বই প্রকাশের খরচ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

বর্তমান সময়গুলোতে ফেসবুক ও কমিউনিটি ব্লগগুলোর কল্যাণে মানুষ আগের ডায়েরির পাতায় লেখার বদলে এখন এসব ডিজিটাল ডায়েরি ব্যবহার করে থাকেন নিজেদের লেখালিখির মাধ্যম হিসেবে । তাতে লেখকের সংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে কাগুজে বই প্রকাশিত কমই হচ্ছে ।
প্রকাশকরা লগ্নিকৃত অর্থের লোকসানের ভয়ে সাধারণত নতুন লেখকদের বই প্রকাশ করতে ভরসা পান না খুব একটা । কিন্তু লেখক যদি নিজ অর্থে বই প্রকাশ করতে চান, সেক্ষেত্রে প্রকাশকরা নবীন লেখকদের বই প্রকাশ করে থাকেন ।
এ ক্ষেত্রে নতুন লেখকদের অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে। এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, প্রকাশক নামধারী ব্যক্তি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছেন বা এমন নিম্নমানের বই প্রকাশ করেছেন যা পাঠক কোনভাবেই ছুঁয়েও দেখতে চায় না।
প্রতিটি বইয়ে আইএসবিএন (নাম্বার) যুক্ত করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এই নাম্বারটি না হলে বইটি প্রকাশের কোন অর্থই হয় না।
বইয়ের প্রচ্ছদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিয়ের আসরে যেমন কুৎসিত মেয়েও মেকআপের কারণে রূপসী বনে যায়, বইয়ের মানসম্মত প্রচ্ছদও তেমনি। এই বিষয়টি লেখক কখনও নিজে না নেওয়াই ভালো। প্রকা্শক যদি শিল্পী না হন, তাহলে যোগ্যতাসম্পন্ন শিল্পীর হাতে ছেড়ে দেয়াই যৌক্তিক।

বই প্রকাশের খরচ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ :
আমরা যারা লেখালেখি করি, ফেব্রুয়ারির গ্রন্থমেলা সামনে রেখে তাদের মধ্যে বই প্রকাশ নিয়ে একটা চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে যায়। মুদ্রণ ও প্রকাশনা জগত্ সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তাদেরকে এ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দেওয়াই এই লেখার উদ্দেশ্য।
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের খরচে যাদের বই প্রকাশিত হয় তাদেরকে খরচের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। কিন্তু যারা প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তিতে কিংবা স্বউদ্যোগে বই ছাপাতে চান তাদের জন্য কিছু হিসাব-নিকাশ এখানে উল্লেখ করা হবে। তবে তার আগে সবার প্রতি অনুরোধ, আপনার লেখাটিকে যদি মানোত্তীর্ণ মনে করেন তাহলে ভালো কোনো প্রকাশকের কাছে জমা দিন।
কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক যদি আপনার পাণ্ডুলিপিটি গ্রহণ করে এবং দুই বছর পরেও সেটা প্রকাশ করে তো তাদেরকে দেওয়াই উত্তম। কোনো প্রকাশক যদি একান্তই তা না করতে চায় তাহলে নিজ খরচে ভালো কোনো প্রকাশকের মাধ্যমে বইটি বের করুন। অনেক বড় প্রকাশকও আজকাল এ পদ্ধতিতে বই প্রকাশ করে। তবে ভালো প্রকাশক আপনার খরচে বই প্রকাশ করলেও পাণ্ডুলিপিটা মানসম্পন্ন কি না দেখে নেবে। পদ্ধতিটা হল এমন, প্রকাশক বইটা প্রকাশ করবে তবে আপনাকে নির্দিষ্ট সংখ্যক বই ক্রয় করতে হবে। সেই নির্দিষ্ট সংখ্যাটা হতে পারে ৩৫০। তবে এই পদ্ধতির আসল ব্যাপারটি হচ্ছে প্রকাশক আপনার কাছ থেকে যে টাকাটা নেবে তা দিয়েই বইটা প্রকাশ করবে। তারা এর পেছনে কোনো ইনভেস্ট করবে না। এরা মূলত বই ছাপানোর সময়ই লেখকের কাছ থেকে তাদের লাভটা আদায় করে নেয়। আর অনেকে সংখ্যার হিসাবে কারচুপি করে। দেখা গেল, আপনার কাছ থেকে এক হাজার বই ছাপানোর খরচ নিয়ে তারা পাঁচশো বই ছাপল। তাই খেয়াল রাখবেন, যত সংখ্যক বই ছাপানো হবে বলে আপনার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ততসংখ্যক বই ছাপা হচ্ছে কি না। কাগজ, ছাপা ও বাঁধাইয়ে মান বজায় থাকছে কি না। বইয়ের দাম ওই প্রকাশনীর ওই মানের অন্য বইয়ের সমতুল্য কি না।

নিজ খরচে যারা বই বের করবেন তারা নিচের খরচের হিসাবটা বোঝার চেষ্টা করবেন। যাদের এ ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই তাদের কাছে কঠিন মনে হলেও আশা করি এটা আপনাকে অনেক কাজে দেবে।

একটি বই প্রকাশ করতে হলে যথাক্রমে এই কাজগুলো আমাদের করতে হয় :
কম্পোজ
প্রুফ রিডিং এবং সম্পাদনা
অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদ ডিজাইন
মেকআপ
পেস্টিং অথবা কম্পিউটারে ফর্মা সেটিং
ট্রেসিং ও পজেটিভ
প্রচ্ছদের পজেটিভ
প্লেট তৈরি
ইনার ও প্রচ্ছদের জন্য কাগজ
ছাপা
লেমিনেশন
বাঁধাই।
ফর্মা কাকে বলে :
একটি ডিমাই (২৩ ইঞ্চি–১৮ ইঞ্চি) বা ক্রাউন (২০ ইঞ্চি–১৫ ইঞ্চি) কাগজ মানেই এক ফর্মা। সাড়ে আট বাই সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি (প্রায়) সাইজের বইয়ে ১৬ পৃষ্ঠায় এক ফর্মা আর বড় সাইজের বইয়ে ৮ পৃষ্ঠায় এক ফর্মা।
১৬ পৃষ্ঠায় ফর্মার বই করতে হলে ডাবল ডিমাই কাগজ এবং ৮ পৃষ্ঠার বইয়ে ডাবল ক্রাউন কাগজ ব্যবহার করা ভালো। এই সাইজ দুটো হল কমন সাইজ। আমাদের দেশের এবং বিদেশের প্রকাশকরা অবশ্য এর বাইরেও বিভিন্ন সাইজের বই বের করে।
আমাদের দেশের মার্কেটে সাধারণত ডাবল ডিমাই এবং ডাবল ক্রাউন সাইজের কাগজ বেশি পাওয়া যায়। সেদিক দিয়ে একটা ডাবল কাগজের দুই দিক ছাপা মানে দুই ফর্মা। তার মানে একটা দশ ফর্মার বই ছাপতে আপনার দরকার হবে পাঁচটি ডাবল ডিমাই বা ডাবল ক্রাউন কাগজ। এভাবে ৫০০ বই করতে কতটি কাগজ দরকার তা আপনি সহজেই বের করতে পারবেন।
বইয়ের ফর্মা সংখ্যার হেরফের হলেও হিসাব করতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এখন চটজলদি বের করে ফেলুন আপনার বইটি কয় ফর্মার হবে এবং কত শিট কাগজ আপনার দরকার। যত শিট কাগজ দরকার তাকে ৫০০ দিয়ে ভাগ করলেই আপনার রিমের হিসাবটি বের হয়ে আসবে। অর্থাৎ ৫০০ শিট=১ রিম। মনে রাখবেন, প্রিন্টিং ও বাইন্ডিংয়ের কয়েকটি পর্যায়ে যেহেতু অনেক কাগজ নষ্ট হয় তাই ৫০০ বই পেতে হলে আপনার কমপক্ষে আরও ৪০-৫০টি বইয়ের ম্যাটেরিয়াল বেশি দিতে হবে।
ডিসেম্বরের দিকে কাগজের দাম সাধারণত বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানের বইয়ে ৬০ থেকে ৮০ গ্রাম কাগজ ব্যবহার হয়। গ্রাম হচ্ছে কাগজের পুরুত্বের হিসাব।

প্লেট কী :
প্লেট হচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি একটি মুদ্রণ অনুষঙ্গ। আপনার বইটি যদি ডাবল ডিমাই মেশিনে ছাপতে চান তবে বইটি যত ফর্মার হবে ততটি প্লেটের দরকার হবে। প্রতিটি প্লেটের মেকিং চার্জসহ দাম পড়বে ৪০০ টাকার মতো। তবে সময়ভেদে গত বছর ৬০০ টাকা পর্যন্ত দাম ওঠে।
প্লেট করার আগে আপনার লেখাগুলোকে ট্রেসিং বা পজেটিভ আকারে বের করতে হবে। বইয়ের মেকআপ করা থাকলে প্রতিটি ট্রেসিং নিতে খরচ পড়বে ১৫ টাকা। এক ফর্মায় ৮টি ট্রেসিং লাগে। আউটপুট নিতে হলে প্রতি বর্গইঞ্চি/প্রতি কালারের জন্য দরকার হবে ৫০ থেকে ৬০ পয়সা। পজিটিভ করতে হলে ফর্মা সেটিং আগে করে নিতে হবে। তবে বাংলা পজেটিভ করতে ফন্টের সমস্যার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
কভার সাধারণত ছাপা হয় ডিমাই মেশিনে। প্রতিটি ডিমাই প্লেটের জন্য খরচ পড়বে ১৫০ টাকার মতো। উভয় ক্ষেত্রেই প্রতি কালারের জন্য একটি প্লেট ব্যবহার করতে হবে। তার মানে আপনার বইটির ভেতরের অংশ যদি এক কালারে ছাপা হয় তবে তার জন্য প্রতি ফর্মায় একটি প্লেট, যদি দুই কালারে ছাপা হয় তাহলে প্রতি ফর্মার জন্য দুটি প্লেট আর যদি চার কালারে ছাপা হয় তবে প্রতি ফর্মার জন্য চারটি প্লেট দরকার হবে।
বইয়ের প্রচ্ছদ সাধারণত চার কালারে ছাপা হয়, তাই এর জন্য চারটি ডিমাই সাইজের প্লেট দরকার হবে।

প্রচ্ছদ :
বই বের করতে হলে প্রচ্ছদের দিকে বিশেষ খেয়াল দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে প্রচ্ছদশিল্পী থেকে শুরু করে সব কাজেই প্রফেশনালদের ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখা উচিত, প্রিন্টিং টেকনোলজি বেশ জটিল। তাই এ কাজে যে-ই জড়িত হবে সে যেন প্রিন্টিংয়ের এ টু জেড অবগত থাকে। আর বইয়ের মূল আকর্ষণই হচ্ছে প্রচ্ছদ এ কথা তো আমরা জানিই। বড় বড় আর্টিস্টরা একটি প্রচ্ছদের জন্য বিভিন্ন রকম পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। তবে প্রচলিত মানের একজন প্রচ্ছদশিল্পীর একটি কাজের পারিশ্রমিক আড়াই হাজার টাকার মতো।
ইলাস্ট্রেশনের খরচ নির্ভর করে ভেতরে কী পরিমাণ কাজ থাকবে তার ওপর।

প্রুফ রিডিং এবং সম্পাদনা :

বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সম্পাদনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু আমাদের দেশে এই পেশায় যোগ্য লোক নেই বললেই চলে। তবু আপনার প্রকাশনাটি মানসম্পন্ন করতে চাইলে একজন যোগ্য সম্পাদক খুঁজে বের করা উচিত। সাধারণ মানের লেখকরা ধারণাই করতে পারেন না তার লেখাটিতে কত ধরনের খুঁত থেকে যায়। একজন ভালো সম্পাদক সেগুলো দূর করতে পারেন। তবে হতাশার কথা এই যে, আমাদের দেশে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রায় কারওই সম্পাদনার ওপর কোনো বাজেট থাকে না। তবে প্রুফ রিডাররা আছেন। তারা টুকটাক ভুলভাল যে ধরেন তাতেও বইয়ের মান কিছুটা বজায় থাকে। মনে রাখা দরকার, আপনি যা জানেন তার মধ্যে কতটুকু ত্রুটি আছে সে ব্যাপারে আপনার মোটেই ধারণা নেই। যদি থাকত তবে আপনি ভুল লিখতেন না। বই প্রকাশের পরে তাতে যে কোনো ধরনের ভুল থাকাটা কতটা হাস্যকর তারা মোটেই জানেন না যারা ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করেন। কয়েকদিন আগে এক বইমেলায় একটি বইয়ের নাম দেখলাম, ‘লেলিন….’। বুঝতেই পারছেন যারা লেনিনের নামটি ঠিকমতো জানেন না, তারা লেনিন সম্পর্কে কী বই বের করবেন। আর একজন বিজ্ঞ পাঠক যখন বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এ ধরনের ভুল দেখবেন তখন ওই বই হাতে নিয়েও দেখবেন না। তাই এই ব্যাপারটিতেও আপনাকে নজর দিতে হবে।
এবারে আমরা একটা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য হিসাব করব। এই হিসাব চূড়ান্ত কোনো হিসাব নয়। এর চেয়ে কম অথবা বেশি বাজেটেও এ ধরনের একটা বই প্রকাশ সম্ভব হতে পারে। এটা নির্ভর করে আপনি কতটা কোয়ালিটি মেইনটেইন করবেন তার ওপর।

নমুনা হিসাব
বইয়ের সাইজ : ৫ ফর্মা (৮০ পৃষ্ঠা)
কাগজ : ৮০ গ্রাম বসুন্ধরা
ভেতরের ছাপা এক কালার
কভার চার কালার, লেমিনেশন ও বোর্ড বাঁধাই
সংখ্যা : ৫০০ কপি
ইলাস্ট্রেশন
মেকআপ ও ট্রেসিং
প্রুফ রিডিং
কাগজ ২ রিম ১৫ দিস্তা
পেস্টিং
ডাবল ডিমাই প্লেট ৫টি
ছাপা ৫ প্লেট
আর্টপেপার ১২০ গ্রাম ৮ দিস্তা
৭০ গ্রাম জ্যাকেটের পেপার ৪ দিস্তা
প্রচ্ছদ ডিজাইন
প্রচ্ছদের পজেটিভ
ডিমাই প্লেট ৪টা
প্রচ্ছদ ছাপা
পোস্তানির কাগজ
লেমিনেশন
বাঁধাই
পোস্তানি প্রিন্ট
অন্যান্য

এই নমুনা হিসাবের সাথে আপনার বইয়ের সাইজ হিসাব করে বের করে নিন আপনার বইটি ছাপাতে কত টাকা খরচ হতে পারে।
লেখক হিসাবে এইসব বিষয় আপনার জানা থাকলে কেউ আর আপনাকে ঠকাতে পারবে না।
এবার বিক্রি
দোকানে বিক্রি ক্ষেত্রে ৪০% ও পরিবেশকদের কাছে বিক্রিতে ৫০% কমিশন দেওয়া যেতে পারে। বইমেলায় ২৫% কম ক্রেতাদের কাছে বই বিক্রি করা হয়। অনলাইন বিক্রির ক্ষেত্রেও ৪০% কমিশন দিতে হয়।

জহিরুল ইসলাম । শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক