সব শিক্ষকই অধিক টাকা রোজগারের জন্য প্রাইভেট কোচিং করান না

আনোয়ারা নীনা

প্রাইভেট বা কোচিং করান শিক্ষক। করে শিক্ষার্থী। সব শিক্ষকই অধিক টাকা রোজগারের জন্য প্রাইভেট পড়ান বা কোচিং করান না, এটা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। আমি বলব—অনেকেই বিদ্যালয়ের প্রতি, শিক্ষার্থীর প্রতি আন্তরিকতার জন্যও পড়ান। কারণ বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো করতে হবে। কিন্তু প্রাইভেট বা কোচিং পড়ানো নিষেধ। না পড়ানোর জন্য আইনও করা হয়েছে। কিন্তু কোথায় গিয়ে এই শিক্ষার্থীরা তাদের সিলোবাস শেষ করবে? কোনো উত্তর পাই না।

আমাদের প্রতিটি শ্রেণিতে ১৩/১৪টি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে হয়। পরীক্ষা দিতে হয়। প্রতিটি পরীক্ষার সিলেবাস সমপন্ন করতে হয়। কিন্তু একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কতদিন সময় পাচ্ছে পাঠগ্রহণ করার বা শিক্ষকরাই কতদিন সময় পাচ্ছে পাঠদানের?

সরকারিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন উপলক্ষে ছুটি থাকে মোট ৮৫ দিন। তারপর সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন, পরীক্ষা (অর্ধবার্ষিক, নির্বাচনী ও বার্ষিক) ৪৫ দিন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১৫ দিন, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অনুষ্ঠান—খেলাধুলা, বিতর্ক, মিলাদ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি নিয়ে আরো ১৫ দিন। অর্থাত্ সর্বমোট ২১২ দিন। বছরের ৩৬৫ দিন থেকে ২১২ দিন পাঠদান থেকে বিরত থাকা হলে বাকি থাকে ১৫৩ দিন। আবার কোনো কোনো শিক্ষক নৈমিত্তিক ছুটি নিতে বাধ্য হন। ধরা যাক ২০ দিনে কমপক্ষে ৭ দিন। তাহলে থাকে মাত্র ১৪৬ দিন। তারপর আবার কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসএসসি, জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষার কেন্দ্র পড়ায় আরো ৪৫ দিন পাঠদান ব্যাহত হয়। তাহলে ১৪৬ দিন থেকে আরো ৪৫ দিন বাদ দেওয়া হলে থাকল ১০১ দিন। প্রশ্ন হলো—এই ১৪৬ বা ১০১ দিনে কিভাবে সম্ভব ১৩/১৪টি বিষয়ের সিলেবাস সমপন্ন করা? এটা আকাশ-কুসুম কল্পনামাত্র। আর তখন যদি অভিভাবকগণ দিশেহারা হয়ে প্রাইভেট বা কোচিংমুখী হন, সেটা কি দোষের কিছু? শিক্ষকরা নাকি প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়ালে ক্লাসে ঠিকমতো পড়ান না! একটা ক্লাসে কি শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক আছে? যেভাবে পাঠদান করানোর কথা সেভাবে কি পাঠদান করাতে পারছেন? মোটেও সম্ভব না। মাধ্যমিক পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্ঠানেই ১৫০-২০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এক একটি ক্লাস করতে হয়। একটি ক্লাসে এত শিক্ষার্থী নিয়ে কি ফলপ্রসূ ক্লাস সম্ভব? এতে কি শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পাঠগ্রহণ, বোঝা বা জানা সম্ভব হবে? তারপরও দোষ সেই শিক্ষকের—ভালোভাবে পড়াচ্ছেন না। কিন্তু পড়াতে যে পারছি না, সেটা বলার বা শোনার কাউকে পাচ্ছি না। বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার। তাই মনে করি তাঁরা শিক্ষকদের মর্যাদার আসনে আসীন করবেন। তাতে শিক্ষারও মান বৃদ্ধি পাবে। মাথাব্যথার জন্য মাথা না কেটে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।

শিক্ষকরা অনেক পরিশ্রমী। অথচ তাঁদের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন হচ্ছে না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সেইসঙ্গে শিক্ষার মানোন্নয়নে কমাতে হবে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যাও। সহ-পাঠ্যক্রমিক বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। পাঠদানের সময়কাল বাড়াতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে এতগুলো পাঠ্যবই চাপিয়ে না দিয়ে শিক্ষার্থীর বেসিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ দিতে হবে। উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা বিষয়ে কোনো সেমিনার বা প্রশিক্ষণ হলে সেখানে নামকরা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক/শিক্ষার্থীরা সুযোগ পান। কিন্তু উপজেলা বা মফস্বল এলাকায় যেসব শিক্ষক রয়েছেন তাঁদের কোনো সুযোগ নাই। মফস্বলের সমস্যা আর শহরের সমস্যা এক নয়। অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাই তৃণমূলের কথা শুনলে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। সবশেষে একটি কথা বলতে চাই—শিক্ষায় সকলের সমান সুযোগ প্রয়োজন।

লেখক- প্রধানশিক্ষক,
হালিমুন্নেছা চৌধুরাণী মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
ভালুকা, ময়মনসিংহ
anwaraninahcmghs@gmail.com

মন্তব্য করুন