নাইটকুইন ।। আঞ্জুমান আরা খান


নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে গিয়ে টুকরো আবেগের ধাক্কায় ফুপিয়ে কেঁদে উঠল অদিতি। অদিতির হাতে সমরেশ মজুমদারের কালবেলা বইটির শেষাংশের পৃষ্ঠা খোলা। এই নিয়ে তৃত্বীয়বার পড়া হচ্ছে কিন্তু আজ আর এগোল না, বই থেকে চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে শুয়েপড়ল অদিতি।
বিছানার এক পাশে উবু হয়ে বসে কাজ করতে থাকা অভিলাষ ফিরে তাকাল। অভিলাষ আর অদিতির চার বছরের সংসার।ছোটোখাটো একটি চাকরী তবু নানা ব্যস্ততায় দিন কাটে অভিলাষের। সে একটু বিরস এবং বাস্তববাদী মানুষ কিন্তু অদিতি কল্পনাবিলাসী এবং অধিক আবেগপ্রবন। বই পড়তে গিয়ে আপন মনে হেসে উঠা, কেঁদে ফেলা তার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব আবেগ অভিলাসের খুব সস্তা মনে হয় কিন্তু আজ কেনো যেন তড়িঘড়ি লেপটপ বন্ধ করে অদিতির পাশে গিয়ে বসল অভিলাষ।।অদিতি কাঁদছে, একটু বেশিই কাঁদছে!অভিলাষ হাত বাড়িয়ে বইটি বন্ধ করে চোখের পানিতে লেপ্টে যাওয়া চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল,
-আজ আর পড়তে হবে না,চা খাবে? করে আনি?
অদিতি ঈষৎ হেসে বলল,

  • না থাক তুমি বারান্দায় গিয়ে বসো আমি করে আনছি।
    চোখ ভর্তি জল নিয়ে একটা মেয়ের হেসে দেয়ার দৃশ্য দেখে অভিলাষের একটু ভাবান্তর হলো,বুকের ভেতর কেমন যেন অজানা একটি মায়া অনুভব করল। অন্যদিন হলে বলতো, বারান্দায় যাওয়ার কি দরকার!
    কিন্তু আজ কিছু বলল না। ধীরপায়ে বারান্দার দিকে গেল অভিলাষ। বারান্দায় পা রেখে প্রথমেই চোখ পড়ল বড়োসড়ো একটি টবের দিকে, মেজাজ সামলে নিয়ে নিচু গলায় বলল,ছাদের জঙ্গল এখানে কেনো! মশার আড়ত বানানোর ব্যবস্থা, চার দিকে এমনিতেই মশার কামড়ে নানা রকম জ্বর হচ্ছে,ছাদ থেকেও গাছ ফেলে দিতে হবে।অদিতি চায়ের পানি বসিয়ে অভিলাষকে শান্ত করতে বারান্দায় এসে বলল,
    -আাজই ছাদ থেকে দাড়োয়ান চাচাকে দিয়ে গাছ টা বারান্দায় আনিয়েছি। ভোর বেলায় নিয়ে যাবে আবার ।তাকিয়ে দেখো এটি একটি অদ্ভূত সুন্দর ফুলের গাছ! পাতার আগা ফেটে কলি বের হয়েছে, পরিপক্ক কলি রাত বারোটায় ফুটতে শুরু করবে, মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে বড় বড় সাদা ফুলে পরিনত হবে। কাছে থেকে দেখব বলে এখানে আনিয়ে রেখেছি। তুমি বসো আমি চট করে চা নিয়ে আসছি, তুমিও জেগে থাকবে আজ আমার সাথে।
    অদিতি রান্নাঘরে ঢুকল।
    অভিলাষের শুনশান নিরবতা, অদিতি কথা বলার সময় জানালার ফাঁক গলে ছিটকে পড়া ঘরের আলো যখন অদিতির মুখের উপর পড়েছিল; অভিলাষ দেখতে পেলো অদিতির চোখে পানি নেই! কিন্তু ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল,’ একি চেহারা হয়েছে অদিতির! গত চার বছরে কখনো তো এমনটা দেখেনি! তখন মনে পড়ল কদিন ধরে ওতো খাওয়া দাওয়াতেও অনিয়ম করছে! আচ্ছা রান্নাঘর থেকে এলে জানতে হবে কী হয়েছে, অভিলাষ চোখ বন্ধ করে অফিসের কিছু পেন্ডিং কাজের কথা ভাবতে গিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। চায়ের পিয়ালা হাতে অদিতি ফিরে এসে নাক ডাকার শব্দ পেয়ে থমকে গেল, কিছুটা অভিমানী মনে চা টা নামিয়ে রেখে রুমে চলে গেল সে। বারোটা বাজতে এখনো তিরিশ মিনিট বাকি বইয়ের বাকী অংশে চোখ বুলানো যেতে পারে কিন্তু অভিলাষ ঘুমিয়ে আছে বারান্দায় রকিং চেয়ারে! ঘুমটা নষ্ট করতেও মন চাইছে না, না হয় বারোটায় ডেকে নিলেই হবে,জেগে উঠে দেখবে চোখের সামনে ফুল ফুটছে! ভাবতে ভাবতে বই হাতে ঘুমিয়ে গেল অদিতি।অভিলাষের যখন ঘুম ভাঙল তখন রাত এক’টা। তার চোখে বিস্ময়! টবের গাছ ভর্তি সাদা নাইটকুইন ফুল প্রায় ফুটে উঠেছে, নেশা ধরা মিষ্টি সুবাস ছড়াচ্ছে! মন ভালো হওয়ার মত পরিবেশ কিন্তু জানলায় চোখ পড়তেই দেখল অদিতি বুকের উপর বই নিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে।মনটা পাশে থাকা ঠান্ডা চায়ের কালচে সরের মত তিক্ত হয়ে উঠল;চায়ের কথা বলে নিজে ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধ বোধে!
    অদিতিকে জাগাবে কিনা ভাবতে ভাবতে অবিলাষ যখন শোবার ঘরে পায়চারী করছে তখনি চোখ পড়ল ওয়্যারড্রপের উপরে রাখা একটি খোলা খামের উপর,দ্রুত খামটি খোলে চোখ ছানাবড়া! আকাশ বাতাস দুলিয়ে হৃদয় মাঝে এক অজানা আবেশের অনুভূতি! নিজেকে পৃথিবীর রাজা-ধীরাজ বলে মনে হতে লাগল। যার অপেক্ষা রাজ্য নয়, অপেক্ষা একটি রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যার।এটি একটি প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট সমেত ডাক্তারী নির্দেশনা, যেখানে রয়েছে অদিতির বাড়তি যত্নের কথা। এটা অদিতি তাকে বলেনি! কিন্তু কেন? সেটা কি তার স্বল্প আয়ের টানাপোড়েন!নাকি অধিক ব্যস্ততায় অদিতিকে দেয়া সময়ের কার্পণ্য! অদিতি হয়ত অভিমান করে নিজেকে অবহেলিত ভেবেছে! মুহূর্তকাল অপেক্ষা না করে অদিতির কাছে ছুটে আসার উপক্রমে চোখে চোখ পড়ে যায় অভিলাষের। ঘুম কেটে গেছে অদিতির। তাকিয়ে আছে অভিলাষের দিকে, সে দেখছে,দেখছে এক অন্য অভিলাষকে, যার পাথরসম হৃদয় গলে বিবেচনা বোধহীন চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে !জগতের সকল ভালোবাসা উগরে দিতে মূহুর্তকালে আছড়ে পড়ে অভিলাষ! এ উচ্ছ্বাস কেবল জৈবিক নয়,একটি বন্ধনের দায়বদ্ধতায় ব্যর্থতার গ্লানি সারাতেও।অদিতি দেখতে পেলো গাছ সমেত টব অভিলাষ শোবার ঘরের মাঝখানে এনে রেখেছে,দ্বিধাহীন আমেজে তখনো সুবাস ছড়াচ্ছে ফুলগুলো।