একটি সুইসাইড নোট/ নাসির আহমেদ কাবুল

পর্ব৭

সারারাত ঘুমাতে পারেনি মৌরি। আজ মায়ের মুখে নিজের জীবনের অজানা কথাগুলো শোনার পর দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি কিছুতে। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী আরিফ হাসান তার বাবা! সতেরোটা বছর পর বাবার নামটা জানতে পেরেছে মৌরি! না, সে মাকে কোনো রকম দোষারোপ করবে না। বরং মাকে সে ধন্যবাদ দেবে এই বলে যে, সে যাকে ভালোবাসে তাকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছে। তার স্মৃতিকে বহন করার জন্য সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছে সে।
রাতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে-করতে মৌরির বার-বার মনে হয়েছে, একদিন পার্থর মুখেও বাবার নামটা সে শুনেছে। কিন্তু তখন সে বুঝতে পারেনি এই আরিফ হাসান তার বাবা। মৌরি ভাবে, নিশ্চয়ই পার্থদা তাকে সাহায্য করতে পারে। সকাল হওয়ার অপেক্ষার থেকে নির্ঘুম কাটায় গোটা রাত। খুব ভোরে উঠে ছাদে চলে যায়। তখনও প্রকৃতি আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে। তবে পূর্ব দিগন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে লাল আভা ছড়িয়ে। পাখিরা ওড়াউড়ি করছে। বাতাস বইছে মন্থরগতিতে। মৌরি ভাবে, সকালটা এত সুন্দর, এত মনোরম, এতটা ব্যতিক্রম সে এর আগে বুঝতে পারেনি কোনোদিন!
দূরে কোথাও থেকে সকালের রাগ ভৈরবীতে কোনো একজনের গলা সাধার সুর ভেসে আসছে। মৌরিও সকালে গলা সাধে, তবে এতটা সকালে নয়। পার্থ বার-বার খুব ভোরে উঠে গলা সাধার কথা বললেও কোনোদিনই সে এতটা ভোরে ঘুম থেকে জাগেনি। আজ ভাবছে জাগলে হয়ত ভালোই হতো, প্রতিদিনের এই অদ্ভুত সুন্দরকে সে উপভোগ করতে পারত।
মৌরি ভাবে, পার্থদা বলছিল সেও সকালে রেওয়াজ করে। তাহলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে পার্থদা ঘুম থেকে জেগেছে। এখন যদি সে পার্থ দার বাসায় যায়, তাহলে পর্থদা কিছু মনে করবে, রাগ করবে তার সাথে? যাই হোক না কেন, মৌরির আর তর সইছে না। আস্তে-আস্তে সে ছাদ থেকে নেমে গেটের বাইরে চলে আসে। ইচ্ছে করলে ড্রাইভারকে ঘুম থেকে জাগাতে পারত, কিন্তু মৌরি তা না করে একটা রিকশা নিয়ে পার্থর বাসার দিকে ছোটে।
পার্থর বাসার সামনে বিশাল একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। রিকশা থেকে নেমে গাছের নিচে দাঁড়ায় মৌরি। পার্থদা জেগে আছে। ভৈরবী রাগে তার রেওয়াজ শোনা যাচ্ছেÑ‘মোহন প্যায়ারে…তুম জাগো…’। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে, এখন কী করবে সে। এত সকালে কলিংবেল বাজানো ঠিক হবে না। তাছাড়া সে এখন গলা সাধছে, এই সময়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রাগ ভৈরবীর আলাপ শুনতে থাকে মৌরি। নিজের অযান্তে চোখ দুটি আর্দ্র হয়ে ওঠে। বার বার চোখ মোছে মৌরি। এক সময় রেওয়াজ থামলে মৌরি মোবাইলে পার্থর নাম্বারে কল করে। দু’তিনবার রিং হতেই পার্থ ফোন রিসিভ করে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘মৌরি তুমি! কী হয়েছে তোমার? কোনো বিপদ নয় তো? এত সকালে ফোন করেছ কেন?’
পার্থর কথায় অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এতগুলো প্রশ্নের কোনটার উত্তর দেবে ভেবে পায় না মৌরি। মৌরি শুধু বলে, ‘পার্থ দা, আমি তোমার বাসার সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি।’
পার্থ আবারও অস্থির হয়। বলে কোনো বিপদ মৌরি? দাঁড়াও আমি আসছি এক্ষুণি। কোনো উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দেয় পার্থ। তারপর তিন-চার মিনিটের মধ্যে গেট খুলে বেরিয়ে আসে। এক দৌড়ে গেট পেরিয়ে মৌরির কাছে গিয়ে অস্থিরভাবে তাকায় মৌরির চোখে। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে, ‘কী হয়েছে তোমার? কোনো বিপদ হয়নি তো?’
পার্থকে দেখে সকল দুশ্চিন্ত দূর হয়ে যায় মৌরির। হাসতে হাসতে বলেÑনা পার্থদা, কোনো বিপদ নয়। তোমার কাছে আসব-আসব করে সারারাত একটুও ঘুমাতে পারিনি।
: ঠিক মতো ঘুমিয়ে সকাল বেলা আসতে পারতে। এত অস্থিরতার কী কারণ মৌরি?
: সে পরে বলব, আজ আমি আঠারোতে পড়লাম। উইশ করবে না?
মৌরির অদ্ভুত চোখে তাকায় পার্থর দিকে। পার্থও তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক, বাকহীনভাবে। তারপর অত্যন্ত ক্ষীণকণ্ঠে বলে হেপি বার্থডে মৌরি…।
মৌরি বলে, আই লাভ ইউ পার্থ দা!
পার্থ কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। কণ্ঠ আটকে ধরে অনিন্দিতা। পার্থ ঘোরের মধ্যে ডুবে যায়। সে এখন তার সামনে মৌরিকে নয়, অনিন্দিতাকে দেখছে। কাঁপা-কাঁপা গলায় পার্থ বলে, আই লাভ ইউ অনিন্দিতা।
মৌরি অভিমান করে বলে, এই পার্থ দা, আমি তো অনিন্দিতা নই, মৌরি। কীসব ভুলভাল বকছ। চলে যাবো আমি?
: ওহ সরি মৌরি!
: ইটস ওকে। চলে তোমার হাত ধরে লেকের পাড়ে ঘুরব। তারপর টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাবো আর তুমি সিগারেট খাবে। আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখব তোমাকে।
মৌরি পার্থ হাত ধরে লেকের দিকে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে-হাঁটতে বলে, ‘আজ তোমাকে আমার ভালোবাসার কথা জানালাম। তুমি খুশি হওনি?’
পার্থর উত্তরের অপেক্ষা না করে মৌরি বলে, ‘আজ তোমাকে আরও একটি বিশেষ কথা বলার জন্য এসেছি।’
: কী?
: তোমার হেলপ লাগবে পার্থ দা। আমাকে সাহায্য করবে তুমি?
: কী বলছ মৌ! তোমাকে হেলপ করব কি না, সেটা জিজ্ঞেস করে জানতে হবে? কী হেলপ লাগবে বলো?
: অস্থির হচ্ছ কেন? চলো আগে চা খাই। তুমি সিগারেট খেতে-খেতে শুনবে।

চা শেষ করে সিগারেট ঠোঁটে পুরলে মৌরি পার্থর হাত থেকে দিয়াইলাশটা নিয়ে খচ করে জ্বালিয়ে পার্থর সিগারেট ধরিতে দিতে-দিতে বলে, ‘বাবার খোঁজ পেয়েছি পার্থ দা!’
পার্থ এক গাল সিগারেটের ধোঁয়া হঠাৎ বাতাসে মিলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘কী! বাবার খোঁজ পেয়েছ? কে সে? কোথায় আছে তোমার বাবা?’
মৌরি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘জানি না, কোথায় আছেন। তবে আমার বাবা চিত্রশিল্পী আরিফ হাসান।’
: কী-কী বললে তুমি? আরিফ হাসান স্যার তোমার বাবা? কে বলেছে, তোমার মা?
: মা বলেছে।
: স্যার কি তোমাকে চেনেন?
: কী যে পাগলের মতো কথা বলছ? কী করে চিনবে আমাকে?
: তাহলে?
: তার যে একটি মেয়ে আছে, সে খবরই তো জানেন না। চিনবে কেমন করে।
: আচ্ছা বলো তো ঘটনাটা কী?
: শোনো পার্থদা। মায়ের সাথে বাবার বিয়ে হয়নি। তবে ভলোবাসা ছিল। আর সেই ভালোবাসা থেকে আমার জন্ম। মায়ের কথায় সে এই পাপটা ইচ্ছে করে করেছেন বাবাকে বিশেষ অনুরোধ করে। মা বাবাকে না পেলেও তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলেন বলে আমার জন্ম হয়েছে।
: ওহ মাই গড! কী অদ্ভুত ভালোবাসা তাদের দুজনের!
: হুঁ। এবার বাবাকে খুঁজে বের করতে হবে। বাবার কাছে যেতে চাই আমি।
: খুঁজবে কি? খোঁজ তো জানি আমি। সপ্তাহে অন্তত একবার যাই স্যারের কাছে। আমি যে হোমে বাচ্চাদের সাহায্য করি, আরিফ হাসান স্যার সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। আমি ছোটখাটো ডোনার হলেও স্যার আমাকে খুব পছন্দ করেন। যাবে তুমি স্যারের কাছে?
: যাবো মানে কি? এক্ষুণি যেতে চাই।
: ওয়েট। তাহলে স্যারকে একবার ফোন করি।
বাধা দেয় মৌরি। পার্থর হাত থেকে ফোন টেনে নিতে নিতে বলে, ‘জানালে অনুমতি তো নাও দিতে পারেন। তার চেয়ে এমনিই চলো পার্থ দা।’
: না করবেন না।
: কী বলবে তাকে?
: তোমার কথা বলব যে, আমার এক বন্ধুকে নিয়ে আসতে চাই।
মৌরি কী যেন ভাবে। তারপর পার্থকে ফোনসেট ফিরিয়ে দিতে-দিতে বলে, ‘আচ্ছা, তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো।’
পার্থ আরিফ হাসানকে ফোন করে বলে, ‘স্যার আমার এক মেয়ে বন্ধু মানে ছাত্রী আছে। আপনাকে দেখতে চায় সে।’
ওপাশ থেকে আরিফ হাসান অবাক হয়ে বলেন, তোমার আবার মেয়ে বন্ধু আছে নাকি? বলোনি তো এতদিন। চলে এসো। আজ সারাদিন একদম ফ্রি আছি।
পার্থ খুশি হয়ে বলে, আসছি স্যার। এক্ষুণি আসছি।

কবি আঞ্জুমান আরা খান

সকল পোস্ট : আঞ্জুমান আরা খান