সুকান্ত পার্থিব
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি, পদ্মার পাড় দিয়ে আর গড়াইয়ের কোল ঘেঁষা ঐতিহাসিক একটি জায়গা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমি। যেখান থেকে বিপ্লবী বাঘা যতীনের উত্থান, জমিদার দর্পণ’র নাট্যকার মীর মোশাররফ হোসেনের ক্রমশ বিপ্লবী লেখক হয়ে ওঠা এবং লালনের বিপ্লবী ন্যাংটা বাহিনীর ইংরেজ লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। কিন্তু এরও মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক বিস্ময়কর ইতিহাস।
নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি তাদের হৃদয় কোঠায় স্থান করে নেন। শত বাধা উপেক্ষা করে অসীম সাহসের সঙ্গে তিনি লিখেছেন ইংরেজদের দুঃশাসন, নীলকর, জোতদার জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে। এ পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এতে কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণের কাহিনীর পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো।
বাউল সঙ্গীতকে সামাজিক জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মানসে উনবিংশ শতকে যে কয়েকজন সাহিত্য সাধক নিজেদের সাহিত্যে নিয়োজিত করেছিলেন, কাঙাল হরিনাথ তাদের মধ্যে অন্যতম পথিকৃত। বাংলা ভাষার ওপর কাঙাল হরিনাথের দখল ছিলো অসাধারণ। এর ফলে তিনি হয়েছিলেন এক কালোত্তীর্ণ সাহিত্যসাধক। যে যুগে হরিনাথ সাহিত্য সাধনা করেন সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাষা ও কল্পনার যুক্তভঙ্গি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক কালজয়ী অধ্যায়।
১২৮৭ সালে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের অনুপ্রেরণায় ও রায় জলধর সেন প্রমুখের প্রত্যক্ষ আগ্রহ আর সহযোগিতায় ‘ফিকির চাঁদ ফকিরের দল’ গঠনের মাধ্যমে বাউল গান রচনা, প্রসার- প্রচারের যাত্রা শুরু করেন। বাউল গানের দল গঠনের অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন লালন সাঁইজীর কাছে। পিতৃপ্রদত্ত নাম হারিয়ে যায় ছদ্ম নামের আড়ালে। ‘কাঙাল’ ও ‘ফিকির চাঁদ ফকির’ নাম ভনিতায় রচনা করে চললেন অসংখ্য বাউল গানসহ অন্য ভাবধারার সঙ্গীত।
ঘুমন্ত নিরক্ষর অলস পাষাণ হৃদয়কে আঘাত হানতে রচিত সঙ্গীতে তিনি ব্যবহার করলেন সহজ ভাব রূপকের দ্যোতনা। কাঙাল রচিত প্রথম গান হিসেবে পরিচিত গানটিতেই নশ্বর প্রাকৃতিক মোহের ঊর্ধ্বে ওঠার আহ্বান-
‘ভামন দিবানিশি অবিনাশী/সত্য পথের সেই ভাবনা,
যে পথে চোর ডাকাতে কোনমতে/ছোঁবে নারে সোনাদানা’।
ফিকির চাঁদের নাম ও দলের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে গ্রাম, থানা, মহকুমা, জেলা ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। এই ঘটনার চমৎকার বর্ণনা রয়েছে রায় জলধর সেন সম্পাদিত ‘কাঙাল হরিনাথ’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে। সামাজিক সামঞ্জস্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় কাঙাল হরিনাথের অকান্ত প্রচেষ্টাও লক্ষণীয়। ভাব সঙ্গীতের রস-ব্যঞ্জনার মাধ্যমে তিনি নিরন্তর চেষ্টা করেছেন সমাজ থেকে তথা মানুষের মানবিকতা থেকে সাম্প্রদায়িকতার ক্ষত আরোগ্য করতে। সমাজমানসকে উজ্জ্বীবিত করতে তিনি লিখেছেন,
‘নানা ধর্মে অন্ধ হয়ে, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব করিয়ে/রহিয়াছে ঘুমাইয়া, হয়ে চৈতন্য দেখার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে যতো ভ্রান্ত/ভগবান এক ভাবিয়ে দেখ লীলারসে ভাবান্ত’।
‘পাথর আর সীসে লোহা, দেখে যাহা/তাকেই লোকে কঠিন বলে,
এ সকল নয়রে কঠিন, গ’লে একদিন/সুকৌশলে উত্তাপ দিলে;
ওরে কঠিন হৃদয় সেই তো রে হয়/পরের দুঃখে যে না গলে’।
ফিকির চাঁদের বাউল দলের বিপুল জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ-অভিভূত হয়ে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মন্তব্য করেছিলেন, ‘এমন যে হইবে তাহা ভাবি নাই। এমন করিয়া যে দেশের জনসাধারণের হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত করা যায় তাহা আমি জানিতাম না।’
পরহিতব্রত হরিনাথকে অনেক বেশি মাত্রায় মানবিকতার দীক্ষায় দীক্ষিত করেছিলো, যে মানবিকতার জায়গা থেকেই তিনি হিন্দু-ব্রাহ্মের বিবাদ মীমাংসায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, শাক্ত-বৈষ্ণবের মিলন-প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হয়েছেন। এই মানবিক মূল্যবোধের চর্চার কারণেই তিনি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষ পর্যায়ের বাংলাদেশে সমসময়ের হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদের নিন্দা করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিদ্বেষ স্বাভাবিকভাবেই তাকে বিচলিত করেছিলো। তিনি লিখেছিলেন-
‘জাতির নামে ধুয়া তুলে/(দিচ্ছ) খড়ো ঘরে আগুন জ্বেলে
এ জাত যে জাত মারবার কল/নদীর জল করছি পান
একই জমির খাচ্ছি ধান/একই ভাষায় গাইছি গান
ভাইয়ের বুকে ছুরি মারে/(তারা) শয়তানের দল’।
‘কোথা থেকে আসে এসব কোথায় যায়/তা ভাবতে গেলে মাথা ঘোরে ভাবনা শেষে ভাব না পায়/ভাইরে বট গাছের বিচি ওতা নিতান্ত কুচি
তার ভিতরে খুঁজলে পাবে জল একটু রতি/মাটিতে পড়ে দুদিন পরে
সেই রতি জল আসমানে ধায়।’
সত্যানুসন্ধান, সৃষ্টিতত্ত্ব নিরূপণ, রূপতত্ত্ব, দৈন্য, আক্ষেপ, ইত্যাদি জগত ও জীবনের অধ্যাত্ম ভাবনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রস পাওয়া যায় কাঙাল রচিত বিভিন্ন ভাবসঙ্গীতে। ভাব ও ভাবনার সমন্বয় করেই তিনি যেনো তার গানের ভাণ্ডার সাজিয়েছেন।
‘ওহে দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো/পার কর আমারে
তুমি পারের কর্তা শুনে বার্তা/ডাকছি হে তোমারে’।
আজ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক অতিক্রমণের পর আমরা ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানসহ সমগ্র উপমহাদেশে এক নিদারুণ সাম্প্রদায়িক বিষবাস্পের মুখোমুখি। ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান যে বারবার আমরা প্রত্যক্ষ করছি তাতে করে উদ্বেগের কারণ ক্রমবর্ধমান। প্রতিবাদ ও মুক্তচিন্তার অনুশীলনের ওপর যে ধরনের নগ্ন আক্রমণ বিনিয়ন্ত্রণের কারণে শাখাবিস্তার করছে, তার পরিণতিতে এক অভূতপূর্ব অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে। এসময় আমাদের প্রয়োজন নতুন এক হরিনাথ মজুমদারের, কাঙাল হরিনাথের। যিনি অন্ধকারে প্রজ্জ্বলন করবেন আলোর মশাল।