তন্বী /অমিত বিশ্বাস

নৌকায় বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আলোচনার বিষয়বস্তু ভূত। ভূত সম্পর্কে আমার মতামত নিরপেক্ষ। সে সব ইনি-তিনি থাকলে আছেন, না থাকলে নেই। আমি কেবল শুনেই মজা পাই।নৌকার ভেতরে আমরা ছাড়া আরো এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। এতক্ষণ তিনি আমাদের কথা শুনছিলেন। হঠাৎ বলে বসলেন, “ভূত সম্পর্কে আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে। শোনার ইচ্ছে থাকলে শোনাতে পারি।”রাকিব বলল, ” হ্যা, নিশ্চয়ই শুনব। এতক্ষণ ধরে যে সব গেছোভূতের মিথ্যা কাহিনী শুনলাম, তাতে মুখ তেতো হয়ে গেছে। একটু জমকালো টাইপের ভূতের গল্প হলে বেশ ভাল লাগে।” লোকটি বলল, “কাহিনীটা জমকালো ঠিক নয়, তবে এতক্ষণ যা শুনেছ তার থেকে আলাদা।”- বললাম, ” তবে তাই শোনান। পথের দূরত্ব কম বলে মনে হবে।” লোকটি বলতে লাগল,
        “ভূত-প্রেতে আমিও ঠিক বিশ্বাস করতাম না। চারপাশে এত ভূতের গল্প, অথচ ভূত দেখেছে এমন লোক পাওয়া যায় না। বিশ্বাস করি কি করে? যাই হোক একবার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আমার এই অবিশ্বাসের কথাই বললাম। ওরা বলল, চাঁদপুর শ্মশানে নাকি কীসব ভূত-প্রেত থাকে। বাজি ফেলে বলল, ওখানে একরাত কাটাতে পারলে নাকি মোটা অংকের টাকা দেবে। আমার টাকার লোভ নেই। আবার বন্ধুদের কাছে ভীতু প্রমাণিত হওয়াটাও বিশেষ সম্মানের নয়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে রাজি হলাম। ঠিক হল সামনের আমাবস্যায় এক রাত ওখানে কাটাব। 
        নির্দিষ্ট দিনে শ্মশানে গিয়ে একটা মোটা গাছের শিকড়ে বসলাম। অমাবস্যার অন্ধকারে জীবন্ত ধরার কঠোরতা প্রতি মুহূর্তেই অনুভব করতে লাগলাম। খানিক বাদে মনে হল, নূপুর পায়ে কেউ একজন আমার চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। দূরে নয়, অথচ কি ক্ষীণ নূপুরের আওয়াজ! ভূতে আমি বিশ্বাস করি না। তবে এত রাতে এই নূপুরের শব্দ কোথা থেকে আসবে? নাকি মনের ভুল? নূপুরে জড়ানো সেই পা দুটি খানিকক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে আমার সামনে এসে থামল। হঠাৎ একটা মায়াবী, অবর্ণনীয় সুন্দর কন্ঠস্বরে কেউ ডেকে উঠল-‘কী চাই এখানে?’
        ভয় পাওয়ার চেয়ে অবাক হলাম বেশি। আগ্রহের সাথে প্রশ্ন করলাম, “তুমি কি ভূত?” অপরপক্ষ বলল,” আমায় পেত্নী বলতে পার।”- হেসে উঠলাম। কোন স্ত্রীলোকের মুখে নিজেকে পেত্নী বলতে শুনিনি কোনদিন। বললাম, “তোমাদের সত্যিই অস্তিত্ব আছে?” ও বলল, ” না হলে তোমার সাথে কথা বলছে কে?”
        পেত্নীর সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বললাম। অমন মিষ্টি সুর যে গলা দিয়ে বের হয় তাকে পেত্নী ভাবতে মন সায় দেয় না। যদিও আসল সবসময় সাদামাটাই হয়। নকলের চমক বেশি। এক সময়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” তুমি মরলে কীভাবে?” ও বলল, ” সে অনেক কথা। শোনার ধৈর্য থাকবে? ” বললাম, ” আমার ধৈর্যের অভাব নেই। ” পেত্নী মৃদুস্বরে হাসল। তারপর বলতে লাগল,
        ‘ আমার নাম ছিল তন্বী। নামকরণ করেছিলেন এক পুরোহিত। যত বড় হতে লাগলাম আমার দেহ সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করে মনে হতে লাগল, পুরোহিত মহাশয় ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। নতুবা এ নাম রাখবেন কেন? পৃথিবীতে নামের কি কমতি ছিল? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পুরুষের চোখে নিজেকে দেখতাম। মনে মনে ভাবতাম, এত রূপ, এত যৌবন যে পুরুষ পাবে, আমায় প্রথম দেখার পর তার মনের ভাব কেমন হবে? এই ভাবনায় শীতল এক পুলক আমার সারা বিকেলটাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। এখন ভাবি, কী দরকার ছিল সেই রূপের? মস্তিষ্কহীন এই করোটির উপরে চামড়ার সেই স্নিগ্ধ আবরণ কি কেউ কোনদিন কল্পনা করতে পারবে? যাক সে কথা। পুরোনো স্মৃতিগুলো কোন মীমাংসায় আসে না। কেবল দুঃখ দেয়।
        ঘরে সুন্দরী মেয়ে থাকলে বাপের যত না আনন্দ হয়, তার চেয়ে বেশি হয় চিন্তা। তার উপর যদি প্রতিবেশী ছেলেদের নজর লাগে! তাই অল্প বয়সে–মাত্র ষোলো পার হতে না হতেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। ষোল বছর বয়স আর যাই হোক বিয়ের জন্য একেবারে অনুপযুক্ত নয়। বরং দশম শ্রেণির পর্যায় সারণি মুখস্থ করার চেয়ে জীবনকে গভীরভাবে মুখস্থ করা অনেক বেশি সহজ। 
        ছেলেদের নজর আমার ভালো লাগত। আমার চোখে চোখ পড়লে যদি কারো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড় হয়, যদি আমায় নিয়ে ছেলেদের মধ্যে সবসময় কলহ লেগে থাকে, তবে তাতে আমার ভাল লাগারই কথা। কোন মেয়ে না চায় ছেলেদের সুনজর তার উপর পড়ুক? উঃ যদি সেই রূপ আমি কোনোভাবে তোমায় দেখাতে পারতাম, তাহলে বুঝতে আমায় যারা দেখেছে তাদের হৃদয় কেমন বিষের নেশায় সর্বদা উন্মাদ হয়ে থাকত।’ – বললাম, ” থাক, তার প্রয়োজন নেই। আমি মাত্রাতিরিক্ত নেশা পছন্দ করি না। তার চেয়ে তোমার কাহিনী বল।”- পেত্নী আবার বলতে লাগল।
        ‘বিবাহ নামক দাঁড়িপাল্লার এক দিকে থাকে পুরুষের অর্থ, অপর দিকে ওজন করা হয় স্ত্রীর রূপ। শুনেছিলাম, আমার স্বামীটি নাকি ধনী। এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। ধনবান পুরুষ কদাচিৎ সুন্দর হয়। তার উপর আবার ডাক্তার। সেই কারণে বিয়ে নিয়ে মনের মধ্যে ভয় ছিল। এত রূপ, এত যৌবন অপাত্রে দান করব? কিন্তু বিবাহ সভায় শুভদৃষ্টিকালে স্বামীর চোখে যখন চোখ পড়ল, তাকে একবার দেখেই নিজের রূপ যেন ভুলে গেলাম। কোন পুরুষ এত সুন্দর হতে পারে! কেবল রূপ নয়, তার গুণও ছিল যথেষ্ট। দোষের মধ্যে ছিল এক যে তিনি নিতান্ত নিরীহ।  রান্নায় লবণ-মরিচের বিস্তর তফাতও অনায়াসে সহ্য করতেন। চোরকে পুলিশে না দিয়ে বরং কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। এমনি ছিল তার স্বভাব। ভেবেছিলাম যোগ্য স্বামীই পেয়েছি।
        আমাদের বৈবাহিক জীবন কিন্তু বিশেষ সুখের ছিল না। স্বামী ছিলেন গম্ভীর। প্রয়োজনের বেশি কথা বলতেন না। লেখার ক্ষমতা কোনকালে হয়েছিল কি না বলতে পারি না তবে প্রচুর বই পড়তেন। এতকাল ধরে স্বামী নিয়ে আমার মনে যে কল্পনা, পদ্মপাতায় ভাসমান জলবিন্দুর মত যৌবনের যে স্নিগ্ধ কামনা বিবাহ লগ্নের প্রতি মুহহূর্তের চিন্তাকে অবর্ণনীয় এক সুখ দিত, স্বামীর সেই গম্ভীর আচরণ তাকে যেন এক মুহূর্তেই ধূলিসাৎ করে দিল। স্বামীর প্রতি প্রেমের চেয়ে ভক্তি জাগল বেশি।
        আমার স্বামীর আর একটা গুণ আমার অসহ্য লাগত। তিনি কথায় কথায় প্রচুর উপদেশ দিতেন। তবে তা আমাকে ছোট বা অস্বস্তিতে ফেলার জন্য নয়। বরং যদি কখনো কোন ভুলও করে বসতাম, সরাসরি সে প্রসঙ্গ না তুলে তাকে অন্যভাবে বোঝাতেন। স্বামীকে দেখে মাঝে মাঝে আমার মনে প্রবল ভক্তির সঞ্চার হত। তাকে স্বর্গের কোন দেবতা বলে তার পায়ে মাথা ঠেকাতে ইচ্ছে হত। তার যে কোন দোষ ছিল না! 
        স্বামীর সাথে যত সময় ব্যয় করতে লাগলাম ততই আমার অজ্ঞানতা আমাকে নিজের কাছেই লজ্জিত করতে লাগল। আমার স্বামী সবসময় আমার খেয়াল রাখতেন। কোন কিছু চাইলে কখনো না করতেন না। গহনা এত গড়িয়ে দিয়েছিলেন যে তা আমার ওজনকেও হার মানাত। কিন্তু বনের পাখিকে সোনার খাঁচায় রেখে রাজকীয় অভ্যর্থনায় তার যতই পরিচর্যা করা হোক না কেন, সে কিন্তু খুশি হয় না। স্বামী চেয়েছিলাম কিছুটা অভিমানি, সামান্য বখাটে গোছের। ভেবেছিলাম তাকে নিজের হাতের গুণে আর রূপের মোহে নিজের মত করে সাজাব। কিন্তু এখন বুঝি, স্ত্রীলোক অন্যের হলে সে আলাদা ব্যাপার কিন্তু নিজের স্ত্রীর রূপ ভুলতে পুরুষ বেশি সময় নেয় না। তবু নিতান্ত ভালোলোক স্বভাব কোন মেয়েই পছন্দ করবে না। তাছাড়া মেয়েরা ভক্তিভরে যে পুরুষের পায়ে হাত দেয়, তাদের কখনো হৃদয়ে জায়গা দেয় না। তাই স্বামীর প্রতি ভক্তি যত বাড়তে লাগল, তিনি যে আমার স্বামী, এ কথা ততই ভুলতে লাগলাম এবং কোন এক সময় কেবল তার জ্ঞানগর্ভ আচরণই ভালো লাগতে শুরু করল। সঙ্গ হয়ে উঠল অসহ্য।
        আমার স্বামীর চোখে সে বিষয় কিন্তু গোপন থাকল না। আমি যে কেবল রান্না করার এক যন্ত্র মাত্র তা তিনি প্রতি মুহূর্তেই বুঝতেন। এও বুঝতেন, যে তাকে পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াই ছিল আমার সৌভাগ্য। তবু তিনি তার এ অপমান নীরবে সহ্য করতেন। প্রতিকারের চেষ্টামাত্র করতেন না।
        একদিন আমার শরীর খারাপ হল। এ রোগকে সম্পূর্ণভাবে শারীরিক বলা যায় না। স্ত্রীমনে অনেকগুলি চাহিদা থাকে যা কেবলমাত্র অর্থ বা গহনা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। আমার কথা বলার মত কেউ ছিল না। স্বামীকে কোন প্রশ্ন করলে কেবল তারই উত্তর দিতেন। বাড়তি প্রশ্ন করতেন না। যদি কখনো বইয়ের কোন বিষয় জানতে চাইতাম, তবেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতেন। কিন্তু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কেবলমাত্র কিছু ধূসর পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে তা কোন স্ত্রীর ভাল লাগতে পারে? আমি চাইতাম ছুটির দিনগুলোতে দুজন কোথাও ঘুরতে যেতে। প্রস্তাব করলে তিনি না করতেন না ঠিকই কিন্তু পার্কে ঘোরার সময় আমার মনে হত পাখির ডাকে তার এলার্জি আছে। আমার স্বামী নিঃসন্দেহে আমায় ভালবাসতেন কিন্তু আমি চাইতাম তার সেই মনের ভালবাসা কণ্ঠনালী ভেদ করে মুখ পর্যন্ত এসে পৌঁছোক। কিন্তু আমার চাওয়া কেবল চাওয়াই রয়ে যেত। তার নিরীহ মুখটির দিকে তাকালে আমার খারাপ লাগত সত্যি কিন্তু কখনো প্রেম অনুভব করতাম না। 
        আমার স্বামী তার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু আমার রোগের কোন পরিবর্তন হল না। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতাম কেবলমাত্র চেহারা ঠিক রাখার জন্য। কেননা মনে হত পৃথিবীতে এই একটি জিনিসই ঈশ্বর আমায় সম্পূর্ণরূপে দিয়েছিলেন। 
        স্বামীর ঔষধে আমার রোগ সারল না। তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্র রোগ সম্পর্কে কতটুকুই বা ধারণা রাখে! আমার স্বামীও সেটা জানতেন। তাই অসুখের পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে তিনি বড় ডাক্তার দেখালেন। কিন্তু অসুখ বিন্দুমাত্র কমল না।
        আমার স্বামী সে সময়ে আমার প্রচুর যত্ন নিতেন। সারারাত হাতের তালুতে কোন ডাক্তারির বই রেখে তিনি জেগে থাকতেন। কিন্তু যখন বুঝতাম এই বইকেই তিনি কর্ণের কবচের মত ব্যবহার করে আমার প্রতি তার সমস্ত প্রেমকে আড়াল করতে চাইছেন, তখন প্রেমের বদলে আমার সারা শরীর জ্বলে উঠত। তার এই ঔদার্যকে শয়তানের ছেলেমানুষি বলে মনে হত। স্বামীর প্রতি প্রবল ঘৃণা জন্মাত।
        আমার অসুখের সময় স্বামী কলেজে যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু একদিন তিনি কিছু না বলেই কলেজে গেলেন। তাতে আমার বিশেষ আপত্তি ছিল না। তিনি না থাকলে বরং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারি। থাকলে সে রাস্তাও বন্ধ হয়। 
        আমার সে অসুখ কিন্তু রূপের মোহ কিছুমাত্র কম করতে পারল না। চেহারার পরিবর্তন ব্যক্তির কাছেই সবার আগে ধরা পড়ে। কিন্তু আমার রূপের বিশেষ পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। আয়নার সামনে যখনি দাঁড়াতাম, অপর পক্ষকে বলতাম, ‘ তন্বী, তুই সত্যিই সুন্দরী! রূপে তোর সমকক্ষ পাওয়া সহজ নয়।’ বলব না-ই বা কেন, আমি আগেই সুন্দরী ছিলাম। তার উপর ঢাকার এ বন্দী জীবন গায়ের সেই রঙ আর চেহারার সেই জ্যোতিকে অনেকখানি বাড়িয়ে তুলেছিল। নিজের কাছে নিজেকে স্বর্গের কোন অপ্সরা বলে মনে হত যে কিনা অনায়াসে মহাদেবের মাথাও ঘুরিয়ে দিতে পারে।”
        খানিক থেমে পেত্নী বলল,
“কি! ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”- বললাম,”না। ঘুমাব কেন?””কেমন লাগছে?””অদ্ভুত!””আমায় দেখতে ইচ্ছে করছে না?””কিছুটা। তবে থাক, সে সময়ে হলে দেখা যেত। এখন তোমার ওই করোটির দিকে তাকালে তোমায় পাওয়ার আশায় না হোক, ভয়ে ঠিকই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হবে। তার চেয়ে চোয়ালের ঠক্ ঠক্ শব্দের সাথে তোমার ওই বীণার মত আওয়াজ শুনি? কি বল?”- পেত্নী এবারও কিছুটা হাসল। তারপর বলতে লাগল,
        ” সেদিন বিকেলবেলা হুমায়ুন আহমেদের ময়ুরাক্ষী বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম আমারো তেমন একটা নদী থাকলে মন্দ হত না। সে হোক কল্পনা, তবুতো একটা কিছু নিয়ে সময় পার করা যেত! হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমার স্বামীর সাথে তার সমবয়সী এক পুরুষ এ বাড়ির দিকেই আসছে। তখুনি বইটি বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে থাকলাম। ভাবটি এমন যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দরজা খোলাই ছিল। স্বামী ভেতরে ঢুকলেন। আমার স্বামীর সাথে আসা সেই লোকটি বলল, “ভাবি তো ঘুমিয়ে পড়েছে।”- তার সেই কন্ঠস্বর কিছুটা ভেজা ছিল।
        রাজপ্রাসাদের সুসজ্জিত কামরায়ই হোক বা বনে অযত্নে বেড়ে ওঠা, ফুলে মধু থাকলে তাতে ভ্রমর বিহার ঘটেই। সে তো আর রাজাকে ভয় পায় না! আমি সেই বন্ধ চোখে যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমার স্বামীর সেই বন্ধুটি মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার সেই সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্মযুগলের মত পা, আলতা রাঙা ঠোঁটের পাশে সামান্য রোগের চিহ্ন সে যে কি অদ্ভুত এক রূপ-লাবণ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে আমার সমস্ত শরীরে, সে রূপ দেখলে বোধ হয় আমি নিজেও মাতাল হয়ে যেতাম। আমি কিভাবে যেন বুঝতে পারলাম আমার স্বামীর সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে বন্ধুবর আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম সেই লোকটির বুকের স্পন্দন, চোখের নেশা। আমি তো সেখানে একজন ছিলাম না! আমি আমার স্বামীর সেই বন্ধু হয়ে নিজেকে লোলুপ দৃষ্টিতে দেখছিলাম। আর দেখছিলাম আমার ভরা যৌবনের অতৃপ্ত দংশণে সেই বন্ধুটির মৃত্যুর আর্তনাদ। যত সেই বন্ধুর রূদ্ধ কন্ঠস্বর কানে আসতে লাগল, এক তৃপ্ত কৌতুকে আমার ঠোঁট দুটি তত কেঁপে উঠতে লাগল। একসময় ধরা পড়ার ভয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলাম। বললাম,
‘এসেছেন?’- স্বামী বলল,’হ্যা। তোমার শরীর খারাপ লাগলে কিছুক্ষণ শুয়ে থাক না…”না আমি ঠিক আছি। উনি কে?”আমার বন্ধু। আলাপ করিয়ে দিই। ও সেলিম। আমরা একসাথেই পড়ি। আর সেলিম ও তোমার ভাবি – যার কথা বলেছিলাম।’ 
        সামান্য কুশল বিনিময়ের পর আমি গেলাম চা আনতে। রান্নাঘরে বসেও আমার কেমন মনে হতে লাগল, সেলিম আমার স্বামীর সাথে কথা বলছে ঠিকই কিন্তু ওর মন পড়ে আছে আমার হাতের স্পর্শে গরম হওয়া কেটলির জলের উপর। প্রতীক্ষায় আছে কখন আমি ঘরে ঢুকি। উঃ সে যে কি নতুন এক পুলক তা কিভাবে বোঝাব তোমায়? আচ্ছা, তোমার কখনো কোন স্ত্রীলোক দেখে মনের মধ্যে ঝড় ওঠেনি?”- বললাম, ‘স্ত্রী লোক ঠিক নয়। তবে একটা মেয়েকে দেখে উঠেছিল। এখন সে আমার স্ত্রী। সত্যি বলছি, যদি আমি হার্টের রোগী হতাম তবে বিয়ের দিন আমাকে বাঁচানো শক্ত ছিল। ছাড়ো ওসব, গল্প শুনি।”- পেত্নী এবারো মৃদুস্বরে হাসল। তারপর বলতে লাগল,
        ” স্ত্রীলোক পুরুষের চোখের নেশা পেলে তাকে ভাল বাসুক আর না বাসুক, ঘোরাতে পছন্দ করে। পুরুষের ভাঙা মন নারীদের সবচেয়ে পছন্দের বস্তু। সেখানে কোন সংকোচ হানা দিতে সাহস করে না। তাই প্রথম দিন যখন বুঝতে পারলাম, সেলিমের চোখে আমাকে দেখার এক মদ লুকিয়ে আছে, তখন ওকে নিয়ে একটু মজা করার জন্য আমার মন নেচে উঠল। মনে হল, রোগ যেন একেবারেই সেরে গেছে। মেতে উঠলাম নতুন আর এক রোগে। কিন্তু কে জানত, নতুন সেই রোগই আমার মৃত্যুর কারণ হবে?”
        বললাম,” বুঝলাম। তো তোমার স্বামী সেটা জানতে পারেন, আর তারপর তুমি আত্মহত্যা কর। এমন কি কাহিনির শেষটা?”” না। আমি আত্মহত্যা করিনি। অত সাহস কোথায় আমার? তবে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন যন্ত্রণা পেয়েছি। এ কাহিনীতে একটু কৌতুক লুকিয়ে আছে। ধৈর্য হারিয়ে ফেলছ না তো!”- এই বলে পেত্নী আবারো হাসল। বললাম,” না, তা নয়। খুব জানতে ইচ্ছে করছে তোমার মৃত্যু কিভাবে হল। যাই হোক। বল, তোমার কাহিনি শুনি।”- পেত্নী বলতে লাগল,
        ” এর পর থেকে সেলিমই আমার ডাক্তার হয়ে বসল। ও সে দিনই বুঝতে পেরেছিল আমার রোগ কিছুমাত্র গুরুতর নয়। এ রোগের জন্য ঔষধও লাগে না। আপনি সেরে যায়। তবু ও বলল যে মাস খানেক নাকি সময় লাগবে। সময় লাগল এক সপ্তাহেরও কম। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হলাম। কিন্তু এ বাড়িতে সেলিমের আনাগোনা চলতে থাকল।
        ধীরে ধীরে সেলিমের সাথে আমার বন্ধুত্ব বাড়তে লাগল। সেলিম দেখতে আমার স্বামীর মত সুদর্শন না হলেও ওর কিছু গুণ ছিল। একে কলেজ টপার তার উপর ও ছিল রসিক স্বভাবের। হাসাতে পারত আর সুন্দরকরে কথা বলতে জানত। একজন পুরুষের এর চেয়ে বেশি আর কি লাগে? ধীরে ধীরে সেলিমকে আমার ভাল লাগতে শুরু করল।
        মানুষের এক স্বভাই এই যে তার নিজের চেয়ে অন্যের জিনিস বেশি ভাল লাগে। আর কোন সুন্দরী স্ত্রীলোক যদি নিজেকে এভাবে দান করতে চায়, তবে কোন পুরুষ ভাললাগার সেই দান ফিরিয়ে দেওয়ার ঔদার্য নিয়ে জন্ম নেয়? তাছাড়া সমাজে কাপুরুষ যারা, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু আয়ত্ত করতে বেশি সময় নেয় না। সেলিম ছিল সেই গোত্রের। চাঁদ যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়, তখন গ্রহন ঠেকায় সাধ্য কার? বলা বাহুল্য, আমার আর সেলিমের বন্ধুত্ব প্রেমে বদলাতে সময় নিল না।
        সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায় না বলেই সস্তা জিনিস দামী বলে মনে হয় নাকি স্ত্রীলোকের সবসময় দামী জিনিসের পরেই লোভ, তা সঠিকভাবে বলতে পারব না, তবে সময়ের ব্যবধানে মনে হত সেলিমকে যেন নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসি। যেখানে প্রেমের অঢেল বন্যা, মানুষের অবহেলা সেখানেই বেশি। আর যেখানে অবহেলা আর কলঙ্কের নির্মম ভয়, মানুষ তার প্রেমকে সেখানেই অঞ্জলি দেয়। আমি জানি, এ কথাগুলো কত বেশি কলঙ্কময়। কিন্তু এখন কি আর সেই কলঙ্কের ভয় আমার আছে? এই দেখনা, আমার শরীরের কতগুলো অস্থি, তাও গুনলে জীববিজ্ঞানের হিসেব মিলবে না, এতে কি কলঙ্ক, কি সুনাম – কোনকিছুরই কি আর অস্তিত্ব আছে?” বললাম,
” হোক সে তোমার অস্থিমজ্জার শরীর। তবু বলব তুমি অন্যায় করেছ।”” তা আমিও স্বীকার করি। কিন্তু একবার ভেবে দেখ, আমার মত রূপ আর স্বামী যদি পেতে, তবে তুমিও কি একই ভুল করতে না? পৃথিবীতে এমন কে আছে যে নিজেকে সঠিক বলে মনে করে না? পরিস্থিতি আর পরিবেশই মানুষকে ভিন্নধর্মী চিন্তা করতে শেখায়। আর সেই চিন্তার ফসলেই কেউ হয় কাপুরুষ আবার কেউ মহাপুরুষ।”” সে তুমি যাই বল, অনুকূলে মহা মূর্খও মহাজ্ঞানী হতে পারে। পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেই বোঝা যায় কার জ্ঞানের পরিধি কত বেশি। তোমার পরিস্থিতি কিন্তু খুব একটা প্রতিকূলে ছিল না।””রাগ করছ আমার উপর?””না ঠিক তা নয়, আচ্ছা এর পরে কি হল? তোমার স্বামী কখনো বিষয়টা জানতে পারেন নি?” পেত্নী বলতে লাগল,
        “পৃথিবীতে গভীর নিয়ে যারা কল্পনা করেন, তারা ক্ষুদ্রকে বৃহৎ করে তোলেন ঠিকই তবে যা সত্যিই বৃহৎ, তা তাদের পাশ কাটিয়ে যায়। তাই প্রথম প্রথম আমার এ নির্লজ্জ আচরণ আমার স্বামীর চোখে ধরা পড়ল না। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা শেষ আছে।
        সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই যেমন অন্ধকার প্রকাশ পায়, তেমনি পাপকে বেশিক্ষণ গোপন রাখা সহজ হয় না। সেও একদিন ঠিকই প্রকাশ পায়। একদিন আমার স্বামী সব জানতে পারলেন। কিন্তু আশ্চর্য হলাম তার আচরণ দেখে। তিনি কোন শাস্তি দিলেন না এমনকি সেলিমকে বাড়িতে আসতে নিষেধ পর্যন্ত করলেন না। কিন্তু তার পরেও আমাদের দেখাশোনা চলতে লাগল। আমার স্বামীর চোখের আড়ালে। স্ত্রীলোক সম্পূর্ণভাবে পাওয়া সম্ভব নয় এমন কাউকে যদি কখনো মন দিয়ে বসে, তবে চিরকাল তার দাসী হয়ে থাকে। তাদের এতেই আনন্দ।
        মিথ্যা বলব না, সেলিমকে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ওর মনে আমার জন্য প্রেম ছিল না। যতক্ষণ তৃষ্ণা না মেটে, পথিক ততক্ষণই ঝর্ণার জল পান করে। তৃষ্ণা মিটে গেলে সেই অফুরন্ত জলরাশির প্রতি তার বিন্দুমাত্র মোহ থাকে না। এ জলপান তৃষ্ণা নিবারণের এক মাধ্যম মাত্র। ঝর্ণার প্রতি প্রেম নয়।
        ধীরে ধীরে আমার প্রতি সেলিমের মোহ কমতে লাগল। ও আগের মত আর দেখা করে না। ফোন করলে এড়িয়ে যায়। সবই বুঝতে পারতাম। কিন্তু অভিযোগ করার মত কোন আদালত ছিল না। চিরকাল ভালবাসা পাওয়াতেই অভ্যস্ত আমি। বিরহের দুঃখ তাই বিষবাণ হয়ে বুকে বিঁধল। অনেক কেঁদেছিলাম ওর জন্য জানো। ওর বলা মিথ্যা কথাগুলো আরো বেশি যন্ত্রণা দিত। সারা দিন যেন কেমন একটা নেশার মধ্যে থাকতাম। ওর জন্য কি বিপুল পরিমানে দুঃখ সয়েছি তা যদি ও কোনদিন জানতে পারত, তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না কখনোই।
        ভালবাসার মানুষ দূরে সরে গেলে ভালবাসা যায় এমন যে কাউকে সামনে পেলেই তাকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। তাই প্রথমবারের মত স্বামীকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে শুরু করলাম। স্বামীর নিরীহ মুখ আর ব্যথিত হৃদয় এইবার আমার কাছে খারাপ লাগতে শুরু করল। কিন্তু আগের সেই স্বামীকে ফেরত পাওয়া সহজ ছিল না। 
        যদিও স্বামীর আচরণে বিশেষ পরিবর্তন দেখলাম না। তিনি এখনো আমার যত্ন নেন, কথা বলেন। কিন্তু এ যে কেবল কর্তব্যের খাতির, প্রেম নয় – সে কথা বুঝতে আমার কষ্ট হত না। আমি প্রায়ই অংকের কোন সমস্যা নিয়ে স্বামীর কাছে যেতাম। তিনি আগের মতই বোঝাতেন কিন্তু তার মুখে আগের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু পেতাম না। তোমায় বোঝাতে পারব না যে নিজের প্রতি তখন কি বিপুল ঘৃণা জন্মাত আমার। যে রূপ নিয়ে বিভোর হয়ে থাকতাম, আয়নার সামনে দাঁড়ালে সেই রূপের প্রতিই বিতৃষ্ণা জাগত। আপন সৌন্দর্যকে যে ঘৃণা করে কিভাবে বুঝবে তার মনোভাব কেমন?
        পৃথিবীতে এমন কেন হয় বলতে পার? ভালবাসলে অবহেলা পাওয়া যায়, আর অবহেলা করলে ভালবাসা। এই ভিন্নধর্মী নিয়ম যে বিশ্বসংসারের কতখানি অন্যায় রচনা তা কেবল চরিত্রগুলোই বুঝতে পারে। লেখক তো থাকেন নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়।
        এই দেখনা আমার জীবনী। কেউ কি অনুমানও করেছিল আমার জীবনের সাথে এমন কোনদিন হবে? কিন্তু হল তো। এমন স্বামী পেয়েছিলাম যার কোন কিছুতেই কমতি ছিল না। যদি প্রথম থেকেই ওকে ভালবাসতে পারতাম তবে কি আজ আমার এ দশা হয়? এতগুলো বছর পরে যখন আমার অস্তিত্ব পৃথিবীর পাতা থেকে একেবারেই মুছে গেছে, তখনও সেই কাহিনীগুলোর দীর্ঘশ্বাস পাঁজরের ফুটো ভেদ করে বের হয়। কোথায় সেই দুই হাজার একুশ আর কোথায় এই দুই হাজার চৌত্রিশ। কল্পনা করতে পার এই অস্থিমজ্জার অসম্পূর্ণ কাহিনী?” – বললাম,
” দাঁড়াও এক মিনিট, এ ২০২১ সালের কাহিনী?”” হ্যা। কেন?”” আমি মনে করেছিলাম আরো অনেক আগের। যাই হোক, তোমার কাহিনী খুব বেশি পুরাতন নয়।”” পুরোনো নয় বলছ? সে শুধু কয়টি বছর মাত্র নয়। সে যে আমার কাছে কত বেশি সময়, তা কিভাবে তোমায় বোঝাব? এক পা এগুতে গেলে যদি দু তিনবার ভাঙা হাড় – গোড় জোড়া লাগানোর ব্যাপার ঘটত, তাহলেই বুঝতে তের বছর কত লম্বা সময়।”” আচ্ছা, সে সময়ে কি একটা মহামারি এসেছিল না? আমরা তখন ছোট ছিলাম। কি যেন নাম…”” সেই মহামারিই তো আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল।” – এই বলে পেত্নী আবার গল্প বলা শুরু করল। কিন্তু এবার আর হাসল না।
       ” সময় তখন দুই হাজার একুশ এর মাঝামাঝি। করোনা তখন বাংলাদেশকে অনেকখানি আয়ত্ত করে ফেলেছে। চারিদিকে এই নিয়ে কোলাহল, মানুষের মাঝে আতঙ্ক, টিভি চ্যানেলগুলোতে সবসময় এই নিয়েই আলোচনা। স্বামী তখন বাড়িতেই থাকতেন। কলেজ বন্ধ, তার উপর লকডাউন। স্বামীর বই পড়ার অভ্যাস আগেই ছিল। এবার সেই নেশা যেন বদভ্যাসে পরিনত হল। আমি আরো বেশি একা হয়ে গেলাম।
        দিন যত বাড়তে লাগল নিজের করা ভুলগুলি আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে মনের মধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করল। এ কেবল ভুল নয়, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কেবল যে আমার স্বামীর সাথে, তা নয়। নিজের সাথেও। এর পর ধীরে ধীরে সেলিমের কথা ভুলতে লাগলাম আর স্বামীকে আরো বেশি করে ভালবাসতে শুরু করলাম। আমি তার চোখে কখনো আমার প্রতি ঘৃণা বা অভিমান দেখি নি। তার এ আচরণ আমার মনকষ্টকে আরো বহুগুন বাড়িয়ে তুলত। প্রেমে ঘৃণা বা ভালবাসা অতি প্রয়োজনীয়। এর মধ্যকার যে সাধারণ আচরণ তা মর্মঘাতী। আমি আমার স্বামীকে মনে মনে ভালবাসতাম। তিনি যেমন আমায় বাসতেন, ঠিক সেভাবে। সে প্রেম ছিল অফুরন্ত। একান্ত গোপন আর দুঃখময়। নিজের ভুলের জন্য অনুশোচনা দিন দিন কেবল বাড়তেই থাকত। 
        এরই মাঝে একদিন রাত্রে আমার স্বামী বললেন, ” এক খালাকে ঠিক করে দিচ্ছি, এখন থেকে সে ই তোমার সব কাজ করে দেবে।” – বললাম,” এর প্রয়োজন নেই, আমি নিজেইতো সব কাজ করতে পারি।”” প্রয়োজন মনে করেই…তাছাড়া তোমার দেখাশোনার জন্যওতো কাউকে প্রয়োজন।”- আমি কিভাবে যেন কিছু অনুমান করলাম। জিজ্ঞেস করলাম,” আপনি যাবেন কোথাও?””হ্যা। চাঁদপুর যেতে হবে।”- আমি এর আগে কখনো স্বামীকে কোন ব্যাপারে প্রশ্ন করিনি। এই আমার প্রথম প্রশ্ন। আমি নিজেই আশ্চর্য হয়েছিলাম সেদিন। স্বামীর কথা বলা বাহুল্য। জিজ্ঞেস করলাম,” চাঁদপুর কেন?””না তেমন কিছু না, এমনিই।”” বলবেন না, চাঁদপুর কি?”” ওখানে ডাক্তার হিসেবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। করোনায় আক্রান্তদের সেবা করার জন্য।””শুনেছি ওটা নাকি ছোঁয়াচে রোগ। আর তেমন কোন প্রতিষেধকও নেই।””হ্যা, কিন্তু সাবধানে থাকলে…””নাই বা গেলেন ডাক্তারের তো অভাব নেই।”” সবাই যদি একই কথা ভাবে তাহলে রোগীদের সাথে কি অন্যায় করা হয় না? আমাকে যেতে হবে।”
        স্বামীকে আটকানো গেল না। তিনি যখন আমায় ছেড়ে গেলেন, বস্তুত তিনি আমাকে চিরতরে ছেড়ে যাওয়ার জন্যই চাঁদপুরের এ বাহানা করেছিলেন, তখন সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারলাম স্বামীকে আমি কতখানি ভালবাসি। তিনি যে আমার জন্যই নিজের সাথে এতবড় অন্যায় করছেন, তা বুঝতে পেরে মন চঞ্চল হয়ে উঠল। বার বার ইচ্ছে করতে লাগল যে ভাবেই হোক ওকে আটকাই। কিন্তু স্বামীর প্রতি সে অধিকার ছিল না। যেখানে আশা আছে অথচ অধিকার নেই, সেখানকার কোন দুঃখ অসহ্য। তাই মনের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলাম। যে ক্ষতি আটকানো একান্ত প্রয়োজন অথচ আটকানোর সামর্থ্য নেই, ক্ষতি যার সে ছাড়া এ ব্যাকুলতা আর কে বুঝবে? সে রাতে বিন্দুমাত্র ঘুম হল না। এক নীরব ব্যথা দুচোখ বেয়ে গড়াতে লাগল। পরদিন সকালবেলা আমায় কিছু না বলেই স্বামী চলে গেলেন। ব্যভিচারিণী স্ত্রীলোকের এই পরিনতি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। আজ অবদি কোন ব্যভিচারিনীর জীবনে সুখকর সমাপ্তি ঘটেছে?
        দুর্বলের প্রধান অস্ত্র ধর্ম। কমতি পড়লে সে যেমন দেবতাকে গালাগালি করে, আবার বিপদে পড়লে সেই দেবতার কাছেই সাহায্য চাইতে তার বাধে না। এই দেবতাই আমার তখন একমাত্র আশা হয়ে দাঁড়াল। আমি রাত দিন প্রার্থনা করতে লাগলাম স্বামী যেন সুস্থ থাকেন। কিন্তু আমার গোপন প্রার্থনা তার কান পর্যন্ত পৌঁছল না। মাসখানেক বাদে খবর পেলাম, স্বামী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সমাজে যা যত পবিত্র, তার ক্ষতি তত বেশি।” বললাম,
“বল কি? মারা গেলেন?””হ্যা।””তারপর?”
        “তারপর আর কি? অনেক কেঁদেছিলাম ওর জন্য। আমার পাপ এত বেশি ছিল যে কাউকে দোষ দিতে পারি নি। মনের মধ্যে সে যে কি বিশাল দুঃখ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম তা তোমায় বোঝাতে পারব না।
        গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হল না। আমার যে কিছু পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা বাকি ছিল। নগদ সুখের যে হিসাব, তা সুদসমেত বুঝে নিতে তো কৃপণতা করি নি। তাই না চাইতেই শুরু হল আমার দুঃখের দিনগুলো। 
        স্বামীর মৃত্যুর পর আমার শরীরে বিশেষ এক রোগ এসে বাসা বাধল। প্রথমটায় শরীরে গোটা গোটা ফুসকুড়ির মত কি সব জন্মাল। প্রথমে মৃদু চুলকাতো। ধীরে ধীরে সেই জায়গাগুলোতে বিষফোঁড়া দেখা দিল। সে কি অসহ্য যন্ত্রনা তা কিভাবে তোমায় বোঝাব? মনের চেয়ে দেহের ক্ষত যে বেশি যন্ত্রণাদায়ক তা সেদিন বুঝেছিলাম। না বসতে পারতাম, না শুতে। দাঁড়ালে যন্ত্রণার পরিমানটা এত বেশি বাড়ত যে সে অনুভূতির কথা কল্পনা করলে এখনো আমার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে ছিলাম। কিন্তু কোন ফল হয় নি। ধীরে ধীরে সারা দেহ সেই চর্মরোগে ছেয়ে গেল। শরীর এত দুর্গন্ধময় হল যে প্রচুর টাকার বদলেও কেউ আমার যত্ন করতে রাজি হল না। সেই রূপ সেই যৌবন সব কেমন করে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। সারা শরীরে কেবল দুর্গন্ধযুক্ত দগদগে ঘা বাস করতে লাগল। আর তার কিছুদিন পরেই আমার মৃত্যু হল।
        আমার এ শাস্তির প্রয়োজন ছিল। আমি যে শাস্তি পেয়েছি এ ভাবনাই এখন আমার একমাত্র স্বস্তির কারণ। পাপ তো আমার কিছু কম ছিল না, তাই না? যাক সে কথা, সকাল হয়ে এল। আজ আসি।।


সমাপ্ত২২ জুন, ২০২১