ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস : ঝিল, জঙ্গল ও লোকালয়ের কথা

তাপসকিরণ রায় ।।

পর্ব -১ /

পাঁচমারি মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত। এটা হোশঙ্গাবাদ জেলায় মধ্যে পড়ে। মধ্যপ্রদেশের একমাত্র পাহাড়ি স্টেশন পাঁচমারি। এ জায়গা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার সাতষট্টি মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এখানকার সাতপুরা অঞ্চল সবচে সুন্দর জায়গা। পাঁচমারিকে এই সাতপুরার রাণীও বলা হয়। এ জায়গা বলতে গেলে ঘন বনে ঢাকা। তারই মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র পাহাড়-পর্বত মালা। আর আছে ঢালান জলপ্রপাত, ঝর্না, ঝিল এবং বড় বড় জলাশয়। সাতপুরা ন্যাশনাল পার্কের অংশ হিসাবে, এখানে খুব ঘন বন আছে। বনের মধ্যে সিংহ, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, সাম্বর, হরিণ এবং অন্যান্য অনেক রকম বন্য জন্তু-জানোয়ার  এখানে বাস করে।

এই পাঁচমারিতেই লাল বাবু থাকে। পাঁচমারিকে মধ্যপ্রদেশের গ্রীষ্ম নিবাসও বলা হয়। গরমের দিনে লাল বাবুর পূর্বপুরুষ সপরিবারে এখানে ঘুরতে এসেছিল। তারপর এ জায়গার মোহ ছাড়তে না পেরে এখানেই বসবাস করতে শুরু করেছিল। বাংলাদেশে থাকার মত তাদের তেমন জায়গা-জমিন ছিল না।  তাই এখানে কিছু কাজকর্ম করতে করতে লাল বাবুর ঠাকুর দা এক ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে নিয়েছিল। লাল বাবুর বাবাও বেশ করিৎকর্মা ছিল। কয়েকটা বছর যেতে না যেতেই সে পাকা দুই ঘরের দালান তৈরি করল। আর বর্তমানের লাল বাবু সেই দুই ঘরকে চার ঘর বানিয়ে দিব্যি বসবাস করছে। বাংলার বাইরে থেকে থেকে সে বাঙালিত্ব বজায় রাখতে পারছিল না। কথা-বার্তা, চাল-চলন সবই প্রায় এখানকার মতো হয়ে গেছে। এখানে বেশির ভাগ হিন্দি কথা বলতে হয়। তবু বাংলার ভাঙচুর কথার চল এখনও লাল বাবুর ঘরে রয়ে গেছে। তার ছেলে-মেয়েরা বাংলা বলে বটে, কিন্তু লেখার বেলায় একেবারে লবডঙ্কা।

লাল বাবুর ব্যবসা সামান্য। কিছু কাঁচা টাকা তার আছে। সে টাকার আবার বেশির ভাগটাই তাকে রাখতে হয় ঘরে। সে জন্য সে ভেবে-চিন্তে দুটো কুকুর পুষেছে। তার মতে বিদেশি কুকুর রাখার কোনও প্রয়োজনই নেই। জায়গা পরিবেশ সব মিলিয়ে চলতে হবে তো ? তাই সে হৃষ্টপুষ্ট দুটো দেশী কুকুরের বাচ্চা ঘরে নিয়ে এসেছে। সে বাচ্চা দুটো আজ বড় হয়েছে। সেগুলো খাওয়া-দাওয়া যা পায় তাতেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে। লাল বাবু নিজে তাদের নাম দিয়েছে, লালু, ভুলু। তার স্ত্রী এ নিয়ে সে সময় একটু আপত্তি জানিয়ে ছিল, ‘এ কি রকম নাম গো ? এ তো তোমার নাম মিলিয়ে নাম রাখা !’

লাল বাবু হেসেছিল, বলেছিল, ‘জানো গো গিন্নি, ছোটবেলা আমি একটা মাত্র সিনেমা দেখেছিলাম। তার নাম ছিল, লালু-ভুলু। কাহিনী বড় ভালো ছিল। দুই বন্ধুর মধ্যে খুব মিল ছিল, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। ওই লালু-ভুলু নামের মধ্যেই কেমন একটা মিল দেখছো না ?’

সেই লালু, ভুলু তখন ছোট ছিল। লাল বাবুর তখন ছেলে-মেয়েরাও ছোট ছিল।  ওদের পছন্দ-অপছন্দ ধরার মত ছিল না। সেই কুকুর দুটোর মধ্যে ছিল ভীষণ মিল। খাবার দিলে কেউ আগেভাগে বেশি খেয়ে নেবে না। কিছুটা খেয়ে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তার মানে বলতে চায় যে, না, এটুকু তুই খেয়ে নে !

লালু মুখ খোলে, মাথা নেড়ে ওঠে, তার মানে হল, না, আমি খাব না, তুই খেয়ে নে ! পাহারাদার হিসেবে লালু-ভুলুর জুড়ি নেই। দিনভর প্রায় ঘুমিয়ে কাটায় ওরা।  আর রাত হলে ওদের চোখে আর ঘুম নেই। লাল বাবুর ঘরে দিনের বেলায় কেউ আসলো তো ওরা দুজনে তাকে শুঁকে শুঁকে চিনে নেয়। ওরা কি বোঝে কে জানে ! কারও ওপর আবার ওরা, ‘ঘেউ ঘেউ’, করে ওঠে। লালু বাবু সঙ্গে থাকলে সেই লোকটার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। না, লোকটার চেহারা ছবি তো খারাপ নয় ! তবে হবে লালু-ভুলু তার ঘ্রাণ শক্তিতে সবকিছু বুঝে নেয়। বুঝে নেয়  কে সৎ, আর কে অসৎ। এ সব কুকুররা বুঝে নিতে পারে। লাল বাবুর ভালো লাগে। সে  লালু, ভুলুর পিঠ চাপড়ে আদর করে দেয়, বলে, ‘সাবাস, এই না হলে আমার কুকুর !’

লালু, ভুলুর জন্য পাড়ার লোকেরা ভীষণ টাইট। বিশেষ করে রাত হলে তো কথাই নেই। ইঁদুর হোক, বাঁদর হোক, তাকে এমন তাড়া করবে যে সে ঘরের ত্রিসীমানায় আসতে ভয় পাবে। এই তো সে দিনের কথা, দুই ধেড়ে ইঁদুর সুড়সুড় করে ঢুকে যাচ্ছিল লাল বাবুর বাড়ির ভেতর। লালু দেখে ফেলল ওদের। প্রথমেই সে ওদের সামনে গিয়ে এক ধমক দিলো। দুই ধেড়ে ইঁদুর আচমকা শব্দে ভয় পেয়ে একেবারে চিৎ হয়ে  পড়ল। ততক্ষণে ভুলু এসে গেছে। ইঁদুরের চিৎপাত অবস্থা দেখে ওরা যেন হেসে উঠলো, ‘খেঁক খেঁক খেঁক।’ তারপর বলল, ‘এই যা যা, এই ঘর মুখো আর যেন তোদের কোন দিন না দেখতে পাই। পশুপাখি নিজেদের কথা, হাবভাব, ডাক বুঝতে পারে। আওয়াজ ধারণা করে নিতেই পারে। কুকুরগুলি চুপ করে গেছে। তা দেখেই ধেড়ে ইঁদুর দুটো উঠে দাঁড়িয়ে দে ছুট। ওরা একেবারে লাল বাবুর বাড়ি থেকে এক শ হাত দূরে গিয়ে তবে থামে। তারপর বলে, ‘আর কোনদিন ও বাড়িমুখো হবো না।’

এ রকম আশপাশের বিড়ালদের অবস্থাও তাই। ওরা শুরু-শুরুতে লাল বাবুর বাড়ি গিয়ে চুরি করে খাওয়া দাওয়া করেছে। কিন্তু এখন পারে না, কারণ ওই লালু-ভুলু। তবুও মেনি বিড়াল নিজেকে চালাক ভেবেছিল। বলেছিল, ‘তোরা পারলি না তো ? দেখ আমি লালু-ভুলুকে ফাঁকি দিয়ে ওদের ঘরে কি ভাবে যাই ! ওর ঘর থেকে আমি মাছ-দুধ খেয়ে তবে আসব।’

–‘চ্যালেঞ্জ রাখো তা হলে ?’ ভীতু বিড়ালরা লেজ উঠিয়ে বলেছিল। 

মেনি সে দিন হাত বাড়িয়ে সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল। তারপরের ঘটনা ছিল এই রকম–

মেনি বিড়াল সন্ধ্যের পর আড়ি পেতে থাকল। লালু-ভুলু তখন বাড়ির পেছনের দিকে ছিল। এ সময় মেনি বিড়াল পা টিপে টিপে এগোল।  তখন ও লাল বাবুর ঘর ছুঁইছুঁই করছিল। ঠিক এমনি সময় বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে লালু-ভুলু এসে হাজির। মেনী বেড়াল ভয় পেলো, মনে মনে বলল, বাপ রে  লালু-ভুলু  কেমন কুকুর রে বাবা ! কি ভাবে টের পেয়ে গেলো ? আমাদের বিড়াল থেকেও দেখছি ওদের ঘ্রাণশক্তি অনেক বেশি !

–‘এই এই এই, কোথায় যাচ্ছিস তুই ?’ ভুলু বলে ওঠে। 

লালু বলল, ‘চোর কাঁহিকা !’

মেনি জানে কুকুর একটা হলে চলত। কিছু সে করতে পারতো কিন্তু ওই দুই দুইটা আহাম্মককে সামলানো বড় মুশকিল ! মেনি তবুও ওদের সামনে দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করল, বলল, ‘এই দেখ ভাই, তোদের একটা কথা জানাতে এসেছিলাম। আসলে তোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে চেয়েছিলাম।’

–‘কোনও কথা না, যা ভাগ, বাতালা ছাড়তে হবে না, চুরি ছাড়া তো আর কিছুই জানিস না তোরা !’ লালু এ কথা বলেছিল।

মেনী বলল, ‘তোদের আমার ভালো লাগে তাই–’

ভুলু বলেছিল, ‘কি ভালো লাগে, বল ?’

মেনী বেড়াল বলেছিল, ‘তোদের প্রভুভক্তি, কাজের ওপর নিষ্ঠা, এসব দেখে আশ্চর্য হই ! তাই এসেছিলাম তোদের সঙ্গে চুপিচুপি মিলতে।

ভুলু বলল, ‘চুপিচুপি কেন ?’

–‘আরে আমাদের হুলো, মিনি ওরা সবাই বড় চোর, আমি আসবো জানলে সবকটা আমার পেছন নিতো। তারপর চুরি করে আমার বদনাম দিত।’

ভুলু একটু নরম হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, কি চাস বল ?’ 

লালুর পছন্দ হচ্ছিল না, বলল, ‘মেনীর কথা সব মেকি, না, না, কোনও কথা আমরা শুনব না। আগে এখান থেকে তুই বেরো !’ 

অবস্থা খারাপ বুঝে মেনীকে ফিরে আসতে হল। ওর চ্যালেঞ্জ বিফল হয়েছিল।  সে জন্য তাকে মিনি, হুলোদের একটা একটা করে চুরি করা মাছের টুকরো দিতে হয়েছিল। মেনীর মনের দুঃখ মনেই রয়ে গিয়েছিল। মেনীর মনে হয়েছিল, ওই লালু কুত্তাটা মোটেও ভালো না। ভুলুটা তবু নরম হয়ে এসেছিল। আসলে দুনিয়ায় যে যার মতলব নিয়ে থাকে দেখছি !

পরবতীর্ পর্ব :  ঝিল ও পিপুল জঙ্গল