স্তনকর ও নাঙ্গেলি


অলোক আচার্য – অত্যাচারের বিরুদ্ধে নারীদের ঘুরে দাড়ানো অথবা নারীর প্রতি বৈষম্য বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ইতিহাস নতুন কিছু নয়। এটি বহু প্রাচীন এবং পৃথিবীতে নারী শক্তির জয়জয়কার হয়েছে। এই প্রতিবাদের ইতিহাসের সাথে একটি প্রতিবাদী নারীর নাম স্বার্ণাক্ষরে লেখা আছে। সে হলো নাঙ্গোলি। সময়টা আজ থেকে প্রায় চারশ বছরের কিছু বেশি সময়, ১৮০৩ সাল। আর স’ান হলো বর্তমান ভারতের কেরালা রাজ্য। সেই সময় যা ট্রাভাঙ্কর রাজ্যে। অস্পৃশ্যতা সেই সময় সমাজের একটি বড় রোগ ছিল। এটা মূলত সেই সময় যখন সমাজে ব্যাপক বর্ণ বৈষম্য বিরাজ করতো। উঁচু-নিচু,ব্রাহ্মণ শ্রেণির সাথে অন্য শ্রেণির ব্যবধান ইত্যাদি বৈষম্যে সমাজে বিষ ছড়াচ্ছিল। সেই সময় সমাজের কিছু অদ্ভূত এবং নির্মম নির্যাতন ছিল। যেমন- পুরুষদের গোঁফ রাখার ওপর কর দেওয়ার রীতি ছিল। আবার নারীদের স্বাধীনভাবে অলঙ্কার পরার ওপরও কর দিতে হতো। আরও একটা নিয়ম বা প্রথা ছিল যা ইতিহাসে নিকৃষ্ট। নারীদের স্তনকর দিতে হতো যা স’ানীয় ভাষায় মূলাক্করম (মূল আকরম) নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় নিয়ম অনুযায়ী, কোনো হিন্দু নারী তার স্তন ঢেকে রাখতে পারবে না। শুধু ব্রাহ্মণদের জন্য এ আইন প্রযোজ্য ছিল না। তারা সাদা এক টুকরো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারতো। যদি এর বাইরে কোনো নারী তার স্তন ঢেকে রাখার ইচ্ছা করতো তাহলে এর জন্য তাকে কর দিতে হতো যা স্তন কর নামে পরিচিত ছিল। এর ফলে খুব সহজেই সমাজের বর্ণভেদ স্পষ্ট হয়ে যেতো। কে উঁচু বর্ণের বা কে নিচু বর্ণের তা বোঝা যেতো। এই নিকৃষ্ট আইনটি উনিশ শতকের প্রথম দিকে দক্ষিণ ভারতে চালু ছিল। যার কর দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না সে তার স্তন উন্মুক্ত রাখতে বাধ্য হতো। তবে বাধ্য হয়েই নিজের মর্যাদার রক্ষার্থে নিন্মবর্ণের হিন্দু মহিলারাও এই স্তন প্রদান করতো। এমনকি করের কম বেশি নির্ভর স্তনের আকারের ওপর। এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এর বাইরে গেলে তাদের জন্য শাস্তি অপেক্ষা করতো। এবার আসা যাক নাঙ্গেলির কথায়। নাঙ্গেলি ছিল সেই সময়ের এক তথাকথিত বর্ণভেদের হিসেবে নিচু বর্ণের মহিলা। নাঙ্গেলি এজহাভা গোত্রের নারী ছিল। বিভিন্ন বর্ণনায় নাঙ্গেলিকে সুন্দরী নারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। বয়স ৩৫। কিন’ তা এই সৌন্দর্য তার জন্য সুখকর ছিল না। নাঙ্গেলি দরিদ্র হলেও আত্নসম্মানবোধ ছিল প্রবল। তার স্বামীর নাম ছিল চিরুকান্দান। এই দম্পতির কোনো সন্তানাদি ছিল না। কৃষিকাজ ছিল তাদের প্রধান পেশা। খুব সাধারণভাবে তারা জীবন যাপন করতো। কিন’ প্রচন্ডরকম দারিদ্রতার জন্য তার স’ন করের পরিমাণ বাড়তে থাকে। একদিন কর সংগ্রহ করতে করতে ট্রাঙ্কভারের গ্রাম প্রধান নাঙ্গেলির ঘরে আসে। কিন’ নাঙ্গেলি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। যখন কর সংগ্রহকারীরা নাছোড়বান্দা তখন নাঙ্গেলি তাদের রেখে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর নিজের স্তনযুগল কেটে তা কলাপাতায় এনে কর আদায়কারীর সামনে রাখে। কিন’ প্রচন্ড রক্তক্ষরণে নাঙ্গেলি সেই সময়ের মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। স্ত্রীর মৃত্যুর শোকে তার স্বামী চিরকান্দানও স্ত্রীর চিতায় ঝাঁপ দিয়ে আত্নহুতি দেন। এটাই নারীর সাথে পুরুষের সহমরণে প্রথম ঘটনা ছিল। নাঙ্গেলির মৃত্যুর পর মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভ দানা বাঁধে। সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ করে। বাধ্য হয়ে কতৃপক্ষ স্তনকর বাতিল করতে বাধ্য হয়। অন্য এক তথ্যে দেখা যায়, এই বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা। এই দাঙ্গায় ’কাপড়ের দাঙ্গা’ হিসেবেও পরিচিত। নাঙ্গেলির এই ইতিহাস যেমন নারীদের প্রতিবাদ এবং সমাজকে একটি কুলষ থেকে মুক্ত করার ইতিহাস।

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য