ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথ/ সুপ্রিয়া বিশ্বাস


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্ম বা মৃত্যু দিবস যখন বিভিন্ন জায়গায় শ্রদ্ধাভরে পালিত হয় সেই সময় একদল নিন্দুক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা কুৎসা রটাতে ব্যস্ত থাকেন। এই দলে যখন শিক্ষিত মানুষ দেখি তখন বেশি খারাপ লাগে।বর্তমানে যে পোষ্টটা বার বার চোখে পড়ছে সেটা রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা। আসলে ঘটনাটা কি জেনে নেওয়া যাক। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা। তিনি লিখেছেন-
কলকাতার যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি নিজেও বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সে কারণে অনেকেই মনে করতেন, রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও বিরোধী ছিলেন। জানা যায়, তখনকার কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজসহ একটি বড় জনগোষ্ঠী ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে ১০-১২টি প্রতিবাদ সভাও করেছিল। এর একটি ছিল কলকাতার গড়ের মাঠের প্রতিবাদ সভা। ওই সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে। ইতিহাসের স্বার্থেই এ কথার সত্যতা যাচাই হওয়া দরকার। কারও কারও মধ্যে একটি ধারণা আছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কলকাতার ওই প্রভাবশালী মহলের একজন, যাঁরা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং বইয়ে যা পাওয়া যায়, তা থেকেই আমাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে।
১৯১২ সালে সেই গড়ের মাঠের প্রতিবাদ সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের কেউই আজ আর বেঁচে নেই। ফলে ওই সভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন কি না বা সভাপতিত্ব করেছিলেন কি না, এ তথ্য জানতে হলে ইতিহাসের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তা ভালোভাবে নিতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে তাঁদের খুশি করার জন্যই ১৯১২ সালের ২১ জানুয়ারি তদানীন্তন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ একটি মুসলিম প্রতিনিধিদলের কাছে অচিরেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বছরের সময়কার বা তার অব্যবহিত কিছু আগের কোনো মানুষই এখন আর বেঁচে নেই। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বিভিন্নজন ভিন্ন ভিন্ন কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। পশ্চিম বাংলা ও বিহার অঞ্চলের কিছু মুসলমানও বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল ভিন্নতর। তাঁদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়টি তাঁদের বা তাঁদের সন্তান-সন্তুতিদের কোনো কাজে আসবে না। যদি কোনো উপকার হয়, সেটা হবে পূর্ব বাংলার মানুষেরই। যে মুসলিম জনগোষ্ঠী এ রকম চিন্তা করত, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মাওলানা আকরম খাঁ, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মৌলভি আবুল কাশেম, মৌলভি লিয়াকত হোসেন প্রমুখ। তদানীন্তন পূর্ব বাংলারও বেশ কিছু মুসলমানের মধ্যে এমন ধারণা ছিল যে, পূর্ব বাংলায় যথেষ্ট পরিমাণ ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাস ছাত্র নেই, যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে ওই টাকা দিয়ে পূর্ব বাংলায় আরও কিছু স্কুল ও কলেজ স্থাপন করলে এই অঞ্চলের মুসলিম ছেলেমেয়েদের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার সুযোগের পরিধিটা বাড়বে। তাঁরা আরও ভাবতেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য যে বাজেট সরকার থেকে আসে, তা অনেকাংশেই কমে যাবে। তবে নিঃসন্দেহে কলকাতার হিন্দু সমাজের কিছু লোক ছাড়া প্রায় সবাই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন।
১৯১২ সালের ২৮ মার্চ তারিখটি ১৩১৮ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের সঙ্গে মিলে যায়। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ ছিল ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ১৪ বা ১৫ চৈত্র। তবে ইতিহাস বলছে, রবীন্দ্রনাথ ওই সময় ছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের শিলাইদহে। শিলাইদহ থেকে তিনি কলকাতায় ফিরেছিলেন ১২ এপ্রিল ১৯১২। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব কবিতা, পত্র ও প্রবন্ধের নিচে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ করতেন। ওই সময় শিলাইদহে অবস্থানকালে তিনি ১৭-১৮টি কবিতা ও গান লেখেন। দেখা যায়, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’ গানটি তিনি রচনা করেন শিলাইদহে; তারিখ ১৪ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুযায়ী যা হয় ১৯১২ সালের ২৭ মার্চ। আরও একটি গান ‘এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী’—এটিও শিলাইদহে বসেই কবি লিখেছিলেন ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ২৬ চৈত্র, ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুযায়ী যা ১৯১২ সালের ৭ বা ৮ এপ্রিল। (সঞ্চয়িতা, অষ্টম মুদ্রণ, প্রতীক প্রকাশন সংস্থা, পৃষ্ঠা ৩৩১)।
ওপরের তথ্যাবলি বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ যেহেতু শিলাইদহে ছিলেন, তাই কলকাতার গড়ের মাঠের সভায় তাঁর উপস্থিত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কবি এসেছিলেন শিলাইদহে একটু বিশ্রাম নিতে।
ঢাকায় রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা : পতিসরে আর সি মজুমদারকে কবির দেওয়া একটি চিঠি সংরক্ষিত আছে। চিঠিটির তারিখ ১৬ মাঘ, বঙ্গাব্দ ১৩৩২। এটি ইংরেজি ৩০ বা ৩১ জানুয়ারি ১৯২৬-এর সঙ্গে মিলে যায়। রবি ঠাকুরের সেই চিঠিটি এখানে অবিকল তুলে ধরা হলো:


‘ওঁ
কল্যাণীয়েষু,
ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ৬ই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাঁদের আতিথ্য ভোগ করে কর্ত্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনোমতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে। তাই দুই নিমন্ত্রণ ক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল। ইতি ১৬ মাঘ ১৩৩২।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’


লক্ষণীয় যে, আর সি মজুমদারকে পাঠানো চিঠির এক জায়গায় কবি উল্লেখ করেছেন, ‘ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্য দূত এসেছিলেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনোমতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে।’ চিঠির এই অংশের পূর্বে তিনি লিখেছেন, ‘১০ তারিখ পর্যন্ত তাঁদের (ঢাকার লোকের) আতিথ্য ভোগ করে কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব।’ এই পত্র থেকেই জানা যায়, কবিকে ঢাকার সাধারণ মানুষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। তখনকার সময় ঢাকাকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা ছিল ঢাকার নবাবদের। দূত পাঠানোও তাঁদের দ্বারাই সম্ভব ছিল। কোনো রাজনৈতিক নেতা বা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ হলে সেটা কবি তাঁর চিঠিতে অবশ্যই উল্লেখ করতেন। তবে রাজনৈতিকভাবেও তখন ঢাকার নবাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। ঢাকায় আগমন, মিউনিসিপ্যালিটির গণসংবর্ধনা, নবাববাড়িতে তাঁর নিমন্ত্রণ ও তাঁদের বোটে রাত্রিযাপন—এসবই প্রমাণ করে, ঢাকার মানুষ ও নবাবেরা নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যথাযথ সম্মান দিয়েই বরণ করেছিলেন।
১৯২৬ সালে ঢাকায় কবিকে যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সংবর্ধনা দিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, মুসলিম হল ছাত্র সংসদ, জগন্নাথ হল, জগন্নাথ কলেজ, হিন্দু মুসলিম সেবা সংঘ, ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিসহ অনেক সংগঠন।
রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন, এ কথা যদি সত্যি হতো, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এতগুলো সংগঠন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এবং গড়ের মাঠের কথিত সভার ১৪ বছরের মাথায় এত বিপুলাকার সংবর্ধনা দিত না। রবীন্দ্রনাথ কার্জন হলে ১০ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি সমসাময়িক সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ঢাকার সুধী সমাজ তা বহুদিন স্মরণে রেখেছে। এখনো সেই বক্তৃতার অনেক কথাই বেশ প্রাসঙ্গিক। সর্বোপরি ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখ কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডক্টর অব লিটারেচার বা ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কিন্তু কবি ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিময় পতিসরে তাঁকে দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-লিট উপাধি প্রদানের সনদের যে প্রতিলিপি আছে, তার নিচে সনদ প্রদানকারী হিসেবে উপাচার্য স্যার এ এফ রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। বলা দরকার, রবীন্দ্রনাথকে ডি-লিট উপাধি দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্যার এ এফ রহমানের একক সিদ্ধান্ত ছিল না, এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের। আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, ১৯৩৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় যাঁদের সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে, তাঁদের মধ্যে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ছিলেন নোবেলজয়ী।
এই সব তথ্য-উপাত্তের আলোকে এটা প্রমাণিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা তো করেনইনি, বরং এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর বন্ধন ছিল আমৃত্যু অটুট!।
ডা. বিশ্বজিৎ ঘোষ : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-তিনি লিখেছেন,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ তৃতীয় বক্তৃতাটি দেন মুসলিম হলে (বর্তমানে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল)। মুসলিম হলের শিক্ষার্থী এবং সমবেত সুধীমন্ডলীর উদ্দেশে ১০ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে সমাজবিষয়ক বক্তৃতা উপস্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ। উল্লেখ্য, মুসলিম হলের বক্তৃতা রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেন বাংলা ভাষায়। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ ভুলে মিলনের আকাক্ষা রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেছেন তার বক্তৃতায়।
ভারতবর্ষের দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায়ের মিলনের আহ্বান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন : ‘ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাগ ও পরস্পরের বিচ্ছেদ দেখে নিতান্ত দুঃখিত, মর্মাহত, লজ্জিত হই। ধর্মে ধর্মে বিরোধ হতে পারে না। কারণ ধর্ম হলো মিলনের সেতু আর অধর্ম বিরোধের। আমাদের অপরাধ স্বীকার করতে হবে, আমরা ধর্মের অবমাননা করেছি বিরোধ করে। পরস্পরের বিরোধে বিরোধে আমাদের মনুষ্যত্ব অপমানিত হচ্ছে, তা দেখে আমি অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছি; বিশেষ করে আমার হিন্দু সমাজের জন্য।… যখন ধর্মে বিকার উপস্থিত হয়, তখনই বিচ্ছেদ প্রবল হয়ে ওঠে। শুধু হিন্দু-মুসলমানে প্রভেদ নয়, সমাজের মধ্যে ভেদের অন্ত নেই।… আমি আমার সমাজের জন্য লজ্জিত হয়েছি; লজ্জার কারণ মুসলমানের মধ্যেও ঘটে। এ ক্ষেত্রে যদি পরস্পর প্রীতি না করি, তা হলে বিধাতা যে দায়িত্ব আমাদের ওপর দিয়েছেন তার কত বড় অপমান করা হয়।’
মুসলিম হলের রবীন্দ্রনাথের সত্যভাষণ শুনে শিক্ষার্থীরা খুবই উদ্বুদ্ধ হয়। মুহুর্মুহু হাততালি দিয়ে তারা রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দিত করে। অভিভাষণের উপসংহারে কবি বলেন : ‘ঈশ্বর এক; তাঁর মধ্যে কোনো ভেদ নাই। যিনি সকল বর্ণের, সকল জাতির জন্য নিত্য, তাঁর গভীর প্রয়োজন প্রকাশ করেছেন। তিনি আমাদের সকলের চিত্ত যুক্ত করুন; বাহিরের শক্তি দ্বারা নয়, শুভবুদ্ধি দ্বারা।’
কার্জন হলে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের ভাষণদ্বয় ছিল উচ্চমার্গীয়। ওই ভাষণদ্বয়ে শিল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। মুসলিম হলের ভাষণে প্রকাশ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সমন্বয়বাদী অসাম্প্রদায়িক সমাজচেতনা। রবীন্দ্রনাথের এই তিনটি ভাষণ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা তেমন চোখে পড়ে না। এ বিষয়ে বিশদ গবেষণার অবকাশ আছে।
তাই একজন গুনীকে নিয়ে সমালোচনার সময় তথ্য উপাত্ত জেনে করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ যারা চর্চা করেন তারা জানেন এক বিশাল বিস্ময়কর প্রতিভার নাম রবীন্দ্রনাথ ।এক জীবনে এত লেখা শুধু প্রতিভা থাকলেই হয়না , সাধনারও প্রয়োজন।কতটা নিজেকে সাহিত্যের প্রতি উৎসর্গ করলে এতটা সাধনা করা যায় তা ভেবে আমি বিস্মিত হই।শুধু শুধু হিংসার বশবর্তী হয়ে এ ধরনের সমালোচনা সত্যিই নিন্দনীয়।


তথ্যসূত্র;বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা।)(ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)