ছোট গল্প : ডেডবডি

সেখ আব্দুল মান্নান ।।

লোকে লোকারণ্য খান বাংলো। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান সবাই ভেঙে পড়েছে খান বাংলোতে। যে শুনেছে সে-ই ছুটে এসেছে শেষবারের মতো চোখের দেখা দেখতে খান সাহেবকে। 
   ডাকসাইটে লোক মাজহার খান। শিক্ষা দপ্তরের বড় আমলা ছিলেন । অবসরের পর পড়াশোনার বাইরে ছোটদের এক্সট্রা ক্যারিকুলাম  নিয়েই ছিল তাঁর অবসর যাপন। তাই পাড়ার ছোটদের যেমন তিনি প্রিয় তেমন বড়দেরও শ্রদ্ধার পাত্র তিনি।
আপাদমস্তক ধবধবে কাপড়ে  ঢাকা খান সাহেবের ডেডবডি । একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে পিপি কিট পরা চারজন শববাহী। তারাই এখান থেকে কর্পোরেশনের গাড়িতে  তুলে ডেডবডি সোজা গোবরা কবরস্থানে পৌঁছে দেবে। করোনার সাথে একটানা লড়াইয়ের পর  গতকাল রাতেই হাসপাতালে মারা গেছেন তিনি।
খান সাহেবের নিথর দেহকে ঘিরে একটা নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে গোলাকারে দাঁড়ানো মানুষের ভিড়ে।  হঠাৎ শিশু কন্ঠের চিৎকারে  চুরমার হল নীরবতা। 

: ড্যাডি গাডেনে ওরা কি করচে ? টক করচে না কেন ? গ্যানপা দেকলে কিন্তু খুব বকবে।
কদিন আগে ঘুষঘুষে জ্বরের সাথে খুকখুক কাশি শুরু হতেই তরিঘরি কোভিড টেস্ট করিয়েছিলেন খান সাহেব। আটচল্লিশ ঘন্টার পর রিপোর্ট পজিটিভ আসতেই নিজে এডমিট হয়েছিলেন হাসপাতালে। তার আগে পুত্র মঞ্জুর খান প্যাথলজি সেন্টার থেকে পজিটিভ রিপোর্টাটা পেয়ে স্ত্রী হেনাকে ফোনে জানানো মাত্রই খান সাহেবের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল নিউটনকে। দাদুর কোল থেকে জোর করে টেনে নেওয়ার সময় কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিল ছোট্ট নিউটন।
অবসরের কিছুদিন পর মৃত্যু হয়েছিল খান সাহেবের ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীর । এরপর তাঁর একাকিত্ব জীবনের ভরসা ছিল নিউটন। এক বছর বয়েস থেকেই খান সাহেব মুখে মুখে নিউটনকে শিখিয়েছেন অ আ ক খ পড়া, ছেলে ভুলানো ছড়া। প্রিয় ছড়া শুনতে শুনতেই দাদুর কাঁধে মাথা রেখেই দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ত সে।
খান সাহেব নিউটনকে সুর করে এ বি সি ডি-ও শেখাতেন। এ ফর এ্যাপেল, বি ফর বল, সি ফর ক্যাট, ডি ফর ডগ্…। সঙ্গে হরেক কিসিমের রাইমসও।
নিউটনের আসল নাম নওরোজ। খান সাহেব নাতিকে আদর করে নিউটন নামে ডাকতে শুরু করেছিলে সেদিন থেকে। যেদিন প্রথম তার অবাক করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়েছিলেন।
ছেলে বৌমা ডিউটিতে বেরিয়ে যাবার পর অন্যদিনের মত সেদিন নওরোজকে কোলে বসিয়ে টিভিতে কার্টুন দেখাচ্ছিলেন খান সাহেব। হঠাৎ কার্টুনের একটা পাখিকে আকাশে উড়তে দেখে নওরোজ জিজ্ঞেস করেছিল, দা-আ-ভাই, ও দা-আ-ভাই, দ্যা-আ-কো পাকিটা আ-গাস থেকে পয়ে গেলে ব্যতা পাবে না ?
নওরোজের প্রশ্নে খান সাহেব হাসতে হাসতে বলেছিলেন, না দাদু ভাই, না পাখিটা পড়ে যাবে না। দেখছ না ওর দুটো ডানা রয়েছে। ওই ডানায় ভর করেই তো উড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মাধ্যাকর্ষণ…।
খান সাহেব কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যান। ভাবলেন আইজ্যাক নিউটনের গ্রাভিটেশন অফ্ ল’র থিওড়ি কি ওর কচি মাথায় ঢুকবে? গাছ থেকে পাকা আপেল মাটিতে না পড়ে উপরে উঠে যায় না কেন, এই প্রশ্নও একদিন ভাবিয়ে তুলেছিল নিউটনকে। তারপর সেটা নিয়ে গবেষণা করেই সায়েন্টিস্ট আইজ্যাক নিউটনে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং কার্টুনের উড়ন্ত পাখিকে নিয়ে দাদুভাইয়ের প্রশ্নটাও ফ্যালনা নয়। নিশ্চয়ই এ ছেলেও প্রতিভাবান, নইলে অমন প্রশ্ন করবে কেন? এখন থেকে প্রপার গাইড করলে হয়ত দাদুভাইও একদিন বড় কিছু হয়ে উঠবে ! আজ থেকে দাদুভাই আমার মাস্টার নিউটন।
টিভির স্ক্রিনে অপলকে চেয়ে নওরোজকে নিয়ে কথাগুলো ভাবছেন। এমন সময় খান সাহেব চমকে উঠলেন নওরোজের কথায়।
: তাইলে আমারও দুতো ডা-আ-না লাগ্গে দা-আ-ও-না দা ভাই, উ-উ-ড়ে যা-আ-বো আ-গা-সে।
সন্ধ্যায় ছেলে বৌমা ডিউটি থেকে ফিরতেই খান সাহেব আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঘটনাটা শুনিয়েছিলেন তাদের।
: জানো বৌমা দাদু ভাই আজ এক কান্ড করছে?
: নিশ্চয়ই দুপূরে আপনাকে ঘুমোতে দেয়নি ?
: আরে না না তা নয়, দাদুভাই আমার লক্ষ্মীসোনা। কোনো দুষ্টুমি করে না। আসলে কান্ডটা ঘটিয়েছে সকালেই। তোমার বেরিয়ে যাবার পর কার্টুন দেখতে দেখতে।
: তার মানে টিভির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ?
: বললাম তো বৌমা দাদুভাই তেমন কোনো দুষ্টুমিই করে না।
: তাহলে!
: তবে শোনো। আরে ওর আব্বু মানে আমার ছেলেটা কোথায়, ডাকো ওকে, শুনুক তার পুঁচকে ছেলের কান্ড।
খান সাহেবের মুখে বৃত্তান্ত শুনে বৌমা হেনা হাসতে হাসতে বলেছিল, জানেন আব্বা আজকেই আপনার নাতির একটা অনলাইন ক্লাসের খবর পেলাম। আমরা দুজনেই খুব চিন্তায় ছিলাম ওর পড়াশোনা শুরু করা নিয়ে। ভেবেছিলাম ছেলেটা বছর দুই হলেই একটা ভালো কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। কিন্তু করোনা সে আশায় ছাই ফেলেছে । দুবছর হতে চলল তার কমার কোনো লক্ষণই নেই। যাকগে শুনুন ওই অনলাইন ক্লাসে আপনার নাতিকে এ্যাডমিশন করিয়ে দেব। ওরা ডেমনস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন ক্লাসের ভিডিও পাঠাবে। আমরা সেগুলো ল্যাপটপে ওকে দেখাব, শোনাব, প্র্যাকটিসও করাব। তাই বলছিলাম কি আব্বা, আপনি আজ থেকেই আপনার নাতিকে শুধু ইংরেজিতেই কথা বলা শেখাবেন। এতদিন বাংলা যা শিখিয়েছেন শিখিয়েছেন।
বৌমার কথায় অবাক হয়ে খান সাহেব। মনে মনে ভাবেন, সায়েন্স নিয়ে পড়তে গেলে ইংরেজিটা ভালো জানা দরকার ঠিকই। তাই বলে ছোট থেকে মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে ?
নিউটনের পড়াশোনা নিয়ে খান সাহেব বেশ কিছুক্ষণ ভাবছেন । চমকে ওঠেন বৌমার কথায়।
: আচ্ছা আব্বা, আপনার নিউটনের পড়াশোনা নিয়ে আমি এতো কথা বললাম আর আপনি চুপচাপ ?
: ও হ্যাঁ, বৌমা তোমরা যে তোমাদের ছেলেকে অনলাইন ক্লাসে এ্যাডমিশন করাবে বলছ তার নাম কি ? খরচপাতিই কেমন ?
: ক্লাসটার নাম ‘ফ্লিন্টো ক্লাস’। একটা ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা চালায় । একটা সেশনের জন্য খরচ প্রায় হাজার পঁচিশেক। দুবছরে পঞ্চাশ হাজারের মতো খরচ পড়বে।
: বলো কি বৌমা, পঞ্চাশ হাজার! জানো, আমায় এম পাস করাতেও তোমার দাদাশ্বশুরের যে ওই টাকাও লাগেনি। আর আমার নাতির পড়াশোনার শুরুতেই…!
: আপনি টাকা নিয়ে অহেতুক ভাববেন না । দুজনে চাকরি করছি। মাস গেলে বেতনও কম পাই না। তাই শুরু থেকে পড়াশোনা ঠিকঠাক হওয়াটাই বড় কথা। আপনি বাংলার বদলে ইংরেজিতে জোর দেয়া শুরু করুন।
বাগানে শোয়ানো দুধসাদা কাপড় ঢাকা খান সাহেবের লাশের দিকে অপলকে চেয়ে কথাগুলো ভাবছে হেনা । পাশেই ছেলেকে কোলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অধ্যাপক মঞ্জুর খান। চমকে ওঠে নিউটনের কথায়।
: ড্যাডি তুমি ওদের বকচ না কেন ? ওরা কি করচে উকেনে? মম্ তুমি বলো না, ওরা কেন এয়েচে?
নিউটনের প্রশ্নের কোনো জবাব নেই আব্বা মঞ্জুর খান আর মা হেনার মুখে। রেলিং ঘেরা বারান্দায় দুজনেই যেন বোবা।
: ড্যাডি এট্টু ওপরে ওটাওনা, ম্যানগোলোর মদ্দে দেখব কি আচে । হ্যাঁ ড্যাডি, দেকতে পাচ্ছি, দেকতে পাচ্ছি। উইযে উইযে উকেনে একটা হোয়াইট মতন কি রয়েচে!
: আহ্, ডোন্ট টক্। চুপ একদম চুপ।
নিউটনের প্রশ্নে নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে ঝেঝিয়ে ওঠে মঞ্জুর খান। পাপার বকুনিতে কেঁদে ওঠে নিউটন।
হেনা মঞ্জুর খানের কোল থেকে ছেলেকে নিজের কোলে নিয়ে আড়ষ্ট গলায় বললে, এসো আমি তোমাকে বলছি। জানো পাপার মনটা খুব খারাপ। তাই তোমাকে বকেছে। ওই যে হোয়াইট কাপড়ে ঢাকা লম্বা জিনিসটা দেকছ, ওটা তোমার গ্র্যান্ডপার ডেডবডি।
: ডেডবডি কী মম্ ?
ছোট্ট নিউটন এ পর্যন্ত অনেক ইংরেজি শব্দ শিখলেও ডেডবডি শেখেনি। অবশ্য ওই কষ্টকর শব্দ শেখার কোনো প্রয়োজন হয়নি ।
ছেলের কথায় হেনা হাউমাউ কাঁদতে কাঁদতে বললে, বাবু তোমার গ্র্যান্ডপা আর তোমার কাছে আসবে না। তোমার গ্র্যান্ডপা আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।
: কিনতু ড্যাডি বলেচে গ্যানপা মুন্নি আন্টির উকেনে বেড়াতে গ্যাচে! নো নো আমি গ্যানপার কাচে যাবো, গ্যানপা।
এবার অবুঝ নিউটনকে বুকে জড়িয়ে ধরে মঞ্জুর খান ফুঁপিয়ে বললে, সরি বাবু সরি, আমি এমনই হতভাগ্য যে শেষবারের মতো আমার পাপার কাছে যেতে পারছি না। তোমাকেও তোমার গ্র্যান্ডপার কাছে…! আমায় ক্ষমা কর বাবু, ক্ষমা কর।

সেখ আব্দুল মান্নান/কলকাতা থেকে

ছবি : গুগল