টুকরো স্মৃতির গল্প-৮

একটি আধুলির গল্প

আমার গ্রামের বাড়ির পাশে চৈত্র মাসের শেষদিন মেলা বসত। মেলায় বাঁশ-বেতের হরেকরকম জিনিসপত্র, বাঁশি, মাটির খেলনা, মিষ্টি-মণ্ডা, তালের পাখা এসব বিক্রি হতো। কৃষ্ণ ও রাধা সেজে ঢোল-পাখোয়াজ ও বাঁশি বাজিয়ে একটি দল নেচে-গেয়ে মেলা মাতিয়ে রাখত। আঞ্চলিক ভাষায় তাদেরকে ‘ভাঙ্গরা’ বলা হতো। কৃষ্ণ ও রাধা যারা সাজতেন, তারা দুজনেই পুরুষ। তখনকার দিনে মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হয়ে নাচ-গান করা সামাজিকভাবে নিষেধ ছিল। সে সময় কঠিন সে অর্গল ভাঙতে পারা অতটা সহজ কাজ ছিল না, এখন যেটা সম্ভব। মাঝে মধ্যে তারা মুঠো মুঠো বাতাস ছড়িয়ে দিতো। এটাকে বলা হতো ‘হরিলুটের বাতাসা’! ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেগুলো কুড়িয়ে খেতো। আমি কখনো এগুলো কুড়াতে যাইনি মায়ের বারণ ছিল বলে।
আমি আট আনা নিয়ে মেলায় রাজার হালে হেলেদুলে হাঁটতাম। ইংলিশ প্যান্টের পকেটে আট আনা রেখে এক হাতে পয়সাটি ধরে ধরে হাঁটতাম, কী জানি যদি হারিয়ে যায়! তবে সত্যি একদিন আট আনা হারিয়ে ফেলেছিলাম! মেলায় যাওয়ার জন্য বাবা আট আনা দিলে জামার বুক পকেটে রেখে আমি আমাদের পিছনের পুকুরে গেলাম হাত-মুখ ধুতে। দুর্ভাগ্য, আমার আট আনা পানিতে পড়ে গেল! হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ পানির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমার আট আনা ফিরে পেতেই হবে যে করে হোক। কিন্তু কীভাবে, পুকুর ভর্তি জোঁক! সামান্য সাঁতার জানি আমি। ভয়কে জয় করে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিলাম। এক ডুবে যেখানে পয়সাটি পড়েছিল সেখান থেকে এক মুঠো কাদামাটি তুলে এনে উঠে পড়লাম, যাতে জোঁক আমাকে ছুঁতে না পারে। না, প্রথমবার আট আনা উঠে আসেনি। এভাবে তৃতীয়বার ডুব দিয়ে কাদামাটি তুলে আনতেই আমার চকচকে আট আনা আমার হাতে চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। আমি যেন বখতিয়ার খিলজি, বঙ্গবিজয় করার আনন্দে উচ্ছ্বসিত আমি!
ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে যে কোনো কাজ করা যায়, তখন থেকেই বুঝেছিলাম। সেই ছেলেবেলা থেকেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজে নেমে পড়তাম। হারতাম না কখনো।
মেলা থেকে একটি বাঁশের বাঁশি ও একটি হার্মোনিয়াম বাঁশি কিনতাম। এ দুটির একটিও বাজাতে পারতাম না আমি। আজও পারি না। আপ্রাণ চেষ্টা করতাম, লাভ হয়নি কোনো। এ দুটি ছাড়াও মাটির তৈরি একটি টিয়া তো কিনতেই হবে আমাকে। ছোটবেলায় আমি শালিক, টিয়া পুষতাম। কখনো কখনো পাখি উড়ে যেত, কখনো আবার বিড়ালে মেরে ফেলত। মৃত পাখিকে কবর দিতাম এবং খুব কাঁদতাম আমি। মেলা থেকে মাটির তৈরি টিয়া পাখি কিনে আসল টিয়া ভেবে সান্ত¦না পেতাম। মায়ের কাছে শিখে নিজের হাতে খাঁচা তৈরি করতাম বাঁশ দিয়ে। আমার বাবার মতো সকল কাজের কাজী আমি। এমন কোনো কাজ নেই আমি পারি না। এগুলো আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি। বাবা ছিলেন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র। কলেজে তাকে ‘মোটা মতি’ বলে চিনতো অনেকেই। কারণ বাবা ছাত্র অবস্থায় স্বাস্থ্যবান ছিলেন খুব। বাবার ডাকনাম ‘মতি’, আমার দাদী এই নামেই ডাকতেন তাকে। আর কাউকে বাবাকে ‘মতি’ নামে ডাকতে শুনিনি। বড় হয়ে বাবার পুরোনো কোর্ট-প্যান্ট দেখে তা বুঝতে পারতাম। শিক্ষিত এবং একজন চাকরিজীবী হয়েও সংসারের সকল কাজ জানতেন তিনি। সুতো দিয়ে জাল বুনানো, মাছ ধরা, পাখি ও সুন্দরবনে গিয়ে হরিণ শিকার করা, খেজুুর গাছ কেটে রস বের করা, গরুর ওলান থেকে দুধ দোয়ানো-কত কী যে জানতেন বাবা! একবার বাবা প্রায় এক বিঘা জমিতে মরিচ ও মুগ ডালের চাষ করেছিলেন। আমি বাবার সঙ্গে মরিচ গাছের চারা রোপণ করেছিলাম। মরিচ পেকে লাল হলে আমরা চাচাতো ভাইবোনরাসহ মরিচ তুলতে যেতাম।
আমাদের খেতে ফলানো ধান ছাড়া বাড়তি ফসল বাবা বিক্রি করতেন না। প্রয়োজনটুকু রেখে বাকিটা অন্যদের দিয়ে দিতেন। সে সময় অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলো বাড়তি ফসল বিক্রি করতে লজ্জাবোধ করত। একবার বন্যার কারণে যথেষ্ট ধান হয়নি। একদিন ঘরে চাল নেই, বাবার হাতেও টাকা নেই। অথচ বাবাকে হাটে যেতে হবে। মা বললেন, ঘরে তো খেতে ফলানো শুকনো মরিচ আছে, সেখানে থেকে কয়েক সের বিক্রি করলেই তো চাল কেনা যাবে। বাবা রাজি হলেন না। মা লুকিয়ে কাজের লোকের হাতে চার/পাঁচ কেজি মরিচ দিলেন বিক্রি করার জন্য। সে বছর মরিচের দামও চড়া। উপায় নেই ভেবে বাবা দেখেও না দেখার ভাণ করলেন। কাজের লোক মরিচ বিক্রি করে টাকা বাবার হাতে দিলে সে টাকা দিয়ে চাল কেনা হয়েছিল।
বাবা কখনো কারো কাছ থেকে ধার নিতেন না। আমি ও আমার অন্যান্য ভাইবোনরা বাবার এই স্বভাবটি পেয়েছি। না খেয়ে থাকলেও দুপয়সা ধার করতে পারি না আমরা।
আমাদের নিজস্ব কাজের লোক ও জমি চাষ করার জন্য লোক থাকার পরেও বাবা নিজে অনেক কাজ করতেন। তবে তিনি নারকেল ও কলা গাছ ছাড়া অন্য কোনো গাছ লাগাতেন না। আমিও বাবার মতো কলাগাছের ড্যাম (চারা) লাগিয়েছি। কলা লুকিয়ে রেখে একা একা খেতাম। কলা আমার খুব প্রিয়, বানরের মতো। বানরের একটি ঘটনা আছে আমার জীবনে। আমার বয়স যখন তিন থেকে চার মাস। মা আমাকে ঘরে শুইয়ে রেখে পুকুর পাড়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন একটি বানর আমাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মা সে দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হলেন, যদি বানর আমাকে নিয়ে চলে যায়! তবে মা বুদ্ধি হারালেন না। তিনি চটজলদি একটি কলা বানরকে দেখিয়ে এক পাশে রাখলেন। বানর আমাকে রেখে কলা নিয়ে চলে গেলো।
মেলা শেষ হওয়ার আগেই কেনাকাটা শেষে সন্ধ্যার আগে বাড়িতে ফিরতে হতো। মেলা থেকে দুটি পথ দিয়ে আমাদের বাড়িতে পৌঁছা যেত। আমাদের বাড়ির পাশের খাল পানিতে টইটুম্বুর থাকলে ও পথ দিয়ে ফেরা হতো না, কারণ খালে কোনো সাঁকো ছিল না। এ কারণে দ্বিগুণ পথ হেঁটে অর্থাৎ প্রায় ৩০ মিনিট অতিরিক্ত হেঁটে বাড়িতে ফিরতে হতো। এই পথে ঘোষদের জমিদার বাড়ি ছিল। বাড়ির সামনে শত বছরের বিশাল একটি বট গাছ। এই গাছটিকেই আমার ভয়, আজও ভয় করি এই গাছটিকে। আমি মনে করতাম এই গাছে ভূতপ্রেত থাকে। বিশাল এই গাছটির নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার গা ছম-ছম করত। কারো হাত না ধরে হাঁটতে পারতাম না। এই গাছটির নিচে হিন্দু দেবদেবীর কিছু মূর্তি দেখেছি আমি। জমিদাররা থাকতে এখানে বেশ বড়ো করে পুজো হতো। জমিদারি প্রথা উঠে গেলে তারা ভারতে চলে যায়। লর্ড কর্নওয়ালিশ এ দেশে গভর্নর হয়ে এসে জমিদার প্রথা চালু করেছিলেন কোম্পানির স্বার্থে। জমিদাররা ছিলেন ইংরেজদের আজ্ঞাবহ। আমার দাদা গ্রামের পঞ্চায়েত ছিলেন, সেটা ইংরেজদের অনুগ্রহেই। আমাদের পূর্বপুরুষ প্রায় পাঁচ প্রজন্ম আগে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলেন। আমাদের এলাকায় জমিদাররা কৃষি জমি বাড়ানোর জন্য দাদার দাদা দুই ভাইকে নিয়ে এসে বলেছিলেন তোমরা যতটা জমি আবাদযোগ্য করতে পারবে, ততটাই তোমাদের। সে সময় এলাকাটি ছিল জঙ্গলে পূর্ণ। জঙ্গলে সাপ ছাড়াও বাঘডাস থাকতো। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রায় ৯ শত বিঘা জমির গাছগাছালি কেটে চাষযোগ্য করছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে দাদা একশত বিঘা জমির মালিক হয়েছিলেন। আমার বাবা তার থেকে ভাগ পেয়েছিলেন দশ বিঘা। পরবর্তীতে আমার দাদীর ভাগ থেকে পেয়েছিলেন দুই বিঘা। আমাদের অঞ্চলে প্রতিটি জমিতে তিনবার ফসল হয়। অর্থাৎ আমাদের জমিগুলো তিনফসলী জমি। ১২ বিঘা জমিতে প্রচুর ফসল হতো আমাদের। স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর আমার বড় ভাই ও বড় দুলাভাইকে রাজাকার ও পাকিস্তানীদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতে টাকার জন্য বেশ কিছু জমি বিক্রি করতে হয়েছিল বাবাকে। এ কারণে আমরা উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্তে নেমে গিয়েছিলাম।
একাত্তরের স্বাধীনতার পর কলকাতা থেকে জমিদার মশাই এসেছিলেন। তারা তাদের পুরোনো বাড়ির বিশাল বটগাছের নিচে এবং আমাদের বাগানের এক কোণে বিশাল একটি পাকুর গাছে নিচে কালিপূজা করেছিলেন। আমরা পুজো শেষে আবার ফিরে গিয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে আইন করে জমিদারি প্রথা বাতিল করা হয়।
মেলা থেকে বাড়িতে এসে সন্ধ্যা হয়ে যেত। কিন্তু বাঁশিতে ফুঁ দিতে পারতাম না। মা বলতেন, রাতে বাঁশি বাজালে ঘরে সাপ আসে। কী আর করা! সারাটা রাত অস্থিরভাবে কাটিয়ে খুব সকালে বাঁশি বাজাতাম, কিছুই হচ্ছে না, তবুও বাজাতাম।
চলবে