আইন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা ও বাংলাদেশের আইনের ইতিহাস

সেলিনা আক্তার নূপুর ।।

আইন কি?

আইনকে যে কোন এক বা একাধিক শব্দ দ্বারা আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। আইনের উৎপত্তি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন আইনবিদগণ আইনকে সংবলিতভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। যদিও তা এখন পর্যন্ত সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।

সাধারন ভাবে বলা যায়, মানুষকে সুষ্ঠু, স্বাধীন এবং সুশৃংখলভাবে পরিচালনার জন্য যে নিয়ম-কানুন তৈরি করা হয় তাকে আইন বলে।

আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ Law যা ল্যাটিন শব্দ Lex থেকে উৎপত্তি হয়েছে।। Lex শব্দের অর্থ হচ্ছে আইন। অর্থাৎ রাষ্ট্র বিচারালয়ের মাধ্যমে যে বিধান প্রয়োগ করে তাকেই আইন বলা হয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন হলো সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক বলবৎযোগ্য বিধান, যা সকলের জন্য অবশ্য পালনীয়।

রাষ্ট্রীয় ভাবে, আইন হলো দেশের জনসাধারণের সুবিধার্থে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এবং অপরাধীকে অপরাধ হতে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকার কর্তৃক যে বিধি নিষেধ, কোন আদেশ, প্রতিবিধান, বিজ্ঞপ্তি, কোন প্রথা বা রীতি বা উপ আইন জারি করা হয়।

আবার সংবিধানের ১১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধঃস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হইবে। সুতরাং ‘আইন’ মানে আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশের আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোন প্রথা বা রীতি এবং উচ্চ আদালতের রায় ।

আইনের খসড়াকে বিল বলে। মন্ত্রীগণ সরকারি বিল উত্থাপন করেন আর বেসরকারি বিল উত্থাপনকারী হলেন সংসদ সদস্য। বেসরকারি বিলের জন্য ১৫ দিনের নোটিশ প্রয়োজন । সরকারি বিলের জন্য ৭ দিনের নোটিশ প্রয়োজন। ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্টপ্রতি সম্মতি দান করবেন।

আইন সম্পর্কে মনীষীদের সংজ্ঞা :

৩৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিষ্টটল লিখেছিলেন, “আইনের শাসন যে কোন ব্যক্তি শাসনের চেয়ে ভাল”।

অধ্যাপক হল্যান্ড এর মতে- মানুষের বাহ্যিক আচরণের নিয়ন্ত্রনবিধি যা সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বলবৎ করা হয়।

আইনবিদ স্যামন্ড এর মতে- আইন হলো ন্যায় প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রয়োগকৃত নীতিমালা।

আইনের উৎস :-

আইনের উৎপত্তি বিভিন্ন উৎস থেকে হতে পারে । তবে প্রধানত ৬ টি উৎস উল্লেখ করা হলো:

১. প্রথা, ২. ধর্ম, ৩. আইনবিদদের গ্রন্থ, ৪. বিচারকের রায়, ৫. ন্যায়বোধ, ৬. আইনসভা।

এছাড়াও আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আইনের উৎস হতে পারে।

১. বিভিন্ন বিধি-বিধান সৃষ্টিকারী আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা চুক্তি যা বিরোধপক্ষসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত;

২. আন্তর্জাতিক প্রথা যা আইন হিসেবে সাধারণভাবে স্বীকৃত;

৩. বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত;

৪. বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান পন্ডিত ব্যক্তিদের মতবাদ যা আইনের বিধান নির্ণয়ে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে সক্ষম।

৫. আইনের সাধারণ নীতিমালা যা সভ্য জাতিসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত।

আইনের বৈশিষ্ট্য:-

আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ ও কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রন করে ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হতে স্বীকৃত এবং আরোপিত। আইন হচ্ছে সর্বজনীন। সমাজে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি সকলের নিকট মান্য। এটি এক ধরনের আদেশ বা নিষেধ।

আইনের বৈশিষ্ট্য চারটি- যথাঃ-

১. আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া ।

২. আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া ।

৩. অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী না বলা।

৪. যে যতোটুকু অপরাধ করবে তাকে ততোটুকু শাস্তি দেওয়া।

আইনের এই চারটি বৈশিষ্ট্যকে Rules of Law বলা হয়।

আইন আদালত:-

আইন প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন আদালত যেখানে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নায্য অধকিার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয় । এই নায্য অধিকার ও ন্যায় বিচার করার জন্য আদালতে রয়েছে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বিচারকবৃন্দ। তারা আইনের আলোকে আদালতে ন্যায় বিচার ও নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতে তাদের দায়িত্বে নিযুক্ত রয়েছেন।

আইন মন্ত্রণালয়:-

বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশকে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র কাঠামো গঠন ও আইনের শাসন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাথে বিচার প্রশাসনের কল্যাণার্থে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়।

আইনের ইতিহাস কি?

আইনের ইতিহাস হল আইন, প্রশাসন ও ন্যায়বিচার, প্রশাসন এবং আইন প্রতিষ্ঠান সমূহের অতীত রেকর্ড। কোন নির্দিষ্ট সময়কালের আইন ইতিহাস কোন একক ব্যক্তির সৃষ্টি কোন ইতিহাস নয়। উহা একসাথে এক প্রজন্মের পদক্ষেপ, অভিজ্ঞতা, চিন্তা ও ভাবনা সংক্রান্ত পরিকল্পনার একটি সমন্বিত ফলাফল। মূলতঃ এটি সে শাখা যা অতীতের আইন।

বাংলাদেশের আইনের ইতিহাস:-

বাংলাদেশের বর্তমান আইন ও বিচার ব্যবস্থা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় দু’শ বছরের বৃটিশ শাসনের কাছে বহুলাংশে ঋণী, যদিও এর কিছু কিছু উপাদান প্রাক-বৃটিশ আমলের হিন্দু এবং মুসলিম শাসন ব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। এটি বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে পর্যায়ক্রমে বিকাশ লাভ করে।

ভারতীয় উপমহাদেশের বৃটিশ আমলের পূর্ববর্তী পাঁচশত বছরেরও বেশী মুসলিম ও হিন্দু শাসনের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। প্রত্যেকটি শাসনামলের নিজস্ব স্বতন্ত্র আইন ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল।

প্রায় পনের’শ বছর আগে এবং খ্রীষ্টীয় যুগ আরম্ভ হওয়ার পরে হিন্দু আমলের বিস্তৃতি ঘটে। সে সময় প্রাচীন ভারতবর্ষ কতিপয় স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং রাজা ছিলেন প্রত্যেকটি রাজ্যের সর্বময় কর্তা।

১১০০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আক্রমণ ও বিজয়ের ফলে মুসলমান আমলের শুরু হয়। যখন মুসলমানরা সকল রাজ্য জয় করে, তখন তারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কোরআনের উপর ভিত্তি করে তৈরি মতবাদও তাদের সঙ্গে করে এনেছিল। পবিত্র কোরআন অনুসারে সার্বভৌমত্ব সর্বশক্তিমান আল্লাহর হাতে ন্যস্ত।

১১০০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আক্রমণ ও বিজয়ের ফলে মুসলমান আমলের শুরু হয়। যখন মুসলমানরা সকল রাজ্য জয় করে, তখন তারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কোরআনের উপর ভিত্তি করে তৈরি মতবাদও তাদের সঙ্গে করে এনেছিল। পবিত্র কোরআন অনুসারে সার্বভৌমত্ব সর্বশক্তিমান আল্লাহর হাতে ন্যস্ত এবং রাজা হচ্ছে পৃথিবীতে আল্লাহর ইচ্ছা ও আদেশ পালনকারী এক অনুগত দাস।

ইংরেজ আমলে বৃটিশ রাজকীয় সনদপ্রাপ্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কিছু কর্মকর্তা ভারতের প্রাচীন আইন ও বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়নের ভার গ্রহণ করে।

রাজা প্রথম জর্জ কর্তৃক ইস্যুকৃত ১৭২৬ সালের সনদ ভারতে ইংরেজ আইন ও বিচার ব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে এ সনদের ত্রুটিসমূহ দূর করার লক্ষ্যে রাজা দ্বিতীয় জর্জ ১৭৫৩ সালে নতুন সনদ ইস্যু করেন। এ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য হাউজ অব কমনস- এর গোপনীয় কমিটি হস্তক্ষেপ করে এবং রেগুলেশন এ্যাক্ট, ১৭৭৩ পাশ করে, যার অধীন রাজা কলকাতায় বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৭৭৪ সালে একটি পৃথক সনদ ইস্যু করে। পরবর্তী সময়ে ১৮০১ সালে মাদ্রাজে এবং ১৮২৪ সালে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) সুপ্রীমকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ভারতে ১৮৫৩ সালে প্রথম আইন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং একটি সর্ব ভারতীয় আইন সভা সৃষ্টি করা হয় যার প্রণীত আইন সকল আদালতের উপর কার্যকর ছিল। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন তথা সিপাহী বিপ্লবের পর ১৮৫৮ সালেই ভারতের শাসনভার বৃটিশ রাজা কর্তৃক গ্রহণ করা হয়। দেওয়ানী কার্যবিধি আইন, ফৌজদারী কার্যবিধি আইন, দণ্ডবিধি, সাক্ষ্য আইন ইত্যাদি সেই সময় প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং সাধারণ আইনী কাঠামোয় বৃটিশ আইন সভা ১৮৬১ সালে ভারতীয় হাই কোর্ট আইন প্রণয়ন করে যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যমান সুপ্রীমকোর্ট প্রতিস্থাপন করে হাইকোর্ট স্থাপন করা হয়। হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার পর দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতের একটি নিয়মিত ক্রমঅধিকারতন্ত্র দেওয়ানী আদালত আইন, ১৮৮৭ এবং ফৌজদারী কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ।

ভারতীয় উপ-মহাদেশের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতে বিদ্যমান বর্তমান ব্যবস্থার আইনগত ভিত্তি হচ্ছে এই দেওয়ানী আদালত আইন, ১৮৮৭ এবং ফৌজদারী কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট বৃটিশ আইন সভা ভারত ও পাকিস্তানকে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর বলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে । এ আইন অনুসারে, স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের জন্য নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত এ দুই দেশের সরকার পরিচালিত হবে ভারত সরকার আইন, ১৯৩৫ এর মাধ্যমে।

১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইন সরকারের গঠন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে দেয়। ফলে শাসন ব্যবস্থা একক বা কেন্দ্রীয় শাসন পদ্ধতি হতে ফেডারেল পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হয়। এ আইনের বিধি অনুসারে ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশেই নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ফেডারেল আদালত চালু রাখা হয়।

পাকিস্তান গণপরিষদ ‘প্রিভি কাউন্সিল (অধিক্ষেত্র বাতিল) আইন, ১৯৫০’ পাশ করে যা পাকিস্তানের ফেডারেল আদালত হতে প্রিভি কাউন্সিলে আপীল দায়েরের ব্যবস্থাকে বাতিল করেছিল। ১৯৫৬ সালে নতুন সংবিধান প্রবর্তনের মাধ্যমে এর আওতায় প্রদেশসমূহে হাই কোর্ট এবং কেন্দ্রে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফেডারেল আদালত পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে কাজ করেছে। পাকিস্তানের এ সংবিধান ১৯৫৮ সালে বাতিল করা হয়েছিল এবং ১৯৬২ সালে নতুন আরেকটি সংবিধান চালু করা হয়, কিন্তু সমগ্র বিচার কাঠামো একই রয়ে যায়।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি সংবিধান গ্রহণ করে যাতে আপীল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রীম কোর্টের গঠন প্রণালী ও কার্যক্রম বর্ণনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের অধঃস্তন বিচার বিভাগ, দেওয়ানী ও ফৌজদারী ব্যবস্থা উভয়ের উৎপত্তি হয়েছিল দেওয়ানী আদালত আইন, ১৮৮৭ এবং ফৌজদারী কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ থেকে। এছাড়াও বাংলাদেশে আরো কতিপয় অন্যান্য বিশেষ আইন আছে, যা কিছু বিশেষ আদালতের ভিত্তিস্বরূপ কাজ করে, যেমন – শ্রম আদালত, শিশু অপরাধ আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ইত্যাদি।

তথ্য সূত্র :

১/ জুরিস্প্রুডেন্স এন্ড লিগ্যাল অব থিয়োরি – কামরুন নাহার সীমা।

২/ আইনের ইতিহাস ও বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা – তানিয়া নুসরাত ।

৩/ উইকিপিডিয়া

৪/ গুগল

লেখিকা আইনের ছাত্র