শিশুসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ/অলোক আচার্য

‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/বাদল গেছে টুটি/আজ আমাদের ছুটি, ও ভাই/আজ আমাদের ছুটি’- মেঘের পরে বৃষ্টি হয়ে রৌদ্র ভাসা সময়ে স্কুল ছুটির যে আনন্দ তা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শৈশবেই এনে দিয়েছেন। ছুটির আনন্দ এর থেকে আর ভালোভাবে প্রকাশ করা যায় না।


আজও যখন মেঘ-বৃষ্টি-রোদের খেলা হয় তখন মনের অজান্তেই কবিতাটি মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। ছুটির সে আনন্দ কেউ কি ভুলতে পারে! আবার মা’কে নিয়ে বিদেশ ঘুরতে যাওয়া সেই ছেলেটির কথা। বিদেশ ঘুরতে গিয়ে যখন তারা ডাকাতের হাতে পরে খোকা বলেছিল, ‘তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে/ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে/বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে/পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরো থরো।/ আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে/আমি আছি, ভয় কেন মা কর।’ তখন খোকা একাই ডাকাতের সাথে লড়াই করে বীরের মতো মা’র সামনে এসে দাড়ায়। মা তখন তার ছোট্ট খোকার কপালে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নেয়। সব খোকাদের চোখে আজ মা’কে বিপদমুক্ত করার এমন প্রত্যয়। এমন সব কবিতা, খোকার মতো বীরপুরুষ তৈরি যিনি করেছেন তিনি আমাদের বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন সব্যসাচী লেখক। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ সাহিত্যের যে শাখাতেই তিনি হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে আজও তা অলংকার হয়ে চূড়ায় অবস্থান করছে। মুক্তার মতো উজ্জল সেই সাহিত্য নিয়ে আমরা হৃদয়ের খোড়াক মিটিয়ে চলেছি। তিনি শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ^ সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে। তাকে নিয়ে গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানে একটি সাহিত্য যুগ, একটি কাল। তিনি কবিদের কবি। যা কাল থেকে কালে প্রবাহমান। একটি-দু’টি লেখায় লিখে যার গুরুত্ব প্রকাশ করার চেষ্টা বোকামীমাত্র। বাংলা সাহিত্যে শিশুদের জন্য যে সাহিত্য রয়েছে মানে শিশু উপযোগী গল্প, ছড়া বা কবিতা এসব কবিগুরুর যুগেও হয়েছে এবং আজও হচ্ছে।


শিশুসাহিত্য সৃষ্টি সহজ কথা নয়। এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো লেখাটি কতটা শিশু উপযুক্ত হয়েছে তা বিবেচনা করা। শিশুমনকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম সফল সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি তাই চ্যালেঞ্জের। শিশুদের জন্য লিখতে হলে নিজেকেও শিশুমনের হতে হয়। শিশুদের মন, চাওয়া-পাওয়া,আনন্দ বেদনা, হাসি-কান্নার উৎস বুঝতে হয়। এগুলো বুঝতে পারলেই স্বার্থক শিশুতোষ রচনা সম্ভব। কবিগুরুও শিুশুদের জন্য লিখতে গিয়ে নিজের প্রাণকে সেই সময়ে নিয়ে গেছেন। এমনিতেই সারল্য ছিল তার বৈশিষ্ট্য। আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য হলো শিশুকালে যা পাঠ করি তার অনেকটা আবার আমরা কৈশর-যৌবন-বার্ধক্যেও মনের কোণে ঠাঁই নেয়। এটাই সৃষ্টির স্বার্থকতা। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির বিশালতা আমাদের সাহিত্য ভান্ডারকে পূর্ণতা দিয়েছে।

আজও আমরা সেই কবিতা, ছড়া আবৃত্তি করি। তিনি শিশুদের জন্য কবিতা, ছড়া, গল্প, ভ্রমণকাহিনী বা জীবনীও লিখেছেন। ছাত্রাবস্থায় কিশোর চরিত্র ফটিকের সাথে পরিচয় হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি গল্পে। ফটিকের কৈশরের উচ্ছলতা, গ্রামের গন্ডি পেরিয়ে শহরের জীবনে গিয়ে ফটিকের বন্দীত্ব, মা’র কাছে যাওয়ার আকুল আবেদন, প্রকৃতির সাথে মিশে শৈশব থেকে কৈশরে পা রাখা ফটিকের শেষ পরিণতি আমাদের চোখে জল এনে দেয়। তার ‘কাবলুয়িওয়ালা’ নাটকটি যা চলচ্চিত্রে রুপান্তরিত হয়েছে সেখানে অন্যতম প্রধান চরিত্র ‘মিনি’। ভিনদেশী কাবলুয়িওয়ালার মিনির প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে কাহিনী এগিয়েছে। মিনি নামের ছোট্ট মেয়েটির চরিত্র নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার ‘ডাকঘর’ নাটকের অমলের চরিত্রও আমাদের মন কেড়ে নেয়।


আবার ফিরে আসি কবিতার কথায়। আজ যখন আমাদের পরিচিত কোনো গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাই তখন তালগাছের দিকে দৃষ্টি পরলেই মনের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে/উঁকি মারে আকাশে।’ যখন অঝর ধারায় বৃষ্টি নামে আমাদের মুখ থেকে আজও বের হয়ে আসে ’ বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর/নদেয় এলো বান।’ আবার আষাঢ় নিয়েই তিনি লিখেছেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে/ তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’ শিশুতোষ মিষ্টি এই ছড়াটি হলো কবিগুরুর বিখ্যাত বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর। কবিগুরু চাঁদকে নিয়ে লিখেছেন ‘চাঁদের আলো নিভে এলো/ সূর্যি ডোবে ডোবে/আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে/চাঁদের লোভে লোভে।’ এভাবে চাঁদ, সূর্য, বৃষ্টি,ফুল, পাখি অর্থাৎ প্রকৃতির সন্নিধ্যে এসে অসংখ্যা শিশু উপযোগী ছড়া, কবিতা লিখেছেন। শিশুরা এসবই অর্থাৎ প্রকৃতির উপাদান নিয়ে মেতে থাকতে পছন্দ করে। নিজের দেখা নদীটাকে এঁকেছেন মনে মনে। লিখেছেন কবিতা। তিনি লিখেছেন ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু/পার হয় গাড়ি/দুই ধার উঁচু তার/ঢালু তার পাড়ি।’


আমাদের একটি প্রজন্মের প্রত্যেকেরই নদীর সাথে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমন কবিতায় চোখের সামনে সেই নদী পাড়ের দিনগুলোকে সামনে দাড় করিয়ে দেয়। আবার এই নদী নিয়েই তার ‘দুই তীর’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমি ভালোবাসি আমার/নদীর বালুচর/শরৎকাল যে নির্জনে/চকাচকির ঘর”। শিশু সাহিত্যে আরও অনেক সাহিত্যকর্ম রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, যা কোনো একটি নির্দিষ্ট লেখায় তুলে আনা কষ্টসাধ্য। যা যুগ যুগ ধরে আমাদের শিশুসাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছে।

অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও লেখক
Email- sopnil.roy@gmail.com

মন্তব্য করুন