শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রস্তুতি//গোলাম মোর্তুজা

পরীর গল্প বা রাক্ষস-খোক্ষসের গল্পের মিছামিছি কাহিনী বলতে বলতে মা বোনেরা নাজেহাল। তিতকুটে বাসি ভাবাবেগের গল্প আর কত! ছোট্ট সোনামণিরা ঘরে থাকতে চায় না। তবুও ঘরেই রাখতে হবে সন্তানদের। সন্তানদের মনে নিস্তব্ধতার আঁধার ঢুকে গেছে। কোনো কিছুই যেন শিশুর মন টানে না। অবশেষে মা বাবারা এক আশ্চর্য জাদুকরি শক্তি মোবাইল হাতে তুলে দিলেন। সন্তানরা তা পেয়ে বড্ড খুশি। মোবাইলের মাঝে ওদের পৃথিবী পরিব্যপ্ত। মা-বাবারা এবার একটু নিশ্চিন্ত হলো এই ভেবে যে, এবার সন্তানকে থামানো গেল। সন্তানরাও ঘর থেকে বের হয় না। সারা দিন মোবাইল, টেলিভিশনে মেতে থাকা-এটা আদৌ কী ভালো হলো? না, ভালো হলো না। মোবাইলে গেম খেলা আর অজানার তরে পাড়ি দেওয়াতে সন্তানরা ওস্তাদ বনে গেল। এ অবস্থায় সন্তানদের মাঝে এক ধরনের ঘরকুনো স্বভাব তৈরি হলো। ঘর থেকে বাইরে বের হওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করলেও হয়তো একদিন আমাদের সন্তানরা পুরস্কার নেওয়ার বাসনা জাগবে না। বাইরে বের না হওয়ার জন্য নানান অজুহাত তৈরি করবে। ঘরই সব।
ঘরই যেন ওদের কাছে আরাধ্য হয়ে যাবে। কল্পনা ও সৃজনীশক্তির অপমৃত্যু। এরকম অবস্থার পরিবর্তন কীভাবে করা যাবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে গেলে এসব ঘরকুণোকে নিয়ে মহাবিপদে পড়া হবে। যে পাখিকে ঘরে বন্দি করা হয়েছে তাকে ছেড়ে দিলে কী উড়ুক উড়ুক মন নিয়ে উড়ে বেড়াবে? যে পাখি উড়বার শক্তি ও সাহস নির্বাসনে দিয়েছে সে কীভাবে উড়বে? এ কাজ করা মুশকিল হবে, তবে দুঃসাধ্য হবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলে যায়। নদী বদলায়। পাড় ভাঙে, পাড় গড়ে। প্রকৃতিও বদলে যায়। বিশ্ব স্থবির। এই স্থবিরতার মাঝে যদি চলনের চাকায় বাতাস লাগে তবে তো চলতে হবে। কিন্তু করোনার কারণে সন্তানদের মনের চারপাশে যে নিষেধের রেখা স্পষ্ট হয়েছে তা অস্পষ্ট করতে সবাইকে কাজ করতে হবে। সবাই বলতে বোঝাতে চাই পরিবারের সবাইকে আর বাইরের সবাই বলতে শিক্ষকদের বোঝাচ্ছি। সময় যখন বদলে যায়- এই বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে সবার আগে নিজে বদলাতে হবে। পরে পরিবারের সন্তানদের বদলানোর কাজে লাগতে হবে। নিজেরা বড় বলে অভিযোজন ক্ষমতাও বেশি নিজেকে কর্মব্যস্ত ও আবার বাইরের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে যোগ করে তুলতে বোধ করি তেমন বেগ পেতে হবে না। বড়ই বেগ ও আবেগ প্রকাশ করতে হবে সন্তানদের বাইরের প্রতিবেশের সঙ্গে মিল করাতে। গরমিল এসে হাজির হবে সত্য সেখানে অভিভাবকদের একটু সচেতন ও চৌকস হতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে পরিবেশের নতুন আবহ নিয়ে পাশাপাশি থাকতে হবে। সন্তানদের সুযোগ্য করে গড়তে কখনো তাদের সামনে ভয়ের তীরন্দাজ সাজবেন না। ওদের সঙ্গে নমনীয় হয়ে বাস্তবতা lvlর কথা বলতে হবে। অতীত ও বর্তমানের সেতু রচনা করতে হবে।

ধমকের স্বরে সন্তানদের বোঝালে তা কেবলই বলাBই হবে। হিতে বিপরীতও হতে পারে। বেশি ডোজ কোনো কিছুতেই ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে না। এভাবে আস্তে আস্তে সন্তানকে বাইরের অর্থাৎ স্কুল-কলেজের পরিবেশের সঙ্গে মেলাতে হবে। এ তো গেল ভেতরের কাজ এবার বলা দরকার বাইরের অর্থাৎ শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে। শিক্ষক মাত্রই আদর্শ। একজন শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক আইডল। শিক্ষকের মাঝেই রয়েছে মোহ আর মায়া। তাই শিক্ষকের এক একটি কথা ওরা (ছাত্রছাত্রীরা) পালন করার চেষ্টা করে। শিক্ষক সচেতন দৃষ্টিতে শিক্ষার্থীর চালচলন, কথাবার্তা অবলোকন করবেন। আর তা শুধরে ভালো অভ্যাস গঠনের জন্য চেষ্টা চালাবেন। এ তো বলা হলো শহরিয়ানার ভাব। এবার গ্রামের কথা বলা যাক। করোনার কারণে শিক্ষার সঙ্গে সব বিদ্যার্থীর দূরত্ব বেড়েছে এটা সত্য, কিন্তু গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মাঝে এ ব্যবধান বহুদূর পর্যন্ত এগিয়েছে। গ্রামের অনেক অভিভাবক অজ্ঞ, অশিক্ষিত ও অসচেতন।
পরিবারে কেউ কাজবিহীন হোক সেটা স্কুল, কলেজ যাওয়া কিংবা আর্থিক কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত থাকা থাকলে অভিভাবকদের মাথায় বোঝা আছে মনে করেন। পরিণামে যা হওয়ার তাই। মেঘ না আসতে বৃষ্টিপাতের মতো কন্যা সন্তানগুলোকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বিদেয় করতে পারলেই যেন বাঁচেন। ছেলে সন্তানগুলোকেও অল্প বয়সে বিবাহ ও কঠোর ও কঠিন কাজে পাঠাতেও তারা পিছপা নন। একদিকে করোনা আরেক দিকে অভাব নামক দানব। সবমিলে মধ্যবৃত্ত ও নিম্নবৃত্তরা ভালো নেই। তারা কন্যা সন্তানদের শুধু শুধু বাড়িতে বসিয়ে খাওয়ানোর চেয়ে বিয়ে দেওয়াই উত্তম মনে করেন। ফলে এই করোনাকালীন মুহূর্তে অনেক শিক্ষার্থী কন্যা সন্তানদের বিবাহ হয়ে গেছে। ছেলে সন্তানদের বিভিন্ন কাজে লাগানোর জোর প্রচেষ্টা-এই প্রচেষ্টাতে তারা কামিয়াবও হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাল্য বয়সেই ছেলে সন্তানদেরও বিবাহ দিয়েছেন। এ ঘটনাগুলো আমাদের শিক্ষার অবস্থা কী করবে সে বিষয়ে ভাবনায় ডোবা ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন বৈকি।
পরীক্ষা না দিয়ে পরবর্তী ক্লাসে। বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ খুব কম, নেই বললেই চলে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে-পাঠদানে ফেরাতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয় আমাদের মননে রাখা জরুরি। দীর্ঘকাল বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা আর এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিরানব্বাই ভাগই চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে নিম্ন মধ্যবৃত্ত আর মধ্যবৃত্তরা। খুবই কষ্ট হচ্ছে বলতে, শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই আর কখনো শ্রেণিকক্ষের পাঠদানের পঠন-পাঠনের আওতায় আনা যাবে না।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এলো অনলাইন ক্লাস। না, তাতেও সব শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে করা গেল না। আর যাবেই বা কী করে। এই দেশে কত জনার-ই অনলাইনে থাকার সক্ষমতা রয়েছে। শিক্ষাটাকে এগিয়ে নেওয়া বলে কথা এলো অ্যাসাইনমেন্ট বা নির্ধারিত কাজ। এটাতেও কী কাজ হলো! বাংলাদেশের ইন্টারনেটের অনেক দাম। এখানে একজন সাধারণ মানুষ নেটের হিসেবি ব্যবহার করতে পারে না। কোনো নেট কোম্পানিও এই দুঃখ-তাপের সময়েও এগিয়ে আসেননি। সস্তা কোনো প্যাকেজও ঘোষণা করেননি। দেশপ্রেমিক আর কোথায় পাওয়া যায়! দেশের দুর্দিনে যদি নিজেদের কাজে না লাগানো গেল তাতে আর কীই বা সার্থকতা থাকল। দেশের তরে জীবন দেওয়ার কথা বলছি না।
শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে দিলে হয়তো আরও অনেক শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষার আওতায় আনা যেত। না, তা হয়নি। শহর আর গ্রামের পার্থক্য এখানে স্পষ্ট। শহরের মানুষগুলো সন্তানের জন্য অনেক কিছু করেন। অর্থাৎ সন্তানের অনলাইন শিক্ষাকাজ চালানোর জন্য নেট কিনে দিতেও পারেন কিন্তু গ্রামের অভিভাবকটির কী অবস্থা! যেখানে পেটের দুমুঠো ভাতের জন্য চিন্তায় মগ্ন, সেখানে নেট কেনা তো নেটবিলাসীই বটে। আবার শুধু নেট কিনলেই কী চলবে! নেট চালানোর জন্য মোটামুটি ধাঁচের মোবাইল, ল্যাপটপ, প্যাড বা কম্পিউটার প্রয়োজন-সেটার ভাবনা তো বাকি থাকল।
মহামারীর পরিস্থিতিতে গ্রামে বেড়েছে অসহায়ত্ব আর শহরে বেড়েছে পেশা পরিবর্তনের হিড়িক। যারা স্থায়ী দরিদ্র তারা তো আছেই এর সঙ্গে আবার নতুন নতুন গরিবের আয়োজনে আমাদের অর্থনৈতিক পরিবেশ ভারী হয়ে গেছে চোখের সামনেই ফ্রেমে বাঁধা ছবির মতো দেখা মিলেছে শহর ও গ্রামের বিভেদ, ধনী ও গরিবের মধ্যে পার্থক্যের বিশাল পাহাড়।
কেউ কেউ দীর্ঘ ছুটির মাঝে কাজ হারিয়ে বাড়িতে অবস্থান করেছে। জমানো টাকা খরচ করেছে। বাড়ির পড়–য়ারা অর্থাৎ স্কুল-কলেজে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা মুখথুবড়ে পড়েছে। পারিবারিক দৈন্যদশা যখন চারদিক থেকে অক্টোপাশের মতো চেপে ধরেছে তখন পারিবারিক অশান্তি যেমন বেড়েছে তেমনি পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনার হাল একেবারেই সিঁকেয় উঠেছে। বেড়েছে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, নারীদের প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানির মতো ঘৃণিত সবকাজ। এসব সন্তানের স্কুল-কলেজে ফেরাতে হিমশিম খেতে হবে।
গত ২৪ আগস্ট, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার মতো তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর জন্য দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত বাংলাদেশে চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই তথ্য আমাদের শিহরিত করে।
শিক্ষার্থীরা বহুদিন থেকেই স্কুলের মাঠ, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে যায়নি। এই না যাওয়া থেকে ওদের মাঝে এক মানসিক বিপর্যয় এসে বাসা বেঁধেছে। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে এই অপূরণীয় ক্ষতি আর না বাড়ার জন্য আমাদের প্রাণপ্রিয় সরকার প্রধান চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বারবারই কোনো চেষ্টাই তেমন একটা কাজে আসেনি। ছেলে ভুলানো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট লিখন, শিখন ফল থেকে লেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। শহরের অভিভাবকগণ অ্যাসাইনমেন্ট শব্দের অর্থ বুঝলেও সন্তানদের ঝামেলায় না ফেলার জন্য কোনো ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার দোকান থেকে উত্তরপত্র নিয়ে সন্তানকে লিখতে বলেছেন।
আবার কোনো কোনো পিতামাতা আদরের দুলাল বা দুলালিকে দিয়ে লিখিয়ে না নিয়ে নিজেই অধ্যবসায়ী মনোভাব নিয়ে খাতা-কলম আর উত্তরপত্র নিয়ে বসে গেছেন। শিক্ষাকে আর কীভাবে কালিমা লেপন করা যায়! কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যখন বাবা বা মাকে নিজের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির কাজে লাগতে দেখে তখন শিক্ষার্থীর মনে শিক্ষার জন্য জিইয়ে রাখা ভালোবাসার কী হাল-হকিকত হয় তার ব্যাখ্যা এখানে করতে গেলে কারো কারো মাথায় বজ্র ভেঙে পড়তে পারে। তাই এক্ষণে হেন লেখা থেকে বিরত থাকলাম। এ তো গেল শহরের চিত্র। ও আরেকটি কথা লেখা অ্যাসাইনমেন্ট জমা প্রদানের জন্য কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যেতে হয় তো কী হলো! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে উপায়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেওয়া হয় সেখানে স্বাস্থ্যবিধি শতভাগ মানা গেল? না, সেটাও সম্ভব হয়নি। সত্যি কথা সেটা সম্ভব করা যাবেও না। এখানেও অভিভাবকের ভিড়। সন্তানদের বাড়িতে রেখে নিজেরাই প্রতিষ্ঠানে এসে জমা দেন।
তারা একপ্রকার হুড়োহুড়ি করে জমা দেন। তারা বোঝেন না, তিনি কোনোভাবে আক্রান্ত হলে পরিবারের সবাই-ই আক্রান্ত হবেন। আসল কথা তারা না বোঝেন করোনা, না বোঝেন স্বাস্থ্যবিধি। শহরের চিত্র আর বর্ণনা না করে এবার একটু গ্রামের চালচিত্র, চালচিত্র না বলে চলচ্চিত্র বললেই ভালো হয়। গ্রামের কিছু শিক্ষিত অভিভাবকগণ কিছুটা অ্যাসাইনমেন্টের অর্থ বুঝলেও খেটে খাওয়া মানুষ, অজ্ঞ, অশিক্ষিতরা বোঝেন না। সেখানে যা বোঝার ছাত্রছাত্রীদেরই বুঝে নিতে হয়। গ্রামীণ ছাত্রছাত্রীরা অ্যাসাইনমেন্ট নামক ধোঁয়াশার মধ্যেই পড়ে আছে। অনেকেই অ্যাসাইনমেন্টের মূল তাৎপর্যও বোঝে না। ওদের মধ্যে যে বা যারা কিঞ্চিত বুঝেছে তারা লিখেছে কোনো রকম। যারা বোঝেনি তারাও বোঝার চেষ্টা করেছে। লিখেছে বিভিন্নভাবে। কেউ কেউ লিখতেও পারিনি। গোঁজামিলের অ্যাসাইনমেন্ট! একজনের দেখে আরেকজনের লেখাবাহাদুর হওয়ার গল্পই যেন অ্যাসাইনমেন্ট। গ্রামের শিক্ষার্থীদের মাঝে অ্যাসাইনমেন্টের প্রভাব একরকম পড়েছে। কিন্তু হাওর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অ্যাসাইনমেন্টের অবস্থা যেন বারো অবস্থা। সেখানে ছাত্রছাত্রীর কত ভাগ আনা গেছে তা গবেষণা সাপেক্ষ ব্যাপার।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, লম্বা সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। এই তথ্যটি সঠিক। দেশের অনেক কিছুই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে খোলা হয়েছে আবার বন্ধও করা হয়েছে। অনেক কিছুর ভিড়ে অনেক কিছু হারিয়েও গেছে। শিক্ষা নিয়ে অনেক ভাবনা হয়েছে। ভাবনার বাস্তব প্রয়োগ যথাযথ করা যায়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য কিছু কিছু সময় হিড়িক উঠলেও সেটা সুরেলা লিরিক হয়ে উঠেনি।
লকডাউন শব্দটি এসময়ে অতি পরিচিত শব্দ হলেও অনেকের কাছে আতঙ্কেরও বটে। গরিব, দুঃখী, মেহনতী মানুষ বড়ই অসহায়। এ সময় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল না।

করোনা আমাদের ঘরে থাকতে বাধ্য করলেও এক অভিনব কায়দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠন চালানো যেত। প্রতিটি স্কুলে শ্রেণিভিত্তিক ব্যাচ করে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনা যেত হয়তো। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানাও যেত। সকাল, দুপুর ও বিকেল ব্যাচ করে দুএকটি ক্লাস চালালে শিক্ষার্থীদের মনের অবস্থা একটু হলেও সজীব ও প্রাণবন্ত থাকত। না, সেটাও করা যায়নি। এই না করা কাজের জন্য যে ক্ষতি হয়েছে তার খতিয়ান কষবে ভবিষ্যৎ।
সেই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বের প্রায় ১৪ কোটি শিশু প্রথম স্কুল যাবে তাদের যাত্রা অনিশ্চিত। এই ১৪ কোটি শিশুর মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ শিশুই বাংলাদেশের। শিশুর মনোদৈহিক বিকাশ প্রথমেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। প্রথম সবকিছুই ভালো লাগে। সবারই প্রথম সবকিছুতেই ব্যাপক আগ্রহ। আর শিশুদের ক্ষেত্রে তা তো স্বপ্নের মতো বড়। বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য ওদের মন আকুলি-বিকুলি করলেও ওরা যেতে পারেনি। ওদের শিক্ষার আলয়ে পাঠানো হয়নি-বিষয়টি এমন নয়। চারদিকে বিষাক্ত করোনাভাইরাসের ছড়াছড়ি। ভাইরাসটির আঘাতে জীবন চলে যাচ্ছে মরণের তরে। করোনা তাড়ানোর কোনো বিধিবদ্ধ ওষুধ আবিষ্কারও হয়নি। বিশ্বপণ্ডিতরা মাথা ঘামিয়েও কোনো প্রতিকার আবিষ্কার করতে পারেননি তখনো। তাই কোমলমতি শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানো যায়নি। যেখানে চলতি শিক্ষার্থীদেরই প্রতিষ্ঠানের ডেরাই ফেরানো যায়নি সেখানে নতুন শিক্ষার্থীদের ফেরানো যাবে কী করে!
করোনা বোধহয় চঞ্চল এই পৃথিবীর সবাইকে একটু থামতে বলেছে। সম্পর্কগুলোকে একটু ঝালাই করে নিতে বলেছে, অথচ কাছে যাওয়া যাবে না। সময়ের পালে বাতাস লাগলেও পাল ছিঁড়ে গেছে। অস্তিত্বের সংকটে সবকিছুই পড়েছে।
১৮ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এখন শিক্ষা পরিকল্পনাবিদদের ধারণা, প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায়। যেকোনো দিন খুলে যাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার তারিখও ঘোষিত হয়েছে। শিক্ষার পালে হাওয়া লাগল তাহলে। আশা করা যায় কদিনের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও ঘোষণা আসবে। এটাও কম ভালো খবর নয়। বহুদিন থেকেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মিলনমেলা হয়নি। সুবর্ণ সুযোগ আসছে এই মিলনের জন্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে তো আর শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখা যায় না। বিকল্প ভাবনায় অনেক কিছুই করা যায় কিন্তু পরিপূরক শিক্ষার জন্য চাই সরেজমিন শিক্ষা। সরেজমিন শিক্ষার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যায়। আর শিক্ষা মানেই তো আদান-প্রদান। শিক্ষক ও ছাত্রের মাঝে চলে এক অমৃত রসায়ন। এই রসায়নের বহিঃপ্রকাশে ছাত্র হয়ে ওঠে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান। তাই তো প্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে হাজারো জনমত। আগামী ১২-৯-২০২১ থেকে স্কুল কলেজ খোলা ঘোষণা আসল। সিদ্ধান্ত ভালো।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা মানেই আগের চিরচেনা গাদাগাদি করে শ্রেণিকক্ষে বসা। এটা থেকে বিরত থাকা জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে যতটা যৌক্তিক কারণ আছে বলে অনেকেই মনে করেন, তেমনি এটাও ভুললে চলবে না যে, করোনা এখনো এ দেশ থেকে যায়নি। তাই বলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পালনীয় কাজ, শিক্ষার্থীদের পালনীয়, অভিভাবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং স্থানীয় নেতা, নেত্রী ও প্রশাসনের দায়িত্ব শীর্ষক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা সরকারের আবশ্যক কর্তব্য।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে সবার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা যথাযথভাবে পরিষ্কার করা দরকার। শ্রেণিকক্ষকে জীবাণুমুক্ত করা উচিত। শ্রেণিকক্ষসহ গোটা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সংযোগগুলো যাচাই করে নেওয়া ভালো হবে। একটি শ্রেণিতে কতজন ছাত্রছাত্রী বসতে পারবে এবং প্রতিটি শিক্ষার্থী কতটুকু ব্যবধানে বসবে তারও একটি ছক থাকা চাই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জীবাণুনাশক টানেল থাকা ভালো। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।
প্রতিষ্ঠানে ঢোকার মূল ফটকে কোনো অভিভাবকের জমায়েত করা যাবে না মর্মে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অভিভাবকদের অবহিত করা যেতে পারে। এ ছাড়াও মূল ফটকে ছাত্রছাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপার সুব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অর্থায়নে ও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় একজন ডাক্তার ও একজন সহকারী রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষককে একই সঙ্গে আসার প্রয়োজন নেই। ক্লাসওয়ারি সময় নির্ধারণ করেই কিন্তু পাঠদান করাতে হবে। তাই বলছি শিক্ষকদের সিফট ভাগ করে দিতেই হবে। জনাসমাগম কমানোর জন্য যা ব্যবস্থা নেওয়ার তা নিতেই হবে। এক্ষেত্রে ব্যাপক সহযোগিতা করবে প্রশাসন। বর্ণনাকৃত কাজগুলো শহরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পূর্ণভাবে প্রতিপালন করা না গেলেও আংশিক করা যাবে হয়তো। কিন্তু গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠিন হবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পালন করাই যাবে না। গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠানই আজও ভাঙা ও বেড়া দিয়ে আচ্ছাদিত। সেখানে কিসের স্বাস্থ্যবিধি মানা। শহরের প্রতিষ্ঠান পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে সত্য কিন্তু গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কী করা যাবে তারও একটা ছক আঁকতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সুধী ও সচেতন মহাশয়গুলোকে এক করে একটি সচেতনতার কাঠামো দাঁড় করাতে হবে।
সচেতনতা বাড়াতে ধর্মীয় স্থানগুলো থেকে প্রচার চালাতে হবে। সবার আগে অভিভাবকগুলোকে সতর্ক করতে হবে।
একদিনে গ্রামের সব প্রতিষ্ঠান না খুলে দিনে দিনে একটা রুটিন মাফিক খুলতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একসঙ্গে খুললে সমাগম বেশি হলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়বে। গ্রামেরও সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে একই দিনে খোলার প্রয়োজন নেই। ধাপে ধাপে একটা চক্র করে খুলতে হবে। জমে থাকা পরীক্ষাগুলো স্তরে স্তরে পূর্ণমান কমিয়ে হলেও নেওয়া দায়িত্ব নয়, দায়। তবে সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায় প্রশ্নের ধরন ও গড়ন দেখে যেন ছাত্রছাত্রীরা দায়সারা ভাব না বুঝতে পারে। এ ধরনের কাজগুলো অবশ্যই চরম সতর্কতার সঙ্গে করা দরকার। এ বিষয়টির সুষ্ঠু ও মার্জিত সমাধান করতে পারে স্ব-স্ব শিক্ষা বোর্ড। স্কুল ও কলেজেও তো কোনো পরীক্ষাই নেওয়া হয়নি বা যায়নি। তাই স্কুল-কলেজগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা বা শ্রেণি উত্তরণ সম্পর্কিত পরীক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। কোনোভাবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ওদের পরীক্ষায় বসাতে পারলেই কিন্তু ওদের মাঝে এক অভিনব ভাবনার উদ্রেক হবে- যা আমাদের বহুদিন আটকে থাকা শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল করবে। অটোপাস বা অ্যাসাইনমেন্ট আর নয়, অটোপ্রমোশনও বাদ। এবার একটু বাস্তব ও মূল্যায়নভিত্তিক শিক্ষার ধারাটি প্রবাহিত হোক।
বহুদিনের জংধরা শিক্ষাকে ঘষামাজা করতে হবে। বিদ্যার্থীদের স্বাধীনসত্তার বিকাশ, নতুন শিক্ষাপ্রবাহের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ওদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করতে প্রথম প্রথম বেগ পেতে হবে সত্য।
তারপরও ওদের নিয়ে আসতে হবে। এই যে নিয়ে আসা- এটা যেন কোনোভাবেই যাচ্ছেতাইভাবে না হয়। জীবনের জন্য শিক্ষা, শিক্ষার জন্য কিন্তু জীবন নয়। জীবনকে তাই ফেলনা ভেবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে মরণ খেলায় মাতা যাবে না। সবাইকে সচেতন হতে হবে। কঠোরভাবে ভালো থাকার ও ভালো রাখার বিধি অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে।
সব শিক্ষক টিকা নিয়েছেন হয়তো। সব শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সেটারও প্রচেষ্টা চলছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনা গেলে বেশ হবে। আমরা যেন ভুলে না যায়, করোনা থেকে বাঁচবার জন্য শুধু টিকার উপর নির্ভর করলে চলবে না। নিয়ম মানতে হবে। আসলেই পৃথিবীর সবক্ষেত্রেই নিয়মের রাজত্ব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারলেই বা খুলে দিলেই শিক্ষা কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হলো না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা পরবর্তী যে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবে তার সমাধান করারও ব্যবস্থা থাকা চাই-তবেই বলা যাবে শিক্ষার গুরুত্ব কতটুকু দেওয়া হলো।
একটি ছোট সাদা কাগজে তাজমহল ছোট করে আঁকলেই কিন্তু তাজমহলের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কমে গেলো না। তাজমহলের একটা প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব আছে এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনবলও আছে। তাই বলি দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো না। সমস্যা বাড়বে। এই সমস্যার সমাধান করবার জন্যও মনোবল, দেহবল ও জনবল থাকা আবশ্যক। কাদের পরীক্ষা কখন কীভাবে নেওয়া যাবে বা কখন কোন ক্লাস হবে বা কোন প্রক্রিয়াই শিক্ষাবর্ষ শেষ হবে বা শুরু হবে-এসব বিষয় তো করাই যাবে। কিন্তু করোনার মতো ভয়াল থাবা আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে আঘাত করলে তা কীভাবে ওভারকাম করা যাবে সেটা ভেবে রাখা বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীর কাজ হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে গিয়ে নানান সমস্যাই জর্জরিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই কর্তাদের মগজে ও হৃদয়ে নানান পরিকল্পনা রাখতে হবে।
এতোদিনের ক্ষতি পূরণ পুষিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলায় সরকারপ্রধান ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এটা এখনকার সময়ের দাবি। হেলে পড়া শিক্ষার প্রাচীরকে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা প্রশংসাই। তবে তা যেন আমাদের আরও ভাবিত করে না তোলে সে বিষয়ে কী কোনো নকশা করা হয়েছে? করা না হলে এখনি করতে হবে। যুদ্ধ করবার আগেই পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন। যুদ্ধে নেমে প্রস্তুতি করবার মতো বোকামি যেন আমরা না করি।
পূর্বের স্বাভাবিক পরিবেশের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন রচিত হোউক।

গোলাম মোর্তুজা : প্রভাষক (বাংলা) মাসকাটাদীঘি স্কুল এন্ড কলেজ
শ্যামপুর কাটাখালী, রাজশাহী

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য