বিশ্বসাহিত্যের ক্রমবিকাশ/কে এম আব্দুল মোমিন

সাধারণত, কোনো একক লিখিত কর্ম সাহিত্য হিসেবে গণ্য হয়। প্রকৃত অর্থে কোনো নির্দিষ্ট শিল্পসম্মতরূপে লেখা বা কোনো লেখার শিল্পসম্মত বা বুদ্ধিবৃত্তিক গুণ থাকলে তাকে সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাহিত্যে ভাষা প্রয়োগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যা সাধারণ ভাষা থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করে। সাহিত্যের ইংলিশ প্রতিশব্দ ‘লিটারেচার’ (literature) ল্যাটিন শব্দ ‘লিটারেচুরা’ (litteratura) থেকে উদ্ভুত। লিটারেচুরা এসেছে লেটার (letter) থেকে। লেটার অর্থ বর্ণ বা হস্তলিপি। ল্যাটিন ভাষায় লিটারেচার বলতে সব রকম লিখিত বিবরণকে বুঝানো হতো। অবশ্য তদানীন্তন সংজ্ঞায় যা বলা হয় বা গাওয়া হয় অর্থাৎ মৌখিক বিবরণও সাহিত্যরূপে গণ্য হয়। সাহিত্য বিষয়ে এ ধারণারও বিবর্তন ঘটেছে। আজকাল মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে বিভিন্ন অলিখিত শিল্পরূপ প্রযুক্ত হয়েছে। সুতরাং সাহিত্যের মৌলিকতা সম্পর্কে লিখিত ও মৌখিকরূপের মধ্যে তুলনা করা জটিল হয়ে পড়েছে। মুদ্রণশিল্পের বিস্ময়কর অগ্রগতির ফলে বিপুল পরিমাণে লিখিত সাহিত্যের সৃষ্টি ও বিতরণ সম্ভব হয়েছে। অধিকন্তু, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ট্যাব ও সেলফোনের মতো ডিজিটাল উপকরণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ব্লগ ফিকশন, লিংকডইন, টুইটার, ফেসবুক জাতীয় ইলেকট্রনিক সাহিত্যও অবিশ্বাস্য গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্বসাহিত্য বলতে সাধরণত বিভিন্ন দেশের জাতীয় সাহিত্যের সমাহারকে বোঝায়। বস্তুত কোনো সাহিত্য কর্ম দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করলে তাকে বিশ্বসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা হয়। অতীতে প্রায়শ পশ্চিমা তথা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রধান সাহিত্যকর্মগুলোকে বিশ্বসাহিত্য মনে করা হতো। পশ্চিমা সাহিত্য পরিচিতি লাভ করে ইউরোপীয় সাহিত্য হিসেবে। ইউরোপীয় ভাষায় পশ্চিমা সংস্কৃতিপুষ্ট এই সাহিত্য। এ সমস্ত ইউরোপীয় ভাষা বলতে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীকে বুঝানো হয়। তবে ভৌগলিক বা ঐতিহাসিক কারণে সম্পৃক্ত বাস্ক ও হাঙ্গেরীয় ভাষা এগুলোর সাথে যুক্ত। পশ্চিমা সভ্যতাকে কেন্দ্র করেই পশ্চিমা সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং উৎকৃষ্ট পশ্চিমা সাহিত্য হচ্ছে পশ্চিমা আদর্শ রীতিনীতি নির্ভর।

পশ্চিমা আদর্শ রীতিনীতির ধারক হচ্ছে পণ্ডিতদের স্বীকৃত বইপত্র, সঙ্গীত ও কলা। এগুলো পশ্চিমা সংস্কৃতিকে যেমন প্রভাবিত করে তেমনি গতিপথ প্রদর্শন করে। এ সমস্ত আদর্শ অনুসারে সাহিত্যকে কল্প-কাহিনী বা ফিকশন ও বাস্তব তথ্যভিত্তিক বিবরণ বা নন-ফিকশন দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। এগুলো আবার গদ্য ও কবিতা দুশ্রেণিতে বিভক্ত। প্রতিটি শ্রেণি পুনরায় নানা শ্রেনিতে বিভক্ত। বস্তুত, আদর্শ পশ্চিমা সাহিত্যের মধ্যে ফিকশন, নন-ফিকশন, কাব্য, নাটক, সঙ্গীত, কলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকে প্রধান শিল্পসম্মত মেধা এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার উন্নত সংস্কৃতি বিকাশের প্রতিনিধিরূপে বিবেচনা করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক জন সিয়ার্ল বলেন, পশ্চিমা রীতিনীতিকে মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে একটি বিশেষ পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য যা সাহিত্য জগতে সক্রেটিস থেকে উইটজেনস্টিন এবং হোমার থেকে জেমস জয়েস পর্যন্ত বিস্তৃত। মধ্যপূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতিতে সৃষ্ট বাইবেল একটি শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে পশ্চিমা সংস্কৃতির রূপ দান করে এবং মানবচিন্তা, সাহিত্য ও কলা বিষয়ক ধারণায় উদ্বুদ্ধ করে অনেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনে সহায়তা করে। অতীতে প্রায়শ পশ্চিমা তথা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রধান সাহিত্যকর্মগুলোকে বিশ্বসাহিত্য মনে করা হলেও বর্তমানে বিশ্বসাহিত্যের পরিমণ্ডল বৃদ্ধি পেয়ে তা বিশ্বে বিস্তৃত হয়েছে। আধুনিক পাঠকসমাজ বিশ্বের অসংখ্য সাহিত্যকর্ম চমৎকার অনুবাদের মাধ্যমে হস্তগত করছে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে জাতীয় ঐতিহ্যের গণ্ডী পেরিয়ে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় শিল্পগুণ, রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে উৎসাহোদ্দীপক বিতর্ক শুরু হয়েছে। জোহান উলফগ্যাঙ ভন গোথা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তাঁর প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধে বলেন, ইউরোপীয় সাহিত্যের পাশাপাশি নন-ওয়েস্টার্ন সাহিত্যকর্মও আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার ও গ্রহণের বিষয়টি ব্যক্ত করেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর শিষ্য জোহান পিটার একারম্যান এ সম্পর্কে গুরু-শিষ্যের একগুচ্ছ সংলাপ প্রকাশ করেন, তখন বিষয়টি আরও গুরুত্ব লাভ করে। গোথা ও একারম্যানের সংলাপে গোথা চাইনিজ উপন্যাস, পার্সিয়ান ও সার্বীয় কাব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁর অনুবাদ কর্মগুলো বিদেশে বিশেষত ফ্রান্সে ব্যাপক প্রশংসিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি একারম্যানের নিকট ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, আসছে বছরগুলোতে বিশ্বসাহিত্য দেখা যাবে জাতীয় সাহিত্যগুলোকে অপসারণ করবে এবং সাহিত্য সৃষ্টির প্রধান ধারায় পরিণত হবে: ‘আমি নিশ্চিতভাবে মনে করি, কাব্য মানুষের বৈশ্বিক সম্পদ। সবখানে ও সবসময় শত শত মানুষের প্রকাশ।…আমি নিজেকেও বিদেশি জাতির মানুষ হিসেবে ভাবি। সবারই তা ভাবা উচিৎ। জাতীয় সাহিত্য এখন নিরর্থক পরিভাষা। আমরা বর্তমানে বিশ্বসাহিত্যের দ্বারপ্রান্তে। প্রত্যেকের উচিৎ বিশ্বসাহিত্যের দ্বার উন্মোচন করে ভিতরে প্রবেশ করা।’ কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টোতে বিশ্বসাহিত্যের অর্থনৈতিক বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বাণিজ্যিক বিনিময় প্রক্রিয়াকে বুর্জোয়া সাহিত্যিক উৎপাদনের বিশ্বজনীনরূপ হিসেবে বর্ণনা করেন। বলা হয়, ‘দেশজ উৎপাদন সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছুলে পুরাতন চাহিদার পরিবর্তে দূরদেশ ও অপরিচিত জলবায়ুতে উৎপাদিত পণ্যের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে আমরা নতুন চাহিদা বোধ করি। … এটা বস্তুগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় প্রকার পণ্যের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। স্বতন্ত্র জাতিগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টি হচ্ছে সাধারণ সম্পদ, যে সম্পদে সকলের অধিকার আছে। জাতির একদেশদর্শিতা ও সংকীর্ণতা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অসংখ্য জাতীয় বা স্থানীয় সাহিত্য থেকে বিশ্বসাহিত্যের সৃষ্টি হচ্ছে।’ মার্টিন পাচনার বলেন, গোথা বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে গভীর ধারণা পোষণ করতেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সাহিত্যের জন্য একটি বিশ্ববাজার তৈরি হতে যাচ্ছে।

EnterWrite to Ajagami-Jalchhabi Writers Group