শিক্ষকতা পেশা কতটুকু মহান! //গোলাম মোর্তুজা

আঁধার ধেয়ে আসে প্রতিটি জীবনে। সেই আঁধারকে ভয় পেলে চলে না। শিক্ষা নামক শক্তি দিয়ে আঁধারকে জয় করার মনোবল অর্জন করতে হয়। সময় ও অসময়ের দ্বন্দ্ব থাকবেই। দ্বন্দ্ব থেকেই সত্য উদঘাটিত হয়। সত্য এলেই ছন্দ আসে। ছন্দ এলেই ছন্দায়িত জীবনের বাঁশি বাজে। তখনই দুঃখে ডুব সাঁতার করা মানুষগুলো বলে ‘আমি সুখী।’ সুখ পরিমাপ করা যায় না। কিংবা সুখকে দেখে দেখে মন ভরানোও যায় না। সুখ অনুভূতির নাম। এ কারণেই সুখের ব্যাখ্যা একেকজনের কাছে একেক রকমের।

জীবনে সুখ যতই ধরা দিক না কেন সুখ কিন্তু দুঃখের ওপিঠ। তাই সুখ খুব বেশি সময় অপেক্ষা করে না। এই তো সুখ, এই তো দুঃখ। সবমিলিয়ে জীবনে চলে প্রেতবৎ ছায়ার মতো সুখ-দুঃখের খেলা। জীবনে অনেকেই সুখী হওয়ার মূলমন্ত্রই ভাবেন টাকা, টাকা আর টাকা। আবার কেউ কেউ ভাবেন, টাকাই সব সুখ বয়ে আনতে পারে না, সেখানে দরকার হয় ভিতরের কাউকে। ভিতরে অর্থাৎ মনের ভিতরের মনকে। এক্ষেত্রে অবশ্য মনকে জারণ করে প্রিয় কোনো মানুষের মুখ। অবশ্য টাকা ছাড়াও জীবন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। জীবনকে দহন বা লেহনের যে কথাই বলি না কেন সবখানে টাকা দরকার।

টাকার সঙ্গে সম্মান থাকলে তো জীবনটা আদুরে হয়ে যায়। যার অনেক টাকা আছে তাকে সুখ নামক পাখিটা ধরা নাও দিতে পারে। তবে অল্প টাকা থেকেও অনেকেই সুখী হতে পারেন। এটা ঠিক যে, টাকা দিয়ে সুখী হওয়ার সব উপকরণ কেনা যেতে পারে। আবার সুখী হওয়ার সব সরঞ্জাম থেকেও দুঃখের দানব এসে সব শেষ করতে পারে। তাতে কী জীবন তো সীমানাহীন। তবুও মানুষ বাঁচে, হন্যে হয়ে সুখ খোঁজে।

সমাজে সামাজিক সম্পর্কের জটিল জালে আমরা আবদ্ধ। একের সঙ্গে আরেকের সম্পর্ক আমাদেরকে এক মায়াবী বন্ধনে ধরে রাখে, গড়ে দেয় জীবনকে। এভাবে তৈরি হয় সময়ের ভূগোল। সমাজের একেক জন একেক পেশা ও বৃত্তিতে নিয়োজিত হয়। শিক্ষিত ও মার্জিত রুচির অধিকারীরা নিজেকে সম্মান ও শ্রদ্ধার বেদিতে আসীন করতে শিক্ষক নামক শব্দের সঙ্গে পরিচিত হন। যুগ যুগ ধরে ‘শিক্ষকতা এক মহান পেশা’- আপ্তবাক্যে পরিণত হয়েছে। সেই আপ্তবাক্যের ফাঁদে অনেকেই ধরা খেয়ে শিক্ষকতা পেশায় নাম লেখান।

প্রথম প্রথম গ্রামে-গঞ্জে বা শহরে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন পেতে পেতে নিজেকে দামি ও সকলের শ্রদ্ধাভাজন মনে করেন। আস্তে আস্তে মোহের পাহাড়ের বরফ গলতে থাকে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হয়। আহ্! এদেশে কোনো কোনো শিক্ষক বেতন পান আবার কেউ কেউ পান না। দীর্ঘসময় বিনা বেতনে পাঠদান করাতে করাতে অনেকেই হাঁফসে উঠেছেন।

জানিনা কবে এই স্বপ্নের ধ্বজাধারী শিক্ষিত মানুষগুলো জোরে শ্বাস ছেড়ে বলবেন, বাঁচলাম, রক্ষা পেলাম। সেই সুদিনের দেখা জীবিত থাকতে পাওয়া যাবে কি না তারও কোনো লক্ষণ চোখে পড়ে না। বেসরকারি তারপরও আবার ননএমপিও-এদের তরে কাজ যারা করবেন বা করার প্রত্যয়ে আছেন তারা যেন আলস্যের মাঝে জেগে আছেন। জেগে জেগে যারা ঘুমান তাদেরকে কীভাবে আর জাগানো যায়। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মন্ত্রণালয় কেন এমন করেন? কেন এমন করছেন?

নীতিমালা- শিক্ষকদের পাওনা না পাওয়ার নাম। নীতিমালা করে ননএমপিওদের পাঁজর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার বড় বড় জটিল শর্তে ননএমপিওরা নাজেহাল। কিন্তু তাই বলে তারা পাঠদান থেকে সরে দাঁড়ায়নি। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যাঘাতও ঘটাননি।

হতাশায় আর অভাবের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে অনেক ননএমপিওদের জীবন থমকে গেছে আবার অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে গেছে। যারা আহ্ণাদ ও প্রত্যাশা নিয়ে শিক্ষক হওয়ার স্মৃতির মিনার গড়েছিল আজ তারা মানবেতর জীবনের করুণ পথে। রাষ্ট্রের কী কোনোই দায় নেই তাদের জন্য। কল্যাণ রাষ্ট্রে তো এমন কাজ শোভন হয় না। বরং কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সুখভাবনা করাই দায়িত্ব।

আর সেখানে দেশে এত এত শিক্ষক অর্ধাহারে, অনাহারে, অর্থাভাবে স্বাধীন দেশে বিলীন হয়ে যাচ্ছে- এটা দেখে রাষ্ট্রপ্রধানের মনে ব্যথার উদ্রেক হওয়া এখন যেন বাস্তবতার দাবি।

আবার একটি প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক শাখা এমপিও হলেও পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি কলেজে রূপান্তরিত হলে আবার নতুন করে কলেজ শাখাকে এমপিও নিতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি বাস্তব ও যুক্তিসম্পন্ন নয় বলেই মনে হয়। একবার প্রতিষ্ঠান এমপিও হয়েছে তো তাতেই হলো। সেই প্রতিষ্ঠানের পরবর্তী ক্লাস খোলার অনুমতি মিললেই ল্যাটা চুকে গেল। কিন্তু না, তা হচ্ছে না। পরবর্তী ক্লাস খোলার সঙ্গে আবার এমপিও নিতে হচ্ছে- যা দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে না।

কিছু কিছু শিক্ষক বেতন পান। স্কুল কলেজের বেতন দিয়ে বর্তমান সময়ে হাসতে হাসতে সংসার চালানো যায় না। মাসের মাঝামাঝি গিয়েই ধার আর দোকানে বাকি নিতে হয়। যেসব শিক্ষকরা (স্কুল, কলেজ) বেতন পান তারা নাকি এমপিও শিক্ষক। এটা কেমন কথা! বিস্ময় জাগে মনে। শিক্ষক এমপিও। গচঙ এর পূর্ণরূপ গড়হঃযষু চধু ঙৎফবৎ বা মাসিক বেতন আদেশ। বোঝা গেল যে, শিক্ষকদের জন্য সরকারিভাবে মাসিক বেতন আদেশ হওয়াই এমপিও। এই টার্ম বা বিষয়টি শুধুমাত্র শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র এমপিওভুক্ত শুধু সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই পায় এই এমপিও এর দেখা। আর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও নামক জাদুময়ী কাল্পিক বাক্সটির দেখা পাননি তারা তো দিনাতিপাতি করেন শিক্ষক হওয়ার হাহাকারে।

দিন যায়, মাস যায়, বছরও যায় আসে নতুন নতুন এমপিও নীতিমালা। নীতিমালার পাহাড় বেয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই পাহাড়ের শীর্ষে উঠে জয়োল্লাস করতে পারে না। তবুও শিক্ষক হওয়ার বাসনা মেটে না। নীতিমালা পূরণের প্রত্যাশায় আবার চেষ্টা-প্রচেষ্টা চলে। এতে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জোরে জোরে শ্বাস নেয়। নীতিমালার নীতি পূরিত হয় না। একটা পূরণ হলে তো হয়। সেটা পূরণ করা গেলে আবার নতুন নীতি আসে মালা হয়ে। শিক্ষকের শিক্ষক হওয়ার স্বাদ মোটেই মেটে না। এমপিও নীতি, মালা হয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখা এবং তা পড়ে গলাতে জড়িয়ে যায়। না, এতেও হয় না। নীতি হয়, নীতি যায়। রাজা যায়, রাজা আসে শিক্ষকের ভালো ভাগ্যের রেখাটি মিলমিলে-ই রয়ে যায়।

এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তবুও দিন গুজরান করে। শিক্ষকতার পাশাপাশি চলে নানান কাজের সুযোগ সৃষ্টির নানান সাধনা। অনেক সাধনার চাপে শিক্ষকতার মূল পাঠ থেকে সরে আসতে হয়। মানে দাঁড়াল, একজন এমপিও শিক্ষক পর্যাপ্ত অর্থ পান না। আর পেলে কে বা নানান ইনকামের ধান্দায় থাকবেন। শিক্ষকের আসল কাজ নিজের জ্ঞানের ভা-ারকে ফুলে-ফসলে পূর্ণ করে তারপর তা শিক্ষার্থীর মাঝে বিলি-বিতরণ করা। অথচ এমপিও শিক্ষকরাই নানান কাজে দৌড়ঝাঁপ করেন-টাকা উপার্জন করেন। শিক্ষার কী হলো! শিক্ষার নামে ছল চলছে। সময় বয়ে যাচ্ছে অথচ শিক্ষার্থীরা তেমন কিছু পেয়ে নিজেকে জ্ঞান-গরিমায় পুষ্ট করতে পারছে কী?

বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকদের নতুন বেতন কাঠামো প্রয়োজন এক পৃথিবী সমান। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে জ্ঞানের মশাল জ্বালাবে কে? এককথার উত্তর হচ্ছে, শিক্ষক। শুধু কী শিক্ষক? না, শুধু শিক্ষক নন। অভিভাবক ও বন্ধুদের দ্বারাও শিক্ষার্থীরা শেখে, বোঝে, জানে। শিক্ষকদের নিয়ে ভাবনার ক্ষেত্র কবে তৈরি হবে? শিক্ষকরা যদি আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল হোন তবে কারও তো ক্ষতি হবে না। বরং শিক্ষকদের ভালো রাখলে তো গোটা জাতিই উপকৃত হবে।

শিক্ষক হবেন জ্ঞান আর প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক। সমাজের বিবেক। সুশীল সমাজ বিনির্মাণের দিকপাল। আদর্শ, সচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক তৈরির সাহসী বীরযোদ্ধা। চরিত্রবান, স্বাস্থ্য সচেতন সমাজ তৈরির হাতিয়ার কিন্তু শিক্ষক। সেই শিক্ষকদের নিয়ে একটি উন্নয়নবান্ধব জনপ্রিয় শাসক চুপ থাকতে পারেন না। শিক্ষকরা পাবেন সর্বোচ্চ বেতন। পাবেন রাষ্ট্রের কাছ থেকে ঈর্ষণীয় মর্যাদা। পাবেন বছর বছর পুরস্কার। শিক্ষকদের সঙ্গে চলবে দেশপ্রধানের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আর বৈঠকি মেজাজে কথাবার্তা। একটু বেশিই বোধহয় বললাম। বললাম শিক্ষকতার একরাশ ভালোবাসার আবেগ থেকে।

সরকারপ্রধানের সঙ্গে মাসে না হোক, ছয়মাস পরেও না হোক, একবছরে একবার তো কথা হতে পারে আর সেদিনই হবে গোটা দেশের সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সকল ভালো শিক্ষকদের মাঝে সম্মাননা, পুরস্কার (অনেক অনেক ভালো নামি-দামী লেখকদের বই) এবং বেশকিছু অর্থ। এটা করতে পারলে একদিকে গোটা দেশের শিক্ষকদের মাঝে এক অনাবিল অনন্দ ছুঁয়ে যাবে। শিক্ষকরা হবেন কর্মচঞ্চল। নিজের পাঠকে করবেন আরও বেগবান ও বুদ্ধিদীপ্ত। অবশ্য এই কাজের জন্য সরকারের কিছু খরচ হবে। এদেশে বিভিন্ন কাজেই তো অর্থ খরচ হয় পরবর্তীতে তার উপকার কতটুকু হয় তা সময়ই জানে।

খরচ হলে হবে তা যদি গোটা শিক্ষক সমাজকে আলোড়িত করে তা করা কোনো দোষের হবে না। বছর শেষে কিছু শিক্ষক- এখানে ভালো শিক্ষকের কথাই বলছি। ভালো মানের শিক্ষকরা যখন সরকার বাহাদুরের কাছে থেকে পুরস্কার পাবেন, তখন অন্যান্য একটু কম ভালো বা মাঝারি মানের শিক্ষকরা পাঠদানে ভালোর থেকে ভালো করার চেষ্টা করবেন। এভাবে ভালোরা আরও ভালো আর অন্যান্যরা ভালো করার সাধনায় মশগুল থাকবেন। এই বিষয়টি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাল্টে দেবে। একজন আতর বিক্রেতার গায়ে আতর লাগাতে হয় না। তার গায়ে মানে গোটা শরীর থেকে বিভিন্ন আতরের সুরভি বের হয়।

তিনি যখন ক্রেতাকে আতরের গন্ধ নাকে দেওয়ার জন্য হাতে তটজলদি এক চিমটে লাগিয়ে দেন তখন কিন্তু আপনাআপনি আতর বিক্রেতার নিজের হাতেও লেগে যায়। আতর নিয়ে অনেকেই নাক সিঁটকান, তাতে কী আতর বিক্রেতার কিছু যায় আসে? না, তাতে আতরবিক্রেতা কিছুই মনে করেন না। তবে বলি কী কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে এই আতরের কদর দিনকে দিন বাড়ছে। আর একটি কথা শিক্ষকরা আতরের মতো। তারা যেখানে যাবেন সেখানেই সুরভি ছড়াবেন। ভালোর তো আর শেষ নেই। ভালো কাজের প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিলে ভালোর সংখ্যা বেড়ে যায়। ভালো কাজে কদর বাড়ে। আদর পায় ভালো কাজকারী। ভালো মানের শিক্ষক খোঁজার ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। দলের লেবাস যেন এখানে কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।

আমাদের সরকারপ্রধানকেই এই ব্যপারে সৎ, যোগ্য, পরিশ্রমী আর নিষ্ঠায় অটুট কিছু সংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করতে হবে। টিমটি সারা বছর জুড়ে কাজ করবে। বছর শেষে ফলাফলের কাগজ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা পড়বে। সেখান থেকে সরকারের কাছে তালিকা যাবে। এবং সরকারপ্রধান তালিকায় থাকা শিক্ষকদের ব্যাকগ্রাউন্ড জানার জন্য আবার একটি বিশেষ টিম গঠন করবেন এবং তা কদিনের মধ্যে শেষ করবেন। অবশেষে ঘটা করে শিক্ষকদের নিয়ে একটি বিশাল জমকালো অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশনা দেবেন। বছরে একবার শিক্ষকদের সঙ্গে মিলনমেলা করলে আমার বিশ্বাস পরবর্তী বছরে শিক্ষার সকল সেক্টরে একটা ঝলমলে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বিরাজমান থাকবে। এতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরা যখন নিজেকে অনেক জানার মাঝে ডুবিয়ে রাখবেন তো সেখান হতে যখন ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিতরণ করবেন তাতেই শিক্ষার্থীরা যোগ্য হয়ে তৈরি হবে। শুধু বছর বছর সার্টিফিকেট অর্জন করার নামই শিক্ষা হতে পারে না। শিক্ষার আসল কাজ বাইরের নয়, ভিতরেরও। শিক্ষার সঙ্গে নিজেকে সুযোগ্য, কর্মঠ, অধ্যবসায়ী, জ্ঞানী করে তুলতে পারলেই শিক্ষার ষোলকলা পূর্ণ হয়।

একটি দেশ এমনি এমনি এগিয়ে যায় না। প্রতিটি সেক্টরের উন্নতিতেই দেশের উন্নতি। শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ ব্যয়ের খাত করতে হবে। কিন্তু এদেশে সেটা হয় না। এমপিওরা যা পেয়েছেন তা তো পেয়েছেনই! তাহলে ননএমপিওরা কেমন আছেন! শিক্ষক হওয়ার বাসনা যে মরেনি উনাদের। শিক্ষক হলেই জীবনের সফলতা আসবে। দাম পাবে সমাজে। মর্যাদার শীর্ষে থাকবে রাষ্ট্রের কাছে। না, এরকম কিছুই হয়নি। শিক্ষার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত কেন বেসরকারি থাকবে! বেসরকারি মানেই তো বেকায়দা। এই সত্যি কথাটি শিক্ষকরা বোঝেও বোঝে না, অবুঝ হয়ে থাকেন। বছরের পর বছর বিনা বেতনে কোনো পেশা বা বৃত্তির মানুষকে দেখা যাবে না নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবে, দায়িত্ব পালন করবে।

একমাত্র শিক্ষক অর্থাৎ ননএমপিও শিক্ষকরাই এই কাজটি করছেন। ননএমপিওদের সুযোগ্য আসনে বসিয়ে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া কর্তব্য। একজন কাজের মেয়ে বা ছেলে কাজ করলে দিনশেষে কিছু না কিছু অর্থ পায়। কিন্তু বেসরকারি বা ননএমপিওদের শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যে, সেখানে বেতন পায় না। বড়ই দুর্ভাগা দেশ! এদেশে গৃহহীনরা গৃহ পায়।

রোহিঙ্গারা স্থান পায়, পায় ঘর, অথচ ননএমপিওরা পায় না বেতন। দীর্ঘদিনের না পাওয়ার বেদনারা ভিতরে ভিতরে ডুকরে কাঁদে। এ কান্না শোনে না কেউ-ই। শুনলেও তা আবেদন জাগায় না। শিক্ষক হয়ে যারা শ্রম দিচ্ছেন তাদের কী সংসার নেই। তাদের সংসার চলে কীভাবে- এটা কে ভাববে। ভাবনার মতো সেরকম ভাবুক কোথায় পাওয়া যায়! ভাবেন অনেকেই তবে সে ভাবনার সঙ্গে অনেক নিরাসক্ত নিয়ম এসে বাধ সাধে। দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান আর কটাই বা আছে। মাধ্যমিক শিক্ষার প্রায় ৯৫ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৬৬০টি প্রতিষ্ঠান সরকারি। শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য বেসরকারি শিক্ষকরাই এগিয়ে আছেন। যারা এগিয়ে আছেন তাদেরকে নতুন নতুন পুরস্কারের (সেটা আর্থিক হলেই ভালো হয়) সরকারের কাছে থেকে ঘোষণা আসাই মানবিক ও সময়োপযোগী হতো। তা কি হলো, নাকি হচ্ছে? না, তা হচ্ছে!

ইতোমধ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি শিক্ষার পরিবেশকে স্বাস্থ্যপ্রদ করেনি। বরং বেড়েছে বিচ্ছিন্নতা। একটি উপজেলায় অনেক ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল অথচ মাত্র একটি স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণের জন্য নির্বাচিত করা শুধু কষ্টসাধ্যই হয়নি, হয়েছে ব্যাপক ঝামেলারও। তাছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব তো আছে। নেতার সেলামির কথা বাদ দেই। একটি-দুটি বিচ্ছিন্নভাবে জাতীয়করণ করে তেমন একটা সুফল পাওয়া যাবে না। যায়ওনি। উপজেলায় একটি স্কুল যখন সরকারি হয় তখন উপজেলার অসংখ্য শিক্ষার্থীই সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বাসনায় মত্ত থাকে।

ফলে যা হওয়ার তাই হয়, মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় ওসব সরকারি প্রতিষ্ঠানে। আর কম মেধাবী, স্বল্প মেধাবী এবং অতি কম মেধাবীরা ঘুরে ফিরে চলে আসে আবার সেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তাতে কী হলো? হলো আর কী বেসরকারি শিক্ষকরা ঘষে-মেজে ভালো কিছু করার প্রত্যাশায় ব্যস্ত থাকলেন, নইলে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান বাড়বে না। শিক্ষার্থীর মান বাড়লেই তো ফলাফল বাড়বে। ফলাফল ভালো করার চেষ্টায় যারা নিয়োজিত থাকেন তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেউ নন, উনারা সবাই-ই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো ছেঁকে ছেঁকে একটি বিশেষ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেসব বাছাই করা শিক্ষার্থীরা এমনিতেই ভালো পরবর্তীতে আরও শাণিত হবে, ভালো করবেই- এটাই স্বাভাবিক। তাই সরকারি বিদ্যায়তনের সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষায়তনের মধ্যে ইঞ্চি-ফুটের ফারাক হয় না, হয় যোজন যেজন।

সরকারি মানেই ভালো এই ধারণা সকলেরই। তাই সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীরা মুখিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি যখন এমপিও ছিল তখন অতটা কদর ছিল না। সরকারিকরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী যে অসাধ্যকে সাধন করল যে রাতারাতি প্রতিষ্ঠানটির মূল্যমান বেশি হয়ে গেল। এমন না যে প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরণের সময়ে সকল শিক্ষককে পরিবর্তন করে সরকারের তত্ত্বাবধানে পাকাপোক্ত শিক্ষা ও দক্ষতায় তৈরিকৃত শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। না, এটাও করা হয়নি। তবে কেন সেসব প্রতিষ্ঠানটি বদলে গেল। মূলকথা, সরকারিকরণ যেকোনো প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট ছকে চলে। থাকে না সভাপতি বা গভর্নিং বডির দৌরাত্ম্য। ফলে শিক্ষকরা প্রাণের আবেগ ও উচ্ছ্বাস মিলিয়ে এবং মিশিয়ে পাঠদানে মনোনিবেশ করেন। থাকে না বেতন কবে হবে তার চিন্তা। থাকে না কম বেতন পাওয়ার ভাবনা। সকল শিক্ষকসহ কর্মচারীরাও হয়ে যায় স্মার্ট। বেসরকারি শিক্ষকদের শরীর থেকে ঘামের যে দুর্গন্ধ ছিল তা পরিবর্তিতরূপে সেখানে পারফিউম এর সুগন্ধে ভরে ওঠে। সবমিলিয়ে এক নিবিড় পরিবেশ বিরাজ করে। তাই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের কোনো বিকল্প নেই।

ননএমপিও বা এমপিও কোনো শব্দই শিক্ষার অভিধানে থাকার আবশ্যকতা দেখি না। আজ যে শিশু, কাল সে নাগরিক। ভবিষ্যতকে, ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দেওয়া তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ভবিষ্যৎ গড়তে হবে বর্তমানকে কাজে লাগিয়ে। শিশুরা যত বেশি জানবে ততই আগামীর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার সুযোগ পাবে। ভালো শিক্ষকরাই ভালো ও সঠিকভাবে জানাতে পারে। যেকোনো দেশের জন্যই ভালো শিক্ষক সম্পদ, তবে সেই সম্পদকে সঠিক ও পরিমিতভাবে ব্যবহার যেমন করতে হবে তেমনি সেই সম্পদকে আরও বাড়ানোর ফন্দি-ফিকিরে থাকতেও হবে। যত ভালো শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো ততই যেন শিক্ষার পথটি সুডৌল হবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর। সময়টা দিনক্ষণ বা মাসের হিসেবে ছোট নয়। তবে দেশের শিক্ষা কেন আজও বেসরকারি হয়ে থাকল। একটা নিয়মের আওতায় এনে একটি বাস্তবভিত্তিক, বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার বড্ড প্রয়োজন। বোধ করি, সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে জাতীয়করণ করতে পারলে ভালো হয়। একসঙ্গে তা করতে না পারলেও দুটি বা তিনটি ধাপে করা যেতে পারে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করলে লাভবান কে হবেন? কারা হবেন? এই প্রশ্নটি থাকতেই পারে।

অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেখানে প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ও সম্মতির হিসেব অঙ্কের হিসেবে অনেক। সে প্রতিষ্ঠান সরকারি হলে সকল সম্পদ ও সম্পত্তি সরকারের-ই হবে। লাভবান সরকারই হবে। সেসবের সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত দেখভালে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এতদিনের বেহিসেবি খরচ আর অর্থ তছরুপাতের একটা বিহিত হবে।

কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্পদ নাও থাকতে পারে। তবে সেসব প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে টাকা আছে। সেগুলোর খোঁজ কেবল সরকারই পাবে। আবার এমনো প্রতিষ্ঠান আছে যে, কোনো নিজস্ব জায়গা নেই। সরকারিকরণের প্রক্রিয়ায় এসব ব্যাঙের ছাতার মতো গজে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাতিল করতে হবে। একটা সমন্বিত সমন্বয় করে পাশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওসব ছাত্রছাত্রীদের ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয় হবে। আর ওসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগুলো যেন বেদনার আঘাতে মুষড়ে না যায় সে ব্যবস্থাও সরকারকেই করতে হবে। শিক্ষকদেরকে পাশের বা উপজেলাভিত্তিক অথবা জেলাভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিধি অনেক। আর সে বিধির ফাঁকফোকর আছে কি না জানি না। তবে বিধিকে টপকিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের নানান উপায়ে ম্যানেজ করে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলোর মুখ দেখেছে সত্য, সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো আজ পুরো শিক্ষাব্যবস্থা তো এমনিতেই অনেক ভার তারপর আবার এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাব্যবস্থার বোঝা শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো না পারছে খুব ভালোভাবে সামনে যেতে, না পারছে শিক্ষার মূল লক্ষ্য পূরণ করতে। এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে দেশের জেলা শহরগুলোতে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র টাকা উপার্জনের ধান্দায় ভাড়া বাড়িতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করে। এসব ভাড়া বাড়িতে চালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একবাক্যে বন্ধ করতে হবে। নিজস্ব জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এটাই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। তাছাড়া শুধু ঘরে ঘরে পাঠদান চললেই তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলে না।

শিক্ষার জন্য চাই পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের আবহ। চাই খেলাধুলার জন্য মাঠ। চাই আনন্দ, উচ্ছলতা প্রকাশের ক্ষেত্র। তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের কী হবে। তাদের ভাগ্যে যেন দুঃখের কালিমা লেপটে না যায় সেটাও ভাবতে হবে সংশ্লিষ্টদের তথা সরকারকেই। কালের বেদনার এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না।

সমস্যাকে আবার জিইয়ে রাখলেও চলবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব জায়গায় হস্তান্তরের জন্য কিছুটা সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। প্রতিষ্ঠান খোলার সরকারি প্রবিধানকে যথাযথভাবে পূরণ করার জন্যও সময় দেওয়া যেতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে কাজে ব্যর্থ হলে সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো অটো বন্ধ হয়ে যাবেÑ এই মর্মে একটি অঙ্গীকারপত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সহি করে নিতে পারলে ভালো হয়।

এভাবে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বেসরকারি শিক্ষার লক্কড়-ঝক্কড়মার্কা বাসটিকে সরব ও সচল করে সরকারিকরণের মহাসড়কে আনা যেতে পারে। শিক্ষকতার এই মহান পেশাটিকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার জোর মিনতি করছি।

অ.আ সময়- 9:7 p.m

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য