সচেতনতার অভাবে রোধ হচ্ছে না বাল্যবিবাহ

সেলিনা আক্তার নূপুর ।।
আমাদের সমাজে এখনও অপরিণত বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে অভিভাবকরা তাদের দায়িত্ব কর্তব্য শেষ করতে চান। অথচ তারা একবারও ভেবে দেখেন না যে, পর্যাপ্ত বয়স না হলে তাদের এই সখের বা দয়িত্ব এড়ানোর বিয়ে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। বাল্যবিবাহ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা রোধ করতে হলে আমাদের এই আইনের বিভিন্ন দিক জানতে ও বুঝতে হবে।

বাল্যবিবাহ বলতে ঐ সকল বিবাহকে বুঝায় যার চুক্তিবদ্ধ পক্ষগণের যেকোনো একজন শিশু। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ বলতে বুঝায়, বাল্যকাল বা নাবালক বয়সে ছেলে মেয়েদের মধ্যে বিবাহ। এছাড়া বর কনে উভয়েরই বা একজনের বয়স বিয়ের জন্য নির্ধারিত বয়সের চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হলে তাকে আইনগত ভাবে বাল্যবিবাহ বলে। এ আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের বয়স ২১ এবং মেয়ের বয়স ১৮ হওয়ার পূর্বে বিবাহ সম্পন্ন হলে তবে তাকে বাল্যবিবাহ বলে।

বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে তিন ধরনের বিবাহ অপরাধ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। যেমন –
১/ প্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে অপ্রাপ্ত বয়স্কের বিবাহ।
২/ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ের বিবাহ।
৩/ অপ্রাপ্তবয়স্ক পাত্র পাত্রীর অভিভাবক কর্তৃক বিবাহ নির্ধারণ বা বিয়েতে সম্মতি দান।

বাল্যবিবাহের ইতিহাস
কবে কোন যুগে বাল্যবিবাহের শুরু হয়েছে তার কোন সুনির্দিষ্ট ইতিহাস না পাওয়া গেলেও আদি যুগের গোত্র ও পরবর্তীকালে নানারকম প্রথা বাল্যবিবাহের ধারণা দেয় এবং এর বিস্তৃতি ঘটে সমাজ-সংসারে। ষোড়শ শতকের অষ্টম দশকেও সমগ্র উপমহাদেশে বাল্য বিবাহের প্রচলন ছিল। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে তৎকালীন সমাজে বাল্যবিবাহ প্রথার প্রমাণ পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাল্য বিবাহ সম্বন্ধে স্ক্রাফটনের মন্তব্য এমন “এই উপমহাদেশের ছেলে মেয়েদের শিশুকালে বিয়ে দেয়া হতো। ১২ বছর বয়সে একজন রমনীর কোলে একটি সন্তান – এটা ছিল সাধারণ দৃশ্য। “

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন
ব্রিটিশ ভারত্ ২8 শে সেপ্টেম্বর তারিখে ১৯২৯ সালে পাস করা হয়। এই আইনে উল্লেখ আছে মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়স ১৪ বছর এবং ছেলেরা ১৮ বছর বয়সের বাতিল করে মেয়েদের জন্য ১৮ এবং ছেলেদের জন্য ২১ বছর বয়স করা হয়েছে। এটি শরদ আইন হিসাবে খুব পরিচিত। এই আইনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হার্বিলাস সারদা। উত্থাপনের ছয় মাস পরে এটি ১ এপ্রিল ১৯৩০ সালে কার্যকর হয় এবং এটি শুধু হিন্দুদের নয়, সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের জন্য প্রযোজ্য। এটি ভারতের সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের একটি ফল ছিল। ব্রিটিশ সরকার তাদের অনুগত হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলির কাছে হেরে যাওয়ার ভয়ের কারণে এটি বাস্তবায়ন করেছিল।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে
এই আইনের ২(ক) ধারা অনুযায়ী ২১ বছরের কম বয়সের ছেলে এবং ১৮ বছরের কম বয়সের মেয়ে কে শিশু বা নাবালক বলে গণ্য করা হবে।

২(খ) ধারা অনুযায়ী বর ও কনের যে কেউ একজন নাবালক হলে তাকে বাল্যবিবাহ বলা হবে। বিবাহের একপক্ষ সাবালক ও অপরপক্ষ নাবালক হলে বাল্য বিবাহের জন্য সাবালক পক্ষকে শাস্তি প্রদান করা হবে।

এই আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী এই অপরাধের জন্য শাস্তি হচ্ছে ১ মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকারের দন্ড।

৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি নাবালকের বিবাহ সম্পন্ন করবে কিংবা পরিচালনা করবে কিংবা অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিবে তাকেও সমপরিমাণ শাস্তি ভোগ করতে হবে।

পিতা, পিতামহ বা অন্যান্য অভিভাবকগণ যারা শরিয়া আইন অনুযায়ী নাবালকের বিয়ে দিতে পারেন তাদেরও ক্ষমতা এই আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী রহিত করা হয়েছে। বাল্য বিবাহের জন্য তারা দায়ী হলে অনুরূপ শাস্তি ভোগ করতে হবে।

একইভাবে এই আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, যেই তারিখে বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়েছে সেই সময় হতে এক বছর সময় অতিরিক্ত হয়ে গেলে কোন প্রকারেই উহার বিচার-আচার গ্রহণ করা যাবে না।

১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বটে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই পদক্ষেপটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এই আইন যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণীত হয়েছিল উহার উদ্দেশ্য যথাযথভাবে পরিপূর্ণতা পাচ্ছে না। কারণ প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় বাল্যবিবাহের খবর প্রকাশিত হয়। এর মূল কারণ জনগণের সচেতনতার অভাব।

১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন বাস্তবায়নে বাঁধা সমূহ :-
এই আইন বাস্তবায়নের বাঁধাসমূহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –
১/ শিক্ষার অভাব
বাংলাদেশে এমন অনেকে স্থান আছে যেখানে এখনো শিক্ষার আলো পৌঁছায় নাই। শিক্ষার অভাবে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকারক দিকগুলি বোধগম্য করতে পারছে না। এতে বাল্যবিবাহ বেড়ে চলেছে।
২/ দারিদ্র
বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ হিসেবে দরিদ্রতাকেই চিহ্নিত করেছেন সমাজবিজ্ঞানী ও আইনজ্ঞগন। তারা মনে করেন, দরিদ্রতা যেহেতু মানুষের সকল মৌলিক চাহিদাগুলোকে কারারুদ্ধ করে ফেলে, সেহেতু মানুষ তখন প্রয়োজনের কাছে সকল আইনকে জলাঞ্জলি দেয়।
৩/ সচেতনতার অভাব
এদেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত। শিক্ষার অভাবে তাদের সচেতনতা কম। সচেতনতার অভাবে ভালো-মন্দ বুঝতে পারছে না ।
৪/ কুসংস্কার
ধর্মীয় কুসংস্কার বাল্যবিবাহ কে উৎসাহ দিচ্ছে। অবিবাহিত নারীর বাবা-মা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের সকলের চোখে নিন্দনীয়। তাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বাবা-মা বাল্যকালে তাদের কন্যাদের বিবাহ দিয়ে থাকেন।
৫/ প্রচারের অভাব
বাল্যবিবাহের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে না বলে দেশের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত জনগণ ইহার খারাপ দিক ও ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পারছে না। ফলে এ সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে না।
৬/ জন্ম নিবন্ধন
বাল্যবিবাহ নিরোধ এ জন্ম নিবন্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে বিয়ের সময় জন্ম সনদ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক। তাতে প্রকৃত বয়স প্রমাণিত হবে এবং বাল্যবিবাহ হ্রাস পাবে।
৭/ প্রশিক্ষণের অভাব
বিবাহ রেজিস্ট্রি কাজে যারা জড়িত তাদের অজ্ঞতা বাল্যবিবাহ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে অনেকে মনে করেন। সে কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
৮/ কঠোর আইনের অভাব
১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইন অমান্য করলে ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। এ শাস্তিমূলক বিধান নামমাত্র শাস্তি বলে বাল্যবিবাহে অনেকে আগ্রহ দেখানোর সাহস করছে।
৯/ অন্যান্য
১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইনের ৯ ধারায় বলা আছে, বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠানের ১ বছর অতিক্রান্ত হলে এই বিষয়ে কোন অভিযোগ আদালতে দায়ের করা যাবে না। এই সময়সীমা ১ বছর হওয়ার কারনে পাড়া প্রতিবেশি বিষয়টি জানতে ও বুঝতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে।

১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বাঁধা সমূহ উপেক্ষা করতে পারলে এই আইন বাস্তবায়ন সম্ভব। আর এই আইনের বাস্তবায়ন হলে বাল্যবিবাহ হ্রাস করা যেতে পারে।

লেখিকা আইনের ছাত্রী

তথ্য সূত্র :-
১/ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন – এডভোকেট তফাজ্জল হোসেন
২/ উইকিপিডিয়া
৩/ গুগল