দুর্গা পূজা : সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অর্থ নীতির সমন্বয়/আইভি সাহা


শরতের শুভ্র সাদা কাশ বন আর নীল আকাশে পেঁজা পেঁজা মেঘের ভেলা, শিউলি ফুলের মৌ-মৌ গন্ধ, জলে ভাসা লাল পদ্ম,  শাপলা জানান দিয়ে যায় দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা।  
দেবী মা কী শুধুই ভক্তের পুষ্পাঞ্জলি, পূজোর সামগ্রী আর ভক্তের ভালোবাসা পেতেই আসেন? শেষে  পূজা লাভ করে সন্তুষ্ট হয়ে তার সন্তানদের আশীর্বাদ করেই কী চলে যান? হ্যাঁ কৃপা বর্ষণতো করেন অবশ্যই  তা না হলে  আমরা কী করে ভালো থাকি এই ধরাধামে! মনের ভক্তি আর বিশ্বাস নিয়েই তো আরাধনা চলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের।
নারী শক্তি রূপিনী দেবী দুর্গা  কন্যা, জায়া, জননী সব রূপেতেই তিনি আছেন জগৎ জননী হয়ে। অশুভ শক্তি বিনাশিনী মা প্রয়োজনে নানা রূপে আবির্ভুত হয়েছেন  নানা সময়ে। কিন্তু পূজোর নয় দিনে নব রূপে পূজো করা হয়। দেবীর আগমনকে স্বার্থক ও সুন্দর করার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চলছে পৃথিবীর জুড়ে সমস্ত হিন্দু ভক্তদের মাঝে।
প্রতিবছর দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার বড় একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরী হয় দেশে এবং  দেশের বাহিরে । প্রতি বছর পূজাকে ঘিরে এই সময়টাতে ব্যস্ততম সময় পার করেন বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ এবং বিভিন্ন  শিল্পীরা। অর্থনীতিতেও প্রাণসঞ্চার হয়ে ওঠে পূজোর সময়। গত দু’তিন বছর অবশ্য বৈশ্বিক মহামারী পরিস্থিতির জন্য নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল পুজোতে এবং অর্থনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে। গতবছরের লোকসান কাটিয়ে উঠে এই বছরের পুজোর আয়োজন হচ্ছে আড়ম্বরপূর্ণভাবে।
মৃৎশিল্পীদের এখন দুচোখের পাতায় ঘুম নেই। কুমোর পাড়াতে  চলছে দেবীকে রং-তুলির আচরে নিখুঁত করে তৈরি করর প্রয়াস। দেবীকে সাজিয়ে প্যান্ডেলে ও মন্দিরে পাঠানোর ধুম লেগেছে চারিদিকে।
ইতোমধ্যে চিত্র শিল্পীরা হয়তো তাদের রং-তুলির আচরে প্যান্ডেলে ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ব্যাস্ততম সময় পার করছেন এখন। এভাবে থিম শিল্পীরা থিম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন দিন রাত পরিশ্রম করে। পূজোকে ঘিরে সুন্দর সুন্দর গেইট তৈরীর যে প্রচলন, তা নান্দনিকতার ছোঁয়ার পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের জন্যও একটা বড় মাধ্যম এসময়।  সব জাতির লোকজন নিযুক্ত থাকেন এ পেশায়।
এই পূজোকে কেন্দ্র করেই জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে  জীবন জীবিকার তাগিদ অনুভব করেন বহু মানুষ। বিজয়া দশমী, বা দশহরাতে নানান জায়গায় যে ছোট বড় মেলার আয়োজন থাকে তাতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীদের ব্যবসা করার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে।  পুজোকে ঘিরে বাহারী মিষ্টির ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। নকুল,বাতাসা, দানাদার, চমচম,  সন্দেশ, সিংগারা, জিলেপী, নারু, হাওয়াই মিঠাইসহ মোয়া, মুড়কিতো আছেই।চটপটি,  ফুচকা বিক্রেতা থেকে পান সুপারি, চা, কফির ছোট পসরা সাজিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যবসা করার তাগিদ অনুভব করে এই পুজোর সময়টাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মানুষেরা। তাই বলতে হয় ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’
বাদ্যযন্ত্র শিল্পীরা এই সময়টাতে বাড়তি আয় করার তাগিদ অনুভব করেন। তেমনি আলোকসজ্জা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদেরও থাকে এই পূজোর সময় বাড়তি একটি বিশেষ  আয়ের উৎস। দেবী দূর্গার বোধন, ষষ্ঠী থেকে দশমী এই পাঁচ দিন ধরে নানান জায়গায় ছোট বড় যে মেলা হয় তা যুগ যুগ ধরে আমাদের কৃষ্টি কালচার বা সংস্কৃতির অংশ হয়ে চলে আসছে। 
কোথাও হয় পুতুল নাচ, সার্কাস, কবি গান, জাড়ি-শারি,ভাটিয়ারী গান, আবার নাগরদোলা চরে মজা নেয় ছোটরা, থাকে সাপের খেলা,বানরের খেলা। আর বেত, কাঠ, পাট, কাঠ দিয়ে তৈরীজিনিস  এসব মেলাতে জুড়ি মেলা ভার। পোড়া মাটির জিনিসপত্র এই মেলাগুলোতে বেশি দেখা যায়। আর দশমীর পরের দিন, বা দশহরাতে অনেক জায়গায় অনুষ্ঠিত হয় নৌকা বাইচ  খেলা। এই নৌকা বাইচ আমাদের দেশের সংস্কৃতির একটি বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে।
পূজো উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা সহ পূজোর ক্লাবগুলো থেকে  এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা কন্সার্ট,নৃত্য, নাটক, গীতিনাট্য ইত্যাদি দেশে ও বিদেশে অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক অংগনের সঙ্গে জড়িত শিল্পী এবং কলাকুশলীরা পুজোকে ঘিরে অনেক ব্যাস্ততম সময় পার করেন। 
পূজোতে যে সব পন্য ব্যবহার করে শিল্পী তার শৈল্পিক কারুকাজে নান্দনিকতার ছোঁয়া এনে দেন সেই পণ্যগুলো হলো পাট শিল্প, প্লাস্টিকের সামগ্রী, পুতি, চুমকি, ভাংগা কাচঁ,কাগজ, শোলা, খালি বোতল, নারিকেলের ছোবরা, সুপারিখোসা, তুলো, কাপড়, সুতা, আলপিন, বাহাড়ি, প্লাস্টিকের ফুল, মাটির তৈরী জিনিসপত্র, পোড়া মাটির জনিস, পাথর, মুখোশ, পুতুল, বাশঁ বেত, কাঠ, রং, চিনা মাটির দ্রব্যসামগ্রী, ঝিনুক শামুক, লেইস, খড়, কুটো,পাতা, বিভিন্ন ধরনের ধাতব সামগ্রী। আর তাজা ফুলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশী হয়ে থাকে এই পুজোর সময়টাতে।
একজন শিল্পী Useless এবং valueless পণ্য ব্যবহারের  নিপুণ শৈল্পিক কৌশলে শিল্প সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলেন, পুজোর মণ্ডপ তৈরীতে। এবং প্রতিমা বানানোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেইসাথে সেটাকে আরও  বেশী  valuable করে তোলেন। সামান্য বস্তু দিয়ে অসাধারণ শৈল্পিক রূপ দিয়ে শিল্পীদের হাতে নান্দনিকতার ছোয়াঁয় আবিষ্কার করেন অসাধারণ সুন্দর শিল্পকর্ম। এ যেন শিল্পী সত্তাকে একীভূত ও একত্রীকরণের মাধ্যমে শিল্প ও শিল্পের সম্বনয় সাধন করার আকুল প্রয়াস চলে। পুজো মানেই উৎসব আর এই উৎসব মানেই , শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির এবং অর্থনীতির মেল  বন্ধন।
অশুভ শক্তি যত যাক তা নিপাত ধুয়ে মুছে যাক আজ সব পাপ তাপ-পৃথিবীতে শান্তির ধারা পড়ুক ঝড়েদেবী দুর্গা শান্তি দেবেন দশ হাত ভরে!

লেখক : কবি ও কণ্ঠশিল্পী