একটি সুইসাইড নোট/নাসির আহমেদ কাবুল

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-১)

পার্থর জন্মদিন আজ। ২৬ জুনের এই দিনটিতে মাকে খুব বেশি মনে পড়ে পার্থর। প্রতিটি জন্মদিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে মায়ের ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। তারপর ছবির উপর হাত বুলাতে-বুলাতে ঝর-ঝর করে কাঁদে। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, মা কেমন আছ তুমি? আমি ভালো নেই একটুও। যে সন্তান কোনোদিন মাকে একটিবারও চোখে দেখল না, যে সন্তান জেনেছে তাকে জন্ম দিতে গিয়েই তার মায়ের অকাল মৃত্যু হয়েছে, সে ভালো থাকে কী করে মা? আমি ভালো নেই, একেবারেই ভালো নেই! তুমি আমাকে দোয়া করো আমি যেন সৎ ও সুন্দর পথে চলতে পারি। যেন আমাকে দিয়ে কারো কোনো ক্ষতি না হয়।
পার্থর জন্ম হয়েছিল একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে। সিজারের মাধ্যমে। গর্ভকালীন জটিলতার কারণে ডাক্তার যখন মা অথবা সন্তান যে কোনো একজনকে বাঁচানো যাবে বলে জানালেন, তখন আত্মীয়-স্বজন সবাই মাকে বাঁচানোর পক্ষে মত দিলেন। কিন্তু স্বামী তাহমিদ সাহেব চাইলেন তার সন্তান বেঁচে থাকুক। মাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে এভাবেই পার্থর জন্ম! হতভাগী মা সন্তানকে একনজর না দেখেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল! সেই থেকে পার্থ একা—খুব একা।
পার্থর বয়স যখন দেড় বছর, পার্থর বাবা আবার বিয়ে করলেন। পার্থর ঠাঁই হলো ফুপুর কোলে। ফুপু পার্থকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। সেই থেকে পার্থর সব আশ্রয়-প্রশ্রয়-ভরসার স্থান হলো ফুপু।
ফুপুর একমাত্র মেয়ে অনিন্দিতার বয়স তখন এক বছর। দুই ভাইবোনের বয়সের পার্থক্য মাত্র ছয় মাসের। সেই থেকে অনিন্দিতা ও পার্থ বন্ধুর মতো বেড়ে উঠতে লাগল। অনিন্দিতা বড় হয়ে পার্থকে ভাই হিসেবে নয়; বরং বন্ধু হিসেবে ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
অনিন্দিতার গায়ের রঙ কালো। তবে তার বড়-বড় দুটি চোখ হরিণীর মতো টানা-টানা এবং মায়াবী। ওর দুই ঠোঁটে সব সময় হাসির ঝিলিক লেগে থাকে। কথা বলে কম। হাসে বেশি। অভিমানী খুব। পার্থ ছাড়া ওর অভিমান বা রাগ কেউ বুঝতে পারে না। মাঝে-মাঝে রাগের ছলে পার্থ বলে, ‘এই নিন্দিতা বক-বক করিস না তো! কান দুটো যে ঝালাপালা হয়ে গেল!’ অনিন্দিতাকে পার্থ নিন্দিতা বললে কৃত্রিম অভিমান করে অনিন্দিতা। একটু পর অভিমান ভেঙে বলে, আচ্ছা বলো তো, তুমি ছাড়া আর কার সঙ্গে কথা বলব আমি! কে আছে আমার তুমি ছাড়া? পার্থ খুশি হয়। অনিন্দিতার বিনুনী ধরে টান দিলে ছুটে পালায় অনিন্দিতা।
অনিন্দিতার বাড়ন্ত শরীর বন্ধু-বান্ধব অনেকের কাছে খুব আকর্ষণীয়। ওর বন্ধুরা এমন কি বয়সে বেশ বড় ছেলেরাও অনিন্দিতার দিকে তাকায়। যেন গিলে খেতে চায়। অনিন্দিতা মনে করে, এটা পুরুষ জাতের স্বভাব; তাই কিছু মনে করে না, রাগ করে না। এ রকম অবস্থায় মেয়েরা বিরক্তি প্রকাশ করলেও মনে-মনে খুশিই হয় অনিন্দিতা। তার কোনো অভিযোগ নেই কারও বিরুদ্ধে।
অনিন্দিতার রূপের আগুন পার্থকেও যে পোড়ায় না, তা নয়। বোন বলে দৃষ্টি সংকুচিত হয় তার। বেয়ারা মনকে বোঝাতে পারে না কোনোকিছুতে। সংস্কারের দেয়াল ভাঙতে চায়, পারে না লোকলজ্জার ভয়ে। মনে-মনে নারীর রূপের কাছে সঁপে দেয় নিজেকে। সমাজ-সংসার তার হদিস পায় না।
এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও লেখাপড়ার দিকে কোনো খেয়াল নেই পার্থর। সারাদিন গান, নাটক ও সংগঠন নিয়ে সময় কাটে তার। ফুপুর কোনো অনুরোধ না ফেললেও লেখাপড়ায় পার্থ একেবারে উদাসীন। ‘ফুপু, তুমি শুধু-শুধু চেষ্টা করছ, ওসব লেখাপড়া আমাকে দিয়ে হবে না।’ পার্থর কথা শুনে অবাক হয় ফুপু।
: কী বলছিস তুই? লেখাপড়া করবি না তো ঘোড়ার ঘাস কাটবি না কি?
পার্থ উত্তরে বলে, ‘ফুপু, গান ছাড়া আর আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না, কোনদিনও না।’
: বিয়ে করে বউকে কী খাওয়াবি? শুধু গান গাইলে পেট ভরবে?
পার্থ বিয়ের কথা শুনে হাসে। বলে, ‘আমাকে বিয়ে করবে কে? একটা গবেট, অপদার্থ, সেকেলে বকলমকে কেউ বিয়ে করে নাকি?’
পাশে সোফায় বসে থাকা অনিন্দিতা হঠাৎ খিল-খিল করে হেসে ওঠে। পার্থ অনিন্দিতার দিকে তেড়ে গিয়ে বলে, ‘হাসছিস যে! হাসার এমন কী হয়েছে যে হাসতে হবে?’
অনিন্দিতা হাসতে-হাসতেই বলে, ‘তোমার কথা শুনেই তো হাসলাম।’
: আমি আবার কী বললাম যে হাসতে হবে?
: ওই যে বললে, তুমি একটা গবেট।
: তো?
: সত্যিই তুমি গবেটÑঅপদার্থ। তোমাকে কেউ বিয়ে করবে না। মৌরিও না।
: আবার মৌরি? আচ্ছা, কেন ওকে বার-বার টেনে আনিস বল তো?
: আনব না? সারাদিন তো ওকেই নিয়েই ভাবো। ও-ই তো তোমার স্বপ্নের রাজকন্যা! যাও, ময়ূরপক্সক্ষী নাও ভাসাও গিয়া, আমার কী!
অনিন্দিতা দম নিয়ে গানের সুরে বলে—
‘রঙিলা মাঝি রে তুই
রঙের বৈঠা বাও
তোমার সঙ্গে যাবো আমি
যেথায় নিয়ে যাও।’
ক্ষেপে যায় পার্থ। ‘নিন্দিতা ভালো হচ্ছে না কিন্তু! একদম ফাজলামি করবি না বলে দিচ্ছি!’
অনিন্দিতাও দমবার পাত্র নয়। ‘শোনো তোমাকে বলছি, একদম ফাজলামি করছি না। তুমি মনে করেছ কিছুই জানি না আমি? সব জানি আমি, হুঁ!’
: কী জানিস?
: সব…।
: না জানিস না। ও আসে শুধু গান শিখতে।
: গান শিখতে তো আরও দু-চারটা মেয়েও আসে। ছেলেরাও আসে। তাদের কথা তো বলিনি!
: তাহলে মৌরির কথা ওমন করে বলছিস কেন?
: সে আরেকদিন বলব।
: না, আজ বলবি।
: না, বলব না। তুমি জোর করতে পারো না। আমি মৌরিকে নিয়ে হাজারবার বলব। ওকে আমি সহ্য করতে পারি না। একদম না।
অনিন্দিতা ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলে ফুপু বলে, ওকে খ্যাপাস না পার্থ। ম্যানেজ কর। না হলে সারাদিন কিছু খাবে না। দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ওর অভিমানটা ভাঙ্গা। জানিসই তো ও ওরকমই।
: আচ্ছা তুমি যাও ফুপু। চিন্তা করো না। ওকে ম্যানেজ করছি আমি।
এই হলো আমাদের পার্থ ও অনিন্দিতা। আরও একজন আছে-মৌরি। মূলত এই তিনজনকে নিয়েই গল্প। গল্পটি নিছক কল্পনা। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। কল্পনা বললেই কি কল্পনা? কারও না কারও সঙ্গে ঘটনা তো মিলে যেতেও পারে। সে ক্ষেত্রে লেখকের কোনো দায় নেই। লেখক দায়হীন এবং দয়াহীনও বটে। না হলে পাঠককে এমন করে কাঁদাতে যাবে কেন?

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়