টুম লোকটার ভূত/তাপসকিরণ রায়

তখন রাত বারটা হবে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারিনি, এবার স্পষ্ট শুনতে পেলাম ঘরের বাইরে কেউ যেন কথা বলছে, কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। –কাঠ নিবা–কাঠ? ঠিক সেই কণ্ঠস্বর–টুমের কণ্ঠস্বর! চমকে উঠলাম আমি–টুম–মানে টুমের ভূত ! ভয়ে ভয়ে জানলার দিকে এগোলাম। জানলার ফাঁক দিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এবার জানলার এক পাট খুব ধীরে ধীরে খুললাম। বাইরে অন্ধকার–গাঢ় অন্ধকার–কিছু দেখা যাচ্ছে না। –কাঠ নিবা? আবারও চমকালাম–টুমের গলা না ! একটা ছায়া নড়ে উঠল বলে হল না ! হ্যাঁ, ঘন অন্ধকার থেকেও আরও ঘন কালো এক ছায়া দাঁড়িয়ে ছিল–ঠিক টুমের মত আকৃতির—বেঁটেখাটো, কুচকুচে কালো, ঝামার মত চেহারা। ভয় পাচ্ছিলাম খুব। এ যে টুমের ভূত ! আমার সামনে দাঁড়িয়ে। নিজের ভয় সামলাবার জন্যেই যেন চীৎকার দিয়ে উঠলাম,কে–কে ওখানে ? সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম নেই–কেউ নেই–টুমের ছায়া অন্ধকার ছায়ার মাঝেই মিলিয়ে গেল! রাত ভোর হল—টুমের কথা মনে পড়ছিল। এক দিন দুপুর বেলার কথা, আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ ডেকে উঠলো, কি গো, কাঠ নিবা ? আমি আর আমার স্ত্রী বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, কালো, নাটা, চিমসা মারা একটা লোক। তাকে দেখলেই বোঝা যায় ও ভীষণ দুর্বল। বয়স বেশ হয়েছে। ওর মাথায় রাখা ছিল শুকনো দু চারটা কাঠের টুকরো। আমাদের মুখের দিকে করুণ ভবে তাকিয়ে লোকটা বলে উঠলো, কাঠ নিবা–নান্নার কাঠ ? ভাল ভাবে কথা বলতে পারে না–কথা বার্তায় কেমন ছোট বাচ্চাদের মত জড়তা ভাব। অনেকটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। ওর শরীর হালকা হালকা কাঁপছিল। আমার স্ত্রী বলল, আহা বেচারা ! রেখে দাও গো ওর কাঠ কটা। দেখে মায়া হচ্ছিল। তবু বললাম, কত নেবা ? –দুই টেহা, কথা বলতেও ওর কষ্ট হচ্ছিল। বললাম, মাথার কাঠ নিচে রাখো, আর ওই গাছের বেদিতে গিয়ে বস। দু চার টুকরা কাঠ কষ্ট করে কুঁথেকাথে মাথা থেকে নামিয়ে রাখল। বেদিতে গিয়ে বসলো, কোমরের প্যাঁচানো ছেড়া গামছা খুলে নিয়ে ধীরে ধীরে মুখের ঘাম মুছল। দেখলাম ওর চোখ দুটোও লাল লাল। পরনে ময়লা এক টুকরো ধুতি ছিল। দু টাকা না, দশ টাকার নোট এনে ওর হাতে দিলাম। ও টাকা হাতে নিয়ে দু হাত দিয়ে উঁচু করে অপেক্ষাকৃত বেশী আলোতে নিরীক্ষণ করে নিলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে দুই আঙ্গুল দেখিয়ে দুই, বলল–কথা যেন ওর গলা দিয়ে পরিষ্কার হয়ে ফুটতে চায় না। আমি বললাম,ওটা তুমি রাখো। আমার স্ত্রী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় থাক? কানেও খাট মনে হল। কথা ভালভাবে শোনার জন্যে ও কান এগিয়ে ধরল। আমি জোর গলায় বললাম, তুমি কোথায় থাক? লোকটা শুধু তার একটা হাত ওপরের দিকে তুলে ঘোরালো–মনে হল ও বলতে চাইল, কে জানে ! লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে গলার স্বর চড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি? এবার শুনতে পেল ও, বলল, তুম–টুম। সেই থেকে আমরা ওকে, টুম বলে জানি। আশপাশের ছেলেমেয়েদের ওর পেছনে খুব লাগতে দেখেছি। বেশী বিরক্ত হলে ও চীৎকার করে ওদের পিছনে তেড়ে যেত–মুখে শুধু বলতে থাকত, মারুম, মারুম। টুম কোথায় থাকত, ওর পরিচয় কি, কেউ তা বলতে পারে নি। দু তিন দিন পরপর আমাদের ঘরে এসে হঠাৎ ডাক দিত, কাঠ নিবা ? শুধু দশ টাকা না, রুটি, ভাত ঘরে যাই থাকত ওকে দেওয়া হত। ও পরম তৃপ্তিতে সব খেয়ে নিত। বেচারা টুম ! সারা দিন কি খেত, কি না খেত, কোথায় থাকত কে জানে ! তবে ইদানীং প্রায়ই আমাদের ঘরে আসছিল। কোন দিন দু টুকরো কাঠ, আবার কোন দিন খালি হাতেই আসত। ও জানত, কিছু না হোক এখানে খাওয়াটা মিলেই যাবে। এমনি দিন কাটছিল—হঠাৎ একদিন ছেলেদের কাছে শুনতে পেলাম, টুম মারা গেছে। –কি করে! আশ্চর্য হয়ে আমি জিজ্ঞেস করে ছিলাম। –কেউ জানে না–রাস্তায় মইরে পইড়ে ছিল, ছেলেদের মধ্যে থেকে একজন বলে ছিল। –কবে? আমি আবার ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম। –এই তো আইজ সক্কালে, ছেলেটাই বলল। –তারপর কি হল? আমি কৌতূহলী হলাম। ছেলেরা বলল, গ্রামের লোকে ওরে পুড়াইতে লইয়া গেছে। টুমের মৃত্যুর দিনই রাত বারটায় আমার ঘরের জানলা দিয়ে ওর ভূতকে দেখতে পেয়েছিলাম। পর দিন মাঝ রাতে স্ত্রী আমায় ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলল, ভয়ে ভয়ে বলল, দেখো, দেখো, জানলায় শব্দ হচ্ছে, বাইরে কেউ এসেছে মনে হয় ! আমি ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালাম, গতকাল রাতের টুমের ভূত দেখার কথা কাউকে বলিনি। সেই ভূতই এসেছে হবে। ঠিক এমনি সময় বাইরে থেকে টুমের গলার আওয়াজ ভেসে এলো, আমায় খাইতে দিবা ? আমার স্ত্রী ভয় পেয়ে খাট থেকে দুই লাফ দিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, ও গো, এ যে টুমের গলা ! চুপ করে থাকলাম, আমি আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু এমনি উপদ্রব তো খারাপ ব্যাপার। আমার দুই ছোট ছোট মেয়ে আছে। ওরা খাটে গভীর ঘুমে অচেতন। কোন রকম ভাবে টুম ভুতের কথা ওরা জেনে গেলে তবে ওরা ভীষণ ভয় পাবে। আমাদের এ রাত জাগা ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হবে। কি হবে ভাবছিলাম। ঠিক এমনি সময় জানলায় হালকা থপ থপ আওয়াজ হল আর সে সঙ্গে শোনা গেল, টুম ভুতের গলা, কাঠ নিবা? ভয় পেয়ে আমি আর আমার স্ত্রী এক সঙ্গে চীৎকার দিয়ে উঠলাম। বিছানায় ঘুমন্ত মেয়েরা সামান্য নড়েচড়ে উঠলো। এবার তৃতীয় দিনের রাত এলো। বেশ রাতে হবে, মনে ভয় নিয়ে আমার স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়ে ছিল। ঘুমের মধ্যেও ওর একটা হাত আমার হাত চেপে ধরা। আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখে ছিলাম–আজ এসপার ওসপার দেখে নেব–টুমের ভূতকে ধমকে দেব। মনে ভেবে নিয়ে ছিলাম, জ্যান্ত থাকতে টুম খুবই দুর্বল ছিল–হতে পারে মরার পরেও ওর ভূত দুর্বল হবে? এ সাধারণ জ্ঞান বলা যায় না, কাজে লেগেও তো যেতে পারে ! সামান্য পরেই জানলায় খুটখাট আওয়াজ পেলাম, জানি টুমের ভূত এসে গেছে। পরক্ষণেই ওর গলা বাতাসে ভেসে এলো, আমারে দুগ্গা খাইতে দিবা? ওর কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি এক ঝটকায় জানালার কাছে চলে গেলাম। গুরুগম্ভীর আওয়াজ করে বলে উঠলাম, খাওয়া নাই–তোর কাঠ আমরা নেব না–আর একবার আসলে কিন্তু তোকে পিটিয়ে মারব। আমার কথায় স্ত্রী জেগে গেছে, খাটের পাশের দেওয়াল ঘেঁষে বসে ভয়ে সে কেঁদে ফেলে ছিল। কিন্তু এদিকে সব চুপচাপ–টুমের আর কোন কথা নেই–জানলাতেও আর ধাক্কা দেয় নি—তবু মনে হচ্ছিল, ভীত মন বারবার ভাবছিল, এখনই বুঝি টুম আবার ডাক দিয়ে বলে উঠবে, কৈ গো, কাঠ নিবা? আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম, সে দিনের পর থেকে টুম কিন্তু আমাদের কাছে আর কোন দিন আসে নি !