নদীতে মেঘের ঢেউ

দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী নদীতে মেঘের ঢেউ/মীম মিজান

নাদান এই নিজেকে বেশ ঋদ্ধ করেছি বিশ্বসেরা ইরানি সাহিত্যের রস আস্বাদনে আর উন্নত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধুপানে। শিল্প-সাহিত্যের সেই উর্বর ভূমিতে আমি স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে অলির মতো ঘুরেছি ইরানি গুলবাগ, মহাফেজখানা, প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের মকবরা, সারি সারি পাহাড়ের ঢালের কৃষিক্ষেত্র, আঁটোসাঁটো লেকের স্বচ্ছ জলে নীলাকাশের নীলাভ মোহনা আর পর্যটকদের ঘরে ফিরে না যাওয়ার কত্ত কত্ত স্থানে। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের আজ গন্তব্য ইরানের উত্তরাঞ্চলের ব্যতিক্রমী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মেঘ ঢেউয়ের নদী, আলামুত পাহাড় বা হাসান সাব্বাহ কেল্লা ও এভান বা আয়ভান হ্রদ ।
সূর্যকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে ছোট ছোট ছয়টি মিনিবাস আসলো। হয়তো আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তারও ঘুম ভাঙবে। আমরা বাংলাদেশী মোট নয়জন পুরুষ একটি মিনিবাসে উঠলাম সাথে দু’জন ভিনদেশী বন্ধু আর তত্ত্বাবধায়ক অগায়ে সাবেরি। ভিনদেশী সহযাত্রী দু’জন হচ্ছেন ভারতের চন্দ্রগুপ্ত ভারতিয়া ও জার্মানির ক্রিস্টোফার। ইরানের সহপাঠী হওয়া সাতাশটি দেশের ১২২জন প্রফেসর, গবেষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে নারীদের জন্য আলাদা মিনিবাস। সেখানে অবশ্য আমাদের দেখভালকারী অগায়ে কেশাভারজ বা জনাব কৃষক ও তার পরিবারও উঠেছে। গোটা মুখজুড়ে বসন্তের দাগওয়ালা পঞ্চাশোর্ধ কৃষক মহোদয়ের সাত কি আট বছরের একটা পরী আছে।
মিনিবাসের সারি সমানভাবে সজোরে ছুটে চলল। খুবই আনন্দ হচ্ছিল। আর চমৎকার এক অনুভূতি খেলা করে যাচ্ছিল নির্ভার এক যুবক মনে। ফর্সা আলোতে কৌতুহলী চোখ ও মন তৃপ্ত হচ্ছিল। যেখানে একটু পানির সন্ধান বা গাছ গাছরা জন্মেছে তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বসতি। এখানে ফসলি জমি কম। অধিকাংশগুলই ফলের বাগান ও অনুরূপ চাষের জমিন। পাহাড়ের উঁচু-নিচু ঢালে যেন পিচঢালা রাস্তার মাঠ। ট্রাক্টরের অগভীর চাষে, আপাতঃ নরম মাটিতে সার-পানি মিশ্রণের ফলে কালো রঙ ধারন করা চুলের বেনির ন্যায় পাহাড়ের পা তক ঢেউ খেলানো জমিনে রোপিত বীজের কিছু বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। এতেই কৃষকের সাফল্য। সামনে এগুতেই দেখি একটা গ্রাম মতো সমভূমি। হাঁটু উচ্চতার। ভুট্টাক্ষেতে স্যুট-কোট পরা অনেক লোকের জটলা। সবার প্যান্ট ভিজে গেছে। মানে রাতের ভালোবাসা শিশিরের ফোঁটাগুলো ভুট্টার কচি সবুজ পাতা থেকে কৃষি দপ্তরের অফিসারদের শুষ্ক প্যান্ট শুষে নিয়ে সিক্ত। এত সকালে প্রজেক্ট নিরীক্ষণে এসেছেন মহোদয়েরা!
যে কয়েকটি বসতি চোখে পড়ল সবগুলোর অবকাঠামো প্রায় একইরকম। টিনের চালের বাংলা ঘরগুলো হয় ইট-সিমেন্ট না হয় কাঠের তৈরি। শীতকালীন শাদাচাদড়ের আতিথিয়েতা থেকে রক্ষার জন্য কাঠের তৈরি ঘরগুলোর বেড়া কাদামাটি দিয়ে লেপে দেয়া। একজনের একটি করে ঘর আর সংলগ্ন পশুশালা, রন্ধনশালা ও প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের ছোট্ট কুঠুরি। নিজ নিজ ঘরবাড়ি আর শস্যক্ষেতের সীমানাজুড়ে সিমেন্ট আর কাঠের খুঁটিতে কাঁটাতারের বেড়া। হাতে মোজা আর মাথায় হ্যাট পরা একজন আপনমনে থরে থরে সাজাচ্ছেন সোনালি, লাল আঙুর। আঙুরভর্তি ক্যারেটগুলো তার খদ্দেরের জন্য অপেক্ষায়। মিনিবাসের প্রথম যাত্রীর আসনে বসা আমি ঝলকে ডান-বামে ঘুরে দেখে নিলাম প্রায় পুরো পরিবেশ। মনে হলো সবুজ আর সবুজ! এই বিরানভূমিতেও সবুজ আছে!
কত্ত যে উঁচু-নিচু পাহাড় তার হিশেব কষতে আমি অক্ষম। পাহাড়ের গায়ে বা খোড়লে উঁকি দিচ্ছে কত নাম না জানা নানা গড়ন আর বয়সের উদ্ভিদ। ও আল্লাহ! তোমার হাজার শুকরিয়া! তুমি এত বিস্তৃত আর উঁচু-নিচু করে পৃথিবী সাজিয়েছো! তাইতো বারবার কুরআনে আহবান করেছ তোমার নিদর্শন দেখতে। রাস্তাগুলি সাপের মত প্যাঁচানো। পাহাড়গুলির গোড়ায় কালো পিচের তৈরি তেলতেলে রাস্তা। প্রথমে মনে হয় যে, উপরে বুঝি আর রাস্তা নেই। কিন্তু সজোরে এগিয়ে যাওয়া মিনিবাসের সামনের গ্লাস দিয়ে দেখি যে, কোথা থেকে যেন জাদুর মতো তাৎক্ষণিক রাস্তা তৈরি হয়ে আমাদের সামনে পড়ছে। এভাবে অনেক উঁচুতে উঠলাম। এঁকেবেঁকে চলল পাহাড়ের গোড়ায় গোড়ায়। হুট করে উপরের দিকে রাস্তা ওঠেনি।
কৌতুহলী দৃষ্টি ও মনন তৃপ্ত হলেও পেট মহাশয় হঠাৎই জানান দিল যে, তা এখন খাবার শূন্য। আগেভাগে উঠে পড়ার জন্য এ অবস্থা। সেই শূন্যতা আরও বেশি করে জানান দিতে শুরু করল যখন দেখতে পেলাম যে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ইরানিরা সপরিবারে বসে নাস্তা করছেন। এরা আসলে পরিবারকে নিয়ে বেড়াতে আর একসাথে খোলা জায়গায় মাদুরে বসে খেতে ভালোবাসেন। তারাও স্নিগ্ধ ভোরের ঘুমকে হঠিয়ে এখানে এসেছেন। আমরা এমন এক উচ্চতায় উঠলাম যে, রাস্তাঘাট ও বাড়িগুলোকে এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।
আমরা সামনের দিকে ঝুঁকেপড়লাম তার মানে মিনিবাসও দক্ষিণে নিম্নমুখী হয়ে ঝুঁকেনিচের দিকে যাচ্ছে। সুবহানাল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! সুবহানাল্লাহ বিহামদিহি! আল্লাহু আকবার! বলে উঠলাম। সামনের যে অকল্পনীয় দৃশ্য তা দেখে আল্লাহর তারিফ না করে থাকতে পারছি না।। মনের অজান্তেই বেরিয়ে এসেছে আল্লাহর প্রশংসা। পৃথিবীর যে কেউ এ দৃশ্য দেখলে মনের অজান্তে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করবে। যদি কেউ নাস্তিক হয় তবে তার ঈমান আনয়নের সমূহ সম্ভাবনা আছে। আমার কি ভাষা আছে এ দৃশ্য প্রকাশ করবার? আমার জ্ঞান নেই লিখে তা প্রকাশ করবার। বিমান থেকে তেহরান ও ইস্ফাহান শহরের আলোকোজ্জ্বল রাতের যে দৃশ্য, সে তো এটির ধারেকাছেও আসবে না।
আমিসহ অন্য সবার চোখ ও মস্তিষ্ক তখন নিচের দিকে নিবিষ্ট। সবাই নিজের আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকেপড়েছে। গাড়ির চালক অগায়ে সাবেরিকে এসব করতে নিষেধ করলেন। “অগায়ুন, লুতফান! ইনতুর নাকুন।’ অর্থাৎ, মহাশয় গণ, অনুগ্রহ করে এরকম করবেন না। আর হাসি মুখে কঠিন করে বললেন, এভাবে ঝুঁকেগেলে কিন্তু আমরা একবারে নিচে পড়ে যাব।
তবুও যারা সামনে ও বাঁপাশে জানালার ধারে বসেছি তারা দেখছি। নিচের দিকে নদীতে পানির বদলে মেঘ বয়ে যাচ্ছে। এও কি সম্ভব! বিস্মিত হয়ে তাই সবাই মুখে বারবার উচ্চারণ করছি আল্লাহর জাত ও সিফাতি নামসমূহ। এক গভীর নদী। যে নদীর প্রশস্ততা তিন কিলোমিটারের মতো। তাতে পানি যেরকম খুব স্রোত নিয়ে মোহনার দিকে বয়ে যায় আর মাঝে মাঝে কুণ্ডলী পাকায়, ঠিক তেমনি মেঘগুলিও গড়িয়ে চলছে। নদীটি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বয়ে যাচ্ছে আর মেঘগুলোও তাই পশ্চিম থেকে পূর্বে ঢেউ উঠিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে।
আমরা তাহলে কত উপরে উঠেছি যে, নিচে মেঘ দেখা যাচ্ছে। বিমানে উঠলেই এরকম মেঘের উপরে সাঁতার কাটা যায়। আর এখানে কিনা বিনা বিমানে মেঘের নদীর উপর আমরা। আল্লাহ তায়ালার এক অপার নিদর্শন এই দৃশ্যটি। তাই বুঝি অন্যান্য ইরানি মানুষজন এভাবেই রাতের আঁধারে ছুটে এসে খানাপিনা করে অপেক্ষা করছিল চোখ ও মনকে অবিশ্বাস্য কিছুর সাক্ষী করার। নিচের দিকে নামছি আর তিন কিলোমিটার মতো দক্ষিণে দেখছি এ পাড়ের মতো পাহাড় ও বাড়ি। তবে আরো পাহাড় আছে সেগুলো ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছিল। সবার ক্যামেরা সচল হলো মেঘের কুলু কুলু বয়ে চলার ক্ষণকে ক্যামেরাবন্দি করতে।
আমরা এঁকেবেঁকে নিচে নামতে লাগলাম। ভাবছি সাগর বা নদীর তলদেশে যেরকমটি শৈবাল, ঝিনুক, মুক্তো আরও কত্ত কিছু থাকে সেরকমটি বোধহয় আজ স্বচক্ষে দেখা ও হস্তগত করার সুযোগ মিলছে। সে খোওয়াব পূরণের জন্য নিশপিশ করছিলাম। মেঘের উপরে থাকা পাহাড়ি রাস্তাগুলোর বর্ণনা দিয়ে শেষ করার নয়। ইরান সরকারকে কি বলব! এদের পরিকল্পনা ও কাজ কত ভালো যে, অতো উঁচুতেও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে। এমন কোনো বাড়ি নেই যারা বিদ্যুৎহীন।
এ মা! যতো নিচে যাচ্ছি, দেখছি মেঘমালার ভাটির দিকে যাত্রা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। মিনিবাসের বহর একবারে নিচে যেখানে নেমে আসলো, সেখানে গ্রাম, দোকানপাট ইত্যাদি। ছোট্ট একটি নদী। খুব সম্ভবত ঝরনার পানি তার বুকে প্রবাহিত। কেননা, পানিগুলো পরিষ্কার ও শীতল। ছোট্ট লোহার ব্রিজ হচ্ছে নদীর দু’পাড়ের সংযোগ। ব্রিজের অদূরে পূর্বদিকে শান বাঁধানো যার নিচে দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছে। শানে বসে অনেকেই সুবহানেহ বা সকালের নাস্তা খাচ্ছিলেন। আমরাও মাদুরে বসে নাস্তা সারলাম।
এরা বাঙালি না। তাই মোটা চালের ভাত খায় না। মাঝে মধ্যে একটু পোলাও টোলাও খায় আরকি। পোলাও যা দিবে তা দু’বছরের বাচ্চার একবারের খাবারের সমান। এই পোলাও চাউলের জন্য ধান বুনেছে স্রোতস্বিনীর ধার ঘেঁষেই। ধানের শিষ এখন হালকা সোনালি বরণ। টুপটাপ করে গোটা কয়েক মাছ লাফাচ্ছিল। মেঘ স্রোতস্বীনির তলদেশে শৈবাল, ঝিনুক বা মুক্তো না পেলেও সবুজ-সোনালি ধানক্ষেত আর গোটা কয়েক মাছ পেলাম।
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার তরুণ তুর্কী এক সহপাঠী কৃষক মহোদয়ের সাত কিংবা আট বছরের সেই পরীটিকে একটি লাল টুকটুকে জামা উপহার দিলো । উপহার পেয়ে বেজায় খুশি হয়ে, “দাসতে শুমা দারদ নাকুনেহ!” বা কৃতজ্ঞতা বলে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা গালে চুমু দিল। সৌজন্যবোধ কাকে বলে তা এদের দেখলেই বুঝা যায়।
সূর্যটা আলো ছড়াল। আকাশের অপরিচ্ছন্নভাব কেটে গেল। আমরা দেখতে পেলাম নীলাকাশ। আর কেউ চাইলেও মামুলি এ দিনের আলো বা রাতের আঁধারেও আর পাহাড়চূড়া থেকে এ গাঙে আর বইতে দেখবে না মোহনার টানে মেঘমালার ঊর্মি। অপেক্ষা কাল বিহানবেলার।

লেখক – গবেষক, অনুবাদক

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য