দি টাইগার অব সুন্দরবন মহারাজা প্রতাপাদিত্য

হাবিব ইবনে মোস্তফা

মহরাজা প্রতাপাদিত্য বাংলার বার ভূইয়াদের অন্যতম ছিলেন। মোঘল যুগে প্রতাবাদিত্য উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের অন্যতম বিষ্ময়। মোগল আমলের যশোরের ইতিহাসে তিনিই প্রধান ব্যক্তিত্ব। মোঘল যুগে যশোর ইতিহাস বলিতে প্রতিপদিত্যের ইতিহাস বলিলেও অতুক্তি হইবে না। মহারাজ প্রতাপাদিত্য দক্ষিণ বঙ্গের সহিত এমনভাবে গ্রথিত যে, তার জীবননাতিহাসকে বঙ্গদেশের ইতিহাস থেকে পৃথক করা যায় না। বাংলার ভুইয়াগনের মধ্যে তিনি বীরত্বে ও রাজশক্তি পরিচালনায় সর্ব্বাগ্রাগণ্য। প্রতাপদিত্য যশোরকে প্রতাপময় করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর রাজা প্রতাপাদিত্যকে তাহার “অন্যদা মঙ্গল” কার্য্যে অমর করিয়া রাখিয়াছেন। মহারাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে জানিতে হইলে বার ভূঁইয়াদের উদ্দেশ্য এবং যশোরদ্য দেশের উৎপত্তির ইতিহাস জানা আবশ্যক।

মহারাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে জানিতে হলে আমাদিগকে ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে হবে।মহামতি বাবর কর্তৃক ১৫২৬ সালে দিল্লীর সম্রাট ইব্রাহীম লোদী পানি পথের যুদ্ধে নিহত হবার পর ভারত উপমহাদেশে মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় আফগান , তূর্কী ও পাঠান শক্তি হীনবল হয়ে পড়ে। এতদসত্বেও বাংলা, বিহার উড়িষ্যা ও আসামে মোঘল বিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে দায়ুদের পতনে বঙ্গ দেশে বহু জমিদার ও ভূস্বামী প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে ওঠে। ইহাদের অধিকাংশই পাঠান এবং হিন্দু। যে সমস্ত জমিদার ও সামন্তরাজ মোঘল কতৃত্ব অস্বীকার করে । স্বাধীন ভাবে চলিতে চেষ্টা করেন তাহারাই বার ভূইয়া হিসেবে পরিচিত হইতেন। ভুঞা শব্দের অর্থ ভূইমালি, ভৌমিক, ভূম্যঠিকারী, রাজা বা জমিদার। প্রভাবশালী রাজা, জমিদার বা স্থানীয় শাসক ভুঞা উপাধি গ্রহণ করিতেন। একটি খন্ড রাজ্য বা এক বা একাধিক পরগনার জমিদারীর মালিকেরা ভুঞা উপাধি গ্রহণ করিতেন। ভূঞারাগণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মোঘলের বিপক্ষচারণ করা। ভূঞাগণ বঙ্গদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আক্রমণকারী মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। মহারাজা প্রতাপাদিত্য ছিলেন এই বার ভূইয়াদের অন্যতম।

মহারাজা প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্য এবং পিতৃব্য বসন্তরায় যশোর রাজ্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা। প্রতাপের কিভাবে যশোর রাজ্যের রাজা হলেন সে সম্পর্কে আলোকপাত করা আবশ্যক। প্রতাপের পূর্বপুরুষ আদিশুরের সময় আগত পঞ্চকায়স্থের একজন ছিলেন। বিরাট গূহের অধস্তন নবম পর্যায়স্থ অশ্বপতি বা আশগুহ ছিলেন ষোড়শ শতকের শেষভাগে একজন শ্রেষ্ঠ রায় বঙ্গজ কায়স্থগণের ‘বাকলা সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করলে আশগূহ শ্রেষ্ঠ কুলীন বলে স্বীকৃত হন। আশগূহের প্রপৌত্র উদ্যমশীল ও কষ্টসহিষ্ণু রামচন্দ্র সুশিক্ষিত হলেও অর্থাভাব জনিত কারনে অর্থান্বেষণে বাকলা ছেড়ে সপ্তগ্রামে গমন করেন। সপ্তগ্রাম তখন গৌড়ের অধীন প্রসিদ্ধ শাসন কেন্দ্র। সপ্তগ্রামে পৌছে নিকটবর্তী পাটমহলে শ্রীকান্ত ঘোষ মহাশয়ের বাটীতে আশ্রয় নেন। শ্রীকান্ত ঘোষও বঙ্গজ কুলীন কায়স্থ। তিনি রামচন্দ্রের রুপে, গুণে মুগ্ধ হয়ে তাহাকে কণ্যা সম্প্রদান করেন। শ্রীকান্ত ঘোষ একজন রাজ কর্মচারী ছিলেন। তার সাহায্য রামচন্দ্রও রাজ সরকারে চাকরী পান। কিছুদিন পর তার প্রথম স্ত্রী ষষ্ঠীবর বসুর কণ্যার গর্ভজাত তিন সন্তান ভবানন্দ, গুণানন্দ ও শিবানন্দ সংস্কৃত ও পারসিক ভাষায় কৃতবিদ্য হয়ে সপ্তগ্রামে রাজসরকারে চাকরী গ্রহণ করেন। তিনজনের মধ্যে শিবানন্দ সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। ক্রমে তিনজনের বিয়ে হল। ভবানন্দের পুত্রের নাম শ্রহরি এবং গুণনন্দের পুত্রের নাম জানকী বল্লভ। শ্রহরি ও জানকী বল্লভ প্রায় সমবয়সী।

উভয়ের মধ্যে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। শিবানন্দ ও তাহার পুত্রগনের সহিত তাহার ভ্রাতা ওভ্রাতুষ্পুত্রগনের মধ্যে সদ্ভাব বিদ্যমান ছিল। রাজকার্যে উচ্চপদস্থ ছিলেন বলে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। একদিন সপ্তগ্রামের শাসনকর্তার সহিত শিবানন্দের মতান্তর উপস্থিত হলে রামচন্দ্রকেও অপদস্থ হতে হয়। তাই রাঁমচন্দ্র আত্মরক্ষার জন্য ৬৫ বৎসর বয়সেও ভাগ্যান্বেষণে কেবলমাত্র ভবানন্দকে সাথে নিয়ে গৌড়ে যাত্রা করেন। বৃদ্ধ রামচন্দ্র ও তৎপুত্র শিবানন্দের কার্যের খ্যাতি পূর্বেই রাজধানীতে পৌছেছিল। গৌড়াঠিপতি মুহাম্মদ শাহ পুরাতন কর্মক্ষম ব্যাক্তিকে ছঅড়লেন না। ক্রমে রামচন্দ্রের পুত্রেরা রাজ সরকারে প্রবেশ করেন। কিছুদিনের মধ্যে রামচন্দ্র পরলোক গমন করেন। রামচন্দ্র যশোর রাজবংশের আদি পুরুষ।
তৎকালীন রাজনীতির আবর্ত থেকে কিভাবে যশোর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেদিক দৃষ্টি নিবন্ধ আবশ্যক। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে ১৫৩৮-৩৯ খৃষ্টাব্দে বাবর পুত্র হুমায়ন গৌড় নগর অধিকার করে ‘জন্নতাবাদ’ নামকরণ করেন। সেখানে তিন মাস অবস্থানের পর হুমায়ন আগ্রার দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ছাপরঘাট নামক স্থানে হুমায়ন শেরশাহের হস্তে পরাজয় করণ করেন। শেরশাহ মগধ ও গৌড় রাজ্য পুনরায় অধিকার করেন। ১৫৫২ খৃষ্টাব্দে শেরশাহের মৃত্যুর পর তার শাসনকর্তা মুহাম্মদ খাঁ সুর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৫৫৫ খৃষ্টাব্দে ছাপরামৌ এর যুদ্ধে তিনি হিমু কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হলে তার পুত্র গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ্ গৌড়ের সুলতান হন। এ কিছুকাল পরে মগধের সুলতান সুলেমান কররানী গৌড়ের অধিকারী হন। এই সুলেমান কররানীর দরবারে ভবনন্দ প্রমুখ তিন ভ্রাতাই কৃপা লাভ উচ্চপদ লাভ করেছিলেন। সুলতান সুলেমান কররানী ভবানন্দকে মন্ত্রী এবং শিবানন্দকে কানুনগো নিযুক্ত করেন। সুলেমান কররানীর দুই পুত্র বায়েজিদ ও দায়ুদের সাথে শিবানন্দের দুই ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীহরি ও জানকীবল্লভের অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। যা যশোর রাজ্য স্থাপনের ব্যাপারে বিরাট অবদান রাখে। তারা সবাই সমবয়স্ক ও সহপাঠী ক্রীড়াসঙ্গী ছিলেন। তাদের প্রতি সুলেমান কররানীর স্নেহ এত অধিক ছিল যে, তিনি স্বীয় পুত্রের সহিত একই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে মানুষ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেন।

সুলতান সুলেমান কররানীর মৃত্যুর পর গৌড়ে অশান্তি দেখা দেয়। সুলেমান কররানীর জৈষ্ঠপুত্র বায়েজিদ সিংহাসনে আরোহণ করবার পর তার জ্ঞাতি ভাই হাসু কর্তৃক নিহত হন। সোলেমানের কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ বিচক্ষণ সেনাপতি লোদি খাঁর সাহায্যে হাসুকে হত্যা করে গৌড়ের সুলতান হন। রাজ্য প্রাপ্তির পর দাউদ অপরিমিত ধনরত্নের অধিকারী হন। পিতৃ-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে দাউদ সহপাঠী শ্রীহরি ও জানকীবল্লভকে যথাক্রমে রাজা বিক্রমাদিত্য এবং রাজা বসন্ত রায় উপাধি দান করে দরবারে আমাত্য পদে বরণ করে নেন। রাজা বিক্রমাদিত্য প্রধানমন্ত্রী এবং রাজা বসন্ত রায় খলিষা বিভাগের কর্তা এবং কোষাধ্যাক্ষ ছিলেন।
দাউদখান কররাণী দুঃসাহসী বীবর ছিলেন। তিনি আরবী ও হিন্দি ভাষায় নিজ নামে মুদ্রা বের করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব আরম্ভ করেন। মোগলদিগকে দেশ থেকে বিতাড়ন করাই তাহার প্রধান উদ্দেশ্য হইল। তিনি বহু সৈন্যাদি সংগ্রহ করে সম্রাট আকবরের রাজ্য আক্রমণ করেন। এই উদ্যত পাঠানকে শায়েস্তা করার জন্য সম্রাট আকবর নিজেই বাংলার দিকে অগ্রসর হন। ১৫৭৪ খৃষ্টাব্দে শোন নদের মোহনায় মোঘল সেনাপতি মোনেম খাঁর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাটনা দুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

এসময় দুরদর্শী ভবানন্দ মোঘলের বিক্রম এবং আকবরের রাষ্ট্রজয়ের সংবাদ জানিতেন। বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ভবানন্দ গুহ দুর্যোগের ঘনঘটা অনেক আগেই আচ করতে পেরেছিলেন। আপন পুত্র শ্রীহরি বিক্রমাদিত্যের সাহায্য মৃত নিঃসন্তান চাঁদ খাঁ মছন্দরীর যমুনার পুর্বপারের বেওয়ারিশ যায়গীর নিজেদের অনুকূলে ব্যবস্থা করে নেন। পরিবারের সকলের আলাপ আলোচনার পর জানকী বল্লভ বসন্তরায়কে দক্ষিণ সমুদ্রের কাছে দক্ষিণ দেশে যশোহর নামক স্থানে চাঁদ খাঁর জায়গীরে পাঠানো হয়। অল্প দিনের মধ্যে বসন্ত রায় জঙ্গল পরিস্কার করে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলেন। শ্রীহরি, জানকী বল্লভ ও শীবানন্দ গৌড়ে থাকিয়া গেলেন। পরিবার বর্গের অন্যরা সকলে যশোরে চলিয়া গেলেন। এভাবে যশোর রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
মহাপরাক্রমশালী মোঘল বাহিনীর হস্তে পাটলা দুর্গ পতনের পর দায়ুদের আমীর ওমরাহ গণ আত্মসমর্পন করাই শ্রেয় মনে করলেন। দায়ুদ শেষ পর্যন্ত লড়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে আমীর ওমরাহ গণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কতলু খাঁ দায়ুদকে কৌশলে মাদক দ্রব্য সেবনের মাধ্যমে অজ্ঞান করে নৌকাযোগে পলায়ন করেন। বিক্রমাদিত্য তার ধন সম্পত্তি নৌকা বোঝাই করে গোপনে সরে পড়েন। গৌড়ের এই অরাজকতার যুগে বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় সুলতানের অপরিমিত ধনরতœ যশোহরে প্রেরণ করেন। এই সম্পদ চিরকালের জন্য তাদের হাতে থেকে যায়। দায়ুদ আকমহলের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। এভাবে একটি দরিদ্র চাকুরিজীবি পরিবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন এবং বিপুল ধন রতেœর অধিকারী হবার সুযোগ প্রাপ্ত হন।

সুলতান দায়ুদ খাঁর সিংহাসন প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র বিপ্লবের সময় তাহারা বণিকের ছদ্মবেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেন; কোথায়ও স্থায়ীভাবে বসবাসের সাহস পান নাই। ইতিমধ্যে গৌড়ের ধনরত্ন বোঝাই অসংখ্য নৌকা যশোহর পৌছিল। ক্রমে ক্রমে কানন বেষ্টিত যশোহরের খ্যাতি প্রচার লাভ করিল। চাঁদ খাঁর জায়গীরে বসন্ত রায় সেখানে জঙ্গল পরিস্কার করেছিলেন সেই জায়গার নাম বসন্তপুর। সম্ভবতঃ এই সময় মুকুন্দপুরে গড়বেষ্টিত রাজধানী স্থাপিত হয়। মুকুন্দপুর এখনও গড়ের চিহ্ন বিদ্যমান।
নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যের নামকরণ হল যশোর। প্রবাদ গৌড়ের যশ হরণ করে এই শহরের শ্রীবৃদ্ধি হওয়ায় স্থানীয় পুরাতন নাম যশোর পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নামকরণ হয় যশোহর। যশোর শব্দ যশোহর শব্দের অপভ্রংশ। যশোহর শব্দের অর্থ পরের যশ হরণকারী অধিক যশস্বী ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে যশোর আরবী শব্দ জসর শব্দের অর্থ সাকো। নদীনালা বিধৌত যশোরাঞ্চলে ‘সাকোর’ আধিক্যের জন্য এরুপ নাম হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। ইংরেজ শাসকগণও এই নাম ঔবংংড়ৎব ব্যবহার করিয়াছেন। আবার সুন্দরবনের আরেক স্থানের নামও যশোর। প্রাচীন যশোর আধুনা যশোর হতে ৮০ মাইল দুরে খুলনা জেলা শ্যামনগর থানার মধ্যে। আমাদের আলোচ্য বিষয় প্রতাপাদিত্যের সহিত সম্পর্কিত যশোর। যশো রাজ্যের রাজধানী ঈশ্বরীপুর সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র গ্রামের নাম যশোর। রাজধানী ঈশ্বরীপুর সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্রগামের নাম যশোর। রাজধানী ঈশরীপুরের নাম যশোর থেকে উদ্ভুদ। যশোর শব্দ মুর্তির সাথে যুক্ত হয়ে হয় যশোরেশ্বরী। এই যশোরেশ্বরী হইতে স্থানের নাম হয় যশোরেশ্বরীপুর। পরবর্তীকালে শব্দের প্রথমাংসের যশ বাদ দিয়ে রাজধানীর নাম হয় ঈশ্বরীপুর। বর্তমানে এই যশোরকে বলতে বুঝায় ঈশ্বরীপুর।

যাহা হউক, দায়ুদের পতনের পর মোঘলেরা গৌড়ের ধন সম্পদ ও হিসাব পত্রের তালাশ করে। মোঘল সম্রাট আকবরের রাজস্ব সচিব টোডর মল্ল জানতে পারেন যে, হিসাবপত্র সমুদায়ই বিক্রমাদিত্য, বসন্তরায় ও শিবানন্দ প্রভৃতির করারত্ব। বিক্রমাদিত্য ও বসন্তরায় কৌশলে তাদের এড়িয়ে চলেন। টোডর মল্ল ঘোষণা কেিলন যে, রাজ সরকারে হিসাব পত্র পাইলে তিনি তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। মোহাম্মদ কুলি খাঁ নামে একজন মোঘল সেনাপতি এসব ধনসম্পত্তির জন্য যশোর আক্রমন করে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যান। এজন্য অবশ্য তিনি টোডর মোল্লের কাছে তিরস্কৃত হয়েছিলেন। পরে বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় ছদ্মবেশে টোডর মল্লের সাথে সাক্ষাৎ করে তারই সাহায্যে ধন সম্পদ প্রত্যাপনের হাত থেকে রেহাই পান এবং বাদশাহের সামন্তরাজ রুপে স্বীকৃত হন।

১৫৭৭ খৃষ্টাব্দে বিক্রমাদিত্য যশোর রাজ্যের রাজ সিংহাসনে আরোহন করেন। রাজা বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় মোঘল বাদশাহের সহিত সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তির সহিত রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। অনেকদিন পর দক্ষিণ বঙ্গ অরাজকতার হাত থেকে রক্ষা পেল। মহারাজ বিক্রমাদিত্য নতুন রাজ্যের রাজা ছিলেন বটে কিন্তু রাজা বসন্ত রায় ছিলেন রাজ্যের সর্বেসর্বা। প্রকৃত শাসক ও পালক। প্রকৃতপক্ষে বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে বসন্ত রায়ই ছিলেন প্রধান চরিত্র। তিনি রাজ্য সংস্থাপন কালে যাবতীয় রাজনৈতিক মন্ত্রণা দিয়েছিলেন। বসন্ত রায় মহাপ্রাজ্ঞ, কর্মকূশল, সুরসিক ও ভক্তিমান ছিলেন। তিনি ছিলেন রাজ্যের দন্ডমুন্ডের কর্তা, প্রধান মন্ত্রী, কোষাধ্যক্ষ, সমাজের নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি অসীম সাহসী ও অসাধারণ যোদ্ধা ছিলেন। তিনি যেমন বিদ্ব্যান ছিলেন তেমনি সঙ্গীত কলাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি চরিত্রবান সাধু পুরুষ। যশোর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং গৌরব বৃদ্ধির কারণ তিনিই।

রাজা বসন্ত রায় কর্তৃক একটি রাজস্ব তালিকা প্রণীত হয়। ১৫৮০ খৃষ্টাব্দের পর পর টোডর মল্ল “আসল তুষার জমা” নামক বাংলার প্রসিদ্ধ রাজস্ব হিসাব প্রস্তুত করেন- তারই ভিত্তি দিন বসন্ত রায়ের তালিকা। পরবর্তীকালে লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বস্তুত তার উপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছিল।
যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর বিক্রমাদিত্যের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়িতে লাগিল। বসন্ত রায়ের চেষ্টায় বিভিন্ন জায়গায় দেবমন্দির স্থাপিত হইল। তিনি বহু গুণী ব্যাক্তিকে সমাদরে আশ্রয় দিয়ে বিক্রমাদিত্যের রাজসভার গৌরব বৃদ্ধি করেন। তিনি বঙ্গজ কায়স্থ, নানা শ্রেণীর কুলীন ও শোত্রিয় ব্রাক্ষ্মণ এবং বঙ্গজ ও রাঢ়ীয় বৈদ্যদের নিয়ে সমাজের গৌরব বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে বহু আত্মীয় স্বজনকে যশোরে এনে “যশোর সমাজ” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিরাট জনপদের সৃষ্টি করে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের রুপ দেন। মহারাজা বিক্রমাদিত্য ছিল যশোর সমাজের সমাজপতি। যশোর রাজ্যের সহিত প্রতিবেশী রাজাদের মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।

নব প্রতিষ্ঠিত যশোর রাজ্যের সীমানা নিয়ে মত পার্থক্য বিদ্যমান। যশোর রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে দিগবিজয় গ্রন্থে আছে-
পূর্ব মধুমতি সীমা, পশ্চিমে ইছামতী,
বাদা ভূমি দক্ষিণে কুশোদ্বিপোহিচত্তরে ॥
অর্থাৎ নতুন রাজ্য পূর্বে মধুমতি, পশ্চিমে ইছামতী, দক্ষিণে সুন্দরবন এবং উত্তরে কুশদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অন্যমতে পশ্চিমে কুশদ্বীপ, পূর্বে ভূষনা ও বাকলার সীমার (মধুমতী) উত্তরে কেশবপুর এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত। নিখিলবাবু যশোর রাজ্যের সীমা নির্ধারণ করতে যেয়ে বলেছেন, “ পশ্চিমে ভাগীরথী, দক্ষিণে সমুদ্র, পূর্বে মধুমতি এবং উত্তরে নদীয়া জেলার দক্ষিণাংশ” ওয়েষ্টল্যান্ড সাে হব বলিয়াছেন, “ এই রাজ্যেল দক্ষিণ সীমা সুন্দরবনের প্রান্তসীমা। পশ্চিমে ইছামতী নদীর পুর্বভাগ, উত্তর ও উত্তর পূর্বাংশ ব্যতীত সমগ্র যশোর জেলায় উত্তরে নদীয়া পর্যন্ত।” নানা ধরণের মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, যশোর রাজ্য বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার সম্পুর্ণ, খুলনা বাগেরহাটের দক্ষিণাঞ্চল, ভারতের চব্বিশ পরগণার কিয়দংশ এই রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল।

মহারাজ্য বিক্রমাদিত্য ও রাজা বসন্ত রায় যশোর রাজ্যের কর্ণধার ও স্রষ্টা। এই বংশের স্বনামধন্য রাজা। “ঞযব শরহম ড়ভ ঝটঘঙঅজইঅঘ”- মহারাজা প্রতাপাদিত্যই এখন আমাদের আলোচ্য বিষয়। প্রাচীন যশোর রাজ্যের রাজধানী সুন্দরবনের ভিতর ছিল বলে সুন্দরবনের অধীশ্বরকে সুন্দরবনের রাজা বলা হয়। এই সুন্দরবনের রাজা মহাজারা প্রতাপাদিত্য মহারাজা বিক্রমাদিত্যের পুত্র। বৈষ্ণব ধর্মমতে পিতা মাতা তাহার নাম রাখিয়াছিল গোপী নাথ। ১৫৬০ খৃষ্টাব্দে বা তার অব্যবহিত পরে অতি অল্প বয়সে শ্রীহরি বিক্রমাদিত্যর ঔরসে উগ্রকন্য বসু কন্যার গর্ভে একটি সন্তানের জন্ম হয়। তাহার নাম রাখা হয় প্রতাপ গোপীনাথ। এই প্রতাপই বিশ্ববিশ্র“ত বঙ্গেশ্বর মহারাজা প্রতাপাদিত্য। যুবরাজ অবস্থায় তিনি প্রতাপাদিত্য নামে পরিচিত হয়েছিল।

রাম রাম বসু প্রতাপ সম্পর্কে লিখিয়াছেন, “জ্যোতিষিরা বললেন সব বিষয়েই উত্তম কিন্তু পিতৃদ্রোহী। হরিষেবিষাদ মনে রাজা অন্নপাশনে পুত্রের নাম রাখলেন প্রতাপাদিত্য।” কার্যক্ষেত্রে প্রতাপ মাতার মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন এবং পিতৃদ্রোহী হয়েছিলেন।তার য়স যখন মাত্র ৫দিন তখন সুতিকাগৃহে তার মায়ের মৃত্যু হয়। শ্রীহরি পতœী বিয়োগে যেমন মর্মাহত হলেন তেমনি পুত্রের পিতৃঘাতী হওয়া নিশ্চিত মানিয়া অশান্তি ভোগ করতে লাগিলেন। সুতরাং প্রথম হইতেই তিনি প্রতাপের উপর আন্তরিক বিরক্ত হইলেন। পিতৃস্নেহ তিনি বিশেষ পাননি।

অল্প বয়সে মা মারা যাওয়ায় কাকীমা বসন্ত রায়ের প্রথমা স্ত্রীর স্নেহে লালিত পালিত হতে থাকেন। পিতা তার উপর বিরক্ত থাকলেও স্নেহমমতার মুর্তিমান অবতার রাজা বসন্ত রায়ের স্নেহগুণে তার বিশেষ কোন ক্ষতি হয় নাই। খুল্লতাত পত্নীর অতুল স্নেহে প্রতাপ যে নিজের জননী নাই তাহা জানিতেন না। প্রতাপ কাকীমাকে মা জ্ঞান করে বড় ভক্তি করিতেন। তার ঔদ্ধত্য মায়ের স্নেহের কটাক্ষে বিলুপ্ত হইত। প্রতাপের রাজত্বকালে এই মাতাই “যশোহরের মহারাণী” বলিয়া পরিচিত ছিলেন।

অতি শিশুকালে প্রতাপ শান্ত ও নিরীহ ছিলেন। আপত্য স্নেহের প্রভাবে বাল্যকালেই প্রতাব চঞ্চল ও অস্থিরমতি হয়ে উঠিলেন। এই সময় প্রতাপ বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি অত্যান্ত তীক্ষè বুদ্ধি ও মেধাবী ছিলেন। তিনি জীবনে সংস্কৃত, ফারসী ও বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি সংস্কৃতি তান্ত্রিক স্তবাদি অতি সুন্দর আবৃত্তি করিতেন। ফারসীতে পত্র লিখিতে ও অতি সুন্দরভাবে কথা বলিতে পারিতেন। প্রাদেশীক বাংলায় তিনি সৈন্যগণের সহিত কথা বলিতেন। এই সব শিক্ষাই তাহার তত মত ছিল না। তিনি শাস্ত্র অপেক্ষা শস্ত্র শিক্ষায় অধিক পক্ষপাতী ছিলেন। তাহার সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট শিক্ষক ছিলেন রাজা বসন্ত রায় স্বয়ং। তিনি পিতৃব্য বসন্ত রায়ের সুযোগ্য অভিভাবকত্বে উত্তর কালের যশোর রাজ্যের সুযোগ্য ব্যাক্তিত্ব হিসেবে গড়ে ওঠেন। পূর্ব থেকেই রাজা বসন্ত রায় উদীয়মান যুবকের অদম্য উদ্যম ও লোক পরিচালনায় ক্ষমতা দেখিয়া প্রতাপের সম্পর্কে অনেক কিছু আশা করিতেন।

প্রতাপের রাজোচিত বিপুল শরীর ছিল। বাল্যকালে তিনি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলে। তিনি তরবারী, তীর চালনা ও মল্লযুদ্ধে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। জন্মাবধি সুন্দরবনের সহিত প্রতাপের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনি সুন্দরবনের জঙ্গলে ব্রাঘ্র, হরিণ, গন্ডার (পূর্বে ছিল) প্রভৃতি শিকার করিতেন। প্রতাপ বন্ধুবান্ধবসহ অরন্যে প্রবেশ করিয়া বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। প্রতাপ অধিকাংশ সময় সূর্যকান্ত ও শংকর নামে দুই অনুচরের সহিত কাল হরণ করিতেন। এই সময় বালক প্রতাপের উচ্ছৃঙ্খলতায় বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় বড়ই বিপদে পড়িলেন। অবশেষে উভয়ে পরামর্শ করে স্থির করিলেন যে, বিবাহ দিলে প্রতাপের মতির পরিবর্তন হইতে পারে। এই জন্য তাহারা উভয়ে উদ্যগী হয়ে প্রতাপের বিবাহ দিলেন। ঘটককারিকায় প্রতাপের তিন বিবাহের কথা উল্লেখ আছে। সর্বপ্রথম প্রতাপের বিবাহ হয় পরমকুলীন, জগদানন্দ রায়ের (বসু) কন্যার সহিত। ১৫৭৮ খৃষ্টাব্দে প্রতাপ সম্মানিত অব্যল্য জিতামিত্র নাগের কন্যা শরৎকুমারীর সহিত মহাসমারোহে বিবাহ করেছিলেন। এই শরৎকুমারীই তাহার পাটরাণী বা প্রধান মহিষী ছিলেন। প্রতাপের তৃতীয় বিবাহ হয়েছিল প্রতাপের রাজা হবার অনেক পরে। বিবাহ হইল পরমাসুন্দরী, গুণবতী, প্রণয়িনী রুপে স্ত্রী পাইলেন কিন্তু তাহার ঔদ্ধত্য ও মৃগয়াভিযান কমিল না। বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় পূণর্বার পরামর্শ করিয়া রাজধানী আগ্রায় রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য প্রতাপকে আগ্রায় পাঠাবার উদ্দেশ্য ছিল, বাদশাহ আকবরের দরবারে যশোর রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে গেলে রাজবাড়ীর উপদ্রব দ্রবীভুত হবে এবং তাহার অনুপস্থিতিকালে ভ্রাতৃদ্বয় কিছুকাল নিশ্চিন্তে রাজ্য শাসন করতে পারবেন। ১৫৭৮ খৃষ্টাব্দের শেষভাগে প্রতাপ সূর্যকান্ত ও শংকরের সহিত রাজা বসন্ত রায়ের পত্র লইয়া আগ্রার দরবারে উপমীত হন। প্রতাপ পত্র লইয়া টোডর মল্লের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তিনিই সুযোগমত প্রতাপকে বাদশাহের সহিত পরিচিত করাইয়া দেন। তিনি বাদশাহ আকবরকে প্রতাপের কথা খুব ভালভাবেই জানাইলেন। প্রতাপ সেখানে বিশাল ভারত সাম্রাজ্যের পরিচালনা বিষয়, বিভিন্ন বীর, বিশেষ করে রাজপুত বীরদেব কীর্তি কলা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পালেন। রাজধানী আগ্রায় তিনি প্রায় দুতিন বৎসর ছিলেন। ১৫৮০ খৃষ্টাব্দে টোডর মল্ল বঙ্গের জায়গীর দার দিগের বিদ্রোহ দমন করবার জন্য বঙ্গে আগমন করেন এবং পরবর্তী বৎসর বঙ্গের শাসনকর্তা নিযুক্ত হইয়া অতি সুন্দরভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। টোডর মল্লের অনুপস্থিতিকালে প্রতাপ কৌশল অবলম্বন করিয়া যশোর রাজ্যের সনদ নিজ হস্তে লইবার করিতে থাকেন। প্রতাপ রাজধানীতে থাকার সময় তার পিতা ও পির্তব্য তার কাছে রাজস্ব পাঠাইতেন। প্রতাপ দুই তিনবারের টাকা সরকারে জমা নাদিয়া আত্মসাৎ করেন। যথাসময়ে সরকার হইতে রাজস্বের অনুসন্ধান করা হইলে প্রতাপ বসন্ত রায়ের নামে দোষারোপ করেন। তাহার দোষে রাজস্ব রাজধানীতে পাঠানো হয় না। বঙ্গের বিদ্রোহের পর এ সংবাদ শুভসূচক বোধ হইলনা। বিক্রমাদিত্যের হাত হইতে যশোর রাজ্য বিচ্যুত করবার আদেশ হইলে গুনগ্রাহী সম্রাট প্রতাপের প্রতি সুদৃষ্টি করেছিলেন এবং উদীয়মান যুবকের নামে যশোর রাজ্যের দ্বিতীয় সনদ লিখিয়া দিয়াছিলেন।প্রতাপ সঞ্চিত অর্থ থেকে বাকী রাজস্ব পরিশোধ করিয়া দিয়াছিলেন।

প্রতাপাদিত্যের রাজ্য প্রাপ্তি সম্পর্কে “সুন্দরবনের ইতিহাস” গ্রন্থের লেখক বলিয়াছেন, “বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায়ের মূলপত্রগুলি তিনি সঙ্গীদের কুপরামর্শে বা স্বত:প্রবৃত্ত হইয়া সম্পূর্ন গোপন করিয়া অস্থলে তাহার স্বপক্ষে সনদ প্রদানের সুপারিশ পত্র বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায়ের নামে তাহাদের অজ্ঞাতে প্রস্তুত করিয়া স্বীয় স্বাথোদ্ধার করিয়া থাকিবেন। দানবীর চরিত্রের এক উচ্ছৃংখল যুবকের পক্ষে জালিয়াতি ও ধোকাবাজীর আশ্রয় গ্রহন মোটেই অসম্ভব ছিলনা। রাজকীয় সীল মোহর প্রস্তুত, জালপত্র তৈয়ার তাহার পক্ষে খুবই সম্ভব এবং সহজ ছিল। বিক্রমাদিত্য ও বসন্তের বার্ধ্যকের অজুহাত তন্নিমিত্ত অক্ষমতা এবং রাজস্ব পরিশোধে অক্ষম প্রভৃতি বহু কথা খরচ করা হইয়া থাকিবে। প্রতাপের ছল চাতুরী , প্রবঞ্চনা মূলক বিবরনী এবং ধোকাবাজীই সম্ভবত তাহার রাজ সনদপ্রাপ্তি এবং পিতার অপসারনের কারন বলিয়া মনে হয়। রাম রাম বসু লিখিয়াছেন, রাজা প্রতাপাদিত্য ভাগ্য পরপর প্রসন্ন হইল এবং নষ্ট বুদ্ধিও সেইমত সবকিছুই বসন্ত রায়ের অজ্ঞাতেই ঘটে। বসন্ত রায় যখন জানতে পারলেন তখন প্রতাপ বাদশাহী সেনা দলে নিয়ে অতর্কিত যশোর দূর্গ অবরোধ করেন। যশোর দূর্গ অবরোধের ফলে সকলেই পিতৃদ্রোহীতার পরিচয় পেল। বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় বুদ্ধিমত্তার সাথে সকল ভূল বোঝাবুঝির অবসান হইল। এভাবে প্রতাপ কৌশলে পিতাকে অপসারিত করিয়া যশোর রাজ্যের অধীশ্বর হইলেন।

প্রতাপ রাজ্যের অধীশ্বর হইবার পর রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেন। ১৫৮৩ সালে রাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর যশোর নগরের ৮/১০ মাইল দক্ষিনে যমুনা নদী ও ইছামতী নদীর সংগম স্থলে সুন্দর বন ঘেষে ধুমঘাট নামক স্থানে এক নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।তথায় প্রতাপাদিত্যের রাজাভিষেক সম্পন্ন হয়। ধুমঘাটের ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে তীরকাটি জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত। ধুমঘাটের দূর্গ নির্মানের প্রধান ভার ছিল পাঠান সেনাপতি কমল খোজার উপর। প্রবাদ আছে যে, প্রতাপের রাজ্যভিষেক উৎসবে এক কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।

মহারাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর যশোর রাজ্য দুই ভাগে ভাগ করিয়া দিয়াছিলেন। প্রতাপ ও বসন্ত রায়ের মধ্যে জমিদারির সম্পত্তি বিভক্ত হইল। প্রতাপ জমিদারির দশ আনা অংশ এবং বসন্ত রায় জমিদারির ছয় আনা অংশ পাইলেন। বসন্ত রায় এ অসম বন্টন আপোষেই মেনে নেন। এবং স্বীয় পুত্রদের ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রশ্ন নাতোলার জন্য নির্দেশ দেন। রাজ্য বিভাজনের পরও বসন্ত রায় অনেক দিন রাজ্যের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন।

বাংলার বার ভূইয়াদের অন্যতম প্রতাপাদিত্য সিংহাসনে আহরন করেই সৈন্যবল বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন। সুচতুর প্রতাপ প্রথম থেকেই মোঘলদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে থাকেন। তিনি মোঘলদের আহ্বানে সামন্তরাজ হিসাবে কয়েকবার যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। তিনি মোঘলদের সাথে যেসব যুদ্ধযাত্রায় অংশগ্রহন করেছিলেন তার মধ্যে মানসিংহের সহিত উড়িষ্যা অভিযান উল্লেখযোগ্য। উড়িষ্যা থেকে তিনি গোবিন্দ দেব বিগ্রহ এবং উৎকলেস্বর থেকে শিব লিংগ এনে গোপালপুর ও বেদকাশী নামক স্থানে স্থাপন করেন।
মহারাজা প্রতাপাদিত্য রাজদন্ড গ্রহন করে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ভাগে মগ ও পর্তূগীজ জলদস্যুদের অত্যাচার দমনে মনোনিবেশ করেন। মগ ও ফিরিংদের অত্যাচারে ভারতের ভূস্বর্গ বঙ্গ দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হল। মগেরা কোন শাসন মানিত না। মগেরা যে মুল্লুকের পড়িত সে এলাকাকে একেবারে ধ্বংস করিয়া ছাড়িত। তৎকালে দক্ষিন বঙ্গ জলদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। তারা এদেশের নারী পুরুষ ধরে নিয়ে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করতো। বন্দীদেরকে হাতের তালুতে ছিদ্র করে সরু বেত ঢুকিয়ে হালি করে জাহাজের পাটাতনের নীচে বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হতো।ভাগীরথী থেকে সুদুর চট্টগ্রাম পর্যন্ত তারা এরুপ উপদ্রব চালাত। এসব জলদস্যুদের হার্মাদ বলা হত। প্রতাপাদিত এদের বশীভূত করেন। অনেকেই তার সেনাবাহিনী তে যোগদান করেছিল।

প্রতাপের দুর্গ সংস্থান দেখিলে বোঝা যায় যে, প্রতাপ রাজনীতি বিশারদ ছিলেন। প্রতাপ রাজত্ব কালে প্রয়োজন বুঝিয়া নানা স্থানে দূর্গ নির্মাণ করেন। প্রতাপের দূর্গ সমূহ পশ্চিমে হুগলী নদী থেকে পূর্বে বালেশ্বর নদী পর্যন্ত এলাকা জুড়ে ছিল। তিনি বেশ কয়েকটি দূর্গ নির্মাণ করেন। উহাদের নাম হল- যশোর দূর্গ, ধূমঘাট দূর্গ, কমলপুর দূর্গ, বেদকাশী দূর্গ, শিবসা দূর্গ, জগদ্দল দূর্গ, সালিখা দূর্গ, সাতলা দূর্গ, আড়াই বাকী দূর্গ, মনি দূর্গ, রায়মঙ্গল দূর্গ, তকশ্রী দূর্গ ইত্যাদি। এই সমস্ত দূর্গের অনেকগুলি গভীর অরণ্যে অবস্থিত ছিল।এখনও কিছু কিছু দূর্গের ভগ্নাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। প্রতাপ আত্মরক্ষার জন্য দুর্গ ছাড়াও গড় নির্মাণ করেছিলেন।

প্রতাপাদিত্য নিম্নবঙ্গ ও সুন্দরবন অঞ্চলে নদীনালা ও খাল বিলের কথা বিবেচনা করে নৌশক্তি ও নৌবাহিনীর দিকে মনোনিবেশ করেন। দেশে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সংস্থান, নদীর অবস্থা ও উপকূলের প্রকৃতি বিচার করে কাতরী নির্মাণ করা হয়। প্রতাপ বাহিনীর ব্যবহৃত দ্রুতগামী নৌকা সমূহের মধ্যে ছিল -ঘুরাব , বেপারী, কোশা, বলিয়া, পাল, মাচোয়া, পশতা, জালিয়া, পিয়ারা, মহলগিরি প্রভৃতি। এই সকল নৌকাসমূহের মধ্যে ঘুরাব সবচেয়ে শক্ত ও শক্তিশালী। তাহার সময়ে যশোরের কারিগর গণ জাহাজ নির্মাণে বিশেষত্ব লাভ করেছিলেন। তৎকালে শায়েস্তা খাঁ যশোর হইতে অনেক জাহাজ প্রস্তুত করিয়া লইয়াছিলেন। প্রতাপাদিত্যের উৎকৃষ্ট কাতরীর সংখ্যা সহস্রাধিক ছিল।ইসলাম খাঁর নবাবী আমলে আব্দুল লতীফ নামে একজন ভ্রমনকারীর বিবরন হতে জানা যায়, “ প্রতাপাদিত্য বঙ্গদেশের শক্তিশালী রাজা। তাহার যুদ্ধসামগ্রীতে পূর্ণ সাতশত নৌকা এবং বিশ হাজার পদাতিক সৈন্য ছিল। এবং তাহার রাজ্যের আয় পনের লক্ষ টাকা।” কালীগঞ্জ – শ্যামনগর সড়কের পূর্ব পার্শ্বে মৌতলার নিকট তাহার জাহাজ ঘাটা কুআর বন নামক স্থানে জাহাজের পোতাশ্রয় ছিল। নিকটবর্তী দুদলিয়া গ্রামে ছিল তাহার কাতরী নির্মাণের ডক। জাহাজঘাটার নৌবিভাগের সর্বাধ্যক্ষ ফ্রেডারিক ডুডলির নামে একটি গ্রাম আছে। ডকের তত্বাবধায়ক ছিলেন খাজা আব্দুল্লাহ এবং নৌসেনার অধ্যক্ষ ছিলেন অগাষ্টস পেড্রো।
প্রতাপাদিত্যের আমীর ওমরাহগনের মধ্যে সূর্যকান্ত ও শংকর প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। সুপন্ডিত, ধীরস্থির কর্তব্যকাসার এবং ব্রাক্ষনোচিত প্রতিভা সম্পন্ন শংকর চক্রবর্তী রাজস্ব ও রাজ্য শাসন ব্যাপারে পরিদর্শন করিতেন। মহাযোদ্ধা, অসমসাহসী, সবশাস্ত্র বিশারদ এবং লোক পরিচালনে অদ্বিতীয়, ক্ষমতাশালী সূর্যকান্ত রাজত্বের প্রথম ভাগে রাজ্যের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। তিনি সৈন্য রক্ষন, যুদ্ধব্যবস্থা ও বলসঞ্চয়ের দায়িত্ব পালন করতেন। শঙ্কর দেওয়ান ও মন্ত্রনা বিভাগের কর্তা এবং সূর্যকান্ত সৈন্যবিভাগের অধ্যক্ষ। প্রতাপ হিন্দুরাজা হইয়াও পাঠান ও পর্তুগীজ সৈন্যরা যুদ্ধে অধিকতর দক্ষ ছিলেন বলে তাহাদের নিযুক্ত করিতেন। প্রতাপের সেনাবাহিনীতে নয়টি ভাগ ছিল। প্রধান সেনাপতির অধীন ইহার প্রত্যেক বিভাগে পৃথক পৃথক সেনানী ছিল। সেনাবাহিনীতে ঢালি বা পদাতিক সৈন্য, অশ্বারোহী সৈন্য, তীরন্দাজ সৈন্য, গোলন্দাজ সৈন্য, নৈ নৈস্য, গুপ্ত সৈন্য, রক্ষী সৈন্য, হস্তী সৈন্য, পার্বত, কুকী সৈন্য, এই নয় বিভাগে বিভক্ত ছিল। যুদ্ধে ঢাল, তলোয়ার, শড়কী, বল্লম, লেজা, কামান, বন্দুক, বর্শা, তীর প্রভৃতি অস্ত্র শস্ত্র ব্যবহৃত হইত। প্রতাপের ঢালী বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন মদন মল্ল। অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ প্রতাপ সিংহ দত্ত এবং সহকারী ছিলেন মাহিউদ্দীন, বৃদ্ধ নূর উল্লা প্রভৃতি। তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন সুন্দর ও ধুলিয়ান বেগ। গোলন্দাজ বাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন ফ্রান্সিসকো রড়া। নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন অগষ্টাস পেড্রো। সুখা নামক এক দুঃসাহসী বীর গুপ্ত বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রক্ষী বাহিনীর প্রধান ছিলেন রতেœশ্বর বা যজ্ঞেশ্বর নয়, বিজয় রাম ভক্ত চৌধুরী প্রমুখ। হস্তী সৈন্য বাহিনীর কোন অধ্যক্ষের নাম পাওয়া যায় না। পাত্রি কুকী বাহিনীর প্রধান ছিলেন রঘু।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৫৮৭ খৃষ্টাব্দে প্রতাপাদিত্য নিজ হাতে রাজ্য শাসন শুরু করেন। ঐ বছরই ধুমঘটি দুর্গ নির্মাণ শুরু হয় এবং অচিরেই কাজ সমাপ্ত হয়। মোঘলদের সামন্তরাজ হবার জন্য মানসিংহের সহিত উড়িষ্যাভিযানে যান। উড়িষ্যা যুদ্ধ থেকে ফিরবার পরে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার মনস্থ করেন এবং মোঘলদের বিরুদ্ধচারণ করতে শুরু করেন। পিতৃব্য বসন্ত রায় তাকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করন এবং ভয়াবহ পরিনামের কথা বুঝাইয়া দেন। প্রতাপ নিষেধ বাণীর উল্টো মর্ম বুঝে বসেন। পিতৃব্য ও ভ্রাতুষ্পুত্র একে অপরের প্রতি বিশ্বাস থাকিল না। প্রতাপ সর্বদা বসন্ত রায়কে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন।

রাজা প্রতাপাদিত্য ১৫৯৯ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি কোন এক সময় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সে সময় বাংলা ও উড়িষ্যার মোঘল পাঠান শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ চলিতে ছিল। প্রতাপ স্বাভাবতই পাঠান শক্তির অনুকূলে ছিলেন। এসময়ই তিনি ভাটি বাংলায় একটি স্বাধীন রাজ্য সংস্থাপনের আশায় স্বাধীনতা ঘোষনা করেছিলেন এবং বাংলার মোগল যুবাদারকে অমান্য করিয়াই কার্যতঃ রাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন। প্রবাদ আছে যে, স্বাধীনতা ঘোষনার সময় তিনি দীন দুখীর পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ বিতরণ করিয়াছিলেন। এই দানের খ্যাতি সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছিল। এই দানের কাহিনী শ্রবনে জনৈক ভাট রচনা করিয়াছিলেন-
“স্বর্গে ইন্দ্র দেবরাজ, বাসুকী পাতালে
প্রতাপ আদিত্য রায় অবনী মন্ডলে”।
স্বাধীনতা ঘোষনার পর প্রতাপের রাজ্যলিস্পা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে থাকিল। তিনি অন্যের জমিদারী হস্তগত করার জন্য চিন্তা করিতে থাকেন।

প্রতাপ কিছুদিন তাহার খুড়ার সহিত সদ্ভাব রক্ষা করিয়া চলিয়াছিলেন। বসন্ত রায় নানাবিধ সৎকার্য সাধন করে প্রজাদের প্রিয়ভাজন হইয়া ওঠেন। পিতৃব্যের এই সুনাম প্রতাপের মনে বিদ্বেষভাবের জন্ম দেয়। এক শ্রাদ্ধ উৎসবে নিমন্তণ পাইয়া প্রতাপ পিতৃব্যের বাড়িতে গমন করেন এবং সামান্য একটা কথায় সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তিন পুত্র সহ তাহাকে হত্যা করেন। এই হত্যাকান্ডের সময় বসন্ত রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র রাঘব রায় এক কচুবনে আত্মরক্ষা করেন বলে পরবর্তীকালে তিনি কচুরায় নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন।

কেহ কেহ বলেন যে, প্রতাপ ও তাহার জামাতা রামচন্দ্র রায়ের মধ্যে যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তাহার মূলে বসন্ত রায়ের কারসাজি ছিল। প্রতাপ শুধুমাত্র পিতৃব্যকে হত্যা করে তাহার প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। পিতৃব্যের মৃত্যুর পর প্রতাপাদিত্য সমগ্র যশোর রাজ্যের অধিকার লাভ করেন এবং মহারাজ উপাধি ধারণ করে রাজ্য শাসন করতে থাকেন।

এখন আমরা বিবাহ রাতে প্রতাপ কর্তৃক জামাতাকে হত্যার প্রচেষ্টা এবং পিতৃব্য বসন্তরায়কে ও বীর কর্ডালোকে হত্যার মাধ্যমে তার চরিত্রের নগ্ন দিক যা উন্মোচিত হয়েছে তা আলোচনা করব। ১৬০২ খৃষ্ঠাব্দে প্রতাপদিত্য তনয়া বিমলা সুন্দরীর সাথে প্রতিবেশী বাকলারাজ কন্দর্পনারায়নের (মৃত্যুর পর) পুত্র রামচন্দ্রের সহিত বিবাহ সম্পাদিত হয়েছিল।
বিবাহ উপলক্ষে যশোর ও বাকলা রাজ্যে বিবাহের ধুমধাম পড়িয়া গেল। এই দুই রাজ পরিবারের মধ্যে বিবাহ বন্ধনের খবরে বিপুল সাড়া পড়িয়া যায়। বাকলার রানীর আদেশে বর যাত্রীদের জন্য নানারকম আরামদায়ক তরুনী প্রস্তুত হয়েছিল। বাকলার বালক রাম মহাসমারোহে বিবাহ উপলক্ষ্যে সদলবলে যশোর যাত্রা করেন। অন্যদিকে যশোরের রাজধানীতেও আনন্দস্রোত রহিয়াছিল। যথাযোগ্য মর্যাদার সহিত বরপক্ষ অভ্যর্থিত হইল। যথাসমারোহে বিবাহ সম্পন্ন হইল। বিবাহ সুসম্পন্ন হওয়ার পরে রাজপুরীতে সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া হরিষে বিষাদ দেখা দিল। উভয় রাজপরিবারের মধ্যে অশান্তি ও বিষাদের তীর দাহ নামিয়া আসিল।

বালক রাজা রামচন্দ্রের বিবাহ রাত্রে রমাই টুঙ্গি নামক জনৈক হাস্যরসিক ভাড় স্ত্রী বেশে সুসজ্জিত হইয়া রাজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া মহারানীর সহিত রসিকতা করিয়া আসিল। অন্দর মহলের এই ঘটনায় রানী অপমানিত হইলেন। এ ঘটনায় প্রত্যপাদিত্য অগ্নিশর্মা হুকুম দিলেন জামাতা রামচন্দ্র ও রামাই টুঙ্গীর শিচ্ছেদ। প্রতাপ কন্য বিমলা বাসর ঘরে স্বামীকে এই মহাসর্বনাশের কথা জানাইয়া দিলেন। বালক রামচন্দ্র প্রাণভয়ে একেবারে অস্থির হইয়া পড়িলেন। রাজা বসন্তরায় যুবরাজ উদয়াদিত্য, যশোরের মহারানী মহাচিন্তায় পড়িয়া গেলেন। রামচন্দ্রের অতিরিক্ত ব্যকুলতা দেখিয়া উদয়াদিত্যের চেষ্টায় রামচন্দ্র রক্ষা পান।

ইতিমধেঘ্য নানা জনে নানা মত প্রকাশ করিতে লাগিল। অনেকে মন্তব্য করিল যে, প্রতাপাদিত্য জামাতার রাজ্য গ্রাস করিবার জন্য এরকম দানবীয় কার্য করিতে উদ্যত হয়েছিল। সতীশ বাবু প্রতাপের কলঙ্ক ধৌত করিতে বিশেষভাবে চেষ্টা করিয়াছেন; “ প্রথমত হিন্দুর ছেলে প্রতাপ কি এতই রক্ত পিপাসু পাষন্ড ছিলেন যে, বিবাহান্তে বালিকা কন্যাকে বিধবা করিয়া জামাতা খুন করিতে উদ্যত হইবেন? দ্বিতীয়ত সেই উদ্দেশ্য থাকিলে বরযাত্রীগণ যশোরে পৌছা মাত্র বিবাহের পূর্বাহ্নে রামচন্দ্রকে খুন করা তাহার পক্ষে অসম্ভব ছিল। প্রতাপাদিত্যের কি একটু বুদ্ধি কৌশল ছিল না? ” ইত্যাদি। রোহিনীবাবু লিখিয়াছেন, “ তাঁহার (প্রতাপের) এই লোকাতীত প্রতিভা, অসাধারণ বাহুবল, দিগ্নন্ডল বিঘোচিত শুভ্র যশোরাজি অবলোকন করিয়া ঈর্ষাপরবশ শত্র“গণ, আত্মীয় বিচ্ছেদ মানসে প্রতাপের নামে অনর্থক এই প্রবাদের সৃষ্টি করিয়া তাঁহার শুভ্র যশোরাশিতে কালিমা লেপন করিতে চেষ্টা করিয়া ছিল। পরবর্তীতে এই লেখকদ্বয়ের মন্তব্য খন্ডন পূর্বক প্রতাপ চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করিব।

রামচন্দ্র মাধব পাশায় পৌছে শ্বশুরালয়ের সহিত সমস্ত সম্পর্ক রহিত করিলেন। রাজপুত্রের মাতা পুত্রকে অন্য কোথাও বিবাহ দেন নাই। প্রতাপ কন্যা বিমলা সুন্দরী বা বিন্দুমতী কৈশোর অতিক্রম করিয়া যৌবনে পদার্পন করিলে স্বামী সন্নিধঅনে যাইতে মনস্থ করিলেন। প্রতাপ কন্যাকে স্বামী সন্নিধানে পাঠাইতে সম্মত হন। অগনিত ধনরতœ ও লোকজন সহ প্রতাপ কন্যা স্বামী সন্ধানে নৌকা যাত্রা করিলেন। যথা সময়ে রাজপুত্রীর তরনসমূহ মাধাবপাশায় রাজবাড়ীর সন্নিকটে আসিয়া পৌছিল। রামচন্দ্র কিছুতেই স্ত্রীকে গ্রহণ করিতে চাহিলেন না। অবশেষে রাজমাতা এইরূপ অনিশ্চয়তার মধ্যে পুত্রবধুকে রাজবাড়ীতে উঠাইয়া আনিতে স্বয়নং নৌকায় গমন করিলেন। শাশুড়ী ও বধু মাতার অপূর্ব মিলনে চারিদিকে ধন্য ধন্য রব পড়ে গেল। মায়ের অনুরোধে রামচন্দ্র বিমলাকে গ্রহণ করিয়া সুখী দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করিয়াছিলেন। বিমলার গর্ভে রামচন্দ্রের দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়।

পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে প্রতাপ স্বাধীনতা ঘোষনার মন্তস্থ করলে বসন্ত রায় তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। প্রতাপ তার সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষন করে যে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষনার বাধা দিয়ে বাঙালীর স্বার্থের বিরোধীতা করেছেন এবং সময়ে প্রতিরোধও সৃষ্টি করিতে পারেন। এই সব ভেবে প্রতাপ তার জোর পরিকল্প করেন। এই সমেয় চাকশ্রী দুর্গের অধিকার নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বিবাদ চরমে ওঠে। ক্ষমাতলোলুপ রাজার পূর্ব হইতেই রাজ্য বৃদ্ধির লিপ্তা অতিমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। প্রতাপ চাকশ্রী দুর্গ দাবী করিয়া বসিলে বসন্ত রায় যে দাবী প্রত্যাখান করে। অবশেষে চাকশ্রী দুর্গ অধিকারে আনার জন্য বসন্তরায়কে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এ সম্পর্কে নিখিল বাবু বলিয়াছেন- উত্তরোক্তর বিদ্বেষভাবে বর্ধিত হওযায় প্রতাপ মনে মনে বসন্ত রায়কে এ জগত হইতে অপসাররিত করিতে ইচ্ছা করিলেন। তিনি তাহার সুযোগ অন্বেষন করিতেছিল”। এই সময়ে নানা কারণে গৃহ বিবাদ চরম আকার ধারণ করে।

বসন্ত রায়ের বার্ষিক পিতৃশ্রাদ্ধ। বসন্ত রায় গোড়া হিন্দু, অক্ষরে অক্ষরে তিন ধর্মের বিধান মেনে চলতেন। জৈষ্ঠ্য পত্নীহতার প্রকৃত পত্নী। বসন্তরায়ের অপুত্রক যে পত্নী প্রতাপের সাথে ধুমঘাটে দ্বিতীয়া পত্নীর প্ররোচনায় তাকে আনার ব্যবস্থা হয়নি। শুরু প্রতাপকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল।

শৈশবে মাতৃহারা প্রতাপ তার এই মাতৃশ্রদ্ধার অবজ্ঞাকে কঠোর মনোভাবের সহিত গ্রহণ করেন। নিমন্ত্রণ রক্ষার নামে প্রতাপ রাজবাড়ীতে কয়েকজন বিশ্বস্থ সৈন্যসহ উপস্থিত হলেন। প্রতাপের রতমুর্তি দর্শনে রাজবাড়ীর সবাই সম্ভিত হয়ে গেল। এক পযায়ে বসন্ত রায়ের বড় ছেলে গোবিন্দ রায়ের প্রতাপের মতলব সম্বন্ধে সন্দেহ হয়। সামান্য প্ররোচনায় তিনি প্রতাপকে লক্ষ্য করে দুটো তীর ছোড়েন। তীর ঠিকমত না লাগায় প্রতাপের জীবন রক্ষা হয়। কালবিলম্ব না করে প্রতাব উন্মুক্ত অসি হস্তে গোবিন্দকে আক্রমন করে দ্বিখন্তি করিয়া ফেলেন। এরপর তিনি বসন্ত রায়কে হত্যা করেন। রাম রাম বসু লিখিয়াছেন- “ গোবিন্দ রায়ের মস্তক কাটিল এবং তাহার স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন তাহাকে কাটিয়া বসন্ত রায়ের কাটা মুন্ডু লইয়া নিক স্থানে গমন করিলেন”। রাম রাম বসু বসন্ত রায়েল নিরস্ত হত্যার কথা বলিয়াছেন। এ সম্পর্কে নিখিলবাবু বলেন, “ বসু মহাশয়ের বর্ণনার কোন মুল্য থাকলে, প্রতাপাদিত্য যে কাপুরুষের ন্যায় স্বীয় পিতৃব্যের প্রানসংহার করিয়াছিলেন তাহা অস্বীকার করার উপায় নাই। পরন্তু বসু মহাশয়ের উক্তি যে, একেবারেই ভিত্তিহীন নহে, তাহাও অনুমতি হয়। কারণ প্রতাপ আরও দুই এক স্থলে এই রূপ কাপুরুষতা প্রকাশ করিয়াছিলেন।

প্রতাপাদিত্য যে বসন্ত রায় পুত্রাধিক øেহদানে লালন পালন করিয়াছিলেন, সেই পিতৃতুল্য প্রবীনকে স্বহস্তে হত্যা করিয়া নর পিচাশের ন্যায় দুস্কর্ম করিলেন। প্রতাপের এহেন দানবীয় কর্মে জনসাধারণ ঘৃণার চক্ষে দেখিতে লাগিল। বসন্ত রায়ের মৃত্যুর পর তার সাত পুত্র জীবিত ছিলেন। তার মধ্যে রাঘব রায় জৈষ্ঠ্য ছিলেন। রাণী বা রেবতী নাুী এক দাসী রাঘবকে কচুবনে লুকাইয়া প্রতাপের তরবারী হতে রক্ষা করেন। এই জন্য পরে তাহার নাম কচুরায় হইয়াছিল। কচুরায় পলাইয়া হিজলীর পাঠান শাসক ঈসা খাঁ লোহানীর দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখান থেকে আগ্রায় আশ্রয় নেন। তিনি রাজা মান সিংহকে প্রতাপের রাজ্য আক্রমণ করার জন্য আমন্ত্রণ করেন এবং প্রতাপের পতনের পর যশোরের সামন্তরাজ হইয়অ যশোরজিৎ উপাধি লাখ করিয়াছিলেন।

পর্তুগীজ বীর কার্ভালহো কে হত্যা প্রতাপাদিত্যের চরিত্রের আর এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। বারভূঞাদের আমলে যে সমস্ত বিদেশী সেনানায়ক বীরত্বের খ্যঅতি অর্জন করেন তাদের মধ্যে কাভালহো অন্যতম ছিলেন। তিনি কেদার রায়ের সেনাপতি ছিলেন। তিনি স্বন্দীপকে পতুর্গীজ উপনিবেশে পরিণত করেন। শেষ পর্যন্ত পর্তুগীজগণ স্বন্দীপ আগ করিয়া হুগলী চলিয়া আসেন। এই সময় আরাকানীর সহিত চরম বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। অচিরেই তাহরা যশোর রাজ্য আক্রমনের হুমকী দেয়।

প্রতাপ মগরাজার সহিত গোপনে সন্ধি করেন। সন্ধির শর্তানুসারে প্রতাপ পর্তুগীজ বীর কার্ভালহোর মস্তক উপহার দিলে মগেরা তার রাজ্য আক্রমণ থেকে বিরত থাকিবেন। প্রতাপ কার্ভালহোকে ডাকিয়া পরম সমাদরে গ্রহণ করিলেন। শেষ পর্যন্ত কার্ভালহোকে হত্যা করিয়া মগ আক্রমণ থেকে রক্ষা পান। সতীশ বাবু প্রতাপ কর্তৃক কাভালোর হত্যা সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করিয়াছেন। পক্ষান্তরে যদুনাথ সরকার বলেন, প্রতাপাদিত্যই এই হত্যাকান্ডের নায়ক। ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের জন্য স্বীয় পিতৃব্যকে নির্মমভাবে হত্যা করিতে পারেন। তাহার পক্ষে একজন বিদেশী সেনাপতিকে হত্যা করা আদৌ অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।

বসন্ত রায়ের হত্যার রায়ে হিজলী আক্রমন এবং কিজয় বাকলা চন্দ্রদ্বীপের সাথে সখ্যতা ও বিক্রম পুরের সাথে মঙ্কি প্রতাপ্যদিত্যের জীবনের স্বরণীয় ঘটনা। ১৫৯৯ খৃষ্টব্দে তিনি স্বাধিনতা ঘোষনা করিয়া সিংহাসনে আরোহন করেন সমুদ্র তীরবতি চাকশ্রেতে পোতাশ্রয় সুসংগঠিত করিলেন । তিনি বাঙ্গালী ও ফিরিঙ্গী সেনানায়কদের অধিনে সৈন্যদের সুশিক্ষিত করিয়া তুলিলেন। তিনি বাংলার সোঘল সুবাদারকে অমান্য করিয়াই কার্যত রাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন । প্রতাপ সুযোগ বুঝিয়া মোঘলদের সাথে বিবাদ শুরু করেন। প্রতাপাদিত্যের সমরযজ্জতার উদ্দশ্যে বাংলার সুবাদারের কর্ণগচর হইলে তিনি পর্যায়ক্রসে শের খা ও ইব্রাহিম খাঁ নামক দুইজন মোঘল সেনাপতিকে প্রতাপের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিলেন কিন্তু তাহারা প্রতাপকে সামান্য ভূসামি মনে করিয়া সে সেনা দল লইয়া যশোহরে আসিলেন। তারা কোন কার্যকারী অবস্থায় গ্রহন করিতে পারল না ; বরং তাহারা যশোর বাহীনির নিকট পরাজয় বরণ করিয়া পশ্চাতপাসারন করিল ।প্রতাপের বিজয়বার্তা চারিদিকে প্রচারিত হইল । বিভিন্ন এলাকার ভ্ঞূাগন তাহার সহিত মৈত্রী স্থাপন করিল এবং বাঘল বাদশাহের বিরুদ্ধে সমবেতভাবে যুদ্ধ করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলেন। সুবাদার প্রেরিত ক্ষুদ্র মোঘল বাহিনীর নিকট পরাজয় বরণ করিয়া পশ্চাদপসরণ করির। প্রতাপের বিজয়বার্তা চারিদিকে প্রচারিত হইল। বিভিন্ন এলাকার ভুঞাগন তাহার সহিত মৈত্রী স্থাপন করিল এবং মোঘল বাদশাহের বিরুদ্ধে সমবেতভঅবে যুদ্ধ করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলেন। সুবাদার প্রেরিত ক্ষুদ্র মোঘল বাহিনীকে পরাস্থ করিলে তাহার ধনলিস্পা আরো প্রবল হইয়অ উঠিল। তিনি মোঘল শাসনাধীন সপ্তগ্রাম বন্দর লুঠ করিয়া ধন সঞ্চয় করিতে অগ্রসর হইলেন। সপ্তগ্রামের মোঘল ফৌজদার প্রতাপাদিত্যের অতর্কিত আক্রমণ রোধ করিতে পারিলেন না। ফলে সপ্তগ্রামের সমুদয় ধনসম্পদ প্রতাপাদিত্যের কুক্ষিগত হইল। প্রতাপ মোঘল বাহিনীকে হটিয়ে রাজমহল পর্যন্ত অধিকার করে নেন। ১৬০০ খৃষ্ঠাব্দের দিকে তার খ্যাতি চরমে পৌছায়।
১৬০৩ খৃষ্ঠাব্দের প্রথম দিকে রাজা মানসিংহ প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য যশোরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। কচুরায় ও রুপরাম ব্যতীত দেশে প্রতাপ বিরোধী সংঘ গড়িয়া উঠিয়াছিল। ভবানন্দ মজুমদার নামক এব ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি মানসিংহের সহিত যোগদান করিয়া পথঘাটের মানচিত্র আঁকিয়া দিয়া সর্বপ্রকারের সাহায্য করিলেন। বর্ষাকালে খাদ্যাদির অভাব দেখা দিলে মোঘল সৈন্যগণের মধ্যে চরম দুর্দশা দেখা দেয়। তখন যশোর রাজ্যেল কর্মচারী ভবানন্দ মজুমদার (দুর্গাদাস) প্রতাপাদিত্যের সুচতুর কৌশলৈ এক গুপ্ত পথ দেখিয়ে রাজধানী আক্রমনের জন্য মুঘল বাহিনীকে সাহায্য করেন। মানসিংহ ও প্রতাপের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। মোঘল বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনে প্রতাপ পরাজয় বরণ করে সন্ধি সুত্রে আবদ্ধ হন। বসন্ত রায়ের পুত্র রাঘাব রায় বা কচু রায় পিতৃ সম্পতি ফিরে পান। প্রতাপ সই সন্ধির ফলে মোঘল বাদশাহের বশ্যতা স্বীকার করেন।

প্রতাপাদিত্যের পরাজয়ের সম্পর্কে ঐতিহাসিকগন বলেন যে, দেবী যশোরেশ্বরী প্রতাপের প্রতি রুক্ষ হয়েছিলেন, যে জন্য পরাজয়। কথিত আছে যে, প্রতাপ ক্রমান্বয়ে ২২জন বাদশাহী সেনাপতিকে পরাজিত করেছিলেন। স্থানীয় লোকের বিশ্বাস সে রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যশোরেশ্বরীর অনুগ্রহে তিনি এই সকল যুদ্ধে জয় লাভ করেছিলেন। একদিন সুরা পানে জ্ঞান হারিয়ে প্রতাপ নাকি জনৈকা অসহায়া রমনীর স্তন ছেদ করার আদেশ প্রদান করেছিলেন। সেদিন দেবী যশোরেশ্বরী রাজ কন্যার রুপ ধারণ করে রাজসভায় উপস্থিত হন। প্রতাপদেবীকে স্বীয় কন্যা মনে করে রাজপুরী থেকে চলে যাবার আদেশ প্রদান করেন। দেবী ‘তথাস্থ” বলে অন্তনিহিত হন। প্রতাপ মন্দিরে গমন করে দেখতে পান যে, যেদিন থেকে নাকি দক্ষিণদিকের রাজ্য মঙ্গলময় হয়ে উঠে যাই হোক প্রতাপের পতন সম্পর্কে মাতা যশোরেশ্বরীর অভিশাপের ফলে ঘটেছে বলে ঈতিহাসিকগণ বলেন, কিন্তু আমরা মনে করি যে, প্রতাপের দুস্কর্ম, অন্ধ অহমিকা, বাড়াবাড়িই তার পতনের মুল কারণ।

“ শিলাময়ী নামে ছিল তার ধামেঃ অভয়া যশোরেশ্বরী।
পাপেতে ফিরিয়াঃ বমিলা বুষিয়াঃ তাহারে অকৃপা করি।
পাতসাহী ঠাটেঃ কবে কেবা আটেঃ বিস্তর লস্কর মারে।
বিমুখী অভয়াঃ কে করিবে দয়াঃ প্রতাপ আদিত হবে।’

প্রতাপের পতন সম্পর্কে যশোরেশ্বরীর অভিশাপ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনের অভিব্যক্তি জি ছাড়া কিছুই নয়।
মানসিংহের হস্তে প্রতাপাদিত্যের পরাজয় বরণের পরে ১৬০৫ খৃষ্ঠাব্দে আগ্রার দরবারে নামা রকম অশান্তি বিরাজ করিতেছিল। মহামতি আকবর মৃত্যু শয্যাশয়ী। তাহার অবর্তমানে সিংহাসনের উত্তরাধিকার লইয়া আমীল ওমরাহগণ দুই দলে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। একদল ছিল শাহাজাদা সেলিম (জাহাঙ্গীর) এর পৃষ্ঠপোষক এবং অন্যদল ছিলেন সেলিমের পুত্র, রাজা মানসিংহের ভাগ্নে শাহাজাদ খসরুর পক্ষপাতী। বাদশাহের নির্দেশে মানসিংহ এ সময় আগ্রায় অবস্থান করতেছিল। অবশেষে মুমুর্ষ বাদশাহ সেলিমকেই উত্তরাধিকারী করিয়া যান। বাদশাহের মৃত্যুর পর শাহাজাদা সেলিম নুরুদ্দিন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করিয়া সিংহাসনে আরোহন করেন। বাংলায় তখন বার ভুঞাদের অনেক বিদ্রোহী। বাদশাহ জাহাঙ্গীর ১৬০৮ খৃষ্টাব্দে সুবাদার ইসলাম খাকে বাংলার শাসন কর্তা নিযুক্ত করে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেন। ঐ বছরের শেষের দিকে (ডিসেম্বর মাসে) তিনি যুদ্ধ যাত্রা করেন। এর পূর্বেই প্রতাপাদিত্য দূত পাঠিয়ে ইসলাম খাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন এবং বিদ্রোহ দমনে সহায়তাদানের আশ্বাস প্রদান করেন। প্রতাপাদিত্য স্বয়ং সুবাদারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সুবাদার প্রতাপাদিত্যের ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া দুটো নতুন জমিদারি শ্রীপুর ও বিক্রমপুর এবং অন্যান্য খেলাফত প্রদান করেন। অবশ্য পরে তিনি প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করেন। এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গই যশোর রাজ্যের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে।

বাংলা নবাব ইসলাম খাঁ প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য প্রকান্ড সৈন্যদল সহ মীর ইনায়ের খাঁকে যশোর রাজ্য আক্রমনের জন্য পাঠান। নবাবের আদেশে ইনায়েত খাঁর অধীন প্রকান্ড সৈন্যদল, অগণিত অশ্বরোহী ও পদাতিক ৫০০০ বরকন্দাজ, ৩০০ রনপোত এবং বহু তোপ সহ যশোর রাজ্য বিজয়ের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। চিরাচরিত প্রথানুযয়ী অন্যান্য সমস্ত রাজগন ও বিদেশী শাসকদের সাথে যোগদান করেন। যথাসময়ে প্রতাপাদিত্য এই ভয়াবহ আক্রমণের সংবাদ পাইলেন।

মহারাজা প্রতাপাদিত্য মোঘল পক্ষের যুদ্ধযাত্রার সংবাদ পাইবা মাত্র নিজের সমগ্র রনবাহিনীকে প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত করিলেন। স্বয়ং প্রতাপাদিত্য এক তাগলইয়া ধুমঘাট দুর্গ রক্ষার্থে রহিলেন। অপর ভাগ লইয়া তাহার জৈষ্ঠ্যপুত্র উদয়াদিত্য অগ্রবর্তী হইযা সালখার থানার কাছে শত্রুপথে বাধা দেবার জন্য পাঠাইলেন। উদয়াদিত্যের অধীনে ৫০০ রনতরী , ৪০ টি হস্তী, এক সহস্র অশ্বারোহী এবং কয়েক সহস্র ঢালী বা পদাতিক সেন্য মালখার মোহনায় উপস্থিত হল। এই সময় যুবরাজ উদয়াদিত্য বয়স্ক যুবক এবং চরিত্রগুনে সর্বজনপ্রিয় ছিলেন। উদয়া দিত্য প্রধান সেনাপতি ছিলেন। তাহার অন্যতম প্রধান সহকারী ছিলেন নৌসেনার অধিনায়ক খোজা কবল এবং অশ্বারোহী ও পদাতিক স্থল সেন্যের ভারপ্রাপ্ত জামাল খাঁ। প্রতাপাদিত্য স্বয়ং অবশিষ্ট কয়েক শত রনতরী ও নানাজাতীয় সৈন্যদল লইয়া যশোর দুর্গে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। মোঘল সৈন্যবাহিনীর সাথে উদয়াদিত্যের নৌবাহিনীর মধ্যে সর্বপ্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

মোঘল বাহিনীর ক্ষিপ্র গতিতে আক্রমনের ফলে যশোরের রাজশক্তি দুর্বল হইয়া পড়ে। তীব্র নৌযুদ্ধে পরাজয়ের পর যুবরাজ উদয়াদিত্য পলায়ন করেন। খাজা কমল বীর বিক্রমে যুদ্ধ করিতে করিতে জীবন বিসর্জন দেন। বীর সেনানীর নেতৃত্বে সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্কের ভাব দেখা গেল। এই খানে আমরা মীর্জা নাথন প্রনীত ‘বাহরিস্তান গায়েবী’ হইতে একটি যুদ্ধের বর্ণনা দিব।

শত্রু নৌবলের পরাজয়ে সমস্ত বাদশাহী ও বাধ্য জমিদার দিগের নওয়ারা যশোহর নওয়ারা লুট করতে গেল, আর কোন দিকে দৃষ্টি নাই, সেনাপতির কথা কেহ শোনে নাই। শুধু ৪ খানি কোশা ও দুই খানি অপর নৌকা উদয়ের পিছনে তাড়া করিল। উদয়ের নৌকার সহিত পলাইয়া যাইতে ছিল এমন একখানি পিয়ারা, ৪খানি কোশা ও দুই খানি অপর নৌকা উদয়ের পিছনে তাড়া কলি। উদয়ের নৌকার সহিত পলাইয়া যাইতেছিল এমন একখানি পিয়ারা, ৪ খানি ঘুরাব এবং ফিরিঙ্গিপূর্ণ একখানি আচোয়া এই ছয়খানি নৌকা প্রভুভক্তি দেখাইয়া নঙ্গর ফেলিল এবং বাদশাহী নৌকার পথ বন্ধ করিয়া দাড়াইল। পরে যখন পাড় দিয়া মীর্যা নাথান ও অন্যান্য সৈন্য নিকটে পৌঁছিল এবং এই শত্রু নৌকাগুলি তীর চালাইয়া পরাস্ত করিল, তখন বাদশাহী নৌকার ৪ খানি লুট করিতে ব্যস্ত হইল। কেবল মোহাম্দ খাঁ পন্নী ও মোহাম্মদ লোদী মীর বহরের অধীন মীর্জা নাথনের দুই খানি কোশা মীর্যাকে দেখিয়া লজ্জার খাতিরে নৌকায় পিছু পিছু ছুটিল। নদী কুল দিয়া মীর্যাও তাহার অশ্বারোহী সৈন্য উদয়কে ধরিবার জন্য দৌড়াইতে লাগিলেন। শত্রু নৌকা সকল পিছনে গুলি চালাইতে চালাইতে পালাইতে লাগিল।

“ক্রমে নদীর এক সংকীর্ণ অংশে যখন উদয়াদিত্যের মহলগিরি তরণী প্রায় ধরা পড়িবার উপক্রম হইল, তখন তিনি উহা পরিত্যাগ করিয়া একখানি প্রত্যুতগামী কোশার উপর লাফাইয়া পড়িলেন এবং কোশার প্রভূভক্ত মোল্লারা বায়ুবেগে নৌকা চালাইল। মুঘল সৈন্য যুবরাজের অতুল সম্পদশালিনী মহলগিরি লুট করিবার লোভ সম্বরন করিতে পারিল না। যেই অবসরে উদয়ের প্রাণ রক্ষা হইল”।

“ মীর্যা নাথন দুঃখে নিজ হাত চাপড়াইতে চাপড়াইতে পাড় ধরিয়া আরও কিছুদুর ছুটিলেন, কিন্তু সঙ্গে তাহার কোশা নাই, কোনই ফল হইল না। যশোহরের নৌবলের মধ্যে ৪২ খানি নৌকা মাত্র পলাইয়া গেল। অপর সবগুলি (তাপসহ) ধরা পড়িল। উদয়ের পরাজয় দেখিয়া জামাল খাঁ হাতিগুলি সঙ্গে লইয়া দুর্গ হইতে পলাইয়া গেলেন মীর্যা নাথন পরিখা পার হইয়া দুর্গে ঢুকিয়া বিজয়েল ভেরী বাজাইলেন। মুঘলগন সেখানেই রাত কাটাইল। ”

সতীশচন্দ্র মিত্র ভাষ্যঃ
যুবরাজ উদয়াদিত্য ফিরিয়া আসিয়া আবার যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। কিন্তু কিছুই লাভ হইল না। সবিশেষে রাজা প্রতাপদিত্য বিপন্ন হইয়া পড়িলেন। তাহার নৌবহর শেষ, সৈন্যগন বিপর্যস্থ। বিজয়োল্লাশে মোঘল সেনাপতির অসংখ্য সৈন্য ও রণতরীসহ রাজ প্রজাদের দ্বারাপ্রান্তে উপস্থিত হইলেন। দুর্গ রক্ষীবাহিনীর সাথে প্রতাপ বীল বিক্রমে যুদ্ধ করেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। এখানে যুদ্ধ করার পর প্রতাপ রনে ভঙ্গ দিয়া দুর্গ মধ্যে পলায়ন করিলেন। মীর্জা সাহেব যুদ্ধ জয় ঘোষণা করিল।
মহারাজ প্রতাপাদিত্য উপায়ন্তর না দেখিয়া আত্ম সমর্পন করা স্থির করিলেন প্রতাপাদিত্য একখানি কোশা নৌকায় চড়িয়া দুইজন মন্ত্রীসহ মোঘল সেনাপতি ইনায়েত খাঁর নিকট সাক্ষাৎ করিলেন। স্থির হইল প্রতাপকে ঢাকার যুবাদার ইসলাম খাঁর সমীপে উপস্থিত করা হইবে এবং তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সেইরুপ কাজ করা হইবে। ৪০ খানা নৌকা সহ ইনায়েত খাঁ রাজা প্রতাপাদিত্যকে লইয়া ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। যথাসময়ে ইনায়েত খাঁর সঙ্গে প্রতাপ ঢাকায় গিয়া পৌছালেন এবং নবাব ইসলাম খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ইসলাম খাঁ প্রতাপের সন্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। “ইসলাম খাঁ প্রতাপকে শৃংখলাবদ্ধ করিয়া লাখিলেন।” প্রতাপাদিত্যের দশ আনা অংশে ইনায়েত খাঁ প্রথম শাসনকর্তা নিযুক্ত হইলেন। অবশিষ্ট ছয় আনা অংশের মালিক রহিলেন রাঘব রায় ও তদীয় ভ্রাতা চাঁদ রায়।

ইনায়েত খাঁর ঢাকা যাত্রার পর মীর্যা নাথন সমস্ত সৈন্যদলের ভারপ্রাপ্ত হইয়া যমুনার তীরবর্তী স্থানে বাসগৃহ নির্মাণ করিয়া বসবাস করিতে লাগিলেন। এই স্থান বসিয়া তিনি ‘ বাহরিস্থান-ই-গায়েবী’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। বহরিস্তান ই – গায়েবী শব্দের অর্থ গুপ্ত বসন্তের দেশ। প্রতাপ বন্দী হবার পর বাদশাহী সৈন্যগণ প্রজাতের ঘরবাড়ী লুটপাট ও সর্বনাশ সাধন করিতে শুরু করিল। এ সম্পর্কে মির্যা নাথন বহারিস্তানে বলিয়াছেন,“ সেই সময়ে উদয়াদিত্যের দুতগন সন্ধি করিবার জন্য মির্যা নঞনের নিকট যাতায়াত করিত। একদিন মির্যা এখন তাহাদিগকে বলিলেন, তোমরা মির্যা…………….. থলিয়া থলিয়া টাকা মোহর এবং রত্ন ও বহু মূল্য দ্রব্য উপহার দিতেছ, আর আমাকে আম ও কাঁঠালের ডাঁলি দিয়াও পুছে না। আমি কি কেহ নই? তোমাদের দেখাইতেছি আমি কে? “যেইদিন দুপুর রাতে নিজ সৈন্য লইয়া বাহির হইলেন এবং আশপাশের গ্রামগুলিতে এরূপ লুঠ এবং স্ত্রী লোকদিগের উপর অত্যাচার করিলেন যে, যশোর আক্রমনের প্রথম হইতে এ পর্যন্ত ইহার সমান কিছুই হয় নাই। [ ইহা মীর্যা নথনের নিজের লেখা, বহারিস্তান, ৫৭ (ক) পৃষ্ঠার অনুবাদ]
অধ্যাপক যদুনাথ সরকার মহাশয় লিখিয়াছেন, মীর্জা এখন প্রজাবর্গের প্রতি যে ভীষন অত্যাচার করিলেন সম্ভবতঃ তাহারই ফলে “ উদয়াদিত্যের নিজের ও প্রজাদিগের প্রাণ ও মান বাঁচাইবার জন্য আবার অস্ত্র ধরিয়াছিলেন।” কালীগঞ্জ থানাধীন মৌতলার পূর্বদিকে কুশলীর মাঠে মির্যা নথনের সাথে উদয়াদিত্যের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। উদয়াদিত্য প্রজাবর্গের মহিমান রক্ষার জন্য শত্রুদিগকে ভীমবেগে আক্রমন করে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন।

ঢাকায় প্রতাপাদিত্যের বন্দী এবং উদয়াদিত্যের মৃত্যুতে রাজপুর নারীদের মধ্যে হাহাকার পড়িয়া গেল। পূর্ব পরামর্শ যত প্রতাপ মহিষী রাণী শরৎকুমারী নারীদের ইজ্জত রক্ষার্থে যশোর রাজবাড়ীর সংলগ্ন পরিখায় নৌকা রাখিতে আদেশ করিলেন। মহারানী অন্যান্য স্ত্রী পরিবার ও শিশু সন্তাসহ সেই নৌকায় আসিলেন এবং গুপ্ত সুড়ংগ পথে নৌকায় করে দুর্গের বাইরে এসে নৌকার তলদেশ ছিদ্র করে জলে ডুবে জীবনাহুতি দেন। এভাবে রাজপুর নারীদের জীবনাবসান হয়। রানী শরৎ কুমারীর নাম অনুসারে এই স্থানের নাম হয় শরৎ খানার দহ এবং এই স্থান ধুমঘাট দুর্গের উত্তর পশ্চিম কোনে অবস্থিত।

জাহাঙ্গীর নগরে (ঢাকায়) প্রতাপ কারারুদ্ধ থাকাকালীন সময় শুনতে পান যে, যুবরাজ শেষ বারের মত মোঘলদের সাথে লড়ে নিহত হয়েছেন এবং পুরনারীরা আত্মহুতি দান করেছেন। এমতাবস্থায় তার মন ভেঙ্গে পড়ে। পরে তিনি লৌহ পিঞ্জরে আবদ্ধ হয়ে নৌকাযোগে আগ্রায় প্রেরিত হন। ১৬১১ খৃষ্টাব্দে ৫০ বৎসর বয়সে আগ্রার পথে বরানসীতে প্রতাপাদিত্যের মৃত্যু ঘটে। এভাবেই বঙ্গের বিখ্যাত বারভুঞার অন্যতম পাঠানের বীরত্ব ও স্বাধীনতা মুঘল হস্তে ভুলুন্ঠিত হয় কথিত আছে বারানসীর চৌষট্টী যে ঘাট তিনি বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন এবং যার উপর কালিমুর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, সেই ঘাটে গঙ্গাম্লান করিতে যেয়ে তার মৃত্যু হয়। কেহ কেহ বলেন, নিজ আংগুরীয়ের মধ্যে লুকায়িত জহর পান করে তিন মৃত্যুবরণ করেন।

এখন আমরা প্রতাপাদিত্য উত্তর যুগ থেকে প্রতাপাদিত্যের আমল পর্যন্ত সাহিত্যের বিকাশ ধারা ব্যাক্ত করিব। ১। যশোরের প্রাচীন সাহিত্য সাধনার ইতিহাস আজ তমসাচ্ছন্ন। মধুযুগের সাহিত্য সাধনার ইতিহাসও তথৈবচ।

বাংলা ভাষায় আদি যুগের সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত এই এলাকায় বিচরণ করতেন। জানা যায় যে, বাংলা ভাষার আদি কবি, আদি সিদ্ধাচার্য ব্যকলা চন্দ্রদ্বীপের (বরিশাল) বাসিন্দা ছিলেন। চন্দ্রদ্বীপের কোথায় কবে তার আবির্ভাব হয়েছিল জানা যায় না। যশোর রাজ প্রতাপাদিত্যের জামাতা রামচন্দ্র খান চন্দ্রদ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন ( পূর্বেই বলা হইয়াছে)। কবি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ বউ ঠাকুরানীর তাট এই রাজ বংশের বিস্মৃত প্রায় ইতিহাসের স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে রচিত। যে ইতিহাসও আমাদের কাছে অজানা। তবে জানা যায় যে, যশোর রাজ প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল। রাজা প্রতাপাদিত্যের পিতৃব্য বসন্ত রায়, রাজা প্রতাপাদিত্য ও যুবরাজ উদয়াদিত্য কবি ছিলেন এবং পদ রাচনা করতেন।

সুধী সমাজের অবগতির জন্য রাজা প্রতাপাদিত্য ও তৎপুত্র উদয়াদিত্যের রচিত দুটি বৈষ্ণব ভাবাপনন পদাবলীর উদ্ধৃত দেওয়া গেল।
১। রাজা প্রতাপাদিত্যের একটি পদ –
বন্ধুর লাগি কোন দেশে যাইসু।
রজনী হইলে কার মুখ চাইমু।
(১) এখানে আমরা রুপ সনাতন ও জীবন গোস্বামী সম্পর্কে কোন কথা ব্যক্ত করিলাম না।
ভোগে ভাত নাহি খ্যঙ্ পিপাসে না খাঙ পানি।
জ্বলিয়া জ্বলিয়া ওঠে হৃদয় আগুনি ॥
শুতিলে না আইসে নিদ্রা বসিলে পোড়ে হিয়া।
বিষ খাই মরি যাইমু কালার বালায় ঠলয়া ॥
প্রতাপ আদিত্য বলে বিড়ম্বনা আছে।
মিছা ভুলি রহিলাম এ ভব মায়া বসে ॥
২। উদয়াদিত্যের একটি পদ –
“ কি বলিতে জানো মুক্তি কি বলিতে পারি
একে গুনহীন আর পরবশ নারী।
তোমার লাগিয়া মোর যত গুরুজন।
সকল হৈল বৈরী কেহ নয় আপন
বাঘের সমাজে যেন হরিনীর বাস ॥
তার মাঝে দীঘল ছাড়িতে নারিশ্বাস
উদয়াদিত্য কহে মনে ঐ ভয় উঠে।
তোমার পরিনতিখানি তিলেক পাছে টুটে। ”

উদয়াদিত্যের দুটি পদ ( একটি ভনিতাযুক্ত, অন্যটি ভনিতাহীন) যথাক্রমে ‘ পদকল্পনাতিকা’ ও রসকল্পবল্লী’তে উদ্ধৃত আছে। ডক্টর সুকুমার যেন মনে করেন যে, গৌড়ের অন্যতম বিখ্যাত পদ কবি গোবিন্দ দাসের ভনিতায় যে প্রতাপাদিত্যের নাম আছে, সেই প্রতাপাদিত্য ও রাজা প্রতাপাদিত্য একই ব্যক্তি। প্রতাপাদিত্যের রাজসভায় গোবিন্দ দাসের যাতায়াত ছিল। গোবিন্দদাসের বন্ধু ছিল বসন্ত রায়। এ সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের পূর্ব ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করিতে হইবে।

মহারাজ বিক্রমাদিত্য ও বসন্তরায় এর পিতা রামচন্দ্র বৈষ্ণব ছিলেন এবং তাহারা জন্মাবধি বৈষ্ণব ছিলেন। তাহারা বৃষ্ণ লীলা পদগান শুনিতে ভালবাসিতেন। এই সময় গৌড়ে তাহাদের সহিত পদকর্তা গোবিন্দ দাসের প্রথম সক্ষাৎ হয়। স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস মধুর কোমলকান্ড পদাবলীর প্রভাবে লোকমাত্রকে মোহিত করে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি বলে আখ্যায়িত হইতেছিলেন। গোবিন্দের পিতামহ দামোদর মহাকবি ছিলেন। কাব্যসভার মন্থন পূর্বক পদাবলী রচনা করিয়া গোবিন্দ দাসের কন্ঠে যখন গীত হইত তখন শোতৃ বর্গের প্রাণ কাড়িয়া লইত। মহাপ্রাণ বসন্ত রায়ের সহিত গোবিন্দ দাসের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। রাজকার্যে অবসর মিলিলে রাজ ভ্রাতৃদ্বয় গোবিন্দকে লইয়া কীর্তন শনিতেন। তাহাদের অনুরোধে গোবিন্দ কিছুদিন পরপর যশোরে আসিতেন। যুবরাজ উদয়াদিত্য ও আজন্ম বৈষ্ণব ছিলেন এবং কীর্তন গান ভালবাসিতেন।
রাজা বসন্ত রায় স্বভাব কবি ছিলেন এবং পদ রচনা করিতেন। গোবিন্দ দাসের সহিত বসন্ত রায়ের মধ্যে কবিতার তর্জ্জায় লড়াই হইত। হর্জ্জায় লড়াই এক ধরণের কবিতার লড়াই- একজন কবিতায় সে সকল প্রশ্ন কিরতেন অন্যজন তৎক্ষণাৎ কবিতায় তাহার উত্তর করিতেন। রাজা বসন্ত রায় এমন তীক্ষèবুদ্ধি সহকারে উত্তর প্রদান করিতেন যে, গোবিন্দদাস ও তাহার কবিত্ব শক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

রামলীলা প্রসঙ্গে গোবিন্দদাস গাহিয়াছেন-
কুসুমিত কুঞ্জ কল্পতরুকানন, মনিময় মন্দিরমাঝ।
রাসবিলাস কলাৎকন্ঠিত, কনোমোহন নটরাজ
কামিনী -কর- কিশলয় বলায়াঙ্কিত রাতুল পদ – অরবিন্দ
রায় বসন্ত, মধুপ অনুসন্ধিত নিন্দিত দাস গোবিন্দ ॥

আবার মানপ্রসঙ্গ গাহিয়াছেনঃ
রায় চম্পতি বচন মানহ, দাস গোবিন্দভান।
রায় চম্পতি ও রস গাহক, দাস গোবিন্দ ভান?
গোবিন্দদাস এসকল স্থানে নিঃসন্দেহে বসন্ত রায়কে বুঝিয়াছেন। কোন কোন স্থানে ‘দ্বিজরাজ বসন্ত’ ভনিতাও আছে। যেমন ঃ শ্রীশ্যামসুন্দরের রুপ প্রসঙ্গ উক্ত আছে।
পদতলে থলকি, কমন ঘর রাগ, তাহে কলহংস কি নুপুর জাগ। গোবিন্দদাস, কহয়ে মতিমন্ত, ভুলল যাহে দ্বিজরাজ বসন্ত।
প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে গোবিন্দদাস যশোহরে আসিতেন। সম্ভবতঃ মোঘলদের সহিত প্রতিপাদিত্যের সংঘর্ষ হেতু যশোহরের সহিত গোবিন্দের পূর্বে গোবিন্দদাস দেহত্যাগ করেন।

গোবিন্দদাসের ভনিতায় প্রতাপের নাম ব্যবহার করা হইয়াছেঃ
এতহি বিরহে আপহি মুরদই, শুনহ নাগর কাল।
প্রতাপ আদিত, এ রস ভসিত, দাস গোবিন্দ গান।
প্রতাপাদিত্য রাজসভায় বহু পন্ডিতকে বৃত্তি দিতেন। রাজ সভায় সমাগত পন্ডিতেরা সমস্যা পুরণ ও নানাবিধ দার্শনিক তর্ক করিতেন। গুরুদেব কমল নয়ন তর্কপঞ্চানন ইহাদের সকলের অগ্রনী ছিলেন এবং তিনিই দুই পক্ষের শাস্ত্র বিচারে মধ্যস্থতা করিতেন। অন্যান্য সভাপন্ডিত গনের মধ্যে অবিলম্ব স্বরস্বতী ও কবি ডিমডিম স্বরস্বতী নামক দুই ভ্রাতার কথা শুনিতে পাওয়া যায়। উভয়ই অসাধারণ পন্ডিত ছিলেন।

অবিলম্ব স্বরস্বতী মুখে মুখে দ্রুত কবিতা রচনা করতে পারতেন বলে তার নাম অবিলম্ব স্বরস্বতী হয়েছিল। ডিমডিম ছিলেন দার্শনিক পন্ডিত, তিনি দ্রুত কবিতা রচনা করতে পারতেন না বলে তার নাম হয়েছিল ডিমডিম স্বরস্বতী। তাহাদের প্রকৃত নাম জানা যায় না। স্বরস্বতী উপাধী তাহাদের কয়েক পুরুষ হইতে চলিয়া আসিতেছিল। প্রতাপাদিত্য অবিলম্ব তাহার ভ্রাতার জন্য বৃত্তি নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। অবিলম্ব স্বরস্বতী শুধু কবি ছিলেন না। তিনি পরম ভক্ত সাধক এবং সিদ্ধকুলে তাহার জন্ম। অবিলম্ব স্বরস্বতীর প্রধান কাজ ছিল মাতা যশোরেশ্বীর মন্দিরে নিত্য চন্দ্রীপাঠ।

জানা যায় যে, প্রতাপের যশোকীর্ত্তনে বলিয়াছেন-
প্রতাপাদিত্য ভূপাল ভালং মম নিভালয়।
স্বেদেন প্রোঞ্ছিতা সন্ত বিধের্দুলেখ পংক্তয়ং।
হে মহারাজ প্রতাপাদিত্য আমার কপালের প্রতি দৃষ্টিপাত কর যেন, তোমার দৃষ্টিমাত্র কপালে দর দর ধারায় ঘর্ম ঝরিবে এবং উহা দ্বারা আমার পোড়া কপালের বিধিলিপি ধুইয়া মুদিয়া যাইবে।

প্রতাপকে তিনি আদিত্য বা সূর্য স্বরূপ কল্পনা করিয়া অনেক কবিতা রচনা করিয়াছেন।
দানাম্বসেক- শীতার্ত্তা যশোর বসন বেষ্ঠিতা।
ত্রিলোকী ও প্রতাপার্কং প্রতাপাদিত্য যেবতে ॥
হে ভাগ্য বিধাতা প্রতাপাদিত্য, তোমার দানরাশি জলধারা তুল্য শীতল, তাহার সিঞ্চনে ত্রিলোকের লোক শীতার্ত্ত হইযাছে এবং শীত নিবানের নিমিত্তে তোমার যশোরূপ বস্ত্র দ্বারা গাত্র আবৃত রাখিয়াছে। অবশেষে তাহাতে শীত দুরীভূত না হওয়ায়, তোমাকে সুর্যতুল্য বলিয়া সেবা করিতেছে।
অর্থাৎ তোমার দান শীলতার কীর্ত্তি কাহিনীতে আকৃষ্ঠ হইয়া সকল লোকে তোমার আশ্রয় লইতে আসিতেছে। বৃত্তিভূক পন্ডিতেরা স্তাবকতা অনেক করিয়া থাকেন কিন্তু অবিলম্ব স্বরস্বতীর মতে সুকৌশলে কবিতা গ্রথিত করিয়া অতি অল্প কবিই প্রসিদ্ধ লাভ করিয়াছেন।

এখন আমরা প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে খ্রিষ্টান পাদবীগণের আগমন এবং প্রতাপ চরিত্র বিবৃত করিয়া প্রতাপাদিত্যের জীবন চরিত্রের ইতিবৃত্ত সমাপ্ত করিব।
খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য যে সব পাদরীগণ সর্বপ্রথম বঙ্গে আগমন করেন তাদের মধ্যে জেসুইটগনই প্রধান। ১৫৪০ খৃষ্টাব্দে ইগ্নেসিয়াম লয়োলা নামক এক স্পেনদেশীয় ব্যক্তিদ্বারা জেসুইট বা যীশু সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। শিক্ষা বিস্তার, মানব সেবা ধর্ম ও প্রচারই তাহাদের উদ্দেশ্য।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়