জন্মদ্বিশতবার্ষিকীতে নবজাগরণের অবিসংবাদিত পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গীয় অঞ্চলে নবযুগের যে সূচনা হয়েছিল, তার অন্যতম উদ্যোক্তা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাঙালি সমাজে প্রগতিশীল সংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান সব সময় অনুকরণীয়। একদিকে যেমন আধুনিক বাংলা ভাষার রূপকার, তেমনি বাল্যবিবাহ রোধ ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় রেখেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা।

১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর, ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন ভারতের মেদেনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সবাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে চিনলেও তার প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছাত্রজীবনে সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন তিনি। এতে যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ল কমিটি বিদ্যাসাগরকে প্রশংসাপত্র প্রদান করেন। আর তাতে প্রথমবার তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি। মাত্র একুশ বছর বয়েসে এর মধ্য দিয়ে ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ চাপা পড়ে যায়। আর সময়ের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। মা ভগবতী দেবী। ছোটবেলায় ঈশ্বরচন্দ্র তার দাদা রামজয় তর্কভূষণের উৎসাহে বাংলা শিক্ষায় শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে আসেন তিনি। সেখানে সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণ বিষয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মাসিক বৃত্তির জন্য মনোনীত হন। ‘বহিস্থ শিক্ষার্থী’ হিসেবে বইসহ আর্থিক সম্মানী লাভ করেন তিনি। সংস্কৃত কলেজে প্রায় তেরো বছর অধ্যায়নকালে ব্যাকরণ, অলংকার, বেদান্ত, ন্যায়শাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন, সংস্কৃত এবং ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন বিদ্যাসাগর।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালি জাতির ইতিহাসে বাংলা গদ্যরীতি, সামাজিক কুসংস্কার প্রভৃতি বিষয়ের সংস্কারক হিসেবে সুপরিচিত। তখন ভারত তথা বঙ্গীয় অঞ্চলে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের উপর বাসা বেধেছিল সামাজিক নানা কুসংস্কার। সামাজিক এসব কুসংস্কার দূরীকরণে দৃঢ়চেতা মনোভাব তাকে ‘সিংহপুরুষ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় হিন্দু নারীদের বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন, বহু বিবাহ প্রথা রদকরণে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। তৎতকালীন বাঙালি পণ্ডিতবর্গের সমালোচনা সত্ত্বেও নিজের চিন্তা-চেতনা থেকে সরে দাঁড়াননি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সামাজিক কুসংস্কার রোধে শুধু জনসচেতনতা তৈরি করেননি, উদাহরণও তৈরি করেছেন। তিনি বিধবা নারীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে বাল্যবিয়ের বিপক্ষেও প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। নারী মুক্তির লক্ষ্যে নারীদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় স্থাপন করেছিলেন বালিকা বিদ্যালয়। কেননা তিনি উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত নারী মুক্তি সম্ভব নয়। সেই সময়ে এসব কাজ করা মোটেও সহজ ছিল না।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, ব্রজবিলাস, প্রভাবতী সম্ভাষণ, শব্দমঞ্জরী, নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (মৌলিক গ্রন্থ); বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, সীতার বনবাস, শিশুপালবধ, রামায়ণ, বাঙ্গালার ইতিহাস, জীবনচরিত, নীতিবোধ, বোধোদয়, ভ্রান্তিবিলাস (অনুবাদগ্রন্থ); পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্, সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ (ইংরেজি গ্রন্থ), অন্নদামঙ্গল, কুমারসম্ভব, রঘুবংশ, অভিজ্ঞান শকুন্তলম, হর্ষচরিত (সম্পাদিত গ্রন্থ); বর্ণপরিচয়, ঋজুপাঠ, ব্যাকরণ কৌমুদী, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (ব্যাকরণ বিষয়ক) প্রভৃতি।

মানবপ্রেমিক বিদ্যাসাগর সর্বদা মানুষের কল্যাণে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। এই মহান বাঙালি পুরুষ ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুতে তৎকালীন বাঙালি সমাজ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শোকাতুর হয়ে পড়েছিল। বাঙালি জাতি সেদিন হারিয়েছিল নবজাগরণের এক অবিসংবাদিত পুরুষকে।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়