আহসান হাবীব; বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

অলোক আচার্য- বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আহসান হাবীবের ’স্বদেশ’ কবিতার প্রতিটি লাইন যেন এক টুকরো বাংলাদেশ, এক টুকরো সোনার বাংলা। অসম্ভব চমৎকার ব্যঞ্জনায় কবি কিশোর কবিতায় দেশের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। তার শুধু এই একটি কবিতা নয় এরকম বহু কবিতায় উঠে এসেছে প্রকৃতি, এই রুপসী বাংলা, এই বাংলার মাঠ,ঘাট,জোনাক পোকা প্রভৃতি। কি এক অদ্ভূত আদরমাখা কবিতার শব্দ, পঙ্তীমালা।
তিনি ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন প্রথম লেখা একটি প্রবন্ধ ছাপা হয় এরপর তার প্রথম কবিতা ’মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’ ছাপা হয় পিরোজপুর গর্ভনমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে। এরপর থেকে নিয়মিতভাবেই তারা লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতো। তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৩৭ সালে দৈনিক তকবির পত্রিকার সহ সম্পাদকের কাজ দিয়ে। তারপর বুলবুল ও সওগাত পত্রিকায় চাকরি করেন। তিনি দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। তার কবিতার বর্ণনা,শব্দচয়ন,আবেগ প্রভৃতির কারণেই তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রধানতম কবি হিসেবে গণ্য হন। তার কবিতায় যেমন প্রকৃতি ও স্বদেশ এসেছে তার সাথে এসেছে গভীর জীবনবোধ। তার কবিতায় উঠে এসেছে সামাজিক বৈষম্য। সমাজের উঁচু-নিচু শ্রেণির ব্যবধানের হিসাব নিকাশ। তার সামাজিক বৈষম্যের প্রতিবাদ, উঁচু-নিচু শ্রেণির ব্যবধান এসবের বিরুদ্ধে কবির শ্লেষাত্বক উচ্চারণ দেখা যায় ’ধন্যবাদ’ কবিতায়। কবিতার প্রতিটি শব্দেই যেন সেই অনুভূতির প্রকাশ। ধন্যবাদ কবিতাটি মূলত এক অভিজাত বড়লোকের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাওয়া তারই অফিসের ছোটো কর্মচারীর বক্তব্য। যেখানে আধুনিক ধনীক শ্রেণির বিলাসিতার বিপরীতে দেশের দরিদ্র শ্রেণির না পাওয়ার বেদনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনিবের কুকুরের নাম ডলি। সেই কুকুরের জন্মদিনে এলাহী পার্টির আয়োজনে ভাগ্যগুণে দাওয়াত পায় সেই কর্মচারী। যে ভেবেছিল ডলি নাম তার মেয়ের। জন্মদিনে গিয়ে সে এতটাই অবাক হয় যে আসার সময় সে কথা মনিবের কাছে প্রকাশ করে। যেখানে মানুষের জন্মদিন হয় না, সেখানে কুকুরের জন্মদিনে এই আয়োজন তাকে অবাক করে দেয়। তার এই অবাক করা আধুনিক তথাকথিত হাই সোসাইটির বিরুদ্ধে শ্লেষ প্রকাশ। কবির অন্যান্য কবিতা থেকে এই কবিতাটি ভিন্ন।
কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তার উপন্যাস এবং শিশু সাহিত্যেও অবদান রয়েছে। রয়েছে প্রবন্ধ গ্রন’। তার কাব্যগ্রন’গুলো হলো রাত্রিশেষ (১৯৪৭), ছায়াহরিণ (১৯৬২),সারাদুপুর (১৯৬৪),আশায় বসতি (১৯৭৪),মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬),দু’হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০),প্রেমের কবিতা (১৯৮১) এবং বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫) ইত্যাদি। কবির বেশ পরিচিত দুটি উপন্যাস হলো রাণী খালের সাঁকো (১৯৬৫) এবং অরণ্য নীলিমা (১৯৬০)। শিশু-কিশোরদের জন্য তার লেখা অবিস্মরণীয়। লিখেছেন প্রচুর ছড়া ও কবিতা। তার শিশুতোষ লেখা সহজেই মনে জায়গা করে নেয়। খুব ছোটবেলায় পড়া তার ’ইচ্ছা” কবিতাটি সবার মনে আজও দাগ কেটে আছে। ’মনা রে মনা কোথায় যাস?/বিলের ধারে কাটব ঘাস/ঘাস কি হবে?/বেচব কাল/চিকন সুতোর কিনব জাল/ জাল কি হবে?/নদীর বাঁকে/মাছ ধরবো ঝাঁকে ঝাঁকে। অর্থাৎ মনা নামের ছোট্র ছেলেটি তার মা আর বোনের জন্য নতুন কিছু কেনার জন্য, উপহার দেওয়ার জন্য কত পরিশ্রম সহ্য করতে চায়। মনার মনের এই ইচ্ছা প্রতিটি কিশোরের মনেই থাকে। তার উল্লেখযোগ্য শিশু সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে, জোছনা রাতের গল্প (১৯৬৭),ছুটির দিন দুপুরে(১৯৭৮),বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর(১৯৭৭),রেলগাড়ি ঝমাঝম,ছোট মামা দি গ্রেট,পাখিরা ফিরে আসে। তার দু’টি সম্পাদিত গ্রন’ও রয়েছে। একটি কাব্যলোকে (১৯৬৮) এবং অন্যটি বিদেশের সেরা গল্প (১৯৬৬)। তার অনুবাদ গ্রন’ হলো প্রবাল দ্বীপে তিন বন্ধু, অভিযাত্রিক কলম্বাস ও ইন্দোনেশিয়া।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। এগুলো হলো ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬),বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬১),আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪),নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭),একুশে পদক (১৯৭৮),আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৪)। বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম আহসান হাবীব। যার লেখা বিভিন্ন রচনা এবং বিশেষত কবিতা এদেশের সাহিত্য ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ।

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য