জীবন থেকে নেয়া।। সাবেকুন নাহার মুক্তি

জয়িতা , নিরুপমা , মাধবী, নীলিমার আড্ডা চলছে জম্পেশ। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। জানালার কাচ দিয়ে দূরের মাঠে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো কাদা মাখামাখি দেখতে সবার চোখ আটকে আছে। চায়ের কাপে সুরুৎ সুরুৎ চুমুকের মাঝে মাঝে ভাঙছিল ঘরের নীরবতা। সবাই কেমন যেন হটাৎ চুপচাপ। শুধু বৃষ্টি আর চা অবগাহন চলছে যেন। অনেক বছর পর বন্ধুদের আড্ডা বসেছে। অনেক কথার ফুলঝুরি শেষে সবাই যেন একটু দম নিচ্ছে।
‘জয়িতা তোর স্বামী তোকে খুব ভালোবাসে তাই না ?’

হটাৎ এক প্রশ্নে চমকে উঠলো জয়িতা। জানালা থেকে চোখ সরিয়ে নিরুপমার দিকে তাকালো সে। সবগুলো চোখ তার দিকে তাকিয়ে। সব গুলো রাঙা ঠোঠ গুলোতে আলস্যময় হাসি। সবাই প্রতীক্ষায় তাকিয়ে আছে একটা উত্তরের আশায়।

‘কীরে কিছু বল , কেমন করে তার ভালোবাসা তোকে জানায় ?’ মাধবীর প্রশ্নে আরো উৎসুক হয়ে গেলো সবাই।
জয়িতা ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। একটা ভাবনায় পরে গেলো যেন। অথৈ সমুদ্রে হাতড়ে তিরিশ বছর পিছনে চলে যাবার চেষ্টায়। রুদ্রর সাথে জীবন শুরু হয় বিশ বছর আগে। সবই তো ঠিক ঠাক , কোনো ভুল নেই জীবন চলায়। একেবারে সিস্টেম্যাটিক সংসার। ছেলে মেয়ে আত্মীয় স্বজন সব নিয়ে একেবারে সুখের সংসার। সমাজ যেভাবে চায় ঠিক সেভাবেই তো চলছে তাদের জীবন। আজ তিরিশ বছর পর একটি প্রশ্নের সোজা সাপ্টা উত্তর দিতে জয়িতার এতো দ্বিধা কেন ?

ইউনিভার্সিটি তে যখন সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ঠিক ওই সময় জয়িতা কে একগুচ্ছ গোলাপ হাতে সাব্বির তার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল। সাব্বির আর জয়িতা একই সাথে পড়তো। দুজনেরই ভালো লাগা কখন হয়েছিল কেউ বুজতে পারে নি। ঠিক ভালোবাসা বলা যাবে না জয়িতার দিক থেকে। ভালো লাগাই ছিল। সেই ভালো লাগাকে সম্বল করে হাত ধরেছিলো সাব্বির এর । কিন্তু এই ভালো লাগা আর ভালো বাসা টা বেশিদূর নিয়ে যেতে পারেনি ওরা। তার পর আর বন্ধুত্বও টিকে থাকে নি ওদের। মাস্টার্স এর পর পরিবারের মতেই বিয়ে হয় ওদের। সুপুরুষ , সুদর্শন, সমাজে নাম ডাক আছে এমন ছেলের সাথেই বিয়ে হয়।
সংসার ,ধর্ম , কর্ম সবই তো ঠিকঠাকই চলছে । কিন্তু কোথায় যেন কি নেই।
জয়িতা এবার একটু মুচকি হেসে বলে, ‘সবই তো আছে কিন্তু কোথায় যেন একটা কিছু নেই।’
বান্ধুবিদের উৎসুক চোখ জয়িতার দিকে। একটু নীরবতা।

জয়িতা বলতে শুরু করে, ‘একটা পরিপূর্ণ ভালোবাসা নেই। হয়তো দিন শেষে এসে বুঝতে পারলাম সমাজের সংসারের সব কিছু ঠিক চালাতে হলে ভালোবাসা কে বিসর্জন দিতে হয়। তাই শুধু মনে পরে সাব্বির এর সাথে কাটানো দিনগুলো। জীবনের অতটুকুই প্রাপ্তি; আমার তাই মনে হয়। খুব একটা খারাপ হয় নি অল্প সময়ের একটা সম্পর্কে জড়িয়ে। মাঝে মাঝে কিছুটা ভালো সময় তো কাটে সেই সুখ স্মৃতি গুলো উপলব্ধি করে।’
একটা দীর্ঘশ্বাসে কিছুক্ষন মৌনতা নেমে আসে বান্ধবীদের আড্ডার ঘরে।

জয়িতা এবার চায়ের কাপ টেবিল এ রেখে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নিরুপমার দিকে- ‘তুই কেমন করে একা এতটা পথ পারি দিলি নিরুপমা ?’
নিরুপমা খুব মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। অসম্ভব সুন্দরী যাকে বলে তাই সে।
ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ সুখেই সংসার করছিলো। কিন্তু এতটা সুখ বেশিদিন ছিল না ওর কপালে। হটাৎ এক রোড এক্সিডেন্ট এ স্বামীর মৃত্যু ওর পুরো পৃথিবীটা বদলে যায়। শুরু হয় একটা সংগ্রামী জীবন।
ছেলেমেয়েদের বড় করা ,উপার্জন করা সমস্ত কিছুই সে এক হাতেই করেছে।
নিরুপমা একটু উঠে দাঁড়িয়ে জানালার গ্রিলটাতে হাত রেখে বাইরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো বৃষ্টির দিকে। ওর বান্ধুবীরাও নিরুপমার নীরবতায় অংশ নিলো।কফোঁটা চোখের জল ওর চিবুক গড়িয়ে গেলো। শাড়ির আঁচলে একটু মুছে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘হাসান চলে যাবার পর এতটা বছর একটু প্রাণ খুলে কাঁদতেও পরিনি। ছেলেমেয়েগুলো কে সামলাতে যেয়ে নিজের কষ্টটা কে বিসর্জন দিয়েছি।’
‘নিরুপমা, কেন তুমি এতদিনে একটি জীবন সঙ্গী খুঁজে নাও নি। এতোটা তো পথ এক হেটে তুমি তো ক্লান্ত?’
মাধবীর প্রশ্নে নিরুপমা একটু ম্লান হাসলো। একটু হেসে উত্তরে বললো জানি না কেন ? কাউকে খুঁজে পাই নি নাকি সমাজের চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল নাকি ছেলেমেয়েরা মেনে নিতে পারবে কি না সেই বেপারটি কাজ করছিলো , ঠিক জানি না কোনটা আসলে বড় বাধা ছিল। নিজের মনের প্রশান্তি করতে যেয়ে আরো একজনের হাত ধরা কতটা জটিলতা তৈরী করবে কিনা জীবন টা সহজ করার চেয়ে সেই ভাবনাতে সাহস করে উঠতে পারিনি।
নিরুপমার জীবনের এই দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত; কাউকে আবারো জীবন সঙ্গী করে বেছে না নেয়া কতটা ভুল বা সঠিক সেটি উত্তর জীবন ওকে দিতে পারে নি। তাই আজ নিরুপমা ভাবে হয়তো জীবনের এই পরিস্থিতি ওকে আরো সংগ্রামী এবং শক্তিশালী করেছে একা পথ চলায়।
নিরুপমার আর জয়িতার জীবনের পূর্ণতা আর অপূর্ণতা কথা ভাবতে ভাবতে মাধবী বলে উঠলো, ‘তোদের জীবনের গল্প শুনে মনে হচ্ছে আমার একা পথ চলার সিদ্ধান্ত টা খারাপ হয়নি।’ একটু হেসে কথা গুলো বলে আবার একটু থেমে গেলো ।
নীলিমা বলে উঠলো, ‘মাধবী সত্যি কি একা থাকার খুব আনন্দ আছে ? জীবনে চলতে গেলে একটু প্রানখুলে নিঃশাস নেবার জন্য তো কাউকে লাগে।’
উত্তরে মাধবী বললো, ‘নিজের জীবনের সাফল্য ধরে রাখতে আসলে ওই দিক টা ভাববার সময় পাইনি। সত্যি মাঝে মাঝে নিজেকে খুব একা মনে হয়। কিন্তু সময় তো আর আমাকে সিন্ধান্ত নেবার সময় দেয়নি।’
নীলিমা বলে উঠলো, ‘এতো কিছু বুঝিনারে আমি। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর সাথে বয়সের পার্থক্য ছিল পনেরো বছরের। প্রেম ভালোবাসা কি সুখ দুঃখ কি এইসব বুঝবার আগেই ছেলে পুলে বড় হয়ে যায়। একটা খুব ছাপোষা জীবন। একঘেয়ে বটে। মেয়ে ছেলে বিয়ে দিয়ে নানী দাদিও হয়ে গেলাম। একটা যৌথ পরিবারের ব্যস্ততা আমাকে নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় দেয়নি। আজ তোদের সাথে এতো বছর পর দেখা হয়ে মনে হলো আমাদের নিজেদের নিয়ে ভাববার দরকার রয়েছে বৈকি।’
বান্ধুবীরা সবাই একসাথে বলে উঠলো, ‘অবশ্যই দরকার আছে।’
চার বন্ধুর বহু যুগ পরে দেখা, একটা আড্ডা, জীবনের গল্প গুলো বলা, সবার মাঝে যেন একটা প্রশান্তি নিয়ে এলো। নতুন চায়ে চুমুকে বন্ধুরা প্রতিজ্ঞা করে নিলো জীবনে যে কোনো প্রাপ্তি না থাকুক না কেন , না পাওয়ার বেদনা গুলো ওরা ভাগ করে নিবে। আর পাওয়ার আনন্দগুলো ওরা একসাথে উপভোগ করবে। আর হাত ছেড়ে দিবে না বাকি জীবনটায়!

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়