ভাষা আন্দোলনে নারী:

সুপ্রিয়া বিশ্বাস– বাংলার ইতিহাসে বাঙালির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দু’টি গৌরবোজ্জল ঘটনা হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দুটি মহান আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছি। আজ সেই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ এর মহান ভাষা আন্দোলনে এ দেশের সর্বস্তরের নর-নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীক হয়েছিলেন। আমাদের বাহান্নর এই মহান ভাষা আন্দোলনে বিপ্লবের সঙ্গী ছিলেন নাম জানা-অজানা অনেক নারী।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ছাত্রীরা। পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে ভাষার দাবির মিছিলগুলোতে ছিলেন তারা সামনের কাতারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতে লুকিয়ে ভাষার দাবির বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত পোস্টার এঁকেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে নারীরাই পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙে। আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরা। আহতদের চিকিৎসা সাহায্যের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েরা চাঁদা তুলে আনে। পুলিশের তাড়া খাওয়া ছাত্রদের নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখে। আন্দোলনের খরচ চালানোর জন্য অনেক গৃহিণী অলঙ্কার খুলে দেন। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ায় অনেক নারীকে জেলও খাটতে হয়েছে। কেউ হারিয়েছেন সংসার। কেউ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হয়েছেন বহিষ্কৃত। সে সময়ের ঘটনা নিয়ে আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণা এবং দলিল ও বইতে এর প্রমাণ রয়েছে।ভাষা আন্দোলনের এই সব বিপ্লবী নারীদের নাম বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকের নাম হয়তো আমরা সবাই ভুলে যেতে বসেছি অথবা কারো কারো নাম হয়তো কেউ কখনো শুনিনি। এখানে ভাষা আন্দোলনের অমর সেই সব নারীদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি-

রওশন আরা বাচ্চু : জন্ম ১৯৩২ সালে মৌলভী বাজার জেলায়। ১৯৪৭ সালে বরিশাল বি.এম. কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ স্থানটিতে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে আহত হন রওশন আরা বাচ্চু। তিনি কুলাউড়া গালর্স স্কুল, ঢাকার আনন্দময়ী গালর্স স্কুল, নজরুল একাডেমীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন সুনামের সাথে।

কল্যানী রানী: ১৯১৬ সালের ২০ মে জন্ম গ্রহণ করেন কলকাতায় ।পরে বৈবাহিক সূত্রে তিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন এবং মমতাজ বেগম হন। ভাষা আন্দোলনের মমতাজ বেগমের নাম কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। ভাষা আন্দোলনের অংশগ্রহণের দায়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ ও কোর্টের কাছে তিনি মুচলেকা দিয়ে মুক্তির বিরুদ্ধে অনীহা প্রকাশ করেন ও পরবর্তীতে জেলে নিজ কর্মকান্ডে অবিচল থেকে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

সুফিয়া আহম্মদ : জাতীয় অধ্যাপিকা সুফিয়া আহম্মদ এর জন্ম ফরিদপুর জেলায়। তিনি রাজমোহন কলেজ থেকে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকা হিসাবে যোগদান করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠির আঘাতে সুফিয়া আহম্মদ আহত হন। পরবর্তীতেও তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

ডঃ শাফিয়া খাতুন : জন্ম ১৯৩১ সালে উত্তর বঙ্গের লালমনিরহাটে। লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চিরকুমারী কৃতি কন্যা ড. শাফিয়া খাতুন ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সময় সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নিয়োগ হন। ১৯৫১-৫২ সালে ছাত্রী অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে তিনি উইমেন্স স্টুডেন্টেস ইউনিয়নের ভিপি ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাস, চামেলি হাউজের ছাত্রীদের নিয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে এক দূর্জয় প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার আহ্বান ছিল তাঁর মতো তেজী নেত্রীর। তিনি তৎকালীন রোকেয়া হলের প্রভোষ্টের দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। ড. শাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ও একজন সদস্য ছিলেন।

হামিদা রহমান : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভাষা সাব কমিটিতে হামিদা রহমান সদস্য মনোনীত হন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হামিদা রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের হয়। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ধ্বনীতে মুখরিত করেছিলেন চারদিক। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোওনা জারি হয়। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতে যশোর কলেজের বৈঠকে তিনি ছেলেদের পোশাক পরে সভায় যোগ দেন। পুলিশের ওয়ারেন্টের অত্যাচারে তিনি সে সময় আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।

ডা. কাজী খালেদা খাতুন : জন্ম পিরোজপুর জেলার স্বরূপ কাঠিতে। ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনের সময়ে ডা. কাজী খালেদা খাতুন ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। তিনি সে সময় মিছিল, সমাবেশ ও অবরোধে সক্রীয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। পরবর্তী ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতেও রাষ্ট্রভাষা দাবির পক্ষে মিছিল করেছেন।

জুলেখা হক ঃ ১৯৫২ সালের প্রথম থেকেই উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জুলেখা হক সে সময় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জনতার সমাবেশে জুলেখা হক অংশ গ্রহণ করেন।

গুলে ফেরদৌস ঃ রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে উত্তাল দিনে গুলে ফেরদৌস ছিলেন ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী। ইডেন কলেজ হোস্টেলের মিছিলে ও সমাবেশগুলো ফেরদৌস সক্রিয়ভাবে নিয়মিত অংশগ্রহণ ও বক্তব্য রেখেছেন। ইডেন কলেজের মেয়েরা তার সান্নিধ্যে এসেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সে সময় জোরালো ভূমিকা পালন করে।