কণ্ঠযোদ্ধা নমিতা ঘোষ : একজন মহান শিল্পী / আইভি সাহা

আমার এই গবেষণালব্ধ লেখাটি হয়তো সবার নজরে আসবে না তবে যে দু’জন পড়বেন তাঁদের জন্যই আমার এই লেখাটি সার্থক হবে বলে আশা করি।

বিশিষ্ট শিল্পী” নমিতা ঘোষ “এই নামটি জন্মের পর থেকে আমার মা’য়ের মুখে শুনে শুনে বড় হয়েছি। একই সঙ্গে দীর্ঘ নয় মাস ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন দুজনে। সেই সুবাদে বন্ধুত্ব ছাপিয়ে আত্মার বন্ধন। পারিবারিক সম্পর্ক বলেই এমন গুণীজনকে কাছ থেকে জানার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের ভাই-বোনের। চিরকুমারী ও নি:সন্তান ছিলেন তিনি। আমার ভাই রাজাকে ছেলে বলেই ডাকতেন।তাঁর শাঁখারী বাজার বাড়িতে বহুবার যাওয়া হয়েছিল আমাদের।

শিল্পী নমিতা ঘোষ গতবছর চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কিন্তু তাঁর অবদান এবং ত্যাগ এই দেশের জন্য রয়ে গেল একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের কন্ঠযোদ্ধাদের তালিকায় আজীবন। আমি খুব সংক্ষেপে তাঁর সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদানের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এই মহিয়সী নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে।

শ্রদ্ধেয় শিল্পী নমিতা ঘোষ ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম একজন নারী কন্ঠশিল্পী। ১৯৬৯ সালে একটি ঘরোয়া গানের অনুষ্ঠানের আসরে সরাসরি তাঁর গান শুনেছিলেন, শ্রদ্ধেয় মহান নেতা ” শেখ মুজিবুর রহমান”

সেদিন সীমিত সংখ্যক অতিথিরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তবে সেই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

শিল্পী নমিতা ঘোষ সেদিনের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এইভাবে ” সেই সিংহ পুরুষকে দেখে গানের আসরে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম” সেদিন নমিতা ঘোষ গেয়েছিলেন লোকঅঙ্গের গান এবং কীর্ত্তণ গান।কীর্ত্তণ শুনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,” যদি এদেশের শাসনভার পাই তাহলে রেডিও ও টিভিতে কীর্ত্তণ গান এবং নজরুল, রবীন্দ্রনাথের গান চালু করবো।

নমিতা ঘোষ বলেন,” এই মহান মানুষটির মুখের এমন কথাগুলো আশীর্বাদের মতো আমার কানে লেগেছিল সেদিন।

সেদিন শিল্পী নমিতা ঘোষের সঙ্গে এই আসরে আরও ছিলেন,আনোয়ার উদ্দিন খান এবং অজিত রায়।

সেদিনের সেই গানের আসরের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা, নমিতা ঘোষকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাবার জন্য প্রচন্ডভাবে উজ্জীবিত করে তোলে। ১৯৬৯ সালের সংগঠিত হওয়া বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠীর মধ্যে দিয়েই কর্মসূচী নেওয়া হয় সবাই মিলে ক্যাম্পে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেবার জন্য।

এর পর এলো ঊনিশোএকাত্তর। পরিবারের সবাই মিলে ২৭ শে মার্চ সকালে সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছান। এরপর নৌকা পার হয়ে যান শুভাড্যা গ্রামে। তারপর বিভিন্নভাবে আখাউড়া সীমান্ত পার হন।১৬ই এপ্রিল আগরতলা,রাজবাড়ি ক্যাম্পে শরণার্থী হন। সেখানে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা প্রিয়দাস চক্রবর্তী বাবু ক্যাম্পে এসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী নমিতা ঘোষের পরিচয় পেয়ে একটি পলিটেনিক্যাল হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।

আগরতলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তখন গান গেয়েছেন, তিনি বলেন, ” আমরা গলায় হারমনিয়াম ঝুলিয়ে গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করে, জামা কাপড় খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাঠাতাম।

নমিতা ঘোষ আরও বলেন,এরপর প্রিয়দাস বাবু,সাবেক কেবিনেট সেক্রেটারি তৌফিক ইমাম সাহেবর সহযোগীতায় মে মাসে দুটো বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করে আমার মাকে ও আমাকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা হয়।পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক আমিনুল হক বাদশা ভাই আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যান।২৯ শে মে আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেছিলাম।

নমিতা ঘোষ আরও বলেন, টালিগঞ্জের সার্কুলার রোডের একটা বিল্ডিংয়ে ছিল গোবরা ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে আরও নারী কণ্ঠশিল্পীরা যোগদান করেছিলেন তাঁরা হলেন, স্বপ্না রায়,অরুণা সাহা, রূপা খান,মালা খান,রমা ভৌমিক,মাধুরী আচার্য প্রমূখ।

আরও ছিলেন পুরুষ গুণী শিল্পী এঁদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় আপেল মাহমুদ, মো: আব্দুল জব্বার, দিলীপ সোম,শেখ আলাউদ্দিন আহমেদ, শহিদুল ইসলাম, শান্তি মুখার্জি, মঞ্জুর আহমেদ, অবিনাশ শীল,বারিস্টার আ: বাদল রসিদ সহ আমরা চৌদ্দ সদস্যের একটি কালচার দল।

পরবর্তীতে ধাপে -ধাপে অনেক গুণীশিল্পীরা এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেছিলেন এবং তাঁরা আলাদা ক্যাম্পে থেকেছেন।

দেশের টানে,জন্মভূমির ভালোবাসায় শত ঝুঁকি নিয়েও গান গেয়েছেন শিল্পীরা।

কথাগুলো কষ্টের হলেও তিনি দৈনিক জনকণ্ঠকে (২০০৯ সালে১৭ই ডিসেম্বর) সাক্ষাৎকার দেবার সময় একটানা বলে গেছেন,” দীর্ঘ নয় মাস পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ কষ্টতো শুধুই নিজের জন্য করিনি,করেছি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। দেশের মানুষের জন্য। আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্য।

মুজিবনগর সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার নির্দেশ দেন। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ১৪ জন শিল্পীকে নিয়ে ব্যারিস্টার আঃ রশিদ বাদল এম.এন.এ এর নেতৃত্বে “বাংলাদেশ কালচারাল ট্রুপ” গঠিত হয়েছিল। চিত্র পরিচালক দিলীপ সোমের ” বিক্ষুব্ধ বাংলা ” গীতি আলেখ্য নিয়ে এই ১৪ সদস্যের এ কালচারাল ট্রুপ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফান্ড করার উদ্দেশ্যে ভারতের বম্বে সহ মহারাষ্ট্র, দিল্লী,কানপুর, পুনা ও গোয়া সফর করে গীতি-নক্সা “বিক্ষুব্ধ বাংলা” মঞ্চস্থ করেছিল।

এবং নানান স্থানে গণ সংগীত ও দেশের গান পরিবেশন করেছিলেন।

আর এর থেকে উপার্জিত অর্থ জমা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। শরণার্থীদের জন্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সেসময় নগদ অর্থ ১১ লক্ষ টাকা,কম্বল, শতরঞ্জি, পুলওভার,ওষুধ সামগ্রী ও পোশাক।

সে সময় কলকাতার এসব অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন বোম্বের চিত্রাভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান, সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখপাধ্যায়,সলিল চৌধুরী,সবিতা চৌধুরী,বিশিষ্ট সাংবাদিক ও যুগ্মসচিব সলিল ঘোষ।

সে সময় তবলা ও হারমনিয়ামে এই গানগুলো সর্বপ্রথম রেকর্ড করা হয়েছিল।মূলত এই গানগুলো তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণা ছিল, মনের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে সেই উত্তাল রক্ত গরম হবার মতো গানের সুর ও বাণী।

তখন যে সকল গান অত্যান্ত জনপ্রিয় হয়েছিল,

সেগুলো হলো – গোবিন্দ হালদারের লেখা, আপেল মাহমুদের সুর ও স্বপ্ন রায়ের গাওয়া “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না”; কাজী নজরুল ইসলামের লেখা নমিতা ঘোষের গাওয়া“ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি”; আব্দুল জব্বারের গাওয়া“জয় বাংলা বাংলার জয়”; আপেল মাহমুদের গাওয়া“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”, ইত্যাদি।

এ ছাড়াও“হায়রে কৃষাণ তোদের শীর্ণ দেহ দেখে যার অশ্রু মানে না”, “সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা, সোনা নয় যত খাঁটি”, “আজি বাংলাদেশে ক্ষুধার আগুন তাই তো জ্বলে” ও আরো অনেক জনপ্রিয় গান এ ট্রুপের শিল্পীগণ।গেয়েছিলেন। তবে বেশির ভাগ গান ছিল যৌথ পরিবেশনায় সব শিল্পের কন্ঠে গাওয়া রেকর্ডগুলো।

এই গুণীশিল্পী নমিতা ঘোষকে নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে বইটি লিখেছেন লেখক আবুল ফজল শামসুজ্জামান। এখানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের নিয়ে বিস্তারিত লেখা আছে এই বইটি ত্রিশ বছর আগে তিনি লিখেছিলেন। বইটি আমার সংগ্রহে আসে একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে। এই প্রসঙ্গে অন্য একটি লেখায় উল্লেখ করবো বিস্তারিত।

শ্রদ্ধেয় শিল্পী নমিতা ঘোষ ছিলেন একজন আশাবাদী মানুষ।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা যখন তাঁদের স্বীকৃতি যথা সময়ে পায়নি এদেশে।তখন তিনি মনে কষ্ট পেয়েছেন, আফসোস করেছেন এ কথা ঠিক কিন্তু তাই বলে সোনার বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখে গিয়েছেন আমৃত্যু। গর্বিত হয়েছেন দেশের জন্য কাজ করতে পেরে।তাঁর জীবদ্দশায় স্বীকৃতি ও সম্মাননা অর্জন করেছেন বহু সেই সাথে মৃত্যুর পরে পেয়েছেন রাস্ট্রীয় মর্যাদা। তিনি বলতেন ” মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশবাসীর সত্যিকারের বিজয় আসবেই”।

তথ্যসূত্র : ১৭ই ডিসেম্বর ২০০৯ সালে জনকণ্ঠ পত্রিকা

তথ্যসূত্র: 1971 @1971liberationwar.,,,