এসো হে বৈশাখ-জাগো নতুন প্রাণে।। অলোক আচার্য

বিগত দুই বছর বাঙালি পহেলা বৈশাখের আনন্দে ভাসতে পারেনি করোনা ভাইরাসের কারণে। দুই বছর পর করোনা ভাইরাসের তান্ডব একেবারেই কম। ফলে পহেলা বৈশাখ ঘিরে আনন্দ বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক কথা। বছরের নতুন দিন প্রতিটি জাতির কাছেই উৎসবের। বাঙালির কাছেও একই কথা প্রযোজ্য। এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্যনীয় তা হলো পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতিরও ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করছে। নিজেদের সংস্কৃতিকে উপস’াপন করছি এবং তা ধারণ করার প্রতিজ্ঞাও করছি পহেলা বৈশাখে। ফলে এই দিনের এক আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা বছরের প্রথম দিন আনন্দময় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। কালবৈশাখীর কালো মেঘের মাঝেও মিশে থাকে আনন্দ, মিশে থাকে উদ্দীপনা। প্রতি বছর তো সেভাবেই পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেই। ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সামিল হয় এই উৎসবে। পহেলা বৈশাখ একটি ঐতিহ্য একটি সুস’ সাংস্কৃতিক ধারা। এই ধারা মনে করিয়ে দেয় আমরা বাঙালি, আমাদের নিজস্বতা বলে কিছু আছে। আমরা সযতনে এই ধারা লালন করে চলেছি। বৈশাখের প্রথম দিনে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর, প্রাণবন্ত। এই সংকটময় পরিসি’তির মধ্যেই বাংলায় একটা নববর্ষ পার হয়েছে। আর একটা নববর্ষ এসেছে। এই করোনর দুই বছরে সাধারণ মানুষের জীবন যাপন আরও কষ্টসাধ্য হয়েছে। কারণ একদিকে মহামারী অন্যদিকে আয় কমেছে। সেখান থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরে দাড়াচ্ছে মানুষ। যে আনন্দ থেমে ছিল, যে আনন্দ উপলক্ষ্য খুঁজছিল তা পহেলা বৈশাখ ঘিরেই কেন্দ্রীভূত হবে। আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও কোলাহলে পূর্ণ হবে এই দিনকে ঘিরে। করোনায় তাদেরও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। বৈশাখের প্রথম প্রহর থেকেই রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের অনুষ্ঠান থাকে। সূর্য ওঠার সাথে সাথেই নতনু বছরের মঙ্গল কামনায় বটমূল প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে। সবার কন্ঠে একসাথে বেজে ওঠে- ’এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ বৈশাখকে বরণ করে নিতে বাঙালি যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে তা মূলত দেশ থেকে দেশে প্রভেদ ঘটে। যে দেশে যে রীতি সেই রীতি অনুযায়ী সংস্কৃতি বিকশিত হয়, প্রসার লাভ ঘটে। সেই দেশের নাগরিক প্রাণান্ত চেষ্টা করে নিজ সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে। আর বিদেশি সংস্কৃতি, আধুনিকতা পর্যন্তও বর্জন করতে দ্বিধা করে না যদি তা নিজ সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়। মাঝে মাঝে এমন সব প্রতিবেদন আমাদের চোখে পরে। আবার নিজ ভাষার সম্মান রক্ষা করেও অনায়াসে বিদেশি সংস্কৃতির চর্চা করা যায়। তবে যদি চর্চাটা ক্রমাগত বিদেশি সংস্কৃতিরই হয় এবং আপন সংস্কৃতি বর্জন করতে শিখি তাহলে তা সাংঘর্ষিক হবে এবং একসময় বিদেশি সংস্কৃতিই নিজের স’ান দখল করবে। যেরকমটা আমাদের দেশে হয়েছে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে বাতাস এমনভাবে ভারী হয়েছে যে আমরা আসলে হিন্দী না ইংরেজি শেখার চেষ্টা করছি নাকি বাংলাটাই ভালোভাবে জানা দরকার সেটাই গুলিয়ে বসে আছি। এই যে বছরের প্রথম দিন বলছি সেখানেও ইংরেজি বর্ষ বরণ করতে আমাদের ব্যাপক তোড়জোরের অভাব নেই। তাতে ক্ষতি কিছু নেই। ক্ষতি হলো যখন কেউ সেখানেই বেশি আনন্দ পান যতটা না পান বাংলা বছরকে বরণ করতে। দিন দিন সেই সংস্কৃতি বদলাচ্ছে। পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিতেই এখন বেশি ঢল নামে। এটাই যে আমাদের প্রাণ। প্রকৃতিরও বৈচিত্র্যতা লক্ষ্যনীয় এ সময়। এই কাটফাঁটা রোদ্দুর আবার এই কালো মেঘে ছেয়ে যায়। কালবৈশাখী হানা দেয়। পহেলা বৈশাখে আমাদের শপথ করতে হবে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন রুখে দেবার। যদিও সেটা বেশ কষ্টসাধ্যই বটে! আমরা চাইলেই কি আর এসব পারি! যেখানে আমাদের মননে জায়গা করে নিয়েছে ভিন দেশী সংস্কৃতি। কিন’ আমাদের বাংলাকে মানে বাংলার সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে হবে। বাংলার পোশাক,কথা বলা, খাদ্য,রুচি,অনুষ্ঠান,মূল্যবোধ,আচরণ সবকিছুই এগিয়ে নিতে হবে এবং ধরে রাখতে হবে। যার সূচনা হয় বছরের প্রথম দিনে অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে।

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য