেখি ক্লাস টিচার রোলকল করছেন। আমি ঘাবরে গেলাম। ‘মে আই কামইন স্যার’ বলতেই হাঁটু কাঁপড়ে শুরু করল। স্যার সেটা লক্ষ্য করে বললেন, ‘আয় আয়। বস। দেরি করলি কেন?’ আমি উত্তর দিতে পারিনি।
এতোগুলো ছাত্র ক্লাসে। আমি মাত্র কয়েকজনকে চিনি। পরে অবশ্য সবার সঙ্গে আমার জানাশুনা হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস সিক্সে পাস করার পর পরই শুরু হলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। রাজাকাররা ঘোষণা করেছিল, ক্লাসে না এলে তাকে ধরে নিয়ে আসা হবে। মাঝে মধ্যে শোনা যেতো যে, মুক্তিবাহিনী থানা আক্রমণ করবে, তখন আমার বাবা ও আমাদের বাসার পাশে জব্বার চাচা (তসলিমের বাবা) গ্রামের বাড়িতে চলে যেতেন। জব্বার চাচার বাড়ি ও আমাদের বাড়ি পাশাপাশি। তিনি আমার বাবার চাচতো-চাচাতো ভাই। গ্রাম থেকে আমাদের মঠবাড়িয়া পাঁচ মাইলের মতো দূরত্ব। নৌকায় বাবা ও চাচা মঠবাড়িয়ায় এসে অফিস করতেন। আমি ও তসলিম নৌকায় চড়ে মাঝে মধ্যে স্কুলে আসতাম নিয়ম রক্ষার জন্য। স্কুলে অ্যামেম্বলি হতো। আমাদের ইংরেজির শিক্ষক মোশাররফ স্যার অ্যাসেম্বলি করাতেন। ক্লাস সিক্সে অবশ্য সাঈদ মৃধা স্যারকে অ্যাসেম্বলিতে পেয়েছি। আমাদের স্কুলের ড্রেস ছিল সাদা হাওয়াই সার্ট ও পাজামা। একটি জিন্নাহ মার্কা সাদা রঙের ক্যাপও আমাদের অ্যাসেম্বলিতে পরতে হতো। স্কুল ড্রেস পূর্ণ না হলে অ্যাসেম্বলিতেও শাসন করা হতো।
স্বাধীনতার বছর অ্যাসেম্বলিতে আমি কখনো পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাইতাম না। ‘পাকসার জমিন’ ছাড়াও আরো একটি গান গাইতে হতো। গানটি ছিলÑ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ…’। একদিন স্যার লক্ষ্য করলেন আমি ওসব গান গাইছি না। তিনি আমাকে কড়া করে একটি থাপ্পর মেরেছিলেন। আমি সেই কষ্টটা আজও ভুলতে পারিনি।
নয় মাসের যুদ্ধের সময় রাজাকাররা আমার কয়েকজন হিন্দু বন্ধুকে জোর করে মুসলমান বানিয়েছিল। তাদের মধ্যে নারায়ণ (থাম্বু) একজন। পাকিস্তানীরা ওর নাম রেখেছিল নাসির উদ্দিন। এ ছাড়াও সুশীল, শৈলেন ও হীরেনকে জোর করে মুসলমান বানিয়েছিল। স্বাধীনতার পর ওরা আবার ওদের ধর্মে ফিরে গিয়েছিল।

চলবে