ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস : ঝিল, জঙ্গল ও লোকালয়ের কথা

ঝিল ও পিপুল জঙ্গল/  দ্বিতীয় পর্ব                  

তাপসকিরণ রায় :

লাল বাবুর বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে আছে এক মন্দির। তার নাম মহাদেব মন্দির। এখানে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা আসে। মন্দির ও তার আশপাশটা দিনভর জমজমাট থাকে। তারপর সামান্য রাত হলেই সব শুনশান হয়ে পড়ে।  চারদিক জনশূন্য হয়ে যায়। পূজারীরা সন্ধ্যের সময় পূজা-আচ্চা সেরে ঘরের দিকে চলে যায়। আর রাতে পাহারার জন্য থাকে দু’চারজন পাহারাদার। এই মন্দিরের  সামনেই বড় রাস্তা। তারপর একটু এগোলে জঙ্গলের সীমানা শুরু হয়। আর সে জঙ্গল ধরে ক’পা এগোলেই পড়ে বেশ বড় একটা ঝিল। এই ঝিলে আছে বড় বড় মাছ, জলসাপ, কাঁকড়া আর কচ্ছপের দল। কচ্ছপের দল এখানে দলে ভারি। ঝিলে ওদের দৌরাত্ম্য কম নয়। ঝিলের  চার পার ঘিরে আছে হালকা জঙ্গল। জঙ্গলে ঝোপঝাড় আর তার মাঝে মাঝে বড় বড় দু’একটা গাছ। এ বনে আছে য়াল, সাপ, বন বিড়াল, সজারু, এ ছাড়া আছে কাঠবিড়ালি ও নানা পাখির দল। বাঘ, ভাল্লুক সাধারণত এ জঙ্গলে আসে না। ঝিলের এক কোনায় বাঁধা থাকে একটা নৌকো। সরকারী ঝিল বলে মিউনিসিপাল অফিস তার তদারকি করে। মাস-দু’মাস অন্তর অন্তর জেলেরা এতে মাছ ধরে। আর কখনও সখনও নৌকা বিহারে এসে পড়ে লোক। এ জন্যে নগরনিগমের অনুমতি নিতে হয়। আর বাকী সময় সে নৌকা জলের ওপর ভাসতেই থাকে।

এখানে দুই কচ্ছপের বেশ দাদাগিরি চলে। ওরা ছোকরা বয়সের। ওদের এক জন হল নট, আর একজন ঘট। এমনি নামগুলি বেশ প্রচলিত ওদের মুখে। এ সব শব্দগুলি চট করে ওদের  মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। নট-ঘট ভীষণ দুষ্টু প্রকৃতির। কারও কথা ওরা মানতে চায় না।

ঝিলের বড় মাছ হল গজাল মাছ।  ও ঝিলের সবচেয়ে বড় মাতব্বর। সবাই গজালকে খুব ভয় করে চলে। ওর কথা ঝিলের সবাই খুব মান্য করে চলে।  তবে নট-ঘট অনেক সময় মাতব্বরের কথাও মানে না। গজাল সে জন্যে ওদের শাস্তি দিতে পারে না। ওরা ছুটে ছুটে পালিয়ে যায়। এই তো সে দিনের কথা, নট-ঘটকে গজাল বলেছিল, ‘এই তোরা আমার জাতের কাউকে বিরক্ত করতে আসবি না যেন !’ কিন্তু কে, কার কথা শোনে ? নট-ঘট সে দিন গজালের নাতিকে এসে পেছন থেকে থাপা মেরে দিয়ে চলে গেল। নাতি বলে কথা, একে তো ছোট, সত্যি তার পিঠ ছড়ে গিয়েছিল। গজাল দাদুকে শেষে নাতি গিয়ে নালিশ করল। গজাল তখনই ডাকাল নট-ঘটকে কিন্তু কোথায় নট-ঘট ? ওরা তো কোথাও নেই ! নেই, নেই, নেই, তিন দিন তাদের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। তিন দিন পরে ওরা যখন গজালের কাছে এলো। নট-ঘট উল্টে বলল, ‘তোমার নাতি আমাদের দেখলেই মুখ ভেংচায়। আমাদের দেখলেই ও চোখ ঘুরাতে থাকে !’

গজাল বলল, ‘তাই বলে আমার নাতির সঙ্গে এমনটা–’ 

নট বলল ‘বিচারের সময় আমার নাতি, তোমার নাতি কি আলাদা নাকি গো ? তুমি মাতব্বর বলে বিচার তো আলাদা হতে পারে না ! বিচার তো সবার জন্য সমান হবে।’

গজাল তখন ওদের ওপর ধমক দিয়ে উঠেছিল। নট-ঘট আর কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘এই যে আমরা কান ধরলাম, উঠ বস করলাম। আর কোন দিন এমন হবে না।’

ওরা দু’তিনবার কান ধরে উঠ বস করেই ছুটে পালিয়ে গেল। ‘ব্যাটার ছেলেরা এ রকমই’, গজাল তা জানে। ওদের শাস্তি দেবার সুযোগই পাওয়া যায় না।

নট ও ঘট মাঝে মাঝে অন্যের উপকারেও আসে। এই তো সে দিন রুই মাছ অসুস্থ হয়ে পড়ল। মনে হয় ওর হার্টের বিমারী। ব্যাস জ্ঞান হারিয়ে ও একেবারে চিৎপাত ! বুড়ো কচ্ছপ কবিরাজ এলো। ওষুধ-পত্র দেয়া হল কিন্তু তাতে কিছু কাজই হল না। কবিরাজ কচ্ছপ শেষে বলল, ‘শাল ফলের রস চাই, তবে এ রোগের নিবারণ সম্ভব।’

শাল ফল ? সে আবার কোথায় পাওয়া যাবে ? ধারে-কাছে কোথাও নেই। ওই পিপুল জঙ্গলে নাকি দু’তিনটে শাল গাছ আছে। তবে এ সময় ফল পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। শাল ফল এনে দেবে কে ? ভেবে ভেবে অসুস্থ রুইয়ের দাদার মনে হল এ কাজ একমাত্র নট-ঘটরাই করতে পারে। নট-ঘটদের ডাকা হল। ওরা এসে দেখল অনেক জনের জটলা সেখানে। গজালও এসেছে রুইকে দেখতে। গজাল বলল, ‘এই নট-ঘট, তোরাই পারবি, দেখ শাল ফল কোথাও থেকে জোগাড় করে নিয়ে আয় !’ গজালের কথায় আদেশের সুর।

নট-ঘটের গজালের এমনি মাতব্বরি ভাল লাগলো না। নট কিছু না জেনেই বলে উঠল, ‘এখন শাল ফুলের সময় না।’ 

–‘এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না’, বলে গজাল মুখ ফেরাল। 

এবার রুইয়ের বড় দাদা নট-ঘটের কাছে এসে ওদের পিঠে হাত রেখে স্নেহের সুরে বলে উঠলো, ‘বাবারা, দেখ না বাবারা, চেষ্টা করে–’

আর কিছু না বলে নট-ঘট রাজী হয়ে গেল। ওরা ঠিক করল সালের ফল ওরাই নিয়ে আসতে যাবে। তবে একটা দিন পরে যাবে।

পিপুল জঙ্গল অনেক দূরে। বন, লোকালয় পার করে যেতে হয়। সেখানে যেতে মাঝে লোকালয় পড়ে।  সে বন পাঁচমারি শহরের এক প্রান্তে। সেখানে যেতে হবে গভীর রাত হলে। নট-ঘট তা জানে। দিনের বেলা কিছুতেই সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। আর ওদের সবচেয়ে বড় শত্রু হবে গিয়ে মানুষ। এ ছাড়া আছে বনের শিয়াল আর লোকালয়ের কুকুর। কুকুররাও ওদের বড় শত্রু। নট ও ঘট আরও একবার গিয়েছিল পিপুল জঙ্গলে। ঝিলে তখন বড় এক শোল মাছের মরো মরো অবস্থা ছিল। ওরা তখন গিয়েছিল ওষুধ আনতে।  তখন ছিল শিমুলের ছাল নিয়ে আসার কথা। সেই পিপুল বনে যেতে বিশেষ বাধা তাদের পেতে হয়নি। কেবল ওই শহরের পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা বাড়ি থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছিল দুটো কুকুর। কুকুর দুটো কম বয়সের হবে। সব কিছু তখনও তারা বুঝে উঠতে পারে না। ওরা তো নট-ঘটদের অদ্ভুত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কুকুররা ওদের পাথরের টুকরো ভেবেছিল হবে। ‘কাউ কাউ’ শব্দ করে ওরা দূর থেকে লেজ নাড়িয়ে যাচ্ছিল। কুকুর দুটো ভয়ে ভয়ে ওদের দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল। প্রথমে তো খুব ঘেউ ঘেউ করে জোরে তেড়ে এসেছিল। মাঝে মাঝে ‘ঘর ঘর’ আওয়াজ করছিল। মুখ ঘুরিয়ে অদ্ভুত ভাবে নট, ঘটের দিকে তাকিয়ে দেখছিল।

এবার কি করবে ? নাট-ঘট ভাবছিল, দৌড়াবে নাকি ! না কি খোলের মধ্যে  ঢুকবে ? নট বলেছিল, ‘আরে দাঁড়া, ছুটিস না, ছুটলে না কি কুকুররা আরও তেড়ে আসে।‘ 

ঘট বলে উঠেছিল, ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা !’ বলে সে দৌড়ানো শুরু করেছিল। অগত্যা নটও বাধ্য হয়ে দৌড়াচ্ছিল। আর তাতেই ঘটে গিয়ে ছিল বিভ্রাট।  কুকুরগুলি ওদের পেছনে দৌড়ে এলো। মুখ দিয়ে ঘটকে প্রায় ধরে ফেলেছিল আর কি ! ঠিক এমনি সময় নট চীৎকার দিয়ে বলেছিল, ‘তাড়াতাড়ি খোলের মধ্যে ঢুকে চুপচাপ বসে থাক !’ তখন নট-ঘট দুজনেই চুপচাপ খোলের মধ্যে ঢুকে বসে ছিল।  কুকুরা দেখল, এটা আবার কি ?  একেবারে নড়ন-চড়ন নেই ! ঠিক যেন দু খণ্ড পাথর পড়ে আছে। একটা কুকুর সাহস করে একটা পাথর উল্টে দিয়ে দেখল, না, সে দিকটাও পাথর খণ্ড বলেই মনে হচ্ছে ! তবে এ দিকটা বেশী চকচকে বলে মনে হচ্ছে। অনেক ক্ষণ বসে ছিল কুকুরগুলো। শেষে ধৈর্য চ্যুত হয়েই বোধহয় ওরা ধীরে ধীরে ঘরের দিকে চলে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য নট-ঘটকে দু-একবার চিৎ করে, উপুড় করে, দেখে নিয়েছিল।

ব্যাস, ওই বাঁধা ছিল সে দিনের বাধা। তারপর ওরা শিমুল জঙ্গলে গিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে শিমুল ছাল তুলে নিলো। তার দুই চার টুকরো মুখে গুঁজে নিয়ে ওরা এক সাথে ফিরে এসেছিল। ফেরার সময় নট-ঘটদের ভীষণ ভয় ভয় করছিল। যদি ওই কুকুর দুটো আবার এসে হাজির হয় ? না, শেষ পর্যন্ত ওদের কবলে আর পড়তে হয়নি। তবে হ্যাঁ কুকুর দুটোর নাম ওদের জানা হয়ে গিয়েছিল। ওরা তখন শিমুল ছাল নিয়ে ফিরছিল। সেই লোকালয়ের পাশ দিয়ে চলছিল। শেষ রাতেই ওর মালিক হবে বাইরে বেরিয়ে ছিল। বেরিয়ে এসে কুকুরদের ডাক দিয়ে উঠেছিল, ‘এই লালু, এই ভুলু তোরা কোথায় গেলি রে ?’