বই প্রকাশের আগে এবং পরে //রহিম ইবনে বাহাজ

ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস, এ মাস জুড়েই লেখক পাঠক প্রকাশকের মিলন মেলা ঘটে, দুষ্ট মহামারি করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে গতবছর মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারও মহাবিশ্বে যেহেতু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে শনাক্ত এবং মৃত্যুর হার বৃদ্ধি সেদিন ঘোষণা শুনলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি হতে অমর একুশে গ্রন’মেলা শুরু হয়েছে। স্বাস’্যবিধি এবং সরকারের নির্দেশনা মেনে সবাই কে সচেতন থাকতে বলা হয়েছে। যাহোক আজকে লেখার বিষয় একটু ভিন্ন একজন নবীন লেখক বা কবি ও কথা সাহিত্যিক বই প্রকাশের আগে অনেক ঝাক্কি ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়, অনেকে প্রতারিত হয়, লাঞ্চিত হয় কেন হয় এবিষয়ে বলবো, ভূঁইফোড় কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাহারি ঢঙের বিজ্ঞাপণ প্রচার করে থাকে যে, আমরা শুধু লেখার মান উন্নত হলে বিনা পয়সায় বই প্রকাশ করে থাকি এবং লেখক কে যোগ্য সম্মানিত করে থাকি, এরকম নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নবীন লেখকদের আকর্ষণ করা হচ্ছে, একটা ঘটনা বলি ২০১১ সালে একুশে গ্রন’ মেলায় আমি শাহবাগ ছবির হাটে বসে হুমায়ুন আজাদ এর বই সৈয়দ শামসুল হক এর বই পড়ছি, এমন সময় এক লোক এসে বলল, ভাই আপনি কি কবি? বললাম না তো, কিন’ কেন? উনি বলল, আপনার মাথার চুল বড় বড় কবি কবি চেহারা তাই বললাম, আমি তাকে বললাম মাথার চুল বড় হলেই কবি লেখক হওয়া যায়না। এগুলো ভ্রান্ত ধারণা। এবার বলুন কি বলতে চান? ভাই কি বলবো আমার বাড়ী ফরিদপুর জেলা ভাঙ্গা থানা ছোট বেলা হতে কবিতা লেখি, এক প্রকাশক কে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি আমাকে ১০০ কপি বই দিবে, একবার বলে আরো টাকা লাগবে আবার বলে এবছর আর হবেনা, কি করবো বলেন নির্বাক হয়ে বললাম আমি কি করতে পারি উনি চোখের জল মুছে বললেন, কিছু পরামর্শ দেন, আমি তাকে বললাম গ্রামে ফিরে যান, আরো কিছু সান্তনা দিয়েছি। বাংলাদেশে সব প্রকাশক এমন নয় হাতে গুনা কয়েকজন, তারা বাইন মাছের মতো ছাই ধরে চামড়া ছিলে ফেলে এতে সাধারণ সৃজনশীল মানুষ প্রতারিত হচ্ছে সুনাম অর্জন করা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গুলোর মান সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে। বই প্রকাশের আগে অবশ্যই যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিবেন নবীন লেখক বৃন্দ। অর্থলগ্নি করবেন কষ্টের অর্জিত অর্থ যদি বুড়িগঙ্গা বিষাক্ত নদীতে চলে যায়, এর দায় আপনারই। আবার অনেকে ১০০/২০০ কবিতা লিখে কবি বনে যায়, কিভাবে শুনুন এই শ্রেণির লোক খুব কম বাংলাদেশে অনলাইন, ওয়েব ম্যাগ, কোন সাহিত্য সংস্কৃতির ম্যাগাজিন বা পাক্ষিক, সাপ্তাহিক, জাতীয় দৈনিক তে তারা লিখেনা, লেখা পাঠাইও না আবার পাঠালেও সাহিত্য সম্পাদক কঠোর ভাবে সম্পাদনা কাজ টি করেন। কেউ কেউ মনে করেন তারা মৌসুমি কবি অমর একুশে গ্রন’ মেলা হলেই নড়েচড়ে বাংলা বাজার, শাহবাগ, কাঁটাবন এলাকায় নিত্য দেখা মিলে, মূলত নিজেকে জাহির করার জন্য ফুটন্ত পুষ্প হয়ে গন্ধ ছড়াতে ব্যাকুল। কিছু প্রকাশক এ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের অর্থ, কিছু বই লেখকের হাতে ধরিয়ে দায়িত্ব হতে ইতি টানে, কবি বা লেখকের অর্থ দিয়ে যখন বই হবে তখন তো প্রকাশক লেখার মান নিয়ে বিচার করে না, লেখা যাই হোক তিনি সাধ্যমতো অর্থ নিচ্ছেন, প্রকৃত অর্থে ব্যবসাটা মূখ্য বিষয়। আমি সাত বছর বাংলা বাজার প্রকাশনী এলাকায় কবিতার পান্ডুলিপি নিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছি। নবীন কবি বা লেখকদের নিজের অর্থায়নে বই প্রকাশের জন্য বলে। উদাহরণ হিসেবে আল মাহমুদ জীবনে প্রথম বই নিজের টাকায় করেছেন। এমনকি হুমায়ুন আজাদও নাকি পান্ডুলিপি নিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে ঘোরাঘুরি করেছেন। এখন তো সবকিছুই ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসাধু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গুলো বলে থাকে, আপনি কি লেখালেখি করেন? বই প্রকাশ করতে চান? টাকার জন্য বই করতে পারছেন না? তাহলে আজই যোগাযোগ করুন। এসমস্ত মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে চলছে কারবারি এতে স্খলন হচ্ছে সাহিত্য সংস্কৃতির মূল্যবোধ।
গত বছর আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়ে ছিল, বহু ডাক্তার এর কাছে গিয়েছি কিন’ রোগ নিরাময় হচ্ছেনা, তিনদিন পর আর রাহা হাসপাতালে যাই ডাক্তার আমার বর্ণনা শুনে ঔষধ পত্র লিখে দিল, দুইবেলা খাওয়ার পর আমি পরিপূর্ণ সুস’। নবীন লেখক বন্ধুরা সঠিক জায়গায় না গিয়ে লোভনীয় বিজ্ঞাপনের তকমা লাগানো অফার দেখে প্রতারিত হচ্ছে। বই প্রকাশের আগে অনেক কবি, কথাসাহিত্যিক, লেখক বন্ধুগণ একটা অংক কষে যেমন ফেসবুকে প্রায় দুই হাজার সদস্য আছে, এরমধ্যে লেখক বন্ধু মহল আছে ৫০০ জন তো সাধারণ বন্ধু মহল তো বই কিনবে না তারা মোবাইল ঘাটাঘাটি করতে বেশি পছন্দ কওে, আর গার্লফ্রেন্ড আছে ৫০ জন অন্তত, এখন হতে একটা তালিকা তৈরি করতে পারি, সৃজনশীল লেখক ৫০০ জন মেয়ে বন্ধু ৫০, সাধারণ মানুষ ২৫০ টোটাল বিক্রি হবে ৮০০ কপি, মেলা হতে বিক্রি হবে ১০০ কপি, আর ১০০ কপি সৌজন্যে দিব কপি অংক শেষ। এক সপ্তাহের মধ্যে সব প্রস’তি শেষ বই লেখকের হাতে প্রথম বই আনন্দ এর মাত্রা একটু বেশি থাকে, যেন প্রথম সন্তানের মতো বইকে বার বার চুমু খাওয়ার অবস’া, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দিল আমার প্রথম বই নিতে চাইলে বিকাশ করুন কুরিয়ার খরচ সহ ১৭০ টাকা। আজ ঝড়ের গতিতে লাইক পড়ছেনা, কেউ কমেন্ট করছেনা, এক ঘন্টায় লাইক পড়ছে মাত্র ৬ জন। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে একটু বুদ্ধি বের করলো ছদ্মনামে একটি নতুন একাউন্ট খুলে নিজেই লাইক কমেন্ট করছে। যে-বন্ধুত্বের মধুর সম্পর্ক ছিল তারাও আজ সাড়াশব্দ দিচ্ছেনা অথচ বই প্রকাশের আগে সবাই উৎসাহ দেখিয়েছে একটা বই দরকার, আমরাই কিনবো। আজ এই শ্রেণির বন্ধু মহল মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাস্তবতা বড়ই নিমর্ম। আবার অনেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বই মেলা হতে সংগ্রহ করবো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন পোস্ট দিচ্ছে বই কিনুন। অনেক পাঠক ঠিকানা দিয়েছে শর্তজুড়ে দিয়েছেন বই হাতে পেয়ে বিকাশ করবো। এই হচ্ছে নবীন লেখকদের বর্তমান পরিসি’তি। গতবছর মার্চে বই মেলা তিন দিন গিয়েছি, করোনা মহামারির কারণে লেখক, পাঠক প্রত্যাশা অনুযায়ী আসেনি, লিটলম্যাগ চত্বরে আড্ডা দিয়েছি দেয়াঙ এর সম্পাদক ও কবি মাহমুদ নোমান, কোন পাঠক কে লিটল ম্যাগ হতে বই কিনতে দেখা যায়নি। তৃতীয় দিন মেলায় দেখা হলো কবি ও প্রাবন্ধিক বঙ্গ রাখাল তাকে বললাম সাধারণ মানুষ তো কবিতার বই কিনে না। তিনি বললেন, কবিতা তো ইন্ডিয়ার হারবাল নয় যে সাধারণ মানুষের কাজে লাগবে, যে যার পছন্দের লেখকের বই কিনছে, নন্দিত, জনপ্রিয়, পাঠক প্রিয়, খ্যাতিমান, বহুল আলোচিত সমালোচিত লেখকদের বই অর্থ দিয়ে কিনছে। এখন যে চিত্র দেখি বর্তমানে যারা নিয়মিত জাতীয় দৈনিক অনলাইন, বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লিখছেন সবাই কিন’ বই কিনতে রাজি নই। লেখক প্রমথ চৌধুরী বই পড়া প্রবন্ধে বলেছেন, একজন আইনজীবি বাংলা সাহিত্যের বই কিনে পড়েনা, কারণ তার কোনো কাজে আসবেনা, জজ সাহেব তো কবিতা শুনতে নারাজী। কিছু মানুষ সৌজন্যের আশায় থাকে। একজন কবি যখন বই কিনতে উৎসাহ দেখা যায়না, এক্ষেত্রে জোর করে বলা যায়। সৃজনশীলতার অভাব, অথচ কবিদের চা আড্ডায় দুই তিনশ টাকা পকেট হতে বিল দেয়ার জন্য আগ্রহ দেখা যায়। কিন’ ১৫০ টাকা দিয়ে বই কিনতে অনীহা। ২০২২ সালে অনেক কবি কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, রম্য লেখক বন্ধু বই প্রকাশ করেছেন, আমি পরিচিতজনদের যোগাযোগ করেছি, বই সম্পর্কে জানতে চাইলাম তাঁরা হতাশার মহা বাণী বললেন, আক্ষেপ হয়ে বললেন, আমার কবি ও লেখক বন্ধু আছে প্রায় ৪০ জন দুঃখের বিষয় ৪ জনও বই কেনার আগ্রহ বা বই সম্পর্কে কোন যোগাযোগ করেনি, বই প্রকাশের আগে অনেক বন্ধু বলছে অটোগ্রাফ সহ বই চাই। রকমারি ডটকম ২৫% ছাড়ে প্রচার হচ্ছে কিন’ সাড়া মিলছেনা, নব প্রজন্মের সৃজনশীল কবিদের কাব্য গ্রন’ প্রকাশ কিন’ বন্ধ হচ্ছে না, এতো কাঠখড় পুড়িয়ে দুর্বার গতিতে ছাপাখানার কলকব্জা চালু আছে, বই বাঁধাই হচ্ছে বাজারে আসছে। কত কপি বিক্রি হলো সেটা বিষয় নয়, যেন জঠর হতে সন্তান দুনিয়ায় মুখ দেখতে পেলো। অমর একুশে গ্রন’ মেলায় বিক্রি না হলেও সমস্যা নেই, ৬ মাস বা একবছর পর মিরপুর ১০ পুরাতন বইয়ের দোকানে থরে থরে সাজানো হবে, নীলক্ষেত পুরাতন বইয়ের দোকানে ২০ টাকা ধরে বিক্রি হবে। অর্থনৈতিক ভাবে লোকসান হলেও একদিন সাহিত্য সংস্কৃতি প্রতিভা উদ্ভাসিত হবেই ধিকিধিকি এ আলো জ্বলবেই, যুক্তরাষ্ট্রের কবি এমিলি ভিকিনসন জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে নিরবে লিখে গেছেন বহু কবিতা। সেসব কবিতা ছাপার ব্যাপারে তাঁর কোন আগ্রহ ছিলনা, জীবিত থাকা অবস’ায় মাত্র ৭ টি কবিতা ছাপা হয়েছিল। প্রকাশকরা একজন নারীর কাছ থেকে ” মেয়েলিপনা ” কবিতা আশা করছিলেন কিন’ ব্যতিক্রম ছিলেন এমিলি ভিকিনসন তাঁর সব কবিতা অপ্রকাশিত থেকে যায় এক হাজার সাতশো কবিতা লিখেছিলেন এমিলি, জীবন সম্পর্কে তাঁরও বিতৃষ্ণা জেগে উঠেছিল, তাঁর সাহিত্য সমাজে কোনো মূল্যায়ন পায়নি। মেলেনি স্বীকৃতি বিয়ে করেননি ব্যক্তি জীবনেও তার সুখকর ছিল না, মৃত্যুর পর তার বোন এমিলির অপ্রকাশিত লেখা সম্পর্কে খোঁজ নেন। তবে বর্তমানে মার্কিন নারী কবি হিসেবে এমিলি বিশ্বের সেরাদের একজন মানা হয়। বই প্রকাশের আগে এবং পরে যেন দুটি মহা যুদ্ধ। কত প্রাচীর সীমানা অতিক্রম করে কাঙ্খিত তথা পৌঁছাতে হয়। বই প্রকাশের আগে এবং পরে জগতের সকল কবি সাহিত্যিকদের নানান ধরনের অভিজ্ঞতা, জটিলতা কুটিলতা সফলতা অর্জন। এবং অশ্বের গায়ে চাবুক মারার মতো দাগ গুলো আজীবন শিক্ষা দিচ্ছে নবীন লেখকদের বই প্রকাশের আগে এবং পরে। তবুও প্রতিবছর আসল কবি, নকল কবি, সৃজনশীলকবি, নবীন কবি, প্রবীণ কবি, সাহিত্যিকদের বই প্রকাশ হবেই। পাঠক বই কিনবেই, এমনই প্রত্যাশা। আমিও চাই অমর একুশে গ্রন’ মেলায় আগত প্রতিটি মানুষ অন্তত একটি বই কিনবে
লেখক- কবি ও কলাম লেখক

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য