কুয়াশা ঢাকা দিন/জহিরুল ইসলাম

ধারাবাহিক মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস

পর্ব – ১ ।।
অনেকটা হন্তদন্ত হয়েই ক্লাসে ঢুকলো রবিন। স্কুলের মেইন গেট পেরুনোর আগেই ঘণ্টা পড়ে গেছে। রবিনের আগেই স্যার যদি ক্লাসে ঢুকে পড়েন তাহলে আজ আবার ভাগ্যে কী জোটে কে জানে? এমনিতেই লেট লতিফ হিসেবে কিছুটা নাম কামিয়েছে রবিন। বাংলা স্যার তো সেদিন বলেই বসলেন, তোমার নাম আবদুল লতিফ না রেখে ভুল করেছেন তোমার বাবা-মা।
শুনে তো ক্লাস জুড়ে সে কী হাসাহাসি! এর মধ্যে আবার একটা ফাজিল টাইপের ছেলে বলে উঠলো, কেন স্যার, রবিনের নাম কেন লতিফ রাখা উচিত ছিলো?
স্যার বললেন, তাহলে লেট লতিফ নামটা ওর সার্থক হতো।
স্যার তো বলেই খালাস, তাঁর তো আর দুনিয়ার সব দিক সামাল দিয়ে তারপর স্কুলে আসতে হয় না! এইতো কিছুদিন আগের একটি ঘটনা। সেদিন সকাল হতে না হতেই মা ডেকে তুললেনÑবাবা রবিন, হোমওয়ার্ক শেষ না করেই রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিস। তাড়াতাড়ি উঠে হোমওয়ার্ক শেষ করে নাশতা খেয়ে রেডি হয়ে নে। স্কুলের সময় হয়ে এলো বলে।
আরও কিছুটা সময় ঘুমানোর ইচ্ছা থাকলেও পারলো না রবিন। মায়ের কথা শুনেই অঙ্ক স্যারের হাতে বেতের লকলকে ডগাটা ওর বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তাই ঘুমজড়ানো চোখে উঠে বসতে হলো। উঠে হাতমুখ ধুয়ে যেই না হোমওয়ার্ক করতে বসেছে পড়ার টেবিলে, অমনি পাশের জানালার ফাঁক থেকে একটা পেয়ারা বাতাসে দুলে দুলে ডাকতে লাগলোÑআয় রবিন, তাড়াতাড়ি আয়। ইমনের চোখে পড়লে কিন্তু আর রক্ষা নেই। টুপ করে পেড়ে নিয়ে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়বে পুকুরের পানিতে। তারপর জলের মধ্যে সাঁতার কাটবে আর রবিনকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাবে ডাঁশা পেয়ারাটা।
না, আর দেরি করা যায় না। কোনোমতে হোমওয়ার্কের খাতা দুটো লেখা শেষ করে একটা গামছা কোমরে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে পুকুরপাড়ের দিকে দৌড় দেয় রবিন। গাছ থেকে পেয়ারাটা পেড়ে পেয়ারাগাছের ডাল থেকেই ঝপাৎ করে লাফিয়ে পড়ে পুকুরের জলে। তারপর পাড়ার অন্য ছেলেদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে কাটতে চোখ দুটো টিয়াপাখির মতো লাল টুকটুকে বানিয়ে ঘরে ফেরে রবিন। দেরি হয়ে গেছে আন্দাজ করতে পেরে মাথা খারাপ হয়ে যায় তার। সাড়ে নটা বেজে গেছে। আবারও সেই লেট লতিফ!
কাল অবশ্য সেরকম কিছু ঘটেনি। রাতে পালিয়ে পালিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুম প্রায় হয়নি বললেই চলে।
রাতে বাবার রুম থেকে ট্রানজিস্টর রেডিওটা চুরি করে নিজের কাছে এনে রেখেছিলো রবিন। পুকুরপাড়ের চালতাগাছতলায় গিয়ে সেটা নিয়ে এতো চেষ্টা করেও সেন্টারটা ধরতে পারলো না সে। মাঝরাতে ঘুমে চোখ দুটো কেবল বুজে এসেছে, তখনই গুড়ুম করে একটা শব্দ হলো কোথাও। শালা রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার বলে গালি দিতে দিতে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে ও। কিন্তু চোখ বুজলেই ওদের পড়শি কাদের চাচার মুখটা ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে। মুখটা প্রথম প্রথম স্বাভাবিক মনে হলেও আস্তে আস্তে সেটা বিকট আকার ধারণ করতে থাকে। রাজাকার শব্দটা মনে এলেই রবিনের চোখে কেন যে কাদের চাচার মুখটা ভেসে ওঠে সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছে ও। আসলে রাজাকার বাহিনীতে যারা নাম লিখিয়েছে তাদের মধ্যে কাদের মিয়াই ওর পরিচিত। তাই ওর কাছে রাজাকার মানেই কাদের চাচা। তো এসব ভাবতে ভাবতে রবিন যখন ঘুমায় তখন প্রায় ভোররাত। সকালে ঘুম থেকে সময়মতো উঠতে না পারলে ক্লাসে তো দেরি হবেই।
ক্লাসের সামনে গিয়ে হাঁফ ছাড়লো রবিন। যাক, আজকের মতো বাঁচা গেছে, স্যার এখনও আসেননি!
ক্লাসে ঢুকতেই পেছনের দিকের একটা বেঞ্চি থেকে শিশিরের আমন্ত্রণ পেলো রবিন। ইশারায় রবিনকে সে তার পাশে বসতে বললো। রবিনও কাউকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে আস্তে গিয়ে শিশিরের পাশে বসে পড়লো।
এই রবিন, শুনেছিস? রবিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো শিশির।
কী?
আবার পালিয়েছে।
কে?
ক্লাস টেন এ-সেকশনের মোস্তফা ভাই।
ওই যে ফার্স্টবয় মোস্তফা ভাই?
হ্যাঁ।
মোস্তফা ভাই এতো ভালো ছাত্র হয়েও যুদ্ধে গেলেন?
হ্যাঁ গেলেন। কেন, যুদ্ধে যাওয়ার সঙ্গে ভালো ছাত্র-মন্দ ছাত্রের সম্পর্ক কী? জিজ্ঞেস করলো শিশির।
না, মানে যুদ্ধটা তো একটা বাজে ব্যাপার। ওটা আমার মতো মন্দ ছাত্রদের কাজ।
শোন রবিন, তুই কি কিছু ভাবছিস?
আচ্ছা, স্যার এখনও ক্লাসে আসছেন না কেন? পÐিত স্যার তো কোনোদিন ক্লাসে দেরিতে আসেন না! কথা ঘোরাতে চাইলো রবিন।
শিশির বললো, মোস্তফা ভাইয়ের ব্যাপারটা নিয়ে স্যাররা আলোচনা করছেন। আজ হয়তো হেডস্যার সব ক্লাসের ছাত্রদের ডেকে একটা বক্তৃতা শোনাবেন। বলবেন, বদমাশ ছেলেটা পালিয়েছে। তোমরা হয়তো শুনে থাকবে ব্যাপারটা। কিন্তু তোমরা তো জানো ওই ছেলেটা এর আগেও অনেকবার পালিয়েছে বাড়ি থেকে। টাকা-পয়সা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার ফিরে এসেছে। আমার প্রিয় ছাত্ররা, কোনো ভালো ছেলে বাড়ি থেকে পালায় না। কোনো ভালো ছেলে তার বাবা-মা এবং শিক্ষকদের কষ্ট দেয় না।
ক্যান, হেডস্যারও কি ওই দলের নাকি? পÐিত স্যারকে নাকি স্কুলে আসতে নিষেধ করেছেন? পÐিত স্যার নাকি ভারতের দালাল?
আরে ওটা তো স্যারের কথা না, ডিসি সাহেবের কথা।
তাহলে পÐিত স্যার এখন কোথায় যাবেন? ইন্ডিয়া চলে যাবেন?
আরে না, স্যারও নাকি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, প্রাণ থাকতে তিনি এ দেশ তো ছাড়বেনই না, স্কুলও ছাড়বেন না। বললো শিশির।
এই শিশির, স্যার আসছেন বোধহয়। ঠোঁটের কাছে একটা আঙুল তুলে চুপ করতে ইশারা করলো রবিন।
তারপরও শিশির ফিসফিসিয়ে বললো, শোন, স্কুল ছুটির পরে তোর সাথে আরও কথা আছে। স্কুলের পেছনের বাগানে অপেক্ষা করবো আমি। তুই চুপি চুপি চলে আসিস।
শিশিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্লাসে ঢুকলেন পÐিত স্যার। ওরা যেমন ধারণা করেছিলো তেমন কোনো উপদেশমূলক বক্তৃতা-টক্তৃতা হলো না ক্লাসে। পÐিত স্যার বাংলা পড়ালেও আজ তিনি কী মনে করে ছাত্রদের ভ‚গোলের জ্ঞান দিলেন কিছুক্ষণ। বø্যাকবোর্ডে চক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ এঁকে দেখালেন। আরও দেখালেন পূর্ব পাকিস্তানের তিনদিকের ভারতের সীমান্ত। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝখানে কতটা দূরত্ব তাও এঁকে দেখালেন। বাংলার ক্লাসে বাংলার ব-ও উচ্চারণ না করে ‘আমার ছাত্ররা সবাই ভালো থেকো’ বলে চলে গেলেন তিনি।
স্যার চলে গেলে ছাত্ররা বলাবলি করতে লাগলো, স্যারের কি আজ মাথা খারাপ হয়েছে? কোথায় তিনি ণত্ব-বিধি আর ষত্ব-বিধি শেখাবেন তা না, তিনি পুরো পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তান দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।