উপবৃত্তি।। শাহনাজ পারভীন

কোভিড নাইনটিন-এর কারণে বিশ্বব্যাপী পেণ্ডামিক চলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গত সতের মার্চ থেকে দফায় দফায় আজ অবধি বন্ধ। কিন্তু ক্লাস চলছে অনলাইনে, অফিস চলছে করোনাকালীন সাবধানতা অবলম্বন করে।

ড. শায়লা একটি কলেজের দায়িত্বশীল পদে কর্মরত। তার প্রতিষ্ঠানে আজ ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের
উপবৃত্তির ভাইভা চলছে। অতিসাবধানতা অবলম্বন করে তিনি ছাত্রী বিবেচনায় কয়েকটি টেবিলে ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করেছেন। প্রথমেই তিনি ছাত্রীদের স্বাস্থ্য সচেতনতার ব্যাপারে একটু ব্রিফিং করেছেন। প্রত্যেকের মাস্ক এবং সেনিটাইজার ব্যবহারে সতর্ক করেছেন। মিনিমাম তিন ফুট দুরত্ব বজায় রেখে লাইন করতে বলেছেন। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, এই পেণ্ডামিক সময়ে ইন্টারভিউ এড়িয়ে যাবেন, কিন্তু সঠিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে এর বিকল্প নেই।

চলছে ইন্টারভিউ। হঠাৎ বারান্দা থেকে অস্ফুট শব্দ ভেসে এলো প্রিন্সিপ্যাল ড. শায়লা ইসলামের কানে-
–উহু। আস্তে টান দে। কান ছিঁড়ে গেলো তো।
–কথা বলিস না। ইন্টারভিউ দিয়ে এসেই তোর মাস্ক ফেরত দেবো।
–আর আমি?
–তুই এখানে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাক।
–মানে? তোরটা কই?
–নো টক। কথা বলিস না। শুনছিস না, মাস্ক ছাড়া ম্যাম এ্যালাউ করছে না।
–তাইলে স্যারের ঐখানে যা।
–না, সে মুখ চিনে চিনে ‘ওকে’ করবে। তার পছন্দসই না হলে সে দিবে না।
–আর ম্যাম?
–সে কারো পক্ষপাত করবে না। তার কাছে সবাই সমান। আমি যাচ্ছি। তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক। নড়বি না। উপবৃত্তিটা আমার খুবই দরকার।
অস্ফুট স্বরের কথাগুলো ড. শায়লা ইসলামের মাথার মধ্যে এক ধরনের অনুরণন তুললো। কিন্তু সে দেখতে পেলো না কিছুই। জানালার ওপারে ভারি পর্দার আড়ালে সহসাই মিহি কথাগুলো মিলিয়ে গেলো।
সে জানে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মাত্র চল্লিশ পার্সেন্ট স্টুডেন্টকে সে উপবৃত্তির আওতায় আনতে পারবে। বাকি ষাট পার্সেন্ট থাকবে এই আওতার বাইরে। অতএব, প্রকৃত যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে তাকে যথার্থ স্টুডেন্টদের বাছাই করতে হবে। নইলে ন্যায্য দাবিদারেরা এই সুবিধা থেকে বাদ পড়ে যাবে। যেটা হবে খুবই অমানবিক।

তাই ড. শায়লা মেয়েদের অ্যাপ্লিকেশনের তথ্য ছাড়াও গভীর দৃষ্টিতে তাদের অ্যাপিয়ারেন্স দেখে প্রকৃত শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইরোটি দেবার, জাজ করবার চেষ্টা করছেন। তিনি দেখছেন, অনেক মেয়েরই দামী হিজাব এবং ড্রেসের সাথে অ্যাপ্লিকেশনের তথ্য মেলে না।
–তোমার বাবা কী করেন?
–ম্যাম দিন মুজুর। আমরা অনেকগুলা ভাইবোন।আমার খুব প্রয়োজন, ম্যাম। খুব জরুরি।
–তোমার আম্মা?
–কিছু করেন না, বাসায় থাকেন।
–ভাইবোনেরা সবাই?
–পড়াশোনা করে।
–ঠিক আছে, যাও, নেক্সট।
—ম্যাম। আমার হবে তো? উপবৃত্তিটা আমার খুব দরকার।
মেয়েটা যায় না। আপাদমস্তক ওয়েল ড্রেসড মেয়েটি শায়লার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আবারও।
–তুমি এসো।
ড. শায়লা অনুমান করলেন, মেয়েটির চেহারা, পোশাক এবং কথাবার্তার সাথে দিনমজুরের বিষয়টি একদমই বেমানান; মোটেও যায় না। তিনি ভাবছিলেন গভীর ভাবে অন্যকিছু।
বারান্দা থেকে আবারও অস্ফুট কথাবার্তা তার কানে এলো।
–এই মোনা, শোনো। হিজাবটা লাবনীর সাথে পাল্টে নাও। ম্যাম কিন্তু সবকিছু দেখছেন। তোমার দামী ড্রেস দেখে ম্যাম টের পেয়ে যাবেন।
–ব্রুসটা খোলো। দ্রুত। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
— তোমার অ্যাপ্লিকেশনে বাবার বাৎসরিক আয় চেঞ্জ করেছো? সব ঠিক আছে কী-না দেখে নাও।
শায়লা জানালার ভারী পর্দার এপার থেকেও দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পায় বর্তমান প্রজন্মের পূঙ্খানুপুঙ্খ বুদ্ধির খেলা। হিজাব বদলের, ব্রুস খোলার। অ্যাপ্লিকেশন চেঞ্জ, অবলীলায় অন্যের মাস্ক খুলে নেয়ার দৃশ্য।
তারপরও সে কিছুই না শোনার, কিছুই না বোঝার ভান করে নড়েচড়ে বসেন। কারণ, তিনি জানেন, চোখে চোখ রেখে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না এবং আভিজাত্য হচ্ছে তিন প্রজন্মের পরম্পরা। তা ইচ্ছে করলেই কেউ লুকোতে পারে না মুহূর্তেই। যাক, অনেকটা সময় কেটে গেলো। তার সামনে এখনো স্টুডেন্টের লম্বা লাইন। অতঃপর তিনি ইন্টারভিউয়ে মনোযোগী হয়ে ওঠেন আবারো।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়